Dont be nervous! চলুন শতদলবাবু ঘরের মধ্যে চলুন। হরবিলাসবাবুর মুখেই এইমাত্র গতরাত্রের সমস্ত ব্যাপার শুনেছি, কিরীটী যেন একপ্রকার শতদলকে ঠেলেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
আমরাও পিছনে পিছনে তার ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলাম।
দেখবেন, সাবধান, কাঁচের টুকরো এখনো ঘরময় ছড়িয়ে আছে! সাবধান করে দিলেন আমাদের শতদলবাবু।
০৫. শতদলবাবুর কথায় তাকিয়ে দেখলাম
শতদলবাবুর কথায় তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই ঘরময় ছোট-বড় কাঁচের টুকরো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কিরীটী সাবধানে পা ফেলে এগুতে এগুতে বললে, ইসু কাঁচের টুকরোগুলো এখনো এইভাবে ঘরময় ছড়িয়ে রেখে দিয়েছেন! কাউকে বলুন ঘরটা তাড়াতাড়ি পরিষ্কার করে দিতে!
হ্যাঁ, এক্ষুনি পরিষ্কার করাচ্ছি। বলে শতদল ভৃত্য অবিনাশকে ডেকে ঘরটা পরিষ্কার করে দিতে আদেশ দিল।
ঘরটা বেশ বড় আকারের হবে। ঘরের মেঝেটা লাল সিমেন্টের তৈরী এবং পুরাতন হলেও এখনো ঝকঝক করে এমন চমৎকার পালিশ। একধারে মস্ত বড় একটা পালঙ্ক এবং তারই একপাশে একটা লোহার সিন্দুক, কাঠের একটা চৌকির ওপরে বসানো। ঘরের অন্য কোণে একটা জানলার একেবারে বরাবর একটা লিখবার টেবিল; ঐ টেবিলটি এখন বিশেষ ব্যবহৃত হয় বলে মনে হয় না, কারণ টেবিলের উপরে নানা কাগজপত্র ও বই এলোমেলো ভাবে ছড়ানো রয়েছে। সেই টেবিলটা থেকে হাতচারেক দূরে অনেকটা ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় ছোট একটি রাইটিং টেবিল, তারই উপরে টেবিল ল্যাম্প বোধ হয় বসানো ছিল এবং জানালাপথে নিক্ষিপ্ত গুলির আঘাতে ল্যাম্পটি মেঝেতে ছিটকে পড়ে চিমনিটা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে।
অবিনাশই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে একটা ঝাড়নের সাহায্যে কাঁচের টুকরোগুলো তুলে, তখনও মেঝের উপরে উলটে-পড়ে-থাকা ল্যাম্পটা তুলে রাখতে যাচ্ছে, কিরীটী এগিয়ে গিয়ে অবিনাশের হাত থেকে একদিকে খানিকটা টোলখেয়ে-যাওয়া ল্যাম্পটা হাতে নিলে চেয়ে, দেখি অবিনাশ, ল্যাম্পটা?
অবিনাশ ল্যাম্পটা কিরীটীর হাতে এগিয়ে দিয়ে ঘর হতে চলে গেল। বারকয়েক ল্যাম্পটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ল্যাম্পটা সামনের টেবিলের উপর বসিয়ে রাখল। এবং হঠাৎ শতদলের একেবারে মুখোমখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, গুলিটা কোন দিক দিয়ে এসে ঢুকেছিল শতদলবাবু?
সামনের ঐ বাগানের দিককার জানালাটাই রাত্রে খোলা ছিল। ঐ জানালাপথেই গুলিটা এসেছিল।
শতদলবাবু হাত তুলে ঘরের অনেকটা মধ্যস্থলে রক্ষিত রাইটিং-টেবিলটার ঠিক মুখোমুখি যে জানালাটা তখনও বন্ধ ছিল, সেইটার দিকে হাত তুলে দেখাল।
কিরীটী আর দ্বিতীয় প্রশ্ন উচ্চারণ না করে নিজেই এগিয়ে গিয়ে ছিটকিনিটা তুলে হাত দিয়ে ঠেলে জানালার বন্ধ কবাট খুলে দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে কী যেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখতে লাগল।
কৌতুহলভরে আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
এ বাড়ির পশ্চাতের অংশ সেটা। দেখলেই বুঝতে কষ্ট হয় না, দীর্ঘদিন জমিটা অসংস্কৃত অবস্থায় পতিত হয়ে আছে। বড় বড় ঘাস ও আগাছায় জায়গাটা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে বললেও অত্যুক্তি হয় না। মধ্যে মধ্যে শেয়াকুলের ঝোপ ও ঝাউগাছ। শেষপ্রান্তে জমির সীমানা দেড়-মানুষ-সমান উঁচু, প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীরের ওদিক দিয়ে জমি ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে, সমুদ্র বেশ কিছুটা দূরে সেখান থেকে। ঐসব ঝোপ ও আগাছার মধ্যে আত্মগোপন করে থেকে আততায়ীর পক্ষে এই ঘরের মধ্যে অবস্থিত কাউকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়াটা এমন কিছু কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়, কারণ নিচের ঐ জমিতে দাঁড়িয়ে ঘরের এই জানালাটা খোলা থাকলে ঘরের ভিতরের অনেকটা অংশই চোখে পড়া সম্ভব মনে হল।
আততায়ী ঐখান থেকেই বোধ হয় শতদলবাবুকে রাত্রে আলোর সামনে বসে থাকতে দেখে গুলি ছুড়েছিল। কথাটা কিরীটীকে সম্বোধন করেই নিম্নস্বরে বললাম আমি।
কিরীটী বোধ হয় নিজের আত্মচিন্তায় অন্যমনস্ক ছিল, আমার প্রশ্নে চমকে ফিরে তাকাল, কী বলছিলি সুব্রত?
বলছিলাম, ঐখান থেকে অনায়াসেই গুলি ছোঁড়া যেতে পারে।
তা পারে। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দিল। কিরীটীর কণ্ঠস্বরে যেন কোন আগ্রহের সুরই নেই।
রাণু এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করা অবধি, এবারে সে শতদলকে বলছে শুনতে পেলাম, তুমি কিন্তু সত্যিসত্যিই কাল খুব বেঁচে গেছ শতদল!
হ্যাঁ, তাই তো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি রাণু, এখনো যেন এর মাথামুন্ডু, কিছুই আমি বুঝে উঠতে পারছি না! আমাকে কারো হত্যা করে কী লাভ থাকতে পারে। তা ছাড়া তুমি তো জান, এ জগতে কারো সঙ্গেই আমার কোন শত্রুতা নেই।
কিন্তু ব্যাপারটা যে রকম দাঁড়াচ্ছে–
রাণুর কথায় প্রতিবাদ জানিয়ে শতদল বলে, সে যাই হোক, ব্যাপারটা ক্ৰমে এমন দাঁড়াচ্ছে যে, এর একটা হেস্তনেস্ত না করে চুপ করে বসে থাকাটাও হয়তো আর উচিত হবে না। আপনি কি বলেন মিঃ রায়?
হ্যাঁ, তা বইকি। We must see to its end! কিরীটী ফিরে দাঁড়িয়ে জবাব দিল।
তাহলে এখন আমার কী করা উচিত? আপনার পরামর্শ কী?
সেইটাই এতক্ষণ আমি ভাবছিলাম, শতদলবাবু। দুটো কাজ সর্বাগ্রে আপনাকে করতে হবে। কিরীটী শতদলের দিকে তাকিয়ে বলে।
কী, বলুন?
প্রথমত সমস্ত ব্যাপারটা এখানকার স্থানীয় থানা-ইনচার্জকে জানাতে হবে। কারণ তাঁদের বাদ দিয়ে আমরা এসব ব্যাপারে এক পাও এগুতে পারব না, তাছাড়া সেটা একেবারেই আইনসঙ্গতও হবে না।