বন্দুকের গুলির শব্দ! প্রশ্নটা এবারে করলাম আমি।
হ্যাঁ। চট করে রাত্রে ঘুম আসে না, তাই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে জেগে বই পড়ি। কালও রাত্রে বসে বসে নিজের ঘরে একটা বই পড়ছিলাম, হঠাৎ বন্দুকের গুলির আওয়াজ, তারই কিছুক্ষণ পরে শতদল ও অবিনাশের চেঁচামেচি শুনে অন্দরের দিকে ছুটে যাই। শতদলের ঘরে গিয়ে দেখি, বেচারী অত্যত নার্ভাস হয়ে পড়েছে। ঘুম আসছিল না বলে জেগে টেবিলের আলোয় বসে কী একটা বই পড়ছিল, এমন সময় হঠাৎ বন্দুকের গুলির আওয়াজ ও সঙ্গে সঙ্গে টেবিলল্যাম্পের চিমনিটা ভেঙে চুরমার হয়ে ঘর আঁধার হয়ে যায়। ও কিছু বোঝবার আগেই অন্ধকারেই আবার একটা গুলি এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। কী ভয়ানক ব্যাপার বলুন তো মিঃ রায়! ও বলে, কেউ ওকে হত্যা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু হঠাৎ কে আবার শতদলকে হত্যা করবার চেষ্টা করবে বলুন তো? আমি তো মাথামুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। ও নিজেও এমন ঘাবড়ে গিয়েছে যে, বাকি রাতটকু বোধ হয় শোয়ওনি। চলুন, আপনি এসেছেন ভালই হল, ওকে একটু সাহস দিয়ে যান।
হরবিলাস গতরাত্রের ব্যাপারটায় যে বেশ একটু উত্তেজিতই হয়ে উঠেছেন, ওঁর কথাবার্তাতেই সেটা বোঝা গেল এবং ব্যাপারটার মধ্যে যথেষ্ট উত্তেজনার খোরাক থাকা সত্ত্বেও কিরীটীকে কিন্তু একান্ত নির্বিকার বলেই মনে হতে লাগল। অস্বাভাবিক বা অত্যাশ্চর্য কিছুই তেমন ঘটেনি, শান্ত ও নির্বিকার কণ্ঠেই সে এবারে হরবিলাসবাবু কে প্রশ্ন করল, তা এত সকালে আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন?
সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, আমি আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। গতরাত্রে আপনারা চলে যাবার পর আমার স্ত্রীর মুখে আপনাদের অনেক কীর্তিকাহিনীই শুনেছি, তাতে করে আমার মনে হল এ ব্যাপারে আপনিই যোগ্য ব্যক্তি বেচারীকে একটা পরামর্শ দেবার।
কেন, শতদলবাবু কি বলেননি আজ সকালে আমাদের তিনি চায়ের নেমন্তন্ন করেছেন, আমরা আসব? কিরীটী দ্বিতীয় প্রশ্ন করল।
কই, না তো! সবিস্ময়ে জবাব দিলেন হরবিলাস।
ও, আচ্ছা চলুন দেখি।
হরবিলাসবাবুকে অনুসরণ করে আমরা তিনজন অগ্রসর হলাম। সংবাদটা শোনা অবধিই লক্ষ্য করছিলাম, রাণুর মুখের পরিবর্তন। রাণু যেন সত্যিই বিস্মিত ও হতচকিত হয়ে গিয়েছে। রাণু, আমার ও কিরীটীর মধ্যবর্তিনী হয়ে পথ চলছিল, সহসা একসময় চাপা কণ্ঠে কিরীটীকে সে প্রশ্ন করল, আপনি শতদলকে সাবধান করে দিয়েছেন, কালই সকালে আমাকে বলছিল! আপনার নাকি ধারণা, ওকে মারবার জন্য কেউ attempt নিচ্ছে! শতদল তো বিশ্বাস করেইনি, সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, আমিও করিনি। কিন্তু এ-সব কী শুনছি—how horrible!
বিশ্বাস করেননি ভুলই করেছেন, এবারে বোধ হয় বিশ্বাস করবেন! কিরীটী মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়।
অন্দর ও বহির্মহলের মধ্যে যোগাযোগের দ্বারটা, সেটা অন্দর থেকে বন্ধই ছিল। বাইরের দরজায় একটা দড়ি ঝুলছিল, হরবিলাসবাবু, সেটা ধরে বার-দুই টান দিতেই অন্দর থেকে একটা অস্পষ্ট ঘণ্টাধনি শোনা গেল এবং অল্পক্ষণ পরেই দরজাটা খুলে গেল। দরজাটা খুলতেই চোখে পড়ল খোলা দ্বারপথে দাঁড়িয়ে একজন বৃদ্ধগোছের লোক। লোকটার বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে তো নিশ্চয়ই। রোগা ও বেটেমত চেহারা। দেহের সমস্ত মাংসপেশীগুলো যেন একেবারে শণের দড়ির মত পাকিয়ে গিয়েছে। মাথার চুলগুলো কাঁচায়-পাকায় মেশানো। লোকটার পরিধানে একটা ধোপদুরস্ত ধুতি ও হাতকাটা গরম বেনিয়ান। বেনিয়ানের উপরে একটা চাদর জড়ানো।
অবিনাশ, শতদল কোথায়? প্রশ্ন করলেন হরবিলাসই।
বাবু তাঁর ঘরেই আছেন। এখনো দরজা খোলেননি। বাবুর কাছেই যাচ্ছিলাম, আপনাদের ঘণ্টা শুনে
এদের বাবুর ঘরে নিয়ে যাও।
আসুন—আজ্ঞে, অবিনাশ আমাদের আহ্বান জানাল।
একটা দীর্ঘ টানা বারান্দা পার হয়ে আমরা অবিনাশকে অনুসরণ করে প্রশস্ত শ্বেতপাথরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে গিয়ে উঠলাম সকলে। উপরের তলাতেও ঠিক নিচের মতোই অনুরূপ একটি টানা বারান্দা। বারান্দার দু-পাশের দেওয়ালে সব বড় বড় ফ্রেমে বাঁধানো নানাপ্রকারের চিত্র টাঙানো। মধ্যে মধ্যে স্ট্যাণ্ডের উপরেও রক্ষিত জয়পুরী টবে পামট্রি। বাড়িটা যে কোন এক শিল্পীর, বুঝতে সেটা আদৌ কষ্ট হয় না। বারান্দার শেষপ্রান্তে যে বন্ধ ঘরটার সামনে এসে আমরা দাঁড়ালাম, তারই ঠিক দরজার দুপাশে দুটো বহুদাকারের স্ট্যাচু একটি স্ট্যাচু হচ্ছে অপূর্ব একটি অর্ধউলঙ্গ নারীর এবং দ্বিতীয় স্ট্যাচুটি হচ্ছে একটি পুরুষের।
এই ঘরে আছেন বাবু। অবিনাশ বললে আঙুল তুলে ঘরটা ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিয়ে।
কিরীটী দরজার গায়ে নক করল টকটক করে এগিয়ে গিয়ে, মিঃ বোস! শতদলবাবু!
ভিতর হতে আহ্বান এল, কে?
আমি কিরীটী, শতদলবাবু দরজা খুলেন—
একটু পরেই দরজা খুলে গেল। সামনেই দাঁড়িয়ে শতদল। চমকে উঠলাম শতদলের মুখের দিকে তাকিয়ে। মাত্র এক রাত্রের মধ্যে এ কী চেহারা হয়েছে তার? সমস্ত মুখে শুধু যে রাত্রি-জাগরণের ক্লান্তি তাই নয়, একটা নিরতিশয় ভয় ও উৎকণ্ঠা যেন মুখের রেখায়-রেখায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এই যে মিঃ রায়, again there was an attempt last night! আবার কাল রাত্রে কেউ, somebody, আমাকে গুলি করে হত্যা করবার চেষ্টা করেছিল। এখন স্পষ্টই বুঝতে পারছি মিঃ রায়, you were right! আপনার কথাই ঠিক–সত্যিই someone is after me! কেউ আমার পিছনে লেগেছে। কিন্তু কে এবং কেন? উত্তেজনায় শতদলের কণ্ঠস্বর যেন একেবারে ভেঙে পড়ে।