তুমি ছিলে না?
না বাবুজী, বরাহনগরে এক দোস্তের ওখানে গিয়েছিলাম। খানাপিনা শেষ হতে হতে অনেক রাত হল, তারপর কোন বাস বা গাড়ি পেলাম না, হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এসেছি।
কত রাতে পৌঁচেছিলে?
রওনা হয়েছিলামই তো রাত তিনটের পর, পৌঁছতে পৌঁছতে সেই প্রায় সাড়ে চারটে। আশেপাশে কোন জনমনিষি নেই, দরজা ঠেলে আব্বাজানকে ডাকতে যাব, হঠাৎ দেখি দরজা খুলে গেল-হাতের ঠেকা লেগেই।
আমি শুধালাম তারপর। চমকে গিয়েছিলাম। আব্বাজান তো কখনো দরজা খুলে শোয় না, খুব সতর্ক মানুষ! শোবার আগে দরজা ঠিক বন্ধ হল কিনা ভাল করে পরীক্ষা না করে কখনো শুতে যায় না। সেই মানুষ দরজা খুলে রেখেছে—কেমন যেন খটকা লাগল।
দরজা খুলে যেতে প্রথমে তোমার চোখে কি পড়েছিল সুলতান? প্রশ্ন করে কিরীটীই এবারে।
অন্ধকার-পাখার ঝটপট শব্দ। মনে হল যেন অন্ধকার ঘরটার সধ্যে সব পাখীগুলো খাচা থেকে বের হয়ে পাখা ঝাপটাচ্ছে। প্রথমটায় কেমন যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিলাম, অন্ধকারেই বোধহয় কয়েক পা এগিয়েছিলাম, হঠাৎ বাধা পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম অন্ধকারে।
কিসে বাধা পেলে?
তখন বুঝতে পারিনি, পকেটে টর্চ ছিল না, তাই কোনমতে অন্ধকারেই উঠে দাঁড়িয়ে হাতড়ে হাতড়ে ঘরের দেওয়ালে আলোর সুইচটা টিপে দিতেই সব কিছু নজরে পড়ল। মেঝের উপর রক্তাক্ত অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে আমার আব্বাজান, ঘরের মেঝেতে চাপচাপ রক্ত আর ঘরের সব পাখীর খাঁচার দরজাই বলতে গেলে খোলা। উড়ছে, বসছে, ডানা ঝাপটাচ্ছে-সব যেন ওলটপালট তছনছ। কিন্তু সে-সব কিছু দেখবারও আমার সময় হয়নি। ছুটে গিয়ে আব্বাজানের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, আব্বাজান! আব্বাজান!
সেই সময় নজরে পড়ল আব্বাজানের গলাটা একেবারে দু-ফাঁক করে কাটা।
তারপর—তুমি কি করলে সুলতান?
আমার চেঁচামেচিতে আশপাশের দোকান থেকে সবাই ছুটে এল। তারাই তখন পুলিসে খবর দেয়। পুলিস এল, সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করল, কিন্তু কেউ কোন হদিস দিতে পারল না। কেউ কিছু বলতে পারল না। কেউ কিছুই নাকি জানে না—জানতেও পারেনি।
.
সুলতানের মুখে সব কথা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল কিরীটী।
তারপর একসময় প্রশ্ন করল, কিন্তু তুমি আমাদের কাছে এসেছ কেন?
বাবুজী, আমার আব্বাজানের কাছেই আপনার কথা শুনেছিলাম। আপনি খুব বড় একজন গোয়েন্দা, আব্বাজানই একদিন আমাকে বলেছিল। হঠাৎ কাল রাত্রে আপনাদের কথা আমার মনে পড়ল বাবুজী। কালই আসতাম, কিন্তু বৃষ্টির জন্য আসতে পারিনি। জানি না আমার আব্বাজানকে অমন করে কে খুন করেছে। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত সে কথা জানতে পারছি আমার মনের দুঃখ যাবে না। কেবলই মনে হচ্ছে সে-রাতে যদি আমি বরাহনগরে না যেতাম তবে হয়ত ঐ ঘটনা ঘটত না। আমার আব্বাজানকে অমন করে প্রাণ দিতে হত না। মনে হচ্ছে তাই আমিই দায়ী-আমার আব্বাজানের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। বলতে বলতে গলাটা যেন কান্নায় বুজে এল সুলতানের।
চোখের কোল বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
একটু থেমে হাতের পাতায় চোখের অশ্রু মুছে সুলতান বললে, জানেন বাবুজী, আব্বাজান সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে যেতে দিতে চায়নি—বলেছিল আজ বরাহনগরে নাই গেলি বেটা, কিন্তু শুনিনি তার কথা। দোস্ত মুসুদ নিমন্ত্রণ করেছে—অনেককালের দোস্তী আমাদের–তাছাড়া অনেকদিন দেখাসাক্ষাৎ ছিল না—তাই আব্বাজানের কথায় কান দিইনি।
সুলতানের দু চোখের কোল আবার অশ্রুতে ভরে ওঠে।
বাইরে আবার বৃষ্টি নামল বেশ জোরে।
বাবুজী, আপনার যোগ্য পারিশ্রমিক হয়ত আমি দিতে পারবো না-তবে সাধ্যমত দেবো-কিছু টাকা আমি সঙ্গেই এনেছি। বলে একশো টাকার খান তিনেক নোট জামার পকেট থেকে বের করল সুলতান!
টাকা তুমি রাখ সুলতান। কিরীটী বললে।
বাবুজী, আপনি কি তাহলে আমাকে কৃপা করবেন না!
আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তোমার আব্বাজানের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে। আমার পারিশ্রমিকের জন্য তুমি ভেবো না, আগে কাজটা হোক তারপর যা খুশি তোমার তুমি দিও।
বাবুজী!
এখন কয়েকটা প্রশ্নের আমার জবাব দাও সুলতান!
বলুন?
তোমাদের কি কোন দুশমন বা শত্রু ছিল?
দুশমন!
হ্যাঁ, তোমার বা তোমার আব্বাজানের?
আমরা ঐখানে আজ বিশ সালেরও উপরে আছি। আব্বাজানকে সবাই ওখানে খুব ভালবাসত-কারণ দায়ে অদায়ে আব্বাজান সকলকেই অর্থ বা তাগদ দিয়ে সাহায্য করত। আমার সঙ্গে অবিশ্যি কখনও কখনও কারও ঝগড়াঝাঁটি মারামারিও হয়েছে, কিন্তু–
আচ্ছা ঐ ব্যবসায় তোমাদের লাভ হত কি রকম সুলতান?
মিথ্যে বলব না বাবুজী, আব্বাজান ঐ ব্যবসা করে বেশ কিছু জমিয়েছিল।
কত টাকা হবে?
তা দশ বারো হাজার তো হবেই।
সে টাকা কোথায় সে রাখত?
ঘরে একটা হাঁড়ির মধ্যে।
সে টাকাগুলো আছে তো?
হাঁড়িটা যেমন ছিল তেমনই আছে, সে আমি ঐদিনই দেখেছি।
তাহলে টাকার জন্য নয়!
কি বললেন বাবুজী?
না, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে সুলতান, কেউ টাকা-পয়সার লোভে তোমার আব্বাজানকে খুন করেনি। আচ্ছা সুলতান!
বলুন বাবুজী?
০৩. কিরীটী একটু থেমে বলে
কিরীটী একটু থেমে বলে, কাউকে তুমি সন্দেহ কর, যে তোমার আব্বাজানকে খুন করতে পারে?
আমার মাথার মধ্যে তো কিছুই আসছে না বাবুজী, অমন নিষ্ঠুরভাবে কেউ আব্বাজানকে হত্যা করতে পারে!