মা’থিন আবার থামলেন।
একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, আমি যেন দিন-কে-দিন হাঁফিয়ে উঠতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত বাড়িতে আর টিকতে পারতাম না-আমি বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলাম। ক্লাবে পার্টিতে যোগ দিয়ে সময় কাটাতে লাগলাম। অবশেষে ড্রিঙ্ক করতে শুরু করলাম।
আপনার স্বামী জানেন না এসব?
সব জানে। কিন্তু সে কখনও আজ পর্যন্ত আমার কোন ব্যাপারে ইন্টারফিয়ার করেনি। সেই থেকে গত কয় বছর ধরে সে আছে তার জুয়েলস আর অর্থ নিয়ে, আর আমি আছি আমার নিজস্ব জীবন নিয়ে। গত বছর আমাদের ম্যারেজ-অ্যানিভারসারিতে আমি বলেছিলাম, আমাকে তো আজ পর্যন্ত কিছুই প্রেজেন্ট করলে না—এবারে এমন কিছু দাও যাতে অন্তত মনে হয় আমারও একটা প্রয়োজন তোমার জীবনে আছে।
তারপর?
ও বললে, কি চাও বল?
যা চাই প্রাণে ধরে দিতে পারবে তো।
পারবো-বল।
তোমার সিন্দুকের মধ্যে একবার একটা বাক্সে তুমি কতকগুলো সেরা মুক্ত দেখিয়েছিলে-ঐ মুক্তোগুলো দিয়ে আমাকে একটা হার করে দাও।
বেশ–দেব। বললে জোসেফ।
সেই মুক্তো দিয়েই বোধ হয় হারটা তৈরী হয়েছিল?
হ্যাঁ।
কিন্তু এক কথায় মুক্তোগুলো তিনি আপনাকে প্রেজেন্ট করে দিলেন, আশ্চর্য লাগছে। প্রথমটায় আমারও তাই মনে হয়েছিল, পরে মনে হল ওই মুক্তোগুলো সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে জোসেফ সংগ্রহ করেছিলো–ওগুলো সে বেচত না। অনেক টাকার অফার পেয়েও কখনও বেচেনি।
কেন?
সত্যিই আশ্চর্য ছিল যেন সেই মুক্তোগুলো। সাদা মুক্তোগুলোর ভেতর থেকে যেন অদ্ভুত দ্যুতি বের হত—কোনটা নীল—কোনটা গোলাপী—কোনটা কমলালেবুর রঙ-জোসেফ বলত ওই ধরণের মুক্তো একই প্রকারের ও একই সাইজের বেশী হয় না। অত্যন্ত রেয়ার স্পেসিমেন সেগুলো। তাই ওর ওই মুক্তোগুলোর প্রতি একটা অদ্ভুত মমতা ছিল-প্রাণে ধরে কখনো বেচতে পারেনি। কিন্তু আমাকে দিলে সেগুলো বেচাও হল না, ঘরের জিনিস ঘরেই রইল তার চোখের সামনে-আমাকেও উপহারের সান্ত্বনা দেওয়া হল-তাই বোধ হয় সেগুলো দিয়ে আমাকে একটা হার করে দিতে তার আপত্তি হয়নি।
মুক্তোর হারটা চুরি যাবার পর নিশ্চয়ই তাহলে আপনার স্বামীর খুব লেগেছে?
শুধু লাগেনি মিঃ রায়, ও যেন পাগল হয়ে গিয়েছে মুক্তোর হারটা হারিয়ে যাওয়ায়। খায় না দায় না কোথায়ও বের হয় না—এমন কি ব্যবসা পর্যন্ত গুটিয়ে বসে আছে সেই অবধি।
স্বাভাবিক। বলি আমি।
ছাব্বিশ বছর ধরে একটা একটা করে মুক্তোগুলো সে সংগ্রহ করে আগলে রেখেছিল যখের ধনের মত-কাজেই বুঝতে পারছেন সেই মুক্তোগুলো ওইভাবে চুরি যাওয়ায় তার মনের অবস্থা কি হতে পারে! সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, এখন আমার মনে হচ্ছে যদি মুক্তোগুলোর ওপরে লোভ না করতাম তবে তো সে আমাকে দিত না আর সেগুলোকে অমন করে হারাতেও হত না। সব কিছুর জন্য আজ তাই আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। আমি যেন কিছুতেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না।
মা’থিনের চোখের কোল দুটো জলে ভরে আসে। নেশায় রক্তিম চোখ দুটো জলে টলমল করতে থাকে। আর এও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, মুখে ওই মহিলা একটু আগে যাই বলুক-ওর স্বভাবে-চরিত্রে যতই অসামঞ্জস্য থাক, ও ওর স্বামী জোসেফকে সত্যিই ভালবাসে। আর হয়ত নিজেও সে কথাটা নিজে জানে না।
কথা বলা বোধ হয় শেষ হয়ে গিয়েছিল মা’থিনের, সে অতঃপর কেমন যেন ঝিম দিয়ে বসে থাকে।
রাত বেশ হয়েছে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত তখন প্রায় সোয়া এগারোটা। বাইরে এখনও বৃষ্টি পড়ছে কিনা কে জানে।
শীততাপনিয়ন্ত্রিত হোটেলের ঘরের মধ্যে বসে সেকথা জানবারও উপায় ছিল না।
কিরীটীও চুপচাপ বসে।
তার বসবার ভঙ্গির মধ্যে শীঘ্র ওঠবার কোন লক্ষণই যেন পরিলক্ষিত হয় না।
ঘরের মধ্যে আমাদের তিনজনকে ঘিরে একটা স্তব্ধতা থমথম করছে।
হঠাৎ কিরীটীই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললে, আচ্ছা মিসেস জোসেফ, আপনার যে হারটা খোয়া গিয়েছে তার মধ্যে কতগুলো মুক্তো ছিল বলতে পারেন?
ওই মুক্তোর মালার মধ্যে যে মুক্তোর কথা একটু আগে বলেছি সব তা ছিল না।
তবে?
রেয়ার ও মূল্যবান মুক্তো ছিল গোটা-কুড়িক—তার মধ্যে ব্ল কুইন মুক্তোটি ছাড়াও গোটা এগারোর দাম সব চাইতে বেশী—অন্তত বিশ হাজার তো তার দাম হবেই। বাকিগুলো ছিল যদিও আসল মুক্তো, তাহলে অত দামের নয়।
আর কতগুলো মুক্তো ছিল?
বোধ হয় সব সমেত আটচল্লিশটা। কিন্তু ও কথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন মিঃ রায়?
কারণ মুক্তোগুলো সব হয়ত পারব না আমরা শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করতে।
পারা যাবে না?
না। কারণ আমার অনুমান–
কী?
মুক্তোর মালাটা যে চুরি করেছে সে সঙ্গে সঙ্গেই হার থেকে মুক্তোগুলো খুলে ফেলেছে। কেন–ও কথা বলছেন কেন?
যেহেতু চোরের ঐ মালার মধ্যে সত্যিকারের আসল ও রেয়ার যে মুক্তোগুলো ছিল সেগুলোর উপরেই লোভ ছিল। সে হয়ত তাই মালাটা হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মালা থেকে সে মুক্তোগুলো খুলে নিয়েছে—আর সব মুক্তোগুলোও হয়ত একজনের কাছে নেই।
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়?
মুক্তোগুলো লুকিয়ে রাখতে হলে সেটাই প্রকৃষ্ট উপায়। আচ্ছা যে বিশেষ মুক্তোগুলোর। কথা একটু আগে আপনি বললেন তার এক-একটির সাইজ কি রকম হবে?
কম-বেশী এক একটা মটরের আকার হবে।
আচ্ছা মিসেস জোসেফ, আজ রাত অনেক হল, এবারে আমরা উঠব।