গেলাম ইউসুফের ওখানে।
ইউসুফ ছিল। সব শুনে বললে, ও চিড়িয়া তো চট করে মেলে না বাবু! একটিই ছিল, আপনাদের দিয়েছিলাম। এখন কোথায় পাব?
আনিয়ে দিতে পার না একটা?
যে এনেছিল সে একজন জাহাজের খালাসী। তার জাহাজ অস্ট্রেলিয়ায় গেলে ওই রকম কাকাতুয়া সে এনেছে বার দুই।
সে আর আসবে না?
চিড়িয়া পেলেই আসবে। প্রায় বছরখানেক সে আসে না।
এক বছরের মধ্যে আর আসেনি সে?
না, তার জাহাজ তো এদিকে বড় একটা আসে না। মধ্যে মধ্যে কখনও আসে। একজন গোয়ানিজ-ডি’সিলভা নাম তার।
হতাশ হয়েই অতঃপর আমাদের ফিরে আসতে হয়েছিল।
অথ কাহিনীর উপক্রমণিকা বা মুখবন্ধ। অতঃপর দেড় বৎসরাধিককাল পরে যে কাহিনীর যবনিকা উত্তোলন করতে চলেছি তার সঙ্গে ঐ ইউসুফ মিঞার নামটা জড়িয়ে গিয়েছিল।
০২. সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সংবাদ
সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সংবাদ সহসা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
সংক্ষিপ্ত সমাচার : টেরিটি বাজারে নৃশংস খুন। টেরিটি বাজারের এক পাখীওয়ালা ইউসুফ মিঞাকে তার ঘরের মধ্যে গলাকাটা মৃতাবস্থায় রক্তাপুত পাওয়া গিয়েছে।
বর্ষাকাল—এবারে বৃষ্টি বা মনসুন শুরু হয়েছে শ্রাবণের একেবারে শেষে। গতকাল বিকেল থেকে শহরে প্রবল বর্ষণ চলেছে একটানা প্রায় বলতে গেলে।
রাস্তাঘাট প্রায় জলমগ্ন। বৃষ্টি একবার সামান্যক্ষণের জন্য ধরে, আবার প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। বিকেলে গতকাল এসেছিলাম কিরীটীর ওখানে কিন্তু গৃহে ফেরা হয়নি প্রবল বর্ষণের জন্য।
সকালবেলা তখনও আকাশটা যেন স্লেটের মত ধূসর ও ভারি হয়ে আছে। থেকে থেকে বর্ষণ হচ্ছে। কিরীটীর বসবার ঘরে আমি কিরীটী ও কৃষ্ণা চা পান করছিলাম। আমার হাতে
ঐদিনকার সংবাদপত্রটা।
সহসা পাতা ওলটাতে ওলটাতে সংবাদটি আমার চোখে পড়ল।
চমকে উঠলাম।
এ কি!
কি হল? কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকাল।
ইউসুফকে কে যেন তার দোকানঘরে নৃশংসভাবে খুন করে গিয়েছে।
ইউসুফ?
হ্যাঁ রে। সেই টেরিটি বাজারের চিড়িয়াওয়ালা-ইউসুফ মিঞা।
কি লিখেছে?
গতকাল সকালে তার দোকানঘরের মধ্যে তাকে রক্তাক্ত গলাকাটা মৃত পাওয়া গিয়েছে।
তার একটা ছেলে ছিল না—কি যেন নাম? কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে।
সুলতান।
সুলতান ছিল না বুঝি ঐ সময়? সেও তো বাপের কাছেই থাকত?
সে রাত্রে সে দোকানে ছিল না। বরাহনগরে তার এক বন্ধুর ওখানে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিল। ভোরাত্রে গিয়ে দেখে দোকানের দরজাটা ভেজানো। দরজা ঠেলে খুলতেই একরাশ পাখী চারদিক থেকে তার চারপাশে ডেকে ডেকে উড়তে থাকে। ঘরের আলোটা নেভানো ছিল।
থতমত খেয়ে প্রথমটায় ব্যাপারটা না বুঝতে পেরে সে অন্ধকারে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর এগুতে গিয়ে পায়ে কি বেধে গিয়ে, মেঝের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারপর কোনমতে উঠে আলো জ্বালতেই চোখে পড়ে তার বাপজান মেঝের উপর পড়ে আছে রক্তাপ্লুত অবস্থায়। তার গলাটা কাটা। সে তখুনি চিৎকার করে আশপাশের সকলকে ডাকে। অতঃপর পুলিস আসে। কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি।
কিরীটী সংবাদটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, লোকটা তো যতদূর মনে পড়ে বেশ নিরীহ শান্তশিষ্ট টাইপের ছিল!
তাই তো ভাবছি, অমন একটা লোককে কে খুন করতে পারে? আর কেনই বা করল অমন করে?
কথা আমার শেষ হল না, জংলী এসে ঘরে ঢুকল, বাবু!
কি রে?
একটা লোক দেখা করতে চায়।
এত সকালে বৃষ্টি মাথায় করে আবার কে এল? বললাম আমি।
কিরীটী বলে, কি চায়? কোথা থেকে আসছে?
আজ্ঞে বললে, বিশেষ দরকার নাকি আছে আপনার সঙ্গে।
যা, কোথা থেকে আসছে, কি নাম-জিজ্ঞাসা করে আয়।
আজ্ঞে বললে, টেরিটিবাজার থেকে আসছে।
টেরিটিবাজার! চমকে উঠি।
হ্যাঁ-ইউসুফ মিঞার ছেলে সুলতান।
যা, এই ঘরে নিয়ে আয়। কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দেয়।
জংলী চলে গেল।
একটু পরেই জংলীর পিছনে পিছনে যে যুবকটি এসে ঘরে ঢুকল তার বয়স বাইশতেইশের মধ্যে।
যুবকটি সুলতানই। বেশ কয়েক বছর পরে হলেও তাকে আমাদের কারোর চিনতে কষ্ট হয় না, কারণ বার-দুই ওকে ইউসুফের দোকানে দেখেছিলাম, তবে অন্য বেশভূষায়। তখন পরনে ছিল চেককাটা এক লুঙ্গি আর সাদা ময়লা পাঞ্জাবি। চুলের বাহারও বিশেষ ছিল না সে-সময়।
সাদামাটা চেহারা ও বেশ। আজ কিন্তু চেহারা ও বেশভূষায় অনেক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হল। মাথায় টেরি, কেয়ারী করে ছাঁট চুল ও ঠোটের উপরে বাটারফ্লাই গোঁফ, মেহেদী রাঙানো নুর দাড়ি। রংটা মাজা-মাজা। পেশল বলিষ্ঠ দেহের গড়ন। পরনে পায়জামা ও লক্ষ্ণৌ চিকনের পাঞ্জাবি।
চিড়িয়াওয়ালা ইউসুফ মিঞার বেটা বলে আজ যেন চিনবারই উপায় নেই সুলতানকে। যেন কোন খানদানী মুসলমানের ঘরের ছেলে। বেশ সৌখীন, চেহারায় ও বেশভূষায়।
বাবুজী, আপনারা দুজনেই আছেন ভালই হল, সেলামালেকুম বাবুজী। আমাকে চিনতে পারছেন?
কিরীটী বললে, বস সুলতান।
কিরীটীর আহ্বানে কোনরকম সংকোচ না করে পায়ের জুতো খুলে ঘরের পুরু দামী কাপেট মাড়িয়ে এসে একটা সোফার উপর আমাদের মুখোমুখি বসল, আপনারা যে গরীবকে চিনতে পারবেন বুঝিনি। বাবুজী, একটা বিশেষ কারণে আপনার কাছে এসেছি। সুলতান কিরীটীর মুখের দিকেই তাকিয়ে বলে কথাটা।
খবরের কাগজে একটু আগেই পড়ছিলাম, তোমার আব্বাজান–
হ্যাঁ বাবুজী, আমার আব্বাজানকে পরশু রাত্রে আমার অবর্তমানে কারা যেন শেষ করে রেখে গিয়েছে।