এই যে—
মহিলা নিজেই পাতা উলটে ফটোটা বের করে দিলেন।
কিরীটী হাতে নিয়ে অ্যালবামের ফটোটা দেখতে লাগল। আমিও দেখি। হঠাৎ চোখ তুলতেই নজরে পড়ল দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে মালা।
মালার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে সরে গেল চট করে দরজার আড়ালে।
এই ফটোটা আমি নিতে পারি?
নিশ্চয়ই-খুলে নিন না।
কিরীটী অ্যালবাম থেকে ফটোটা খুলে নিল। পোস্টকার্ড সাইজের সিপিয়া প্রিন্টিং করা ফটোটা। খুব ভাল উঠেছে ফটোটা।
পাখীটার ক্লোজ-আপে ফটোটা তোলায় রঘুনাথনের মুখটাও স্পষ্ট উঠেছে। রঘুনাথন বোধ হয় ফটো তোলার সময় যে ফটো তুলছিল তার দিকেই তাকিয়ে ছিল।
মহিলা আবার বললেন, জোসেফ আমাকে ইণ্ডিয়াতে আসতে দিতে চায়নি—একপ্রকার জোর করেই আমি চলে এসেছি-কারণ হারটার সঙ্গে আমার একটা সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে ছিল—
কি রকম? কিরীটী প্রশ্ন করে।
জোসেফ আমার স্বামী হলেও বলব, মানুষ বড় কৃপণ-প্রকৃতির।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। হাত দিয়ে তার কখনও একটা পয়সা গলে না। তবু গতবছর আমাদের ম্যারেজঅ্যানিভারসারি ডে-তে সে ওই পার্লের হারটা আমাকে প্রেজেন্ট করেছিল—আর আমাদের এগার বছরের ম্যারেড লাইফে ওই প্রথম তার বিবাহ বার্ষিকীতে মূল্যবান প্রেজেন্ট আমাকে। যার দাম কমপক্ষেও ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা!
কিন্তু তাই যদি বলেন তো—
কিরীটী মুখের কথা শেষ হল না, মা’থিন বললেন, বুঝতে পেরেছি, আপনি আমার এ হীরার সেটটার কথা বলছেন তো?
হ্যাঁ–মানে–
কিন্তু ওই সেটটা জোসেফের দেওয়া নয়।
যদি কিছু মনে না করেন তো–
মনে করবার কিছু নেই মিঃ রায়-মা’থিন হাসলেন। হেসে বললেন, এটা আমার বাবার বিয়েতে দেওয়া উপহার।
কিন্তু মনে হচ্ছে ও হীরাগুলো নকল নয়—অনেক দাম হবে।
আমার বাবার আমিই একমাত্র সন্তান। বাবারও জুয়েলারীর ব্যবসা আছে-রেঙ্গুনের একজন ধনী নামকরা জুয়েলার আমার বাবা।
একটা কথা বলব মিসেস জোসেফ?
বলুন?
অ্যালবামের প্রথম পাতাতেই যে ফটোটা দেখলাম আপনার পাশে—তিনি নিশ্চয়ই আপনার স্বামী?
হ্যাঁ, আমার স্বামী। তাহলেও আমিই কিন্তু প্রথম পক্ষ। আমাদের দুজনার মধ্যে বয়সের পার্থক্য অনেক। প্রায় বাইশ বছর।
বাইশ বছর!
হ্যাঁ। যখন আমাদের বিয়ে হয় আমার বাইশ আর আমার স্বামীর চুয়াল্লিশ-rather he was an old man at that time. বাবার এতটুকুও ইচ্ছা ছিল না আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে মত দিতে হয়েছিল আমার একান্ত ইচ্ছা দেখে।
বলতে বলতে একটু থামলেন মা’থিন। হাতের গ্লাসটা তার শূন্য হয়ে গিয়েছিল, একটা বড় পেগ গ্লাসে ঢেলে সোড়া মিশিয়ে দীর্ঘ একটা চুমুক দিয়ে বলতে লাগলেন আবার মা’থিন, জোসেফ দামী ও রেয়ার জুয়েলসের সন্ধানে বলতে গেলে সারা পৃথিবীটা ঘুরেছিল তার দীর্ঘ বাইশটা বছর-জীবনের বিচিত্র তার সে অভিজ্ঞতা। মধ্যে মধ্যে সে রেঙ্গুনে আসত, আমাদের মার্চেন্ট স্ট্রীটের বাড়িতে থাকত। ওই আসা যাওয়াতেই তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়।
মা’থিন আবার থামলেন।
তারপর?
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর বাইরের ঘরে বসে বসে জোসেফ তার জীবনের অভিজ্ঞতার কথা-নানা ধরনের দামী-রেয়ার জুয়েলসের বিচিত্র সব কাহিনী আমাকে শোনাত। গল্প
উপন্যাসের চাইতেও সে-সব রোমাঞ্চকর। আমি অদ্ভুত একটা thrill যেন অনুভব করতাম। সেই সব কাহিনী জোসেফের মুখে শুনতে শুনতে। একটু একটু করে তার প্রতি আমি আকৃষ্ট হই-হয়ত সমস্ত ব্যাপারটা আপনাদের কাছে absurd—অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু তবু আমি যেন কেমন একটা আকর্ষণ অনুভব করতাম, আর সেই আকর্ষণই আসলে তার প্রতি অনুরক্ত করে তোলে ক্রমশঃ।
আমি বললাম ঐ সময়, rather interesting!
মা’থিন বলতে লাগলেন, ও কয়েকদিন পরে চলে যেত, আমি কিন্তু ওর পথ চেয়ে থাকতাম। আবার কবে আসবে! লুকিয়ে আমি অবশেষে ওকে পত্র লেখা শুরু করি। ওর জবাব আসত আমার এক বান্ধবীর ঠিকানায়। বলতে পারেন ঐ চিঠি লেখালেখির মধ্যে দিয়েই আমাদের পরস্পরের মধ্যে নিবিড় এক ভালবাসা গড়ে ওঠে।
তারপর?
তারপর আর কি, একদিন আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। বাবা-মা প্রথমটায় খুব আপত্তি করেছিল, কিন্তু আমার জেদের কাছে তারা হার মানতে বাধ্য হল। চলে এলাম স্বামীর সঙ্গে সিঙ্গাপুরে….কিন্তু বিয়ের পর পাচটা মাসও গেল না, আমার ভুল ভেঙে গেল।
ভুল!
তাই বলব-ভুলই। কারণ দেখলাম আমাদের গৃহে যখন সে গিয়ে অতিথি হত, তখনকার আলাপ-আলোচনা ও পরবর্তীকালে চিঠিপত্রের লেনদেনের ভিতর দিয়ে যে আলাপ-আলোচনা আমাদের হয়েছে সেটা জোসেফের চরিত্রের একটা দিক মাত্র এবং সেটা তার চরিত্রের আদৌ আসল দিক নয়।
কি রকম?
জিজ্ঞাসা করলাম আমিই মা’থিনের মুখের দিকে তাকিয়ে।
যদিও ইতিমধ্যে আমরা—আমি বা কিরীটী দুটো পেগের বেশী খাইনি, মা’থিন কিন্তু ছটা পেগ শেষ করে সপ্তম শুরু করেছিলেন।
লিকারের প্রভাবে তখন তার মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। চোখের তারা দুটো চক করছে। বেশ নেশা হয়েছে—আর হবারই কথা।
অনর্গল সে বকে চলেছে। নেশার প্রভাবে মানুষ এমনিই হয়—বল্লাহীন হয়ে পড়ে।
হাতের গ্লাসে আর একটা চুমুক দিয়ে মা’থিন বললেন, মানুষটা দেখলাম জীবনে দুটি বস্তুই ভালবেসেছে—আর তা হচ্ছে ঐসব জুয়েলস ও অর্থ। তার মনের সমস্ত কোমলতা-সেন্টিমেন্ট-আশা-আকাঙক্ষা সব যেন ঐ নীরস পাথরগুলো এবং অর্থকে ঘিরেই। অবিশ্যি। সে যে আমাকে কোনরকম অবহেলা বা অযত্ন করত তা নয়—কিন্তু একজন অল্পবয়সী যুবতীর পক্ষে তার কি মূল্য বলুন-স্বামীর অবহেলা বা অযত্ন তবু সহ্য হয়—কিন্তু ক্যালাসনেস সহ্য হয় না!