হীরা সিং নিঃশব্দে কেবল একবার মাথাটা হেলাল।
প্রবল বর্ষণের মধ্যে দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে-ওয়াইপার দুটো ঘন ঘন ওঠানামা করছে। উইস্ক্রীনের মসৃণ গাত্রের উপর কিন্তু তাতে করে সামনের রাস্তাটা যে খুব স্পষ্ট দেখা যায় তা নয় বরং ভিতরের বাষ্পে কেমন ঝাপসা ঝাপসা হয়ে যায়।
ট্রাম, লরি, বাস, ট্যাক্সি ও প্রাইভেট কারগুলো যথাসাধ্য নিজেদের বাঁচিয়ে এদিক ওদিক চলেছে।
তারই মধ্য দিয়ে ছাতা মাথায় পথিকের দল চলেছে। পথের দু পাশে দোকানের সামনে প্রবল ধারার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মানুষের ভিড় জমেছে।
ভাবছিলাম কিরীটী হঠাৎ এ্যাণ্ড হোটেলে এ সময় চলেছে কেন?
হঠাৎ কিরীটীর কথায় চমক ভাঙল।
সুব্রত।
কি?
ম্যাডাম মা’থিন গ্ৰাণ্ডে উঠেছেন–তার ওখানেই যাচ্ছি। একদম মনে ছিল না রেভদ্রমহিলা আজ সন্ধ্যার সময় তার সুইটে ড্রিঙ্কের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
কথাটা যদিও আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়—কারণ কিরীটী এই বৃষ্টির মধ্যে কেবল এক স্বল্পপরিচিতা মহিলার ড্রিঙ্কের আমন্ত্রণে তার হোটেল-সুইটে চলেছে, কথাটা আর যেই বিশ্বাস করুক আমি বিশ্বাস করতে পারি না।
তাই চুপ করেই রইলাম।
তোকে কিন্তু একটা কাজ করতে হবে সুব্রত!
কি? আবার তাকালাম কিরীটীর মুখের দিকে অন্ধকারে।
আমি যখন ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলব, তুই যতটা সম্ভব চারদিক নজর দিয়ে দেখবি।
তুই কি ড্রিঙ্কের নিমন্ত্রণ রাখতেই চলেছিস?
তাছাড়া আর কি! ভদ্রমহিলা খুব অ্যাকমপ্লিশড্–আলাপ করে আনন্দ পাবি। চোখে-মুখে একটা বুদ্ধির প্রাখর্য আছে।
আমি কোন জবাব দিই না।
.
হোটেলে পৌঁছে-লিফটে তিনতলায় উঠে লম্বা করিডোরটা অতিক্রম করে নির্দিষ্ট সুইটের সামনে গিয়ে পৌঁছলাম।
বেল টিপতেই ভিতর থেকে নারীকণ্ঠে আহ্বান এল, কাম ইন!
০৪. সুইটের সিটিং রুমে
ভিতরে প্রবেশ করে সুইটের সিটিং রুমেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে মুখোমুখি হলাম।
ভদ্রমহিলা সত্যিই সুন্দরী—দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মত নিঃসন্দেহে।
বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। রোগা পাতলা গড়ন। গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল গৌর। পরনে বর্মিনীদের ধরনে একটি দামী সিল্কের লুঙ্গি ও গায়ে আন্দির ফুলহাতা জামা। মুখের গড়ন ঠিক বর্মিনীর মতই।
পাতলা একটা প্রসাধনের ছাপ মুখে। মাথায় বিরাট একটি প্যাগোড়া খোঁপা। দু হাতে তিনগাছা করে হীরকখচিত চুড়ি, গলায় হীরার কণ্ঠি, কানে হীরার দুল। উজ্জ্বল আলোয় হীরকখণ্ডগুলি যেন ঝিলিক হানছিল।
গুড ইভনিং—আসুন মিঃ রায়, আপনার জন্যেই আমি অপেক্ষা করছিলাম। কথাটা বলে। মহিলা আমার দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় কিরীটীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন।
আমার বন্ধু-সহকারী—সুব্রত রায়।
মহিলা প্রত্যুত্তরে মৃদু হেসে বললেন, আপনারা দুজনেই রায়?
হ্যাঁ। হাসল জবাবে কিরীটী।
বসুন।
মুখোমুখি দুটো সোফায় আমরা বসলাম। মহিলাও বসলেন মুখোমুখি।
বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, তাই না?
হ্যাঁ। কিরীটী জবাব দিল।
বৃষ্টি দেখে ভাবছিলাম বোধ হয় আসতে পারবেন না!
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এ সময় বৃষ্টি তো হবেই-মনসুন–
উনি যখন আপনার সহকারী—আমরা নিঃসংকোচেই কথাবার্তা বলতে পারি মিঃ রায়, তাই তো?
হ্যাঁ।
মালা!
মহিলার ডাকে ভিতরের ঘর থেকে একটি চব্বিশ-পঁচিশ বছরের বর্মী তরুণী বের হয়ে এল।
ইয়েস ম্যামু—
বুঝলাম মালা ঐ মহিলার পরিচারিকা।
মালাও দেখতে সুন্দরী এবং পরিচারিকা হলেও তার বেশভূষা দামী এবং চোখে-মুখে প্রসাধনের চিহ্ন সুস্পষ্ট।
মালা, ড্রিঙ্কস্! কি দেবে বলুন মিঃ রায়-হুইস্কি?
আনুন।
আমার কাছে কিন্তু সব রকম ড্রিঙ্কসই আছে-অন্য কিছু যদি
না, হুইস্কিই আনতে বলুন।
বলা বাহুল্য ইংরাজীতেই কথাবার্তা চলছিল। ভদ্রমহিলা চমৎকার শুদ্ধ ইংরাজী বলেন।
মালা চলে গেল।
আরও আধঘণ্টা পরে। দ্বিতীয় রাউণ্ড ড্রিঙ্কস চলেছে তখন। দেখলাম ভদ্রমহিলা বেশ ভালই ড্রিঙ্কস করতে অভ্যস্ত।
কিছুক্ষণ নানা ধরনের কথাবার্তার পর হঠাৎ একসময় ভদ্রমহিলা বলেন, মিঃ লাহিড়ী বলছিলেন, আপনি ঠিকই আমার হারটা উদ্ধার করে দেবেন।
কিরীটী কোন জবাব দেয় না।
মহিলা আবার বলেন, আমি যখন আমার স্বামীকে বললাম, এ আর কারও কাজ নয়-ওই রঘুনাথনেরই কাজ আর সে হারটা চুরি করে সোজা ইণ্ডিয়াতেই এসেছে, জোসেফ কি বলেছিল জানেন?
কি?
বলেছিল তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে জেনো সে হার আর কোনদিনই ফিরে পাওয়া যাবে না। কারণ রঘুনাথনকে কোনদিনই আর trace করতে পারবে না। আচ্ছা মিঃ রায়–
বলুন?
একবার ওর দেশে গিয়ে খোঁজ করলে হত না?
একটা কথা মিসেস জোসেফ–
কি বলুন তো?
ওই রঘুনাথনের কোন ছবি আপনার কাছে আছে?
ছবি? You mean, Photo?
হ্যাঁ।
আমার album-এর মধ্যে থাকতে পারে। Yes-হ্যাঁ, মনে পড়েছে-আমার পাখীটার খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে ও যখন একদিন পাখীটাকে খাওয়াচ্ছিল আমি পাখীটার একটা ফটো নিয়েছিলাম—বোধ হয় সেটা আমার album-এ আছে।
রঘুনাথনই কি পাখীটাকে খাওয়াত নাকি?
হ্যাঁ। পাখীটা ওকে খুবই ভালবাসত। বেশীক্ষণ ওকে না দেখতে পেলেই পাখীটা চেঁচাত নাথন নাথন করে।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। সামনে এলে চুপ করত।
মিসেস জোসেফ!
বলুন?
Album কি আপনার সঙ্গে আছে?
হ্যাঁ।
একবার দেখতে পারি album-টা?
আনছি আমি।
মহিলা উঠে গেল এবং একটু পরেই সুদৃশ্য চামড়ার দামী একটা অ্যালবাম হাতে ঘরে এসে ঢুকলেন।