সে বললে, আপনারা তাহলে কিছুদিন এখানেই থাকবেন, লেডি মিত্র?
হ্যাঁ, যতদিন না ওর আবার ইচ্ছে হয় ফিরে যাবার! বড্ড জেদী আর একগুঁয়ে মেয়ে আমার।
কিরীটী হাসতে হাসতে বলে, কিন্তু সামান্য ওঁর সঙ্গে আমার যা আলাপ হয়েছে, তাতে মনে হয় she is really charming!
আপনিই বলুন তো মিঃ রায়, জায়গাটি really চমৎকার নয়? মামির ধারণা, এমন বিশ্রী জায়গা নাকি আর ভূ-ভারতে নেই! রাণুই এবারে জবাব দেয়।
বয় সুদৃশ্য চায়ের ট্রের ওপরে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে এসে সামনের টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখল।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী বললে, আপনি বোধ হয় হোটেলের বাইরে যাননি লেডি মিত্র, গেলে দেখতেন বাইরের দৃশ্য এখানকার সত্যিই চমৎকার!
আমার আবার পায়ে হেঁটে বেড়াতে এমন বিশ্রী লাগে! লেডি মিত্র জবাব দিলেন।
তা অবশ্য ঠিক, পায় হেঁটে বেড়ানোও আপনার অভ্যাস নেই, ভালো তো লাগবেই না আপনার। কিরীটী লেডি মিত্রের কথায় সায় দিয়েই কতকটা যেন বলে ওঠে।
এমন চমৎকার সী-সাইডে কেউ আবার গাড়িতে চেপে বেড়ায় নাকি, মামির যেমন উদ্ভট সব, রাণু প্রতিবাদ জানায়।
শুনছেন মিঃ রায় আমার মেয়েটির কথা?
তা তো সত্যি, অভ্যাস না থাকলেও, কিরীটী আবার বলে।
অভ্যাস! অভ্যাস আবার কী? দুদিন হেঁটে বেড়ালেই অভ্যাস হয়ে যায়। মেয়ে বলে উঠে।
না মিস মিত্র, তারও একটা বয়স আছে। কিরীটী মৃদু হাস্যসহকারে বলে।
সে রাত্রে আমাদের আহার শেষ করতে করতে প্রায় রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেল।
দুজনে এসে হোটেলের বারান্দায় দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে পাশাপাশি বসলাম। হোটেলটি ইতিমধ্যেই যেন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। ঘরে ঘরে যে যার শয্যা নিয়েছে রাত্রের মত। বোধ হয় কেবল আমরা দুজনেই জেগে এখনও।
বালুবেলার উপর অদূরে গর্জমান সমুদ্রের ঢেউগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে কলচ্ছাসে। ভাঙা ঢেউইয়ের চূর্ণগুলোতে মধ্যে মধ্যে ফসফরাসের সোনালী চমকি ঝিলমিল করে ওঠে। দিবারাত্র একটানা ঢেউ ভেঙে-গড়েই চলেছে যেন
সমুদ্রের খেলা। ওর চোখে কি ঘুম নেই!
আমিই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলাম, ব্যাপার কী বল তো কিরীটী, লেডি মিত্রকে হঠাৎ অত তোষামোদ করতে শুরু করলি কেন?
ভদ্রমহিলাকে যখন একটু তোষামোদপ্রিয়ই দেখলাম, আগে থাকতেই খানিকটা তোষামোদ করে ভবিষ্যতের জন্য হাতের মধ্যে রেখে দিলাম, প্রয়োজন হলে কাজে লাগানো যাবে।
তোর মতলবটা কি সত্যি করে বলবি? সত্যিই কি তুই সকালবেলাকার কী একটা accident হয়ে গিয়েছে, সেটার ভূতকে এখনো কাঁধে করে বেড়াচ্ছিস?
হ্যাঁ রে, কতকটা সেই সিন্দবাদ নাবিকের অবস্থা। কিন্তু আমার কথা যদি বিশ্বাস করিস তাহলে বলতে পারি, সকালবেলাকার ব্যাপারটা যোগসূত্রহীন সামান্য একটা এলোমেলো দুর্ঘটনাই নয়। পর পর কতকগুলো দুর্ঘটনা, যেগুলো একসূত্রে গাঁথলে শেষ পর্যন্ত হয়তো গিয়ে দাঁড়াবে একটা মার্ডার বা নিষ্ঠুর হত্যায়!
You mean
হ্যাঁ I mean শীঘ্রই যদি আমার পূর্বে দূরদৃষ্টির ক্ষমতা না নিঃশেষ হয়ে গিয়ে থাকে, অমি নিশ্চয় করে বলতে পারি, I can hear the footsteps! হ্যাঁ সুব্রত, আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি নিষ্ঠুর মত্যু নিঃশব্দে ফেলে এগিয়ে আসছে অবশ্যম্ভাবী অবধারিত। কিরীটীর কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার সুস্পষ্ট আভাস। কিরীটী তখনও তার বক্তব্য শেষ করেনি, কিন্তু আমার চোখে যখন ব্যাপারটা পড়েছে, আমি চেষ্টা করব to my last to stop it! প্রতিরোধ করতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
তোর কি স্থির বিশ্বাস তাহলে something is going to happen? কোনো একটা কিছু শীঘ্রই ঘটবে?
হ্যাঁ, যদি আমার ক্যালকুলেশন ভুল না হয়, চব্বিশ থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই আবার একটা চেষ্টা হবে। বার বার চারবার।
কিরীটীর অনুমান যে কতখানি নির্ভুল, পরের দিন সকালেই সেটা জানা গেল।
খুব ভোরে উঠেই আমি, কিরীটী ও রাণু নিরালার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম।
ভোরের আলো তখনও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। সমুদ্রের বুকে একটা আলোছায়ার পর্দা যেন থির থির করে কাঁপছে। শীতের সকাল হলেও কোথাও কুয়াশার লেশমাত্র ছিল না। আকাশের প্রান্তে শুকতারাটা নিভে যায়নি তখনও।
নিরালার লৌহফটকের সামনে এসে আমরা যখন পৌঁছলাম, পূর্ব দিগন্ত যেখানে জলকে আলিঙ্গনের মধ্যে টেনে নিয়েছে, সেখানটা সূৰ্য-সারথির রথচক্রের ঘর্ষণে ঘর্ষণে ও সপ্ত অশ্বের খুরের আঘাতে যেন রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে।
গতকাল সন্ধ্যার মত লৌহফটক খোলাই ছিল, ফটক ঠেলে তিনজনে আমরা কম্পাউণ্ডের ভিতরে প্রবেশ করলাম।
একটু অগ্রসর হতেই হরবিলাসের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। কালো রঙের একটা ওভারকোট গায়ে, হাত দুটো পকেটের মধ্যে প্রবিষ্ট করে হাঁটতে হাঁটতে হরবিলাস গেটের দিকেই এগিয়ে আসছিলেন।
এই যে মিঃ ঘোষ, সুপ্রভাত! কিরীটীই প্রথমে সুপ্রভাত জানাল।
হরবিলাসও আমাদের শুভ প্রভাত জানালেন প্রত্যুত্তরে, সুপ্রভাত। খুব সকালেই এসেছেন দেখছি! যান, শতদল বোধ হয় বসেই আছে। সারাটা রাত বেচারা শোবার ঘরে খিল তুলে বসে আছে, পাশে একটা লোডেড রিভলভার নিয়ে।
ব্যাপার কী? কোন দুর্ঘটনা? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে কিরীটী প্রশ্ন করে।
কী জানি মশাই, রাত দুটো-আড়াইটের সময় হঠাৎ পর পর দুটো বন্দুকের গুলির শব্দে চমকে উঠে—