ব্লু কুইন ও অন্যান্য কিছু মূল্যবান মুক্তো সরানোর জন্য এবং টেরিটিবাজারের ইউসুফ মিঞাকে হত্যা করবার অপরাধে।
মশায়েরা কি গাঁজায় দম দিয়ে এসেছেন। আবার ব্যঙ্গভরা কণ্ঠে বলে ওঠে থি’ব।
মিসেস জোসেফ, কিরীটী এবারে অদূরে দণ্ডায়মান নির্বাক মা’থিনের দিকে তাকিয়ে বললে, আপনার বুদ্ধির তারিফ করি ম্যাডাম-কিন্তু তাহলেও বলব
কিরীটীর কথা শেষ হল না। আমাদের সকলের দৃষ্টি তখন মা’থিনের উপর গিয়ে পড়েছিল মুহূর্তের জন্য, আর সেই মুহূর্তটুকুরই সুযোগে অঘটনটা ঘটে গেল।
একটা তীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকার করে টলে পড়ল মা’থিন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাঘের মত ঐ বয়সেও কিরীটী থি’বর উপরে ঝাপিয়ে পড়ে তাকে যুযুৎসুর পঁচে ধরাশায়ী করে।
শীগগিরি হাতকড়া লাগান মিঃ লাহিড়ী। কিরীটী চেঁচিয়ে ওঠে।
পূর্ণ লাহিড়ী মুহূর্ত দেরি করেন না-পকেট থেকে হাতকড়া বের করে থিবির হাতে পরিয়ে দেন।
হিংস্র দুটো চোখের দৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল, থি’ব যেন কিরীটীকে সুযোগ পেলে মুহূর্তে শেষ করে দেবে–
কিরীটী থি’বর হাতে হাতকড়া পরানো হতেই এগিয়ে যায় ভূপতিত মা’থিনের দিকে।
রক্তে তার সমস্ত জামা লাল হয়ে উঠেছে।
একটা ছোট ছোরা তার বামদিককার বক্ষে সমূলে বিদ্ধ।
থেকে থেকে মা’থিনের সমস্ত দেহটা আক্ষেপ করছে।
হঠাৎ ঐ সময় কেবিনের দরজাটা খুলে গেল, জাহাজের একজন খালাসী একটা খাঁচা হাতে কেবিনের মধ্যে এসে ঢুকল—তার পশ্চাতে ক্যাপ্টেন।
ক্যাপ্টেন কেবিনের মধ্যে পা দিয়েই বলে ওঠেন, Good God! এ কি?
ক্যাপ্টেন, শীগগিরি আপনার জাহাজের ডাক্তারকে ডাকুন-বাঁচবে না বুঝতে পারছি, তবু let us try!
ক্যাপ্টেন ছুটে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন।
মা’থিন-মা’থিন।
চমকে আমরা ফিরে তাকালাম।
খাঁচার মধ্যে কালো ময়না পাখীটা বলছে, মা’থিন-মা’থিন।
খালাসীটা তখনও হতভম্ব হয়ে খাঁচাটা হাতে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মিনিট দশেকের মধ্যেই জাহাজের ডাক্তার এল। কিন্তু বাঁচানো গেল না মা’থিনকে। সে মারা গেল।
শুধু মৃত্যুর আগে একটা কথা সে কোনমতে টেনে টেনে জড়িয়ে জড়িয়ে বলে গেল, কিরীটী যেন মুক্তোগুলো পেলে তার স্বামী জোসেফকে পাঠিয়ে দেয়। সে পারল না মুক্তোগুলো উদ্ধার করতে।
স্ট্রেচারে করে ঢাকা দিয়ে মা’থিনের মৃতদেহটা জাহাজ থেকে নামিয়ে আনা হল এবং থি’বকে হাতকড়া পরা অবস্থায় পুলিস-ভ্যানে সশস্ত্র প্রহরীর জিম্মায় তুলে দেওয়া হল।
.
ঐদিনই দ্বিপ্রহরে। গরাদের মধ্যে হাতকড়া অবস্থায় থি’ব। কিরীটী নানাভাবে তাকে প্রশ্ন করল, কিন্তু থি’ব একেবারে যেন বোবা। তার মুখ থেকে একটি কথাও বের করা গেল না। এবং মুক্তোগুলো যে কোথায় আছে তারও কোন সন্ধান করা গেল না।
অবশেষে কিরীটী বললে, ও মুখ খুলবে না মিঃ লাহিড়ী। ডি’সিলভার সন্ধান যতদিন না পাওয়া যায় আমাদের অপেক্ষাই করতে হবে। আপনি সমস্ত জাহাজে জাহাজে ওয়ারলেস মেসেজ পাঠিয়েছেন তো?
হ্যাঁ, আশা করছি দু-চারদিনের মধ্যেই ডি’সিলভার সন্ধান পাব।
ঠিক আছে চলুন, আপনার অফিস-ঘরে যাওয়া যাক। কিরীটী বললে।
সকলে আমরা লাহিড়ীর অফিস-ঘরে এসে ঢুকলাম। চেয়ারে বসে একটা চুরোটে অগ্নিসংযোগ করতে করতে কিরীটী বললে, পাখীটা কোথায়?
আমার কোয়ার্টারেই আছে। কিন্তু পাখীটা যেন ক্রমশঃ কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে মিঃ রায়-কিছু খাচ্ছেও না!
স্বাভাবিক। মুক্তোগুলো হজম করতে পারবে কেন? বেচারী। ইচ্ছা ছিল অমন একটা rare specimen যদি বাঁচানো যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে তা আর সম্ভব হবে না। ও না মরলে আমাদেরই ওকে মারতে হবে-মুক্তোগুলো ওর পেট থেকে উদ্ধার করবার জন্য।
কিন্তু থি’ব যদি জানতই পাখীটার পেটেই মুক্তোগুলো আছে, পাখীটাকে মারেনি কেন? লাহিড়ী প্রশ্ন করে।
এমন একটা আশ্চর্য পাখী—ওর দামও তো কম নয়—তাই ভেবেছিল হয়ত পাখীটার পায়খানার সঙ্গে যদি মুক্তোগুলো বের হয়ে আসে, তাহলে মুক্তোগুলোও পাওয়া যায়, পাখীটাকেও মারতে হয় না।
পরের দিনই পাখীটা মারা গেল। পাখীটার পেট চিরে ফেলা হল-বারোটা বড় আকারের মুক্তো ও রু কুইন পাখীটার পেটের মধ্যেই পাওয়া গেল। নাড়ীর মধ্যে ঘা হয়ে গিয়েছিল। সেই ঘা-ই পাখীটার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।
লাহিড়ী বলেন, চমৎকার পন্থা নিয়েছিল দেখছি লোকটা মুক্তোগুলো সরাবার অন্যের দৃষ্টি থেকে।
নিঃসন্দেহে। আর তারও হয়ত পাখীটার উপরে লোভ ছিল বলে শেষ পর্যন্ত পাখীটা মারতে পারেনি।
০৯. তিনদিন পরেই তার পাওয়া গেল
তিনদিন পরেই তার পাওয়া গেল, জোসেফ কলকাতায় আসছে সিঙ্গাপুর থেকে দিন দুয়েকের মধ্যেই এবং ওই দিনই ডি’সিলভার সন্ধান পাওয়া গেল।
অস্ট্রেলিয়ার বন্দরে এম. এস. বাটোরি জাহাজে সে ছিল। অস্ট্রেলিয়া সরকার তার কলকাতায় আসার ব্যবস্থা করেছিলেন।
পরের দিন ডি’সিলভাও এসে পৌঁছাল।
ডি’সিলভাকে রঘুনাথনের ফটো দেখানো হল, কিন্তু ফটো দেখে সে বললে তার সঙ্গে গিয়ে ইউসুফ মিঞাকে ময়নাটা বিক্রি করেছিল সে ওই লোক নয়।
কিরীটী প্রশ্ন করল, তবে সে লোকটা কোথায়?
সে তো হুজুর কলকাতাতেই থাকে।
কলকাতায় থাকে?
আজ্ঞে।
কোথায় থাকে কলকাতায় জান?
খিদিরপুরের এক বস্তীতে। তার নাম রতিলাল-জাহাজের মাল খালাস করে।
তারপর কিরীটীর প্রশ্নের উত্তরে যা বললে ডি’সিলভা, রতিলালকে ডি সিলভা অনেক দিন আগে থাকতেই চেনেতার বস্তীর বাসায় সেবার গিয়ে তার ঘরে ওই ময়নাটা সে দেখতে পায়। রতিলাল বলে, জাহাজের মাল খালাস করতে করতে খাঁচাসমেত ঐ পাখীটা সে দেখতে পায়। পাখীটা রবিন রবিন বলে ডাকছিল।