আচ্ছা সুলতান?
বলুন বাবুজী।
পাখী কিনতে তো অনেকেই আসত তোমাদের কাছে?
তা আসত। অনেক সময় অনেক বড় বড় রহিম আদমীও আমাদের ঐ দোকানে পাখীর খোঁজে এসেছে।
গত সাতদিনের মধ্যে বা ধর দিন দশ-পনেরোর মধ্যে এমন কোন বিশেষ খরিদ্দার তোমাদের দোকানে এসেছিল কি, মানে আমি বলতে চাই সাধারণ পাখীর খদ্দের নয়, কোন দামী পাখী যা হয়ত এদেশে চট করে পাওয়া যায় না?
তেমনি তোকই কিছু মনে পড়ছে না বাবুজী!
সব সময়ই কি তুমি দোকানে থাকতে?
না, তা থাকতাম না বটে। আব্বাজানই সব সময় থাকত দোকানে। দোকান ছেড়ে কখনও আব্বাজান ইদানীং কোথায়ও যেত না।
হয়ত তুমি যখন ছিলে না, তখন আসতে পারে?
তা পারে হয়ত। ভাল কথা, মনে হচ্ছে কথাটা আপনার জানা উচিত।
কি কথা বল তো?
দিন পনের-ষোল আগের ব্যাপার। ডি’সিলভার সঙ্গে একটা লোক একটা সিঙ্গাপুরী ময়না নিয়ে এসেছিল। ঐ ধরণের ময়না আট-দশ বছরে হয়ত একটা-আধটা আসে।
সিঙ্গাপুরী ময়না?
হ্যাঁ। দেখতে ভারি সুন্দর। কালো কুচকুচে-ঠোঁটটা ঠিক সাধারণ ময়নার মত হলদে নয়, হলদে আর সাদায় মেশানো, অনেকটা ফিকে সোনার মত রং, চোখ দুটো লাল। ঐ পাখীকে শেখালে সে যে কেবল মানুষের মত শেখানো বুলিই কপচায় তা নয়, মানুষের মত যা আপনি জিজ্ঞাসা করবেন তার মনিব সম্পর্কে, সব বলবে। মনিব যদি বেরুবার সময় কোথায় সে যাচ্ছে এবং কখন ফিরবে বলে যায়—কেউ এসে মনিব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে ঠিক বলে দেবে। অথচ না জানা থাকলে অন্য ময়না থেকে চট করে ঐ ময়নার পার্থক্য বোঝা যায় না।
ভারি আশ্চর্য তো!
হ্যাঁ বাবুজী, সত্যিই ওই পাখীর তুলনা নেই। দামও তেমনি।
কি রকম দাম?
দু হাজার তো বটেই—
বল কি সুলতান! একটা পাখীর দাম দু হাজার।
অমন চিজ, তার দাম হবে না! লক্ষ্ণৌর এক নবাবের ঐরকম একটা পাখী ছিল। নবাব মরবার পর সে পাখীটা চার হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
সেই রকম একটা ময়না এসেছিল তোমাদের দোকানে?
হ্যাঁ, ডি’সিলভার সঙ্গের লোকটি অমনি একটি ময়না এনেছিল।
ইউসুফ কিনেছিল ময়নাটা?
হ্যাঁ।
কতোয়?
হাজার টাকায়।
তারপর?
যে লোকটি ডি’সিলভার সঙ্গে এসেছিল ঐ ময়না নিয়ে, সে কিন্তু ঐ ময়নার গুণাগুণ জানত না। ডি’সিলভাও সঠিক জানত মনে হয় না। তবে ডি’সিলভা আব্বাজানের সঙ্গে ব্যবসা করে করে রীতিমত চালাক হয়ে উঠেছিল-আব্বাজানের মুখের হাবভাব দেখেই চিড়িয়ার দাম কিছুটা অনুমান করে নিত। তারপর দামদস্তুর শুরু করত। ঐভাবে দামদর করতে করতেই আঁচ করে নিলে ডি’সিলভা, চিড়িয়াটা দামী না সাধারণ চিড়িয়া একটা।
তারপর?
চিড়িয়া চিনতে আব্বাজানের জুড়ি এ শহরে ছিল না। আব্বাজানের মুখে শুনেছি প্রথম যৌবনে আব্বাজান লক্ষ্ণৌর এক সাহেবের কাছে চাকরি করত। তার ছিল চিড়িয়া পোর শখ। দেশ-বিদেশ ঘুরে ঘুরে নানা ধরনের চিড়িয়া এনে নিজের বাড়ির বাগানে বিরাট বিরাট খাঁচা তৈরী করে তার মধ্যে জড় করেছিলেন। সাহেবের যে চিড়িয়া পোরই শখ ছিল তাই নয়, চিড়িয়া চিনতেও তার জুড়ি দ্বিতীয় কেউ ছিল না। চিড়িয়া দেখেই তিনি বলে দিতে পারতেন কি জাতের কোন দেশের চিড়িয়া সেটা, তার কি গুণাগুণ। দীর্ঘ ছয় বছর তার কাছে থেকে আব্বাজান চিড়িয়া সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছিল। পরে কলকাতা শহরে এসে চিড়িয়ার ব্যবসা শুরু করে।
কিন্তু সেই সিঙ্গাপুরী ময়নাটার কথা তুমি কি বলছিলে সুলতান? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
সুলতান আবার বলতে শুরু করে, সেই লোকটা চিড়িয়া বেচে চলে গেলে আব্বাজানকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, অত দাম দিয়ে ঐ ময়নাটা কিনলে কেন? আব্বাজান বললে, যে দামে কিনেছি তার তিন গুণ দামে চিড়িয়াটা বিক্রি হবে বেটা। তুই বরং এক কাজ কর, রায় সাহেবকে একটা খবর দিয়ে আয়।
মানে আমাকে।
হ্যাঁ, কিন্তু আসি-আসি করতে করতে আমার আসা হয়নি আপনার কাছে। ইতিমধ্যে একটা ব্যাপার ঘটেছিল–
কি?
চিড়িয়াটা কেনবার ঠিক দিন সাতেক পরে এক সন্ধ্যায় বিরাট একটা গাড়িতে চেপে একজন সুটপরা ভদ্রলোক আমাদের দোকানের সামনে এসে গাড়ি থেকে নামল। সে এসেই সেই চিড়িয়াটার খোঁজ করল। আব্বাজান বললে, আছে, কিন্তু দাম তিন হাজার টাকা পড়বে।
তারপর?
লোকটি চিড়িয়াটা দেখতে চাইল, আব্বাজান দেখাল, আর আশ্চর্য, খাঁচা সমেত চিড়িয়াটা তার সামনে এনে রাখতেই, চিড়িয়াটা হঠাৎ বলে উঠল, রবিন রবিন রবিন! আব্বাজান তখন শুধায় লোকটিকে, চিড়িয়াটা কি আপনার চেনা? আপনার নাম কি রবিন?
লোকটি কি জবাব দিল?
বললে না না, ওই চিড়িয়া আমি আগে কখনও দেখিইনি, তাছাড়া আমার নামও রবিন নয়। আব্বাজান আর কোন কথা বলে না। লোকটা দর-কষাকষি শুরু করল এবং শেষ পর্যন্ত দরে না পোযাতে লোকটা চলে গেল।
কত টাকা দিতে চেয়েছিল লোকটা?
দু হাজার পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলি।
হুঁ। তারপর আর সে আসেনি?
না।
পাখীটা এখনও তাহলে বিক্রী হয়নি?
না। তবে—
কি?
সে রাত্রে আবার যখন একে একে চিড়িয়াগুলোকে খাঁচায় ভরলাম—সেই ময়নাটাকে কিন্তু দেখতে পেলাম না।
সে পাখীটা নেই?
না।
পুলিসকে কথাটা তুমি জানিয়েছিলে সুলতান?
না। মনে হয়নি। আজ আপনার কথা শুনে হঠাৎ মনে হওয়ায় কথাটা আপনাকে বললাম।
অনেকক্ষণ অতঃপর কিরীটী চুপ করে রইল। একটা চুবরাটে অগ্নিসংযোগ করে নিঃশব্দে ধূমপান করতে লাগল। মনে হল কিরীটী যেন কি ভাবছে।