হ্যাঁ, গতরাত থেকে আমিও ঐ কথাটাই ভাবছিলাম। মৃদুভাবে শতদল বলে।
শুধু, ভাবা নয় মিঃ বোসু আপনার উচিত ছিল ইতিমধ্যে থানা-ইনচার্জকে সমস্ত ব্যাপার বলে তাঁর পরামর্শ নেওয়া। যাক আর দেরি করবেন না, এখুনি কোন একজনকে থানায় পাঠিয়ে দিন এবং লিখে পাঠান তিনি যেন এখনি একবার অনুগ্রহ করে এখানে আসেন, লিখবেন বিশেষ জরুরী।
এখনি দেব? হ্যাঁ, আর এক মুহূর্তও দেরি করা উচিত হবে না।
কিরীটীর নির্দেশমত তখুনি শতদল একটা কাগজে স্থানীয় থানা অফিসারকে সংক্ষেপে ব্যাপারটা লিখে এবং কিরীটীর নামটাম ঐ সঙ্গে যোগ করে মালী রঘুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিল।
থানা অফিসার আসুন, ততক্ষণ আমরা চা-পান-পর্বটা শেষ করে নিই, কি বলেন শতদলবাবু!
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আমি এখনি আসছি, শতদল বোধ হয় সকলের চায়ের ব্যবস্থা করতেই ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
রাণু দেবী সমুদ্রের দিককার খোলা জানালাটার ধারে গিয়ে চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
আমি কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ওঁরা দুজনেই যে নার্ভাস হয়ে গিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে!
কিরীটী পকেট থেকে সিগার-কেসটা বের করে একটা সিগার কেস থেকে টেনে নিয়ে সেটাতে অগ্নিসংযোগের চেষ্টায় ছিল, আমার কথার কোন জবাব দিল না। বুঝতে পারলাম তার নিঃশব্দতার কারণ। কোনো একটা বিষয়ে যখনই সে গভীরভাবে চিন্তা করে, সেই চিন্তার মধ্যেই সে বরাবর এমনভাবে অন্যমনা হয়ে যায় যে বাইরের পারিপার্শ্বিকের থেকে সে যেন অনেক দূরে চলে যায়।
আমি আর একবার কতকটা অনন্যোপায় হয়েই ঘরটার চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। ঘরটার দিকে তিনটে তিনটে করে ছটা জানালা। দক্ষিণের দিকে সমুদ্র, উত্তরের দিকে একটু পূর্বে দেখা সেই খোলা জমিটা— প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়িটার পশ্চাতের অংশ। ঘরের দেওয়ালে বড় বড় সব অয়েল-পেনটিং এবং সবগুলোই নারী ও পুরুষের প্রতিকৃতি। বোধ হয় শিল্পী রণধীর চৌধুরীর পূর্বপুরুষদের প্রতিকৃতি। প্রত্যেকটি প্রতিকৃতি যেন একেবারে সজীব, প্রাণবন্ত। কী অদ্ভুত শিল্পচাতুর্য!
শতদল এসে প্রবেশ করল অবিনাশকে সঙ্গে নিয়ে, অবিনাশের হাতে চায়ের ট্রে।
চা পরিবেশন করল রাণু দেবী কিরীটীরই অনুরোধে। চা-পান করতে করতেই একসময় কিরীটী তার অর্ধসমাপ্ত কথার জের টেনেই যেন বলতে লাগল, যে কথাটা আপনাকে বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলাম, আমার কিন্তু মনে হয়, এর পর আর আপনার এইভাবে একা একা এ বাড়িতে থাকা উচিত হবে না। এবং যুক্তিসঙ্গতও হবে না মিঃ বোস।
রাণু যেন কিরীটীর কথাটা কতকটা লুফে নিল। সে বলে ওঠে, আমিও সেই কথাটাই বলব বলব ভাবছিলাম তোমাকে শতদল। কিরীটীবাবু, ঠিকই বুলেছেন। এ বাড়িতে আর তোমার এভাবে risk নিয়ে একা একা থাকা উচিত নয়।
তোমার যেমন কথা রাণু! একা একা আবার আমি এ বাড়িতে আছি কোথায়? ভিতরের মহলে অবিনাশ আছে, দিন দুই হল অবিনাশের এক ভাইপো এসেছে, রমেশ। তাকেও এ বাড়ির কাজে আমি নিযুক্ত করেছি, তাছাড়া দাদুর একমাত্র বোন হিরন্ময়ী দিদি ও হরবিলাস দাদা এবং তাঁদের মেয়ে সীতা আছে। এতগুলো লোক বাড়িতে আছে। প্রতিবাদ জানায় শতদল।
তা হোক শতদলবাবু হরবিলাসবাবু ও তাঁর স্ত্রী-কন্যা তাঁরা সকলেই থাকেন বাইরের মহলে। ভিতরে এত বড় মহলটায় বলতে গেলে আপনি তো একাই থাকেন। অবিনাশের বয়স হয়েছে, সেও হয়তো থাকে ভিতরের দিকে, কিন্তু এ অবস্থায় রাত্রে যদি আচমকা একটা বিপদ-আপদ ঘটে তো সময়মত কারো সাহায্যও তো আপনি পাবেন না! তা ছাড়া আমি এমন একজন লোককে সর্বদা আপনার কাছে কাছে রাখতে চাই, যিনি সর্বতোভাবে আপনাকে সাহায্য তো করতেই পারবেন এবং সর্বদা আপনার প্রতি দৃষ্টিও রাখতে পারবেন। কিরীটী জবাব দেয়।
কিন্তু এমন কোন একজন সহচর আমি এখন পাই বা কোথায় মিঃ রায়? শতদল যেন একটু চিন্তিতই হয়ে ওঠে।
এমন কোন আত্মীয় কেউ কি আপনার নেই, যিনি অন্ততঃ কিছুদিন এসে আপনার কাছে থাকতে পারেন?
কিছুদিন মানে! সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় শতদল কিরীটীর মুখের দিকে।
এই ধরুন, দিন ১৫।২০! দেখুন না ভেবে কেউ আছেন কিনা? কিরীটী আবার শতদলের মুখের দিকে তাকায় কথাটা বলে।
না, এমন কাউকেই মনে পড়ছে না। তবে আমার দাদার বোন ঐ হিরন্ময়ী দেবী, ওঁদেরই না হয় আমি অনুরোধ জানাতে পারি ভিতরের মহলে এসে থাকতে-শতদল বলে।
আমার মনে হয়, সেইটাই সব চাইতে ভাল ব্যবস্থা হবে। আমিই কথাটা বলি।
হরবিলাসবাবু ও তাঁর স্ত্রীকে অনুরোধ জানাতে তাঁরা শেষ পর্যন্ত স্বীকৃত হলেন অন্দরমহলে এসে থাকতে এবং মনে হল হরবিলাস যেন প্রস্তাবটা আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করলেন। কিন্তু কেন যেন আমার মনে হল কিরীটীর এ প্রস্তাবে হরবিলাসবাবু, সম্মত হওয়ায় শতদল খুব বেশী সন্তুষ্ট হতে পারেনি। হরবিলাসবাবুকে প্রস্তাবটা জানাবার জন্য আমরাই সকলে নিচে বাইরের মহলে গিয়েছিলাম। হরবিলাস-পরিবারের স্থান পরিবর্তনের ব্যবস্থাটা যাতে ঐদিনই সম্ভব হয়, কিরীটী শতদলকে সেই অনুরোধ জানাল।
শতদল বললে, রঘু ফিরে আসুক, সে এলেই অবিনাশ ও রঘু সব ব্যবস্থা করে দেবেখন।
ঠিক এই সময় রঘু এসে ঘরে প্রবেশ করল এবং বললে, দারোগাবাবু এসেছেন নিজেই। বাইরে অপেক্ষা করছেন।