সুলতান!
বাবুজী?
ডি’সিলভা কলকাতায় এলে কোথায় থাকে তুমি জান?
না তো বাবুজী। তবে সে আর কোথায় থাকবে—তার জাহাজেই থাকত। আচ্ছা সেই লোকটিকে দেখলে তুমি চিনতে পারবে?
কেন পারব না—নিশ্চয়ই পারব।
লোকটা দেখতে কেমন বল তো?
লোকটা বেঁটে, গায়ের রং খুব ফর্সা, চ্যাপ্টা নাক, ছোট ঘোট চোখ, পুরু ঠোঁট। ভারতীয় বলে ঠিক মনে হয় না।
বয়স কত হবে?
বছর চল্লিশ হবে।
আচ্ছা আজ তুমি যাও সুলতান, কাল হয়ত তোমার দোকানে একবার যেতে পারি। স্ব্যার দিকে দোকানে থাকবে তো?
থাকব।
অতঃপর সুলতান বিদায় নিল।
.
সুলতান বিদায় নেবার পরও অনেকক্ষণ কিরীটী নিঃশব্দে বসে বসে চুবোট টানতে থাকে। বুঝতে পারি কোন একটা চিন্তু কিরীটীর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বাইরে বৃষ্টি সমানে ঝরতে থাকে। ঘণ্টাখানেক বাদে আমি বিদায় নিলাম।
কিরীটী তখনও পূর্ববৎ সোফাটার উপর বসে অন্যমনস্কভাবে ধূমপান করে চলেছে।
বাইরে বের হয়ে দেখি কিরীটীর বাসার সামনে বেশ জল জমেছে। প্রায় গোড়ালি ড়ুবে যায়। হীরা সিংকে ডাকলাম।
হীরা সিং আমাকে একটু বাসায় পৌঁছে দেবে?
কেউ নেই সাক্-ঠারিয়ে, হাম আভি গাড়ি লয়তেহেঁ।
হীরা সিং শেষ পর্যন্ত আমাকে গৃহে পৌঁছে দিয়ে গেল।
সারাটা দ্বিপ্রহর আমি ইউসুফের হত্যার ব্যাপারটাই চিন্তা করতে লাগলাম। সুলতানের কথায় মনে হল কোন ডাকাতি বা রাহাজানির ব্যাপার নয়। ইউসুফকে হত্যা করার পিছনে কারও কোন গুঢ় উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু সেটা কি? কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
সেই ময়নাটার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই তো?
ময়নাটা নিখোঁজ হয়েছে।
সুলতানের কথা শুনে মনে হয় ইউসুফ মিঞার নৃশংস হত্যার সঙ্গে হয়ত ঐ কালো পাখীটার কোন যোগসূত্র কোথাও আছে এবং ঐ হত্যার পিছনে কোন গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে।
.
সন্ধ্যার দিকে আবার কিরীটীর ওখানে গিয়ে দেখি কিরীটী তার বসবার ঘরে বসে আপনমনে তাস নিয়ে একা একা পেসেন্স খেলার মধ্যে মগ্ন হয়ে আছে। পাশের সোফায় গিয়ে বসলাম।
আড়চোখে তাকালাম কিরীটীর মুখের দিকে, কিন্তু তার মুখের কোথাও কোন চিন্তার রেখা পর্যন্ত যেন নেই।
একটা ইংরাজী পিকটোরিয়াল টেনে নিয়ে সামনের সেন্টার টেবিলের উপর রেখে তার পাতা ওলটাতে লাগলাম।
নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে একসময় কিরীটীই কথা বলল, তুই চলে যাওয়ার একটু পরেই পূর্ণ লাহিড়ী এসেছিলেন।
ডি. সি.?
হ্যাঁ।
হঠাৎ?
সঙ্গে এক ভদ্রমহিলা ছিলেন।
ভদ্রমহিলা?
হুঁ।
কে সে?
সিঙ্গাপুরের এক বিখ্যাত জুয়েল-মার্চেন্ট মিঃ জোসেফের বর্মিনী স্ত্রী মা’থিন।
হঠাৎ কি ব্যাপারে তোর কাছে এসেছিলেন?
ভদ্রমহিলার একটি বহু মূল্যবান মুক্তার হার চুরি গিয়েছে।
মুক্তার হার!
হ্যাঁ-তার ধারণা সেটা ভারতবর্ষে এসেছে।
হঠাৎ ঐ রকম ধারণার কারণ?
কারণ একটা আছে বৈকি।
কি রকম?
ভদ্রমহিলার রঘুনাথন নামে এক মালয়ালী ভৃত্য ছিল। মাসখানেক আগে হঠাৎ রঘুনাথন নিরুদ্দেশ হয়ে যায় এক সকালে—অনেক খোঁজ করেও তাকে পাওয়া যায় না এবং ঐ দিনই ভদ্রমহিলা জানতে পারেন তার বহুমূল্যবান সেই মুক্তার মালাটিও পাওয়া যাচ্ছে না।
মালাটা কোথায় ছিল?
আগের দিন একটা পার্টিতে ভদ্রমহিলা ঐ মুক্তার মালাটি গলায় পরে পার্টিতে যান ফেরেন অনেক রাত্রে একটু মত্ত অবস্থাতেই। তার স্পষ্ট মনে আছে রাত্রে গৃহে ফিরে শয়নের পূর্বে মালাটি গলা থেকে খুলে নিজের মাথার বালিশের তলায় খুলে রেখে দিয়েছিলেন। দুপুরে সেই মালার কথা মনে পড়ায় মালার খোঁজ করতে গিয়ে দেখেন বালিশের নীচে মালাটি নেই। তখন তিনি ঘরের সর্বত্র খোঁজেন, যদি অন্য কোথায়ও রেখে থাকেন রাত্রে, কিন্তু বহু অনুসন্ধান করেও সেটির আর কোন সন্ধান পাওয়া যায় না।
তারপর?
আরও একটা ব্যাপার ঘটেছিল–
কি?
ভদ্রমহিলার একটি ময়না পাখী ছিল—
ময়না পাখী?
হ্যাঁ, ঠিক যেমনটি আমরা আজ সুলতানের মুখে শুনেছি তেমনি একটি ময়না ঐ মহিলার ছিল। রঘুনাথনের নিরুদ্দেশের সঙ্গে সঙ্গে খাঁচাসমেত ঐ ময়নাটিও নিখোঁজ।
সত্যি!
হ্যাঁ। আর সেই কারণেই পরশু সকালের প্লেনে ঐ মহিলা কলকাতায় এসে পৌঁচেছেন-এখানকার পুলিসের সাহায্যে যদি কোন উপায়ে বের করা যায় তার মুক্তার মালাটি-কারণ তার স্থির বিশ্বাস ঐ মুক্তার মালা, ময়না পাখীটি ও রঘুনাথনের সঙ্গে একটা যোগাযোগ আছে। পূর্ণ লাহিড়ী তাই মহিলাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলেন।
তবে কি কিরীটী–
কি?
ঐ ইউসুফের হত্যার সঙ্গে–
আমার ধারণা তাই সুব্রত। এবং আমার অনুমান যদি ভুল না হয় তো ইউসুফ ঐ ময়নাটিকেই কিনেছিল ডি’সিলভার সঙ্গের সেই লোকটির কাছ থেকে—ওই পর্যন্ত বলেই সহসা কিরীটী সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
সুব্রত!
কি? চল, একবার বেরুব।
রাত তখন আটটা হবে। বাইরে বৃষ্টি নেই বটে তবে আকাশ মেঘে মেঘে থমথম করছে।
এ সময় কোথায় বেরুবি? বাইরে আকাশের অবস্থা ভাল নয়। বললাম আমি।
কিরীটী সে কথায় কর্ণপাত না করে বললে, তুই বস্ সুব্রত, চট করে জামাটা গায়ে দিয়ে আসছি আমি।
কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
গাড়ি যখন রসা রোডে পড়ল ওভারব্রীজটার তলা দিয়ে, ঝমঝম করে বর্ষণ শুরু হয়ে যায়।
কিন্তু চলেছিস কোথায় এই বৃষ্টির মধ্যে?
প্রশ্নটা করে তাকালাম আমি আমার পার্শ্বে উপবিষ্ট কিরীটীর মুখের দিকে। অন্ধকারে কিরীটীর মুখটা ভাল দেখা যায় না। কিরীটী আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একটা চুবরাটে অগ্নিসংযোগ করতে ব্যস্ত হয় লাইটারের সাহায্যে। চুরোটটা ধরানো হলে পর বলল, আমাকে নয় হীরা সিংকে উদ্দেশ করে, হীরা সিং, গ্র্যান্ড হোটেল।