Site icon BnBoi.Com

আলোকে আঁধারে – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

আলোকে আঁধারে - নীহাররঞ্জন গুপ্ত

০১. প্রস্তাবটা তুলেছিল সজলই

 

প্রস্তাবটা তুলেছিল সজলই প্রথমে যে, একটা দিন সকলে মিলে বটানিকসে গিয়ে হৈ চৈ করে কাটানো যাক।

এবং প্রস্তাবটা তুলেছিল সে মিত্রানীর কাছে এসে তার বাড়িতে এক সকালে। বেলা তখন নয়টা সোয়া নয়টা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারই সেই আনন্দ উৎসবে যোগ দেওয়া হয়ে ওঠেনি। ছুটি না শেষ হতেই তাকে চলে যেতে হয়েছিল। বৎসর তিনেক হবে প্রায় সজল কলকাতায় ছিল না। সেকেন্ড ডিভিশনে হায়ার সেকেন্ডারি পাস, তারপর বি. কম.-এ কোনমতে পাস করে যখন সে নিজেও স্থির করতে পারছে না অতঃ কিম্ কোন্ লাইনে, কোন্ পথে পা বাড়াবে, আত্মীয় বন্ধু-বান্ধব নানা জনে নানা পরামর্শ দিচ্ছে, সজল সকলের অজ্ঞাতেই এবং নেহাতই একটা খেয়ালের বশে কমপিটিটিভ পরীক্ষায় বসে গিয়েছিল—পাস সে করবেই না জানত।

সাধারণ মিডিওকার ছাত্র সে কিন্তু রেজাল্ট বেরুলে আশ্চর্য, দেখা গেল প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতে প্লেস একটা সে নীচের দিক হলেও পেয়ে গিয়েছে। এবং তারই জোরে একটা চাকরি তার আজকালকার দিনে লোভনীয়ই বলতে হবে পেয়ে গেল। বন্ধুবান্ধবেরা তো বটেই, আত্মীয় ও পরিচিতজনেরা ওর এই হঠাৎ সাকসেসে বেশ একটু যেন আশ্চর্যই হয়েছিল। প্রথমে দিল্লীতে ট্রেনিং, তারপর বৎসরখানেক এদিক ওদিক হাতেকলমে ট্রেনিং শেষ করে একদিন সে নর্থ বেঙ্গলে পোস্টেড হলো বোধ হয় কিছুদিনের জন্যই। এবং ঐ পোস্টিংয়ের খবরটা তার পরিচিত বন্ধুমহলে সকলেই পেয়েছিল।

মিত্রানী সেদিন সকালে কলেজে বেরুবে বলে উঠি-উঠি করছে-হঠাৎ সজল এসে ঘরে ঢুকল। পরনে দামী সুট, বড়লোক বা অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে না হলেও পোশাকে আশাকে বরাবরই সে কিছুটা শৌখীন ও ফিটফাট ছিল। কিন্তু আজকের বেশভূষা ও শৌখীনতার মধ্যে একটু বিশেষত্বই ছিল বুঝি সজলের। দেখতে সজল কালোর উপর মোটামুটি মন্দ নয়, সুগঠিত পৌরুষোচিত দেহ। বেশ লম্বা।

হ্যালো মিত্ৰানী—

আরে আরে কী আশ্চর্য, সজল তুমি। উচ্ছল আনন্দে মিত্রানী বলে ওঠে।

হাসতে হাসতে আরো দুপা এগিয়ে এসে সজল বললে, হ্যাঁ, সজলের প্রেত নয়-সজল চক্রবর্তীই–

হাসতে হাসতেই মিত্রানী জবাব দেয়, সে তো দেখতেই পাচ্ছি—শুনেছিলাম নর্থ বেঙ্গলের কোথায় কি একটা একজিকিউটিভ পোস্ট নিয়ে গিয়েছে–।

সজল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলে, আর বলো না—ঐ নামেই বড় পোস্ট দিবারাত্র এক মুহূর্ত বিশ্রাম নেই। তোমরা তো ভাবো কি জানি কি একটা হয়ে গিয়েছি, কিন্তু আসলে—

বোস সজল, চা করে আনি। কতকটা যেন সজলকে থামিয়ে দিয়েই কথাটা বললে মিত্রানী। কারণ মিত্রানী জানত, একবার শুরু করলে সজল থামবে না।

না না-সজল বললে।

সে কি-যখন-তখন আগের মত চা খাও না বুঝি আজকাল আর!

না।

তাহলে তোমার সেই থিওরি, সব সময়ই টির সময়–

জান না তো, সর্বক্ষণ কাজ নিয়ে কি ব্যস্ত থাকতে হয় আমায়—তাছাড়া বানিয়ে দেবে কে?

কেন, বানাবার কেউ নেই!

শ্রীমান বাহাদুর আছে বটে, তবে সে যা চা বা কফি বানায়—

তা এবার জীবনে যখন থিতু হয়ে বসেছে—তোমার কথায় চা-কফি বানাবার জন্য কাউকে একজনকে ঘরে নিয়ে এসো না। হাসতে হাসতে বললে মিত্রানী।

তার মানে বিয়ে তো! সজল বললে।

হ্যাঁ—তা ছাড়া আর কি?

কি জান, বিয়ে তখনি করা যায় মিত্রানী, যখন মনের মত কাউকে পাওয়া যায়। তাছাড়া তুমি তো জানো মিত্রানী, ওয়াইফ এবং কম্প্যানিয়ন আমি একই সঙ্গে চাই।

ওয়াইফই একদিন কম্প্যানিয়ন হয়ে ওঠে সজল। মিত্রানী হাসতে হাসতে বললে।

না। ওটা তোমার ভুল। সব সময় ঠিক তা হয় না। আর তখন নিজের হাত নিজে কামড়ানো ছাড়া আর উপায় থাকে না।

তা বাংলাদেশে কি মেয়ের অভাব আছে নাকি। খুঁজলে তুমি যেমনটি চাইছো তেমনি

অত সময় বা ধৈর্য কোনটাই আমার নেই।

ঘড়িতে ঐ সময় নয়টা বাজতেই মিত্রানী চমকে ওঠে, উঃ বাবা, নটা তুমি বোসো সজল, আমি চট করে স্নান করে তৈরী হয়ে নিই—

কেন? এত তাড়াহুড়ো কিসের?

আমি যে একটা কলেজে প্রফেসারী করছি কিছুদিন হলো—

সত্যি?

হ্যাঁ—এম. এ. পাস করে ডক্টরেটের জন্য তৈরী হতে হতে একটা পেয়ে গেলাম—তবে মাইনে সামান্যই–

আজকাল আর সে কথা বলো না মিত্রা, আজকাল শিক্ষক, অধ্যাপকদের মাইনে তো ভালই দেয় শুনেছি আমাদের দেশে

তা অবিশ্যি দেয় তবে সেই সঙ্গে জীবনযাত্রার মানটাও মার্কারি কলমের মতো প্রত্যহ ঊর্ধ্বগতির দিকেই চলেছে—বোসা আমি আসছি–

না, না—আজকের দিনটা ড্রপ কর—নাই বা কলেজে গেলে আজ অধ্যাপিকা।

তা কি হয়, মেয়েরা ক্লাসে আমার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকবে—

একটা দিন না হয় বসেই রইলো, ড়ুব মেরে দাও আজকের দিনটা—কতদিন পরে এলাম! কতদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হলো বল তো, আমার অনারেই আজ না হয় কাজে ড়ুব দিলে

তা হয় না সজল। অথচ আমি শুধু তোমারই জন্য—

আমারই জন্য?

তাই, তোমারই জন্য এসেছি।

সত্যি বলছো?

বিশ্বাস তুমি যে করবে না তা আমি জানি মিত্রা, নচেৎ এতগুলো চিঠি লিখেছি অথচ একটারও জবাব দাওনি—

ডোন্ট টেল লাই সজল, তোমার প্রত্যেকটা চিঠিরই জবাব আমি দিয়েছি।

হ্যাঁ  দিয়েছে, তবে আমার প্রশ্নের জবাব দাওনি। যে জবাবটি পাওয়ার জন্য প্রতিদিন তোমার চিঠির প্রত্যাশায় থেকেছি–

মিত্রানী মৃদু মৃদু হাসতে থাকে।

আচ্ছা, তুমি কি সত্যিই আমার চিঠির অর্থ বুঝতে পারোনি?

পারবো না কেন! মিত্রানী মৃদু মৃদু হাসে মুখের দিকে চেয়ে।

তবে?

কি তবে?

জবাব দিলে না কেন আমার প্রশ্নের?

ওসব কথা থাক সজল।

না। মুখোমুখি প্রশ্নটা যখন উঠলোই–জবাব আমি চাই—

নাই বা দিলাম জবাব!

না, বল—

আচ্ছা সজল, আমরা কি পরস্পর পরস্পরের কাছে বরাবর বন্ধুর মতই থাকতে পারি না, যেমন আমরা অনেকেই অনেকের সঙ্গে আছি আজো–

আচ্ছা মিত্রা!

বল?

তুমি অন্য কাউকে—মানে অন্য কারোর বাগদত্তা?

না–সে রকম কিছু নয়, তবে–মানে ঐ পর্যায়ে এখনো পৌঁছায়নি ব্যাপারটা—

অর্থাৎ?

অর্থাৎ মন জানাজানির পালা এখনো চলছে। যাক গে ওসব কথা। তুমি একটু বোসো। লক্ষীটি, আমি স্নান সেরে তৈরী হয়ে নিই চট করে—

মিত্রানী লঘুপদে ঘরের সংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

সজল একাকী ঘরের মধ্যে চেয়ারটার উপর বসে রইলো। মিত্রানীর শেষের কথাগুলো যেন অকস্মাৎ একটা ফুৎকারের মত ঘরের একটি মাত্র আলো নিভিয়ে দিয়ে গেল।

সব কিছুই যেন সজলের অকস্মাৎ শূন্য মিথ্যা মনে হয়, মিত্রানী ঘর থেকে বাথরুমে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। যে সন্দেহটা গত তিন বৎসর ধরে একটা ধোঁয়ার মতই তার মনের মধ্যে জমা হচ্ছিল, সেটা যেন গাঢ় কালো একটা মেঘের মত তার সমস্ত মনের মধ্যে নয়নজলে,

ছড়িয়ে পড়েছে এই মুহূর্তে।

সমস্ত সংশয় ও সন্দেহের যেন শেষ নিষ্পত্তি করে দিয়ে গেল মিত্রানী আর কত সহজেই না সেটা করে দিয়ে গেল।

আর কোন প্রশ্নেরই অবকাশ রইলো না কোথাও।

এত বছর ধরে যে আশাটা মনের মধ্যে সযত্নে সে লালন করেছে, নিজের মনে নিজেই স্বপ্ন দেখেছে, সব কিছুর উপর যেন একটা পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়ে গেল মিত্রানী সেই মুহূর্তে।

ঘরের সংলগ্ন বাথরুমে স্নান করছে মিত্রানী, শাওয়ারের ঝিরঝির বারিপতনের সঙ্গে সঙ্গে একটা গানের সুর মিশে যাচ্ছে।

বহু পরিচিত গানটা সজলের। বহুবার সজল গানটা শুনেছে মিত্রানীর কণ্ঠে। প্রথম শুনেছিল তাদের কলেজেরই একটা ফাংশানে। মিত্রানী যে গান গাইতে জানে জানা ছিল না কথাটা সজলের। সেই প্রথম ফাংশানে শুনেছিল তার গান।

একা মোর গানের তরী
ভাসিয়েছিলাম নয়নজলে,
সহসা কে এলো গো
এ তরী বাইবে বলে।

ঐ গানের মধ্যে দিয়ে যেন সেদিন সজলের মিত্রানীর সঙ্গে নতুন করে পরিচয় ঘটে। তারপর কতবার অনুরোধ করে মিত্রানাকে দিয়ে গানটা ও গাইয়েছে।

কেন মোর প্রভাত বেলায়
এলে না গানের ভেলায়,
হলে না সুখের সাথী
এ জীবনের প্রথম খেলায়।

সজল বসেই থাকে। শাওয়ারের বারিপতনের ঝিরঝির শব্দ- তার সঙ্গে সুরের গুঞ্জন। যা জানবার ছিল–যা জানবার জন্য এত বছর ধরে সে প্রতীক্ষা করেছে তা তো তার জানা হয়ে গিয়েছে, তবে কেন এখনো সে বসে আছে।

কেন মিত্রানীর ঘরের দরজার সামনে ভিক্ষুকের মত হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে এখনো, অপেক্ষায়

কিসের অপেক্ষা! আর কেনই বা এ অপেক্ষা!

এবারে তো তার চলে যাওয়াই উচিত।

মনে মনে চলে যাবার কথা ভাবলেও, কেন জানি সজল উঠতে পারল না।

ঐ সময় স্নান সেরে ভিঙে চুলের রাশ পিঠের উপর এলিয়ে দিয়ে মিত্রানী বাথরুম থেকে বের হয়ে এলো।

প্রসন্ন স্নিগ্ধ-স্নানের পর মিত্রানীর দিক থেকে যেন চোখ ফেরাতে পারে না সজল, চেয়েই থাকে।

মিত্ৰানী মৃদু হেসে বললে, কি দেখছো সজল অমন করে আমার দিকে চেয়ে! মনে হচ্ছে যেন কখনো এর আগে তুমি আমাকে দেখনি–বলতে বলতে মৃদু হাসে মিত্রানী।

তেরচাভাবে টুলটার উপরে বসে মিত্রানী—সামনের ড্রেসিং টেবিলটার আয়নার দিকে আলোকে আঁধারে তাকিয়ে চুলে চিরুনি চালাচ্ছে মিত্রানী।

মিত্রানীর গলাটা কি সুন্দর মনে হয় সজলের! কখনো ঐ গ্রীবা মিত্রানীর স্পর্শ করেনি বটে সজল কিন্তু মনে হচ্ছে পাখীর গ্রীবার মতই যেন নরম তুলতুলে ও কোমল।

তারপর চিরুনি চালাতে চালাতেই প্রশ্ন করল মিত্রানী, কদিনের ছুটি নিয়ে এসেছো সজল?

এসেছিলাম তো দিন কুড়ি ছুটি নিয়ে—তবে ভাবছি দুচার দিনের মধ্যে ফিরে যাবো।

কেন? সে কি—এত তাড়াতাড়ি ছুটি না শেষ করেই ফিরে যাবে কেন? না, না, এসেছো যখন, আমরা পুরানো বন্ধু-বান্ধবরা মিলে বেশ কটা দিন হৈ হৈ করে কাটানো যাবে। তা অন্যান্য সকলের সঙ্গে দেখা হয়েছে, ক্ষিতীশ অমিয় মণি বিদ্যুৎ সুহাস সতীন্দ্র

পাপিয়া কাজল—

না—

দেখা হয়নি কারো সঙ্গে? কারো সঙ্গে দেখা করোনি?

–আচ্ছা মিত্রানী, আমি উঠি আজ আরে বোসো বোসো—একসঙ্গেই যাবো—তুমি যাবে শ্যামবাজারের দিকে— আমারও তো কলেজ ঐদিকেই

না—আমার একটু কাজ আছে সেক্রেটারিয়েটে। আচ্ছা চলি, বলেই উঠে দাঁড়াল সজল এবং মিত্রানীকে আর কোন কথার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

 

ঐ দশজনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটা প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল—সেই কলেজজীবনের ফার্স্ট ইয়ার থেকেই। ডিগ্রী কোর্সে সকলে এসে একসঙ্গে একই কলেজে ভর্তি হয়েছিল। এবং কলেজ-জীবনের দীর্ঘ তিন বৎসরের পরিচয়ে ও ঘনিষ্ঠতায় ওদের পরস্পরের মধ্যে একটা মধুর প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল স্বভাবতই।

সজল কিছুদিন ওদের সঙ্গে আর্টস পড়েছিল, তারপর হঠাৎ আর্টস ছেড়ে দিয়ে কমার্স নিয়েছিল। তার ক্লাস হতে সন্ধ্যার দিকে, কিন্তু তাতে করে মেলামেশার কোন অসুবিধা হয়নি। ওদের মধ্যে বিদ্যুতের বাবার অবস্থাই ছিল সবচাইতে ভাল। বনেদী ধনী বংশের ছেলে তো ছিলেনই—নিজেও ওকালতী করে সমরবাবু—বিদ্যুতের বাবা—প্রচুর উপার্জন করতেন।

শ্যামবাজার অঞ্চলে বিরাট সেকেলে বাড়ি। তিন-চার শরিক—এক এক শরিকের এক এক মহল–একতলায় একটা বিরাট হলঘর ছিল—প্রতি রবিবার সন্ধ্যার দিকে ঐ দশজন বিদ্যুৎদের ঐ হলঘরে জমায়েত হয়ে আড্ডা জমাতো। প্রতি রবিবারের সেটা ছিল ওদের একটা বাঁধা রুটিন।

শুধু আড়াই নয়—গান-আবৃত্তিও চলতো মধ্যে মধ্যে। বিদ্যুতের মা শৈলবালা প্রচুর জলযোগের ব্যবস্থা করতেন সবার জন্য!

এক বিদ্যুৎ ছাড়া অন্য সবাই মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়ে। ওদের—মানে, ছেলেদের মধ্যে সুহাসই ছিল লেখাপড়ায় সবার সেরা এবং মেয়েদের মধ্যে ছিল মিত্রানী।

০২. সজলের একটা কমপ্লেক্স ছিল

সজলের কিন্তু একটা কমপ্লেক্স বরাবরই ছিল। সেই কমপ্লেক্সের জন্যই বোধ হয় সে অন্যান্যদের সঙ্গে ঠিক মন খুলে মিশতে পারত না। শুধু তাই নয়, জীবনটাকে বরাবরই সে একটু সিরিয়াস ভাবে নিয়েছে—ভাল চাকরি করবে–জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে—জীবনে সাচ্ছল্য আসবে এটাই ছিল তার স্বপ্ন বরাবরের। সজল চলে যেতে মিত্রানীর মনে হলো, সজল আজো তেমনি আছে—তিন বছরে কোন পরিবর্তনই হয়নি তার। জীবন সম্পর্কে আজো সে তেমনি সিরিয়াস।

মিথ্যা বলেনি সজল মিত্রানীকে, কমপিটিটিভ পরীক্ষায় পাস করে চাকরি নিয়ে কলকাতা ছাড়বার পর, বিশেষ করে গত দুই বৎসরে যে-সব চিঠি সজল তাকে লিখেছে তার মধ্যে প্রায় শেষের দিকের সবগুলো চিঠিতেই একটি কথা যেন বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিখেছে সজল তাকে। এবং তার সহজ অর্থই হচ্ছে, সজল তাকে জীবনসঙ্গিনীরূপে পেতে চায়—অবশ্য মিত্রানীর যদি আপত্তি না থাকে।

মিত্রানী সজলের সব চিঠিরই জবাব দিয়েছে কিন্তু কেন না-জানি কোন চিঠির মধ্যেই সে লিখতে পারেনি সজল যা চায় তা হতে পারে না, তার পক্ষে সজলের অনুরোধ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়—বরং কিছুটা কৌশলেই যেন সজলের প্রশ্নের জবাবটা এড়িয়েই গিয়েছে এবং এও ভেবেছে মিত্রানী, সজল হয়ত নিজে থেকেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে এবং একসময় ঐভাবেই হয়ত ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।

কিন্তু এখন বোঝা গেল তা হয়নি।

সেদিনকার মিত্রানীর মনের ঐ কথাগুলো পরে মিত্রানীর উইরীর পাতায় আরো অনেক কথার সঙ্গে একেবারে শেষের দিকে জানতে পারা গিয়েছিল।

প্রায় নিয়মিতই বলতে গেলে প্রতি রাত্রে ঘুমোতে যাবার আগে মিত্রানী ডাইরী লিখতো, কিন্তু যাক—সে তো আরো পরের কথা।

নীচের কথাগুলো মিত্রানীর ডাইরীর পাতা থেকেই জানা যায়।

বেচারী সজল। সত্যিই ওর জন্য আমি দুঃখিত। হয়ত আজ স্পষ্ট করে ওকে আমার জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল কথাটা ঃ সজল, মনে মনে আমি সুহাসের কাছে অনেকদিন থেকেই বাগদত্তা। আমি শুধু অপেক্ষা করে আছি কবে সুহাস এসে আমায় বলবে, মিতা, তোমাকে আমি ভালবাসি তোমাকেই আমি চাই।

কি জানি—পারলাম না বলতে কিছুতেই যেন কথাটা সজলকে।

ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা যেন কিছুতেই অমন স্পষ্ট করে ওকে জানিয়ে দিতে পারলাম না।

বুঝতে পারছি অনেকখানি আশা নিয়েই সজল আজ আমার কাছে এসেছিল।

কিন্তু কি করবো—আমি কি করবো কি আমি করতে পারি?

আচ্ছা আমি যেমন সুহাসকে ভালবাসি, সেও কি তেমনি আমায় ভালবাসে?

কি জানি বুঝতে পারি না। ও এত চাপা যে কিছুই বোঝা যায় না ওর ভিতরের কথা।

কেন যেন মিত্রানীর চোখে সেরাত্রে একেবারে ঘুম ছিল না।

পরের দিন সকালে উঠে সবে চায়ের কাপটা নিয়ে বসেছে, বাবার ঘরে টেলিফোনটা বেজে উঠলো এবং একটু পরেই বাবার গলা শোনা গেল, মিতান মা, তোমার ফোন

চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখেই মিত্রানী বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকল। মিত্রানীর বাবা অবিনাশ ঘোষাল ঐদিনকার সংবাদপত্রটা পড়ছিলেন। মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দেখে বললেন, তোমাকে এত করে বলি মিতান মা ফোনটা তোমার ঘরে নিয়ে নাও—যখন-তখন এত বিরক্ত করে—

বাড়িতে ফোন আসার কিছুদিন পর থেকেই অবিনাশ ঘোষাল এ কথা বলে আসছেন। নিজে বরাবর স্কুল-মাস্টারি করেছেন—এখনো করছেন—রিটায়ার করবার প্রায় সময় হয়ে এলো, তার এক ছেলে এক মেয়ে-ছেলে বড়, ডাক্তার-ছেলে প্রণবেশই তার নামে ফোনটা এনেছিল বছরখানেক আগে বাড়িতে—সরকারের কাছে বিশেষ আবেদন জানিয়ে। কিন্তু ফোন বাড়িতে আসার মাস তিনেকের মধ্যেই সে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছে।

অবিনাশ ঘোষাল কখনো কারো কাছে ফোন করেন না—তাঁকেও বড় একটা কেউ ফোন করে না। ফোন আসে মিত্রানীর কাছেই।

এবং মিত্রানীই ফোন করে কখনো-সখনো।

মিত্রানী রিসিভারটা তুলে নিল, হ্যালো!

মিত্রানী নাকি? আমি সুহাস।

কেন জানি সুহাসের নামটা শুনেই ধক্ করে ওঠে মিত্রানীর বুকের ভিতরটা। তাকে বন্ধু-বান্ধবরা ফোন করে, সুহাস কখনো আজ পর্যন্ত তাকে ফোন করেনি।

সুহাস অবিশ্যি সময়ই পায় না বড় একটা। এম. এ. পড়তে পড়তেই, তার বরাবর অত ভাল পরীক্ষায় রেজাল্ট হওয়া সত্ত্বেও পড়া ছেড়ে দিয়ে কোন একটা মার্চেন্ট অফিসে চাকরি নিয়েছে।

মাইনে এমন বিশেষ কিছুই নয়।

মিত্রানী চাকরির সংবাদটায় তেমন নয়, যতটা পড়া ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে বিস্মিত হয়ে শুধিয়েছিল, তা তুমি পড়া ছেড়ে দেবে কেন?

সুহাস বলেছিল, দুটো তো একসঙ্গে ম্যানেজ করা যাবে না মিত্রানী—

কিন্তু পাসটা করেই না হয় চাকরিতে ঢুকতে—অনেক ভাল চান্স হয়ত পেতে।

ঠিক, তা হয়ত পেতাম, কিন্তু সময় তো দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে না। আজকের অভাবটা হয়তো আরো তখন দুঃসহ হয়ে উঠবে।

কিন্তু এম. এ.-তে তুমি নির্ঘাত ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতে, তখন অনেক ভাল চাকরি হয়ত তোমার জুটতো।

হয়ত নাও জুটতে পারতো, তাছাড়া–

কি?

তুমি যা বলছে—এম. এ.-র রেজাল্টটা ভাল হলে এবং সেরকম চাকরি না পেলে ব্যর্থতাটা হয়ত আরো বেশী পীড়া দিত মিত্রানী, এই বরং ভাল করেছি–

তোমার এত ভাল কেরিয়ার, মিত্রানী তবু যেন বোঝাবার চেষ্টা করেছে সুহাসকে।

সুহাস বলেছে, মাইনেটা কিন্তু নেহাৎ কম নয়—ডি. এ.. নিয়ে প্রায় তিনশর মতো পাবো–তারপর উন্নতি করতে পারলে

কি জানি, মিত্রানী বলেছে, আমার যেন মনে হচ্ছে তুমি বোধ হয় ভুল করলে সুহাস।

আরে আমরা তো জন্ম-মুহূর্তেই ভুল করে বসে আছি—

মানে?

এই প্রচণ্ড স্ট্রাগলের জমানায় মধ্যবিত্ত ঘরে জন্মানোটাই তো একটা ভুল—পথ সী, সব পথে কাঁটা—দুপা এগুতে গেলেই হোঁচট খেতে হবে।

সুহাস আর সজল যেন একে অন্যের সম্পূর্ণ বিপরীত! মিথ্যে নয়, মিত্রানীর কত সময় পরবর্তীকালে মনে হয়েছে সজলের মতো সুহাস কেন মনের মধ্যে সাহস পেল না! মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে তো দুজনাই—অথচ সুহাস লেখাপড়ায় কত ভাল ছেলে!

এম. এ.-টা পাস করতে পারলে সে অনায়াসেই একটা ভাল কলেজে কাজ পেয়ে যেতো–তা না একটা সামান্য কেরানীগিরিতে ঢুকে গেল, যার কোন ভবিষ্যৎ নেই–যে চাকরি-জীবনে কোন উত্তরণ নেই! বস্তুত বন্ধুদের মধ্যে সুহাসই প্রথমে চাকরিতে ঢুকেছিল।

তারপর কমপিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে সজল চাকরিতে ঢুকলো, সুহাস চাকরিতে ঢোকার পর যেন অন্য সকলের কাছ থেকে কেমন একটু দূরেই চলে গিয়েছিল। ডিগ্রী কোর্স শেষ হবার পর থেকেই ওদের বিদ্যুতের বাড়ির আভড়ায় সমাপ্তি ঘটেছিল। তাহলেও মধ্যে মধ্যে পরস্পরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হতো। তবে ঐ দেখাসাক্ষাৎ হওয়া পর্যন্তই, আগের মতো আড্ডা দেওয়া আর হয়ে ওঠেনি। প্রত্যেকে প্রত্যেকের খোঁজখবর অবিশ্যি পেতো এ ওর কাছ থেকে মধ্যে মধ্যে।

সকলেই যে যার ধান্ধায় ব্যস্ত। সকলেই চাকরি করে, একমাত্র বিদ্যুৎ ছাড়া।

যাদের বাড়িতে ফোন আছে, যেমন বিদ্যুৎ, কাজল, মণি এবং মিত্রানী-তারা পরস্পর পরস্পরকে মধ্যে মধ্যে ফোন করতে।

সুহাস কখনো তাকে ফোন করেনি। আর মিত্রানীও কখনো আজ পর্যন্ত সুহাসকে ফোন করেনি—বিশেষ করে তাই মিত্রানী একটু যেন বিস্মিতই হয়েছিল সুহাসের ফোন পেয়ে।

সুহাস ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আবার বললে, আমি সুহাস!

কি খবর সুহাস-হঠাৎ ফোন করছো?

সজল কলকাতায় এসেছে জানো? সুহাস মিত্রানীর প্রশ্নের জবাবে বললো।

জানি। পরশু সে আমার এখানে এসেছিল।

কয়েকটা মুহূর্ত অতঃপর স্তব্ধতা, তারপর সুহাসের গলা শোনা গেল, মিত্রানী!

বল।

বলছিলাম–মানে, সজল তোমাকে কিছু বলেছে?

মিত্রানী ভেবে পায় না সুহাসের প্রশ্নের কি জবাব দেবে। সজল সেদিন তাকে যে কথাটা বলেছিল সেটা কি কাউকে বলা ঠিক হবে! বিশেষ করে সুহাসকে!

চুপ করে আছো কেন মিত্রানী, সজল তোমাকে কিছু বলেছিল?

না—মানে বলছিলাম, হঠাৎ ঐ প্রশ্ন কেন?

সুহাস আবারও তার প্রশ্নটায় পুনরাবৃত্তি করলো, বল না, সজল তোমাকে কিছু বলেছিল?

না তো সেরকম কিছু তো আমার মনে পড়ছে না সুহাস-তবে কি তুমি ঠিক জানতে চাও যদি বলতে–

আচ্ছা মিত্রানী, সজল কি তোমাকে বলেছিল যে সে তোমাকে ভালবাসে—সে তোমাকে বিয়ে করতে চায়? আর জবাবে তাকে তুমি বলেছিলে, তা সম্ভব নয়—কারণ তুমি অন্য একজনকে ভালবাসো?

তোমাকে—মানে সজল তোমাকে ঐ কথা বলেছে? মিত্রানীর কণ্ঠস্বরে খানিকটা বিস্ময় যেন ফুটে ওঠে।

সুহাস তখন আবার বললে, নচেৎ আমি জানবো কি করে, বল! সজলের কাছে। অবিশ্যি তুমি তার নামটা বললানি—তাকে এড়িয়ে গিয়েছে, কিন্তু আমাকে তো তুমি বলতে পার—কে সে? আমাদের বন্ধুদের মধ্যেই কেউ কি?

কি হবে নামটা জেনে তোমার?

বস্তুত মিত্রানীর যেন কিছুটা অভিমানই হয়। সবার মধ্য থেকে শেষ পর্যন্ত সুহাসই কিনা তাকে আজ নামটা জিজ্ঞাসা করছে! আজও কি সে তাহলে বুঝতে পারেনি মিত্রানীর মনটা কোথায় বাঁধা পড়েছে!

কি হলো মিত্রানী, বলো?

মিত্রানী আর কোন কথা বলেনি ফোনে—নিঃশব্দে সে ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখেছিল। ঐ তারিখের মিত্রানীর ডাইরীর পাতায়—ঐ ঘটনার কথাটা লিখবার পর সে লিখেছে? আজ বুঝতে পারলাম, এতদিন যা ভেবে এসেছি তা মিথ্যা। সেই সঙ্গে বুঝতে পারলাম, সুহাসের মনের মধ্যে কোথাও আমি নেই।

০৩. ঐ ঘটনারই পরের দিন

ঐ ঘটনারই পরের দিন সজল আবার হঠাৎ এলো বিকেলের দিকে মিত্রানীদের ওখানে। শেষের ক্লাস দুটো মিত্ৰানীকে নিতে হয়নি বলে একটু আগেই কলেজ থেকে চলে এসেছিল ও। গতকালের ঘটনার পর থেকেই মনটা তার ভাল ছিল না, টেলিফোনে সুহাসের কথাগুলোই যেন কেবল তার মনে পড়ছিল। মুখে কোনদিন কথাটা সে প্রকাশ না করলেও –সুহাস কেন বুঝতে পারলো না মনটা তার এত বছর ধরে কোথায় বাঁধা পড়েছে।

নিজের ঘরে ক্যামবিশের আরাম-কেদারাটার উপরে গা ঢেলে দিয়ে চোখ বুজে পড়ে ছিল মিত্রানী-সজলের জুতোর শব্দটা পর্যন্ত তার কানে প্রবেশ করেনি সজলের কণ্ঠস্বরে

সে চোখ মেলে তাকাল।

মিত্রানী!

কে? ও সজল, এসো,–মিত্রানী উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। কিন্তু সজল তাকে বাধা দিয়ে বললে, আর ব্যস্ত হতে হবে না তোমাকে, বসো বসো-বলতে বলতে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সজল ওর মুখোমুখি বসে পড়ল।

মিত্রানী ভেবেছিল সেদিনকার তার ঐ স্পষ্ট কথার পর সজল বোধ হয় জীবনে আর তার সামনে এসে দাঁড়াবে না। কথাটা ভেবে তার একটু কষ্টও হয়েছিল, এখন সজলকে আসতে দেখে সে যেন একটু খুশিই হয়। শুধু তাই নয়, ঐ মুহূর্তে সজলের চোখমুখের ভাব দেখে মিত্রানীর মনেও হলো না, তার সেদিনকার সেই কথায় সজল এতটুকু অসন্তুষ্ট হয়েছে বা সে কথাগুলো তার মনে আছে!

কখন ফিরলে কলেজ থেকে? সজল শুধালো।

এই কিছুক্ষণ আগে–মিত্রানী বললে।

তোমাকে যেন একটু কেমন ক্লান্ত মনে হচ্ছে, মিত্রানী!

মিত্রানী মৃদু হেসে বলল, না। সে সব কিছু নয়—আচ্ছা সজল—

বল?

সুহাসের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল বুঝি?

শুধু সুহাস কেন, সকলের সঙ্গেই তো দেখা করেছি—কেন বল তো, হঠাৎ সুহাসের কথা কেন?

না, এমনি—

তা কই, আজ যে চায়ের কথা বললে না?

চা খাবে?

খাবো না মানে—এনি টাইম ইজ টি-টাইম।

বোসো—আমি আসছি–

মিত্রানী ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সজল বসে বসে একা একা মিত্রানীর টেবিলের উপর রাখা বই ও খাতাপত্রগুলো ঘাঁটতে লাগল। একটু পরেই মিত্রানী ঘরে ফিরে এলো।

জানো মিত্রানী, একটা প্ল্যান করেছি,—সজল বললে।

প্ল্যান!

হ্যাঁ, কে কবে কোথায় কখন থাকি—বিশেষ করে আমি তো আজ এখানে কাল সেখানে, তাই ঠিক করেছি একদিন সকলে মিলে সারাটা দিন কোথাও হৈ-চৈ করা যাবে।

বেশ তো। মন্দ কি—নট এ ব্যাড আইডিয়া!

পরশু শনিবার কি যেন একটা ছুটি আছে—তাই বিদ্যুৎকে আজ সকালেই বলেছি—আমরা সকলে শনিবারের দিনটা বটানিকস-এ গিয়ে হৈ-চৈ করে কাটাবো! কেন, বিদ্যুৎ তোমাকে ফোনে কথাটা বলেনি? সে তো বলেছিল, সে-ই তোমাকে ফোনে আমাদের প্ল্যানটা জানিয়ে দেবে—

না, এখনো বলেনি। হয়ত আজ সন্ধ্যেবেলা বলবে। তা সবাইকে কথাটা জানানো হয়েছে?

বিদ্যুৎ সকলকে জানাবার ভার নিয়েছে—তার গাড়ি আছে, ফোনও আছে, তার পক্ষেই সুবিধা।

প্রৌঢ়া গোপালের মা, মিত্রানীদের বাড়ির দাসী ঐ সময় ট্রেতে করে দুকাপ চা ও একটা প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল।

মিত্রানী একটু নীচু টুল এনে সামনে রেখে বলল, এটার উপরে রাখ গোপালের মা!

গোপালের মা ট্রে-টা নামিয়ে রেখে চলে গেল।

সজল বললে, এ কি, এক প্লেট খাবার কেন—তুমি কিছু খাবে না মিত্রানী?

না। এ সময় আমি এক কাপ চা ছাড়া কিছু খাই না।

রাত্রি প্রায় আটটা পর্যন্ত মিত্রানীর সঙ্গে সজল এটা-ওটা নানা গল্প করে এক সময়। মিত্রানীকে গান গাইবার জন্য অনুরোধ করল।

মিত্ৰানী প্রথমটায় গান গাইতে চায়নি কিন্তু সজলের পীড়াপীড়িতে গাইতেই হলো। সজল বললে, সেই গানটা গাও মিত্রানী!

কোন্ গানটা?

সেই যে অতুলপ্রসাদের সেই গানটা—

অতুলপ্রসাদের তো অনেক গান আছে, কোন্টা শুনতে চাও তাই বলো না।

সেই যে একা মোর গানের তরী—

মিত্রানী গেয়ে শোনায় গানটা। তারপর এক সময় সজল বিদায় নেয় মিত্রানীর কাছ থেকে। সজলকে দুদিন আগে স্পষ্ট করে তার প্রস্তাবে না বলার পর থেকেই মিত্রানীর মনের মধ্যে স্বভাবতই যে সংকোচটা দেখা দিয়েছিল তার যেন বিন্দুমাত্রও আর অবশিষ্ট থাকে না। যাক্, শেষ পর্যন্ত তাহলে সজল ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেয়নি। মনটা মিত্রানীর হালকা হয়ে যায়।

 

বিদ্যুৎ মিত্রানীকে ফোন করেছিল পরের দিন সকালে।

সজল কলকাতায় এসেছে কয়েক দিনের ছুটিতে তুমি তো জান মিত্রানী—বলেছিল বিদ্যুৎ।

জানি, মিত্রানী বললে।

সে বলেছিল, কাল শনিবার আমরা পুরানো দিনের বন্ধুরা একটা দিন বটানিস্-এ হৈ-চৈ করে কাটাববা—

হ্যাঁ, সে কাল আমার এখানে এসেছিল—বলছিল তোমাকে নাকি কথাটা বলেছে—তুমি সকলকে জানাবে।

জানিয়েছি। সবাই রাজী। সুহাস কি বললো?

সেও রাজী বৈকি। তাহলে তুমি আসছো তো মিত্রানী?

হ্যাঁ—যাবো। তা খাওয়াদাওয়ার কি হবে?

সে ব্যবস্থা আমিই করবো বলেছি সকলকে। তা কি মেনু করা যায় বল তো? কাজল বলছিল—

কি বলছিল?

একে এই বৈশাখের প্রচণ্ড গরম—কোন কিছু হেভী নয়–লাইট রিফ্রেশমেন্ট-এর মত কিছু–

তা সত্যি–সময়টা আউটিং-এর পক্ষে আদৌ ভাল নয়—যা প্রচণ্ড গরম চলছে—

তা অবিশ্যি ঠিক। তবে আজ কদিন থেকে প্রত্যেক দিনই তো সন্ধ্যায় কালবৈশাখী হচ্ছে—মেঘ করে কয়েক ফোটা বৃষ্টি পড়ছে—সন্ধ্যার দিকটা বেশ ঠাণ্ডাই মনে হয়।

আচ্ছা বিদ্যুৎ, কোল্ড ড্রিং-এর কিছু বন্দোবস্ত করলে হয় না?

বিদ্যুৎ বললে, সে ব্যবস্থা আমি করেছি–একটা আইস-বক্স নেবো—তার মধ্যে কোল্ড ড্রিংক্স থাকবে। আর থাকবে—কি বল তো?

বরফ।

না—আইসক্রীম—

ওঃ, হাউ লাভলি! তবে একটু বেশি করে নিও কিন্তু–

নেবো।

হ্যাঁ  বাবা, আমার দুটো-একটায় হবে না। যত খুশি যেন পাই–

এসময়ে আউটিং-এর ব্যবস্থা হলেও সজলের পরিকল্পনাটা কিন্তু সকলেই আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। বহুদিন সকলে একত্রে মিলে আড্ডা দেয়নি।

কলেজ-জীবনের সেই আনন্দময় দিনগুলো যেন হারিয়েই গিয়েছিল প্রত্যেকের জীবন থেকে।

কথা ছিল যে যার মত বটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়ে পৌঁছবে এবং সেই প্রাচীন বটবৃক্ষের তলে গিয়ে একত্রে মিলিত হয়ে জায়গা একটা বেছে নেওয়া হবে। তবে সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই সকলকে পৌঁছতে হবে।

মিত্রানীর পৌঁছতেই মিনিট পনেরো দেরি হয়ে গিয়েছিল। মিত্রানীকে দেখে সকলে হৈ হৈ করে উঠলো। মিত্রানী সকলের দিকে তাকাল।

সবাই এসেছে বিদ্যুৎ, ক্ষিতীশ, অমিয়, মণি, সতীন্দ্র, সুহাস, পাপিয়া, কাজল—কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে মিত্রানী বললে, ব্যাপার কি, বিদ্যুৎ-আমাদের আজকের আউটিং-এর পরিকল্পনাকারী সজলকে দেখছি না যে—সজল আসেনি?

বিদ্যুৎ বললে, ভেরী স্যাড!

স্যাড! কি ব্যাপার? সজলের কিছু হয়েছে নাকি?

না—

তবে?

হঠাৎ একটা জরুরী ট্রাংক কল পেয়ে তাকে তার কর্মস্থলে আজকেই সকালের প্লেনে চলে যেতে হচ্ছে।

এতক্ষণে হয়ত এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে—বলছিল সকাল সাড়ে দশটায় বাগডোগরার প্লেন। বিদ্যুৎ বললে।

বেচারী—তারই উৎসাহে সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করা হলো—অথচ সে-ই আসতে পারল না!

হ্যাঁ, খুব ভোরে আজ আমার ওখানে এসেছিল সজল, বললে, আমাকে হঠাৎ চলে যেতে হচ্ছে ভাই। জনই তো, পরের চাকরি—রেসপনসিবল পোস্টে আছি—সকালের প্লেনেই ফিরে যেতে হচ্ছে। তাতে আমি বলেছিলাম, প্রোগ্রামটা তাহলে ক্যানসেল করে দিই। সজল বললে, না, তা করো না–নাই বা থাকলাম আমি তোমাদের মধ্যে—তোমরা সকলে এনজয় করবেটার লাক নেক্সট টাইম! তাই আর কাউকে কথাটা জানাইনি—তা ছাড়া সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে গিয়েছে।

বেচারী সজল!

০৪. সকলেই সজলের অনুপস্থিতিটা

সকলেই সজলের অনুপস্থিতিটা সেদিন যেন সর্বক্ষণ অনুভব করেছে। তবু সকলে অনেক দিন পর একত্রে মিলিত হওয়ায় প্রচুর হৈ-চৈ করতে লাগল।

বৈশাখের ঐ প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও যেন কারো এতটুকু কোন ক্লান্তিবোধ হয়নি। ক্রমে ক্রমে বেলা পাঁচটা বাজে কারোর ফেরার কথা মনেই হয়নি। বরং সবাই স্থির করে, চাঁদনী রাত আছে—সন্ধ্যার পর সকলে ফিরবে।

সুহাস ঐ সময় বললে, কাগজে আজ লিখেছে কিন্তু বজ্রবিদ্যুৎসহ সন্ধ্যার দিকে এক পশলা বৃষ্টি হতে পারে,

অমিয় বললে, তাহলে আজ অন্তত নিশ্চিন্ত থাকতে পার বন্ধু—আমাদের ঐ আবহাওয়া অফিসের ফোরকাস্ট কোনদিনই ঠিক হয় না। যে দিনটি তারা বলেন, ঠিক তার উল্টোটিই হয়—

সকলে অমিয়র কথায় হেসে ওঠে। সুহাস বললে, কিন্তু কদিন ধরেই আবহাওয়া অফিসের ফোরকাস্ট মিলে যাচ্ছে কিন্তু।

অমিয় বললে, আজ আর মিলবে না দেখে নিও, তাছাড়া—-ছন্দপতন তো শুরুতেই ঘটে গিয়েছে—

কাজল শুধায়, কিসের আবার ছন্দপতন ঘটলো?

উদ্যোক্তাই শেষ পর্যন্ত অনুপস্থিত-আসা হলো না তার।

মিত্রানী সুহাসের মুখের দিকে তাকাল। একবার ইচ্ছা হয়েছিল তার সুহাসকে জিজ্ঞাসা করে, সজল তাকে আর কি বলেছিল। কিন্তু পারে না— কেমন যেন একটা সংকোচ বোধ করে।

কাজল ঐ সময় হঠাৎ বলে ওঠে, তোকে আজ যা নীল রংয়ের সিল্কের শাড়িটায় দেখাচ্ছে না—

সুহাস মৃদু হেসে বললে, মিত্রানীর প্রেমে যেন আবার পড়ে যেও না কাজল, দেখো—

সুহাসের কথায় যেন একটু চমকেই তাকাল মিত্রানী তার মুখের দিকে।

কাজল হাসতে হাসতে জবাব দেয়, যাই বলো সুহাস, আমাদের ছেলে-বন্ধুগুলো একেবারে গবে—দলে মিত্রানীর মতো একটা মেয়ে থাকতে এত বছরে এখনো কেউ ওর প্রেমে পড়তে পারল না।

সুহাস বললে, কি করে জানলে কাজল যে আমাদের মধ্যে কেউ এখনো ওর প্রেমে পড়েনি?

মশাই, অত রেখে ঢেকে কেন? কাজল বললে, কেউ কিছু মনে করবে না—বলে ফেলো, বলে ফেলো—আফটার অল উই আর ফ্রেন্ডস হিয়ার!

মিত্রানী বলে ওঠে, আঃ, কি হচ্ছে কাজল

দেখ বাবা–তোরা যে যাই বলিস, কাজল বললে, প্রেমের ব্যাপারটা কিন্তু সত্যিই আমার বড় ভাল লাগে—প্রেমে পড়াটাও যেমন আনন্দ—প্রেমে কেউ কারোর পড়েছে। শুনেও আনন্দ

বিদ্যুৎ হাসতে হাসতে ঐ সময় বলে ওঠে, অমিয়-ক্ষিতীশ-সুহাস, তোরা কেউ কোন কাজের নোস—মেয়েটা প্রেমের জন্য এত হেদিয়ে উঠেছে, অথচ তোরা—এতগুলো পুরুষমানুষ

সুহাস বললে, একেবারে নীরব–পাষাণ-সব পাষাণ বুঝলে কাজল—

কাজল বলে ওঠে, থাক্ বাবা থাক্‌——আমি না হয় কালোকুচ্ছিত আছি০০

সতীন্দ্র তাড়াতাড়ি বলে, ছিঃ, কাজল-ডোন্ট বি সিরিয়াস! সতীন্দ্র ব্যাপারটা হালকা করে দেবার চেষ্টা করে।

মিত্রানী ঐ সময় বললে, আচ্ছা, তোমরা কেউ আর কি কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না। যে, প্রেম নিয়ে সকলে বাকযুদ্ধে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছো?

সতীন্দ্র বললে, ঠিক,—অনা কথা বলো, অন্য কথা।বরং একটা গান হোক, মিত্রানী একটা গান গাও—

অবশেষে মিত্রানীর গানের ভিতর দিয়েই সমস্ত ব্যাপারটা যেন হালকা হয়ে গেল।

 

খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকতে ঢুকতেই বেলা প্রায় তিনটে হয়ে গেল। সকলে হাঁটতে হাঁটতে অতঃপর গঙ্গার ধারে যায়। এবং গঙ্গার ধারে অনেকক্ষণ বসে ছিল ওরা—ইতিমধ্যে অপরাহের আকাশে কখন কালো একখণ্ড মেঘ জমতে শুরু করেছে। ওদের খেয়ালও হয়নি কারো, হঠাৎ খেয়াল হলো আচম্বিতে একটা ধুলোর ঘূর্ণি এলোমেলোভাবে ছুটে আসায়। পরিদৃশ্যমান জগৎটা যেন মুহূর্তে সেই ধুলো আর রাশাকৃত ছেড়া পাতায় একেবারে মুছে একাকার হয়ে গেল।

আঁধি!

মেয়েদের শাড়ির আঁচল আর চুলের রাশ এলোমেলো এবং কেউ কিছু ভাল করে বুঝবার আগেই দলের নজন কে যে কোথায় কেমন করে ছিটকে পড়লো ওরা যেন বুঝতেই পারল না। অবশ্য ঐ প্রচণ্ড ধুলোর ঝড়ের মধ্যে কারো দিকে কারো নজর দেবার মত বুঝি কোন সুযোগও ছিল না।

মিনিট পনেরো কি কুড়ি হবে-ধুলোর ঝড় যখন থেমেছে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি—তারই মধ্যে বিদ্যুৎ লক্ষ্য করলো, সে দলছাড়া হয়ে একটা ঝোপের সামনে দাঁড়িয়ে। এদিক ওদিক তাকাল বিদ্যুৎ, কিন্তু আশেপাশে দলের আর কাউকেই সে দেখতে পেল না।

বিদ্যুৎ অন্যান্য সবাইকে খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে চলল।

পরে জানা গিয়েছিল, একা বিদ্যুই নয়—সতীন্দ্র, অমিয়, মণি (মণিময়), ক্ষিতীশ, কাজল, পাপিয়া সাতজনই ওরা একে অন্যকে বেশ কিছুটা সময় খুঁজে বেড়িয়েছে। অবশেষে সকলে যখন একত্রিত হয়েছে, কাজলই বললে, সুহাস মিত্রানী, তাদের দেখছি না—তারা দুজন কই?

মিত্রানী—সুহাস। তাই তো, সবাই যেন ঐ মুহূর্তে কাজলের কথায়, মিত্রানী ও সুহাস যে, তাদের মধ্যে নেই—ব্যাপারটা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠলো।

মিত্রানী সুহাস কোথায় গেল!

সকলেই সুহাস আর মিত্রানীর নাম ধরে ডাকে আর ওদের খোঁজে।

মিত্রানী—সুহাস! কোথায় তোমরা! মিত্রানী সু-হা-স—

বিদ্যুৎই ওদের মধ্যে শেষ ঝাপসা আলোয় প্রথমটায় সুহাসকে আবিষ্কার। করেছিল—সর্বপ্রথম। অর্থাৎ ওর দৃষ্টিই সকলের আগে সুহাসের উপরে গিয়ে পড়ে।

সুহাস উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে আছে—একটা ভাঙা পত্রবহুল গাছের ডাল, তারই নীচে সুহাসের দেহের নিম্নাংশ চাপা পড়েছে।

বিদ্যুৎ আর অমিয় তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ভাঙা ডালটা টেনে সরায়—অন্যরা সুহাসের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে। কাজল ডাকে, সুহাস!

সবাই তার গলায় যেন একটা কান্নার সুর শুনছিল।

মিত্রানীর কথা ঐ মুহূর্তে আর কারো মনে ছিল না। মনেও পড়েনি কথাটা কারো যে একা সুহাসই নয়, মিত্রানীকেও পাওয়া যাচ্ছে না সুহাসকে নিয়েই সকলে তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

কাজল বসে পড়েছিল একেবারে সুহাসের মাথার সামনে। তার মাথাটা নিজের কোলের উপর তুলে নিয়ে ডাকে, সুহাস—সুহাস–

সুহাস যেন অতি কষ্টে চোখ মেলে তাকাল।

সুহাস—কাজল আরো ঝুঁকে পড়ে সুহাসের মুখের কাছে।

কে?

আ—আমি কাজল।

বিদ্যুৎ এগিয়ে এলো। সে বললে, লেগেছে কোথাও তোর সুহাস?

হ্যাঁ—মাথায়—

সত্যিই সুহাসের মাথায় আঘাতের চিহ্ন ও রক্ত।

সুহাস উঠে বসতে বসতে বললে, উঃ, ভীষণ চোট লেগেছে মাথায়। এখনো মাথার মধ্যে ঝিম ঝিম করছে, ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠে সুহাস বললে। তারপরই একটু থেমে বললে, মিত্রানী—মিত্রানী কোথায়?

বিদ্যুৎ বললে, মিত্রানীকে দেখছি না। তুই দেখেছিস তাকে?

না তো—তবে—

কি তবে? অমিয় সাগ্রহে শুধায়।

ধুলোয় ঘূর্ণির অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, সুহাস পূর্ববৎ ক্লান্ত গলায় বলতে থাকে থেমে থেমে, হঠাৎ আমার মাথায় একটা প্রচণ্ড আঘাত পেলাম পিছন থেকে—মাথাটা ঝিম্ ঝিম্ করে উঠলো—সব অন্ধকার হয়ে গেল

তারপর? বিদ্যুৎ শুধালো।

জানি না। তারপর আর কিছু জানি না।

০৫. মিত্রানীকে বেশী খুঁজতে হয়নি

মিত্রানীকে বেশী খুঁজতে হয়নি–

সুহাস যেখানে পড়ে ছিল–সেই ঝোপটারই অন্য দিকে একটা গাছের নীচে, মিত্রানীকে পাওয়া গেল–চিত হয়ে পড়ে আছে মিত্রানী। হাত দুটো ছড়ানো। বিদ্যুৎই প্রথমে দেখতে পায়।

তার পরনের নীল মুর্শিদাবাদী সিল্কের শাড়িটার আঁচল বুকের উপর থেকে সরে গিয়েছে আর শাড়ির প্রান্তভাগটা প্রসারিত হাঁটুর অনেকটা উপরে উঠে এসেছে। বাঁ দিককার জঙ্ঘা অনেকটা

গায়ের ব্লাউজের বোতামগুলো মনে হয় কেউ যেন হ্যাচকা টানে ছিড়ে ফেলেছে। তলার ব্রেসিয়ারটারও একই অবস্থা।

চোখ দুটো যেন মিত্রানীর ঠেলে বের হয়ে আসছে। যেন এক অসহ্য যন্ত্রণার স্পষ্ট চিহ্ন ওর সারা মুখে তখনো। মুখটা সামান্য হাঁ করা, উপরের পাটির দাঁতের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। বোবা—সবাই যেন বোরা হয়ে গিয়েছে।

বিদ্যুৎই সামনে মিত্রানীর মুখের উপরে ঝুঁকে পড়ে অর্ধস্ফুট একটা চিৎকার করে ওঠে।

মিত্রানী—মিত্রানী মরে গেছে—

হ্যাঁ–সত্যিই—মিত্রানী মৃত।

ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই যেন কেমন বোবা–বিমূঢ়।

সবাই একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। কেমন যেন বোবা অসহায় দৃষ্টিতে। সুহাস-বিদ্যুৎ-অমিয়-সতীন্দ্র-কাজল-পাপিয়া-মণি-ক্ষিতীশ–

ইতিমধ্যে আসন্ন সন্ধ্যায় ঝাপসা অন্ধকার কখন যেন আরো ঘন, আরো জমাট বেঁধে উঠেছে।

কেউ কাউকে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না, ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে কেবল আটটি মানুষের উপস্থিতি।

সামান্য কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তেই বাতাসে একটা আলগা ঠাণ্ডার আমেজ তখন।

মিত্রানী মৃত।

নজন এসেছিল—তাদের মধ্যে একজন থেকেও নেই-পড়ে আছে ওদের সকলের। চোখের সামনেই তার প্রাণহীন দেহটা মাত্র। মিত্রানী আর কোন দিনই কথা বলবে না—-হাসবে না, সুললিত মধুর গলায় রবীন্দ্র বা অতুলপ্রসাদের গান গেয়ে উঠবে না।

ভারী জমাট প্রাণান্তকর স্তব্ধতাটা যেন বিদ্যুতের কণ্ঠস্বরে হঠাৎ তরঙ্গায়িত হয়ে উঠলো। সকলকেই যেন সে প্রশ্ন করলো, এখন কি করি আমরা?

বিদ্যুতের প্রশ্নে সকলেই নিঃশব্দে এ ওর মুখের দিকে তাকাল। তাই তো, কি এখন করবে ওরা—কি করতে পারে ওরা?

সুহাস জবাবটা যেন দিল, মিত্রানীকে তো এইভাবে এখানে ফেলে যেতে পারি না–

বিদ্যুৎ বললে, তবে কি করবো?

ওর মৃতদেহটা চল তোমার গাড়িতে করেই—

বিদ্যুৎ বললে নিয়ে যাবো?

হ্যাঁ—

কোথায়? কোথায় নিয়ে যাব। বললে আবার বিদ্যুৎ।

ক্ষিতীশ বললে, আচ্ছা বিদ্যুৎ, এমনও তো হতে পারে এখনো ও মরে যায়নি বেঁচে আছে। আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না, হয়ত ঝড়ের মধ্যে আচমকা পড়ে গিয়ে খুব বেশী আঘাত পেয়ে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।

তাহলে? কাজল বললে।

পাপিয়া বললে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয় না—

ক্ষিতীশ বললে, হ্যাঁ  সেই ভাল। চ, আমরা ওকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলি–

বিদ্যুৎ মাথার দিকে ধরলো, ক্ষিতীশ আর অমিয় দুজন পায়ের দিকে। মিত্রানীর দেহটা তুলতে গিয়েই বিদ্যুৎ যেন হাতে কিসের স্পর্শ পেয়ে তাড়াতাড়ি বললে, এই, কারো টর্চ আছে—টর্চের আলোটা ফেল তে।

টর্চের আলো ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ বললে, নামাও–

ওরা আবার একটু যেন থতমত খেয়েই বিদ্যুতের কথায় মিত্রানীর মৃতদেহটা মাটির উপরে নামাল।

দেখি সতীন্দ্র, টর্চটা–

বিদ্যুৎ সতীন্দ্রের হাত থেকে টর্চটা নিয়ে মিত্রানীর গলার কাছে ফেলতেই সর্বপ্রথম ব্যাপারটা তার নজরে পড়লো, মিত্রানীর গলায় একটা সাদা সিল্কের রুমাল পেঁচিয়ে গলার পিছন দিকে শক্ত গিঁট দিয়ে বাঁধা। অন্যান্য সকলেরও ইতিমধ্যে ঐ দিকে দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে।

কি–কি ওটা মিত্রানীর গলায়! কাজল চেঁচিয়ে উঠল চাপা কণ্ঠে। তবে—তবে কি ওকে কেউ গলায় রুমালের ফাঁস দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে—

অমিয় তখনো তাকিয়ে ছিল, মিত্রানীর গলার দিকে। সে-ই বললে, হা-ওকে রুমালের ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করেই মেরেছে–

চিৎকার করে ওঠে কাজল, খুন!

অমিয় আবার বললে, হ্যাঁ—আমার তো তাই মনে হচ্ছে কাজল। সাম ওয়ান কিল্ড হার। শি হ্যাজ বীন ব্রুটালি মাড়ার্ড।

সুহাস বললে, কিন্তু কে? কে হত্যা করলে মিত্রানীকে ঐভাবে—

ক্ষিতীশ বললে, কে হত্যা করেছে এখনো জানি না বটে, তবে ওকে যে হত্যা করা হয়েছে—তাতে কোন ভুল নেই—

মিত্রানীকে হত্যা করা হয়েছে!

কথাটা যেন প্রচণ্ড একটা শব্দ তুলে সকলের কর্ণপটাহের উপর আছড়ে পড়লো একই সঙ্গে।

তাহলে এখন কি করবো? ক্ষিতীশের প্রশ্ন। তার গলার স্বরটা যেন কেঁপে গেল। মনে হলো সে যেন বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছে।

সন্ধ্যায় অন্ধকার আরো ঘন—আরো গাঢ় হয়েছে।

অস্বাভাবিক একটা স্তব্ধতা যেন চারিদিকে।

আবার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলো সুহাসই। বললে, এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেই তো চলবে না। একটা কিছু তো আমাদের করতেই হবে মণি।

দলের মধ্যে মণিময়ই সব চাইতে বেশী প্র্যাকটিক্যাল। ভেবেচিন্তে কাজ করে এবং বরাবরই দলের সংকট-মুহূর্তে যা পরামর্শ দেবার সে-ই দেয়। এতক্ষণ সে একটি কথাও বলেনি—চুপচাপ এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, সুহাসের প্রশ্নে এতক্ষণে সে কথা বললো, আমার মনে হয় সুহাস এক্ষেত্রে আমাদের একটি মাত্রই কর্তব্য

মিনমিনে গলায় জবাব দিল অমিয়, কি?

আমাদের মধ্যে যে হোক একজন এখুনি শিবপুর থানায় চলে গিয়ে ব্যাপারটা তাদের বলুক

থানায়—থানায় কেন? সুহাস কাপা গলায় প্রশ্ন করে অন্ধকারেই মণিময়ের মুখের দিকে তাকাল।

বুঝতে পারছে না সুহাস, মিত্রানীর মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় যখন, তখন থানায় খবর একটা আমাদের দিতেই হবে। ধীরে ধীরে কথাগুলো বললে মণিময়।

কিন্তু থানায় খবর দিলে—

সুহাসকে থামিয়ে দিয়ে মণিময় বললে, তাছাড়া আমরা আর কি করতে পারি সুহাস? মৃতদেহটা এখান থেকে নিয়ে গেলে বা ফেলে রেখে গেলে এখানেই, আমরা সকলেই বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়বো—

বিপদ! বিপদে পড়বো কেন? সুহাস আবার বললো।

কি বলছো সুহাস! আমাদের সকলকে আজ এখানে সেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কতজনায় হয়ত হৈ চৈ করতে দেখেছে—তাদের মধ্যে কেউ যদি আমাদের কারোর পাড়ার লোক হয়, আমাদের কাউকে চিনে থাকে—ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে পুলিস যখন খোঁজখবর শুরু করবে সেই সময় যদি–

মণিময়কে থামিয়ে দিয়ে সতীন্দ্র এতক্ষণে কথা বললো, য়ু আর রাইট মণিময়, সঙ্গে করে নিয়ে গেলে ডেথ সার্টিফিকেট-এর হাঙ্গামা, তাছাড়া শুধু ডেথ সার্টিফিকেট হলেই হবে না—মিত্রানীর বাবা আছেন ডাক্তার দাদা আছেন, তাঁদেরই বা কি বলবো? আর তাদের অজ্ঞাতে ডেড বডি সকারই বা করবো কি করে—আর যদি এখানে ফেলে যাই, একটু আগে মণিময় যা বললো—আরো জটিলতার সৃষ্টি হবে। তার চাইতে আমিই না হয় যাচ্ছি থানায় সেখানে থেকে ডেকে নিয়ে আসি সব কথা বলে—তোমরা ততক্ষণ এখানে অপেক্ষা করো।

কথাগুলো বলে সতীন্দ্র অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

ওরা সাতজন অন্ধকারে ভূতের মত যেন দাঁড়িয়ে রইলো।

কেউ কারো মুখ ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না। আবছা-ঝাপসা অথচ অন্ধকার থাকার কথা নয়—চাদনী রাত—কিন্তু একটা হালকা মেঘের তলায় চাদ ঢাকা পড়ায় চাঁদের আলো প্রকাশ পায়নি।

ক্ষিতীশ, বিদ্যুৎ, অমিয়, সুহাস, মণিময়, কাজল, পাপিয়া অল্প অল্প ব্যবধানে সব দাঁড়িয়ে।

অমিয় ওদের মধ্যে চেইন স্মােকার। এতক্ষণ সে একটিও সিগারেট ধরায়নি। ক্ষিতীশ ঘন ঘন নস্য নেয়—সেও যেন নস্য নিতে ভুলে গিয়েছে।

আরো কিছুক্ষণ পরে চারিদিকে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়লো। অন্ধকার সরে গিয়ে সব যেন স্পষ্ট হয়ে উঠলো। সকলেই সকলকে এখন দেখতে পাচ্ছে। সকলেই দেখতে পাচ্ছে তাদের সামনে পড়ে আছে মিত্রানীর প্রাণহীন দেহটা।

ঘড়ির কাঁটা যেন আর ঘুরছেই না। থেমে গিয়েছে—সময় যেন হঠাৎ থমকে থেমে গিয়েছে। নিস্তব্ধতা যেন আরো কষ্টকর—আরো দুঃসহ।

অত বড় গার্ডেনটা একেবারে জনপ্ৰাণীহীন–একটা স্টীমারের ভো শোনা গেল। শব্দটা কাপতে কাপতে মিলিয়ে গেল।

আরো—আরো অনেক পরে। দূর থেকে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল—ঐ দিকেই আসছে আলোটা। দুটো প্রোজ্জ্বল অনুসন্ধানী চোখের মত একেবারে এগিয়ে আসে আর সেই সঙ্গে শোনা যায় দূরাগত একটা গাড়ির ইজিনের শব্দ। শব্দটা স্পষ্ট হতে

স্পষ্টতর হয়।

একটা জীপ গাড়ি এসে থামল ওদের সামনে।

প্রথমে থানা-অফিসার সুশীল নন্দী—দুজন কনস্টেবল—আর নামলো সতীন্দ্র।

কোথায় ডেডবডি? সুশীল নন্দী জিজ্ঞাসা করলেন।

ঐ যে, সতীন্দ্র দেখিয়ে দিল।

হাতে নন্দীর জোরালো টর্চ ছিল, সেই আলো ফেলে নন্দী মিত্রানীর মৃতদেহের সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন। নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করলেন মৃতদেহটা—গলার ফাসটা দেখলেন, তারপর উঠে দাঁড়ালেন। সকলের মুখের দিকে তাকালেন।

সুশীল নন্দী আগেই থানায় বসে সতীন্দ্রর কাছ থেকে ব্যাপারটা শুনেছিলেন—তাই বোধ হয় ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে আর গেলেন না। সোজাসুজিই একেবারে প্রশ্ন শুরু করলেন—আপনারা তা হলে কেউই কিছু জানেন না বা দেখেনও নি—কে ওর গলায় ফাঁস দিয়ে ওকে খুন করলো?

সবাই চুপ। কারো মুখে কোন কথা নেই।

হুঁ। আচ্ছা ভদ্রমহিলার কোন শত্রু বা ঐ ধরনের কিছু ছিল?

শত্রু! প্রশ্ন করলো সতীন্দ্র।

হ্যাঁ–শত্রু, বললেন নন্দী, যে হয়ত সুযোগের অপেক্ষায় ছিল—আজ সুযোগ পেয়ে—-থাক সে কথা, আচ্ছা একটা কথা বলুন তো–আজ সারাটা দিন আপনাদের আশেপাশে কাউকে ঘুর ঘুর করতে দেখেছেন–

মণিময় বললে, না—তাছাড়া আমরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। কোন দিকে তাকাবার আমরা ফুরসৎ পাইনি–

কোয়াইট ন্যাচারাল–তবু–

না—অফিসার, মণিময় আবার বললে–সে-রকম কিছুই আমাদের কারো চোখে পড়েনি–

আপনারা কাউকে সন্দেহ করেন এ ব্যাপারে? আবার নন্দীর প্রশ্ন।

না—এবার সুহাস মণিময় একত্রেই জবাব দিল।

আপনাদের সঙ্গে তো গাড়ি আছে?

হ্যাঁ, বিদ্যুতের গাড়ি আছে, মণিময় বললে।

বিদ্যুতবাবু কে?

বিদ্যুৎ এগিয়ে এলো। বললে—আমিই বিদ্যুৎ সরকার।

আপনিই একা তাহলে গাড়িতে এসেছিলেন আজ? আর বাকী সব—

মণিময় জবাব দিল-ট্রামে বাসে।

বিদ্যুৎবাবু—

বলুন—

আপনাদের সকলকে একবার থানায় যেতে হবে—সুশীল নন্দী বললেন।

থানায় কেন? সুহাস বলল।

আপনাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা করে এক-একটা জবানবন্দি–আই মীন স্টেটমেন্ট চাই–

মণিময় বললে, বেশ, যাবো আমরা—

এক কাজ করুন, বিদ্যুৎবাবুর গাড়িতে যারা পারেন যান, বাদ বাকি সব জীপে উঠুন।

০৬. সে রাত্রে ছাড়া পেতে পেতে

সে রাত্রে ছাড়া পেতে পেতে প্রায় রাত সোয়া এগারোটা বেজে গিয়েছিল সকলের। শ্রান্ত-অবসন্ন হয়ে ফিরেছিল যে যার গৃহে। ফিরতে ওরা সকলে পারত না হয়, যদি থানার একজন সেপাই কলকাতার দিকে ফিরতি একটা খালি ট্যাক্সি থামিয়ে ওদের ফিরে যাবার ব্যবস্থা করে না দিত।

থানা-অফিসার সুশীল নন্দী একটা কথা বিশেষ করে ওদের বলে দিয়েছিলেন, কলকাতা থেকে কেউ যেন অন্যত্র কোথাও না যায়—তাকে না জানিয়ে।

মিত্রানীর প্রৌঢ় বাপ অবিনাশ ঘোষালকে তার কন্যার মৃত্যু-সংবাদটা ওরা কেউই দিতে সম্মত হয়নি–তাই অগত্যা সুশীল নন্দী স্থির করেছিলেন পরের দিন সকালে তিনিই অবিনাশ ঘোষালকে সংবাদটা দেবেন। কিন্তু তা আর তাকে দিতে হয়নি—তার আগেই অর্থাৎ সেই রাত্রেই–

রাত একটা নাগাদ বিদ্যুতের কাছ থেকেই সংবাদটা পেয়েছিল মিত্রানীর দাদা ডাঃ প্রণবেশ ঘোষাল।

কি একটা সরকারী কাজে প্রণবেশ কলকাতায় একদিনের জন্য এসেছিল।

রাত্রি নয়টা নাগাদও যখন মিত্রানী ফিরে এলো না—অবিনাশ ঘোষাল ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, ছেলেকে ডেকে বলেছিলেন, প্রণব, খুকী তো এখনো ফিরল না-বলেছিল সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসবে—

প্রণবেশ বলেছিল, বন্ধুবান্ধবরা মিলে বটানিকসে হৈ চৈ করতে গিয়েছে—একা তো নয়-ভাবছেন কেন?

রাত নটা বাজে, তুমি বরং এক কাজ করো—বিদ্যুতের বাড়িতে একটা ফোন কর—

প্রণবেশ ফোন করে জানলো, তখনও বিদ্যুৎ ফেরেনি—

তারপর রাত সাড়ে নয়টা, পৌনে দশটা—পৌনে এগারোটা-পনেরো মিনিট অন্তরঅন্তর ফোন করে গিয়েছে প্রণবেশ।

কিন্তু ঐ একই জবাব—বিদ্যুৎ এখনো ফেরেনি—-

শেষটায় কিন্তু প্রণবেশ নিজেও বেশ চিন্তিত হয়ে উঠেছিল। এত রাত হয়ে গেল, এখনো না ফেরার কারণটা কি? পথে কোন দুর্ঘটনা কিছু ঘটেনি তো? ঘটাটা এমন কিছু আশ্চর্যও নয়। সে একবার ঘর একবার বাইরে করতে থাকে।

সাড়ে এগারোটা—বারোটা-সাড়ে বারোটা না তখনো ফেরেনি বিদ্যুৎ। অবশেষে প্রণবেশই লালবাজারে ফোন করে তারা কোন সংবাদ জানে না–তারা বলে শিবপুর থানায় ফোন করতে।

রাত তখন একটা প্রায়।

হঠাৎ ঐসময় ফোন ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠলো।

হ্যালো-ডাঃ প্রণবেশ ঘোষাল—

প্রণবেশবাবু—আপনি তো মিত্রানীর দাদা?

হ্যাঁ—

শুনুন—একটা স্যাড নিউজ আছে।

স্যাড নিউজ–কি?

মিত্রানী ইজ ডেড।

কি-কি বললেন—চিৎকার করে ওঠে প্রণবেশ—প্রৌঢ় অবিনাশ ঘোষাল ঐ সময় পুত্রের পাশেই দাঁড়িয়ে।

হ্যাঁ-মিত্রানীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে—

না, না—এ আপনি কি বলছেন—মিতু-মিতু। কিন্তু কে-কে আপনি! কি আপনার নাম?

বিদ্যুৎ সরকার—

তারপরই অপর প্রান্তে একটা ঠং করে শব্দ ও ফোনটা ডিসকানেকটেড হয়ে গেল।

হ্যালো হ্যালো—অধীরভাবে ট্যাপ করে প্রণবেশ–কিন্তু না, অন্য প্রান্ত ফোন ছেড়ে দিয়েছে ততক্ষণে।

কি! কি হয়েছে প্রণব! অবিনাশ ঘোষাল আশঙ্কায় যেন একেবারে ভেঙে পড়ল।

বিদ্যুৎ বিদ্যুৎ সরকার কে বাবা? প্রণবেশ বলে উঠল।

মিতুর ক্লাস-ফ্রেণ্ড—

প্রণবেশ তখুনি আবার ফোন করল। কিছুক্ষণ রিং হবার পর অপর প্রান্ত থেকে সাড়া এলো—কে!

বিদ্যুৎ সরকার আছেন?

কথা বলছি—

আমি মিত্রানীর দাদা কথা বলছি একটু আগে আপনি ফোন করেছিলেন—

ফোন করেছিলাম, আমি!—বিস্ময় বিদ্যুতের কণ্ঠে।

হ্যাঁ—একটু আগে আপনিই তো আমাদের বাড়িতে ফোন করে বললেন—

আমি তো এইমাত্র—নট ইভন টু মিনিটস-ফিরছি—

আপনি আমাকে ফোন করেননি?

না—

মিত্রানী-মিত্রানীর মানে আমার বোন মিত্রানীর কোন খবর কিছু জানেন? আপনারা তো একসঙ্গে আজ সকালে বটানিকসে গিয়েছিলেন?

কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কোন সাড়া এলো না।

বিদ্যুৎবাবু—শুনছে–বিন্দুবাবু-হ্যালো—হ্যালো–

কোনো সাড়া নেই—অথচ প্রণবেশ বুঝতে পারছে অপর প্রান্ত তখনো ফোন ছেড়ে দেয়নি!

কি হলো প্রণবেশ? অবিনাশ ঘোষাল আবার প্রশ্ন করেন অধৈর্য কণ্ঠে।

প্রণবেশ ফোনটা নামিয়ে আবার ডায়েল করে—রিং হয়ে যাচ্ছে–কেউ ধরছে না।

প্রণবেশ শেষ পর্যন্ত ফোনটা নামিয়ে রাখল।

একটু আগে কে ফোন করেছিল প্রণব?

বিদ্যুৎ সরকার—অথচ বিদ্যুৎ সরকার এইমাত্র বললে সে ফোন করেনি—এই নাকি ফিরছে–

মিতুর খবর

সে কিছু বলল না—অথচ–আমি আসছি বাবা—প্রণবেশ কোনমতে শার্টটা গায়ে চাপিয়ে যেন ঝড়ের মত বের হয়ে গেল।

স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলেন অবিনাশ ঘোষাল।

কালীঘাট থেকে শ্যামবাজার অনেকটা পথ-প্রণবেশ রাস্তায় বের হয়ে দেখলো— জনহীন রাস্তা খাঁ খাঁ করছে–কোনরকম যানবাহনের চিহ্নমাত্রও নেই–যতদূর দৃষ্টি চলে। রাস্তার এ-প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। এত রাত্রে যে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না তা জানত প্রণবেশ। একটু এগিয়ে গেলেই হালদার-পাড়ায় একটা ট্যাক্সির আড্ডা আছে—অনেক বছর পাঞ্জাবীদের ঐ পাড়ায় বসবাস করার জন্য প্রণবেশের সেটা জানা ছিল, আর বুড়ো ট্যাক্সি ড্রাইভার কর্তার সিংকে চিনতে প্রণবেশ-প্রণবেশ হাঁটতে লাগলো।

প্রণবেশের ভাগ্য ভাল, কর্তার সিং দূরপাল্লার এক সওয়ারীকে মাত্র কিছুক্ষণ পূর্বে পৌঁছে দিয়ে আস্তানায় ফিরে খাটিয়া পেতে শয়নের উদ্যোগ করছিল।

প্রণবেশ এসে সামনে দাঁড়াল। সর্দারজী!

প্রণববাবু–ইতনি রাত মে কেয়া বাৎ হ্যায়—

বড় বিপদে পড়েছি সর্দারজী, একবার এখুনি শ্যামবাজার যেতে হবে—অথচ কোন ট্যাক্সি এত রাত্রে পাচ্ছি না–

ঠিক হ্যায়, চলিয়ে—

 

শ্যামবাজারে অ্যাডভোকেট সমর সরকারের বাড়িটা খুঁজে বের করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি প্রণবেশের। বিদ্যুৎ তখনো জেগেই ছিল।

ফোনে প্রণবেশের প্রশ্নের জবাবে সে কোন কথা বলতে পারেনি। কেমন করে দেবে সে অত বড় দুঃসংবাদটা

গলা যেন কেউ তার চেপে ধরেছিল। দোতলায় নিজের ঘরের মধ্যে একটা ইজিচেয়ারের উপরে বিদ্যুৎ জেগে বসে ছিল। গাড়ির শব্দে জানলায় উঁকি দিয়ে দেখতে পেল তাদের বাড়ির সামনে ট্যাক্সিটা থেমেছে–

কে একজন তাদের সদরে দাঁড়িয়ে।

 

দুর্ঘটনার সংবাদটা ছোট্ট করে সংবাদপত্রে তৃতীয় পৃষ্ঠায় নীচের দিকে প্রকাশিত হয়েছিল ঘটনার পরের পরের দিন।

বটানিক্যাল গার্ডেনে গত পরশু পিকনিক করতে গিয়ে দলের মধ্যে একটি তরুণীর রহস্যজনক মৃত্যু। মৃত্যু ঘটেছে রুমালের ফাসে। উক্ত তরুণীর নাম মিত্ৰানী ঘোষাল। পরে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

কিরীটী সকালবেলা তৃতীয় কাপ চায়ের সঙ্গে ঐ দিনকার সংবা ত্রের পাতা ওলটাচ্ছিল—অন্যমনস্কভাবে–তরুণীর বাড়ি যে কালীঘাট অঞ্চলেই কিরীটী বুঝতে পারেনি এবং শুধু তাই নয়—তারই পরিচিত মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে ঐ মিত্রানী তাও বুঝতে পারেনি। পিরবার কথাও নয়—সংবাদটার মধ্যে এমন কিছু বিশেষত্ব ছিল না, যেটা তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে। যেমন প্রত্যহ সংবাদটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে তেমনি পড়তে থাকে কিরীটী!

ঘণ্টাখানেক বাদে কৃষ্ণা এসে ঘরে ঢুকলো,—শুনছো, তোমার মাস্টারমশাই—

কার কথা বলছো? কিরীটী স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল।

কালীঘাটে তোমার সেই পুরনো মাস্টারমশাই থাকেন না!

অবিনাশবাবু–

হ্যাঁ—তার মেয়ে নাকি গত পরশু বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বটানিক্যাল গার্ডেনে পিকনিক করতে গিয়েছিল—

সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী সজাগ হয়ে বসে, কি হয়েছে তার?

গলায় রুমালের ফাঁস দিয়ে কে যেন তাকে হত্যা করেছে—

তুমি—তুমি কার কাছে শুনলে?

এই তো একটু আগে আমাদের পাশের বাড়ির যশোদাবাবু বলছিলেন–যশোদাবাবু আর অবিনাশবাবু তো শালা-ভগ্নীপতি।

কিরীটী তাড়াতাড়ি আবার সংবাদপত্রের পাতা উল্টে সংবাদটা খুঁজে বের করে বার দুই ভাল করে সংবাদটা পড়লো, তারপর উঠে দাঁড়াল।

একটু বেরুচ্ছি কৃষ্ণা।

এই সকালে আবার কোথায় বেরুবে। সকালে তো হেঁটে এসেছো—

একবার মাস্টারমশাইয়ের ওখানে যাবো।

অবিনাশবাবুর ওখানে?

হ্যাঁ–ব্যাপারটা আমাকে একটু জানাতে হচ্ছে–

অবিনাশ ঘোষালের সঙ্গে কিরীটীর পরিচয় সেই যখন সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে– ফার্স্ট ক্লাসের ছাত্র—অবিনাশবাবু সেই সময়েই স্কুলে সেকেন্ড টীচার হয়ে আসেন–অঙ্ক করাতেন ক্লাসে—পরে, বৎসর চারেক পরে, ঐ স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক হন।

সবে তখন এম, এস-সি. পাস করে অবিনাশ ঘোষাল স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে এসেছিলেন–

কতই বা বয়স তখন তাঁর, বছর আটাশ-ঊনত্রিশ হবে।

মাত্র মাস আষ্টেক পড়েছিল কিরীটী অবিনাশবাবুর কাছে–গণিতশাস্ত্রের প্রতি তিনিই কিরীটীর মনের মধ্যে একটা আকর্ষণ ও প্রীতি জাগিয়ে তোলেন।

যার ফলে শিক্ষা সমাপ্ত করেছিল কিরীটী পরবর্তীকালে রসায়ন-শাস্ত্রে শেষ ডিগ্রী নিয়ে এবং যে শ্রদ্ধা ও প্রীতির সম্পর্ক সেদিন শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে গড়ে উঠেছিল সেটা সেদিন পর্যন্তও অক্ষুন্ন ছিল। সময় পেলেই কিরীটী যেতো অবিনাশবাবুর ওখানে। সহজ সরল আত্মভোলা মানুষটিকে ওর বড় ভাল লাগে।

অবিনাশবাবু খুব খুশি হতেন কিরীটীকে দেখলে।

এসো–এসো, কিরীটী রায় যে—-

পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে কিরীটী বলেছে, ভাল আছেন তো মাস্টারমশাই?

হ্যাঁ-বাবা, ভালই তো আছি। তার পরই বলতেন, তোমার নতুন রহস্য উদঘাটনের কাহিনী কিছু শোনাও।

কিরীটী হাসতে হাসতে বলতো, আমার চাইতে সুব্রতই ভাল বলতে পারে মাস্টারমশাই-একদিন তাকে নিয়ে আসবো, শুনবেন।

মধ্যে মধ্যে সুব্রতও কিরীটীর সঙ্গে আসততা—সে তখন বেশ জমিয়ে বসে কিরীটীকাহিনী শোনাত।

কি শ্রদ্ধা–কি আগ্রহ নিয়েই যে শুনতেন অবিনাশ ঘোষাল সেসব কাহিনী—শোনা নয় যেন গিলতেন।

একদিন বলেছিলেন সুব্রতকে অবিনাশ ঘোষাল–-বুঝলে সুব্রত, প্রবলেম সলভ করবার অদ্ভুত এক ন্যাক ছিল কিরীটীর–কঠিন কঠিন প্রবলেম ও অনায়াসেই সলভ করে দিত—রহস্য উদঘাটনের ব্যাপারেও তার সেই প্রতিভার স্ফুরণ–

কিরীটীর প্রশংসায় যেন একেবারে শিশুর মত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন।

মিত্রানীকে কিরীটী কয়েকবার দেখেছে, বেশ স্থির বুদ্ধিমতী মেয়েটি, মনে হয়েছে।

কিরীটী যখন অবিনাশ ঘোষালের ওখানে পৌঁছাল বেলা তখন প্রায় সাড়ে আটটা হবে। ইতিমধ্যে রৌদ্রের তাপ বেড়েছে–আর একটা রৌদ্রতাপ-দগ্ধ দিন।

প্রথমেই প্রণবেশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আকস্মিক বিপর্যয়ে প্রণবেশ আর কর্মস্থলে ফিরে যায়নিকটা দিন ছুটি নিয়েছে।

কিরীটীর সঙ্গে প্রণবেশেরও পরিচয় ছিল।

এই যে কিরীটীবাবু, আপনার কথাই ভাবছিলাম, প্রণবেশ বললে।

মাস্টারমশাই কোথায় প্রণবেশবাবুঃ কিরীটী শুধাল।

বাবা উপরের ঘরে—আমাদের বাড়িতে গত পরশু একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে কিরীটীবাবু-আমার বোন মিতু–

আমি জানি—

জানেন! কার কাছে শুনলেন—

সংবাদটা আজকের সংবাদপত্রেও ছাপা হয়েছে, তাছাড়া আমার স্ত্রীকে আপনার মামা যশোদাবাবু

কি করে যে হলো এখনো যেন কিছুই মাথায় আসছে না। কিরীটীবাবু, মিতুর মত মেয়েকে—কথাটা আর শেষ করতে পারে না প্রণবেশ—তার গলার স্বর যেন বুজে আসে–চোখের কোণ দুটো জলে ভরে ওঠে।

সমস্ত ব্যাপারটা আপনি বোধ হয় জানেন?

হ্যাঁ-মোটামুটি শুনেছি ওর বন্ধু বিদ্যুৎ সরকারের মুখে আর বাকিটা শিবপুর থানার ও. সি. সুশীল নন্দীর মুখ থেকে গতকাল দ্বিপ্রহরে। বাবার সঙ্গে দেখা করবেন?

হ্যাঁ—

কেমন যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন বাবা। বড় ভালবাসতেন মিতুকে—

চলুন মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি।

দুজনে দোতলায় এলো।

বাড়িতে সর্বক্ষণ লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত থাকেন অবিনাশ ঘোষাল–একটা চৌকির উপরে মাদুর বিছানো—একটা বালিশ শিয়রের দিকে-গ্রীষ্মকালে ঐ মাদুর আর বালিশটিই তার শয্যা—আর শীতকালে একটি চাদর।

চারিদিকে ছোট বড় আলমারীতে একেবারে ঠাসা-গণিতশাস্ত্রের বইতে-চৌকির অর্ধেকটায়ও খাতাপত্র বই সব ছড়ানো

ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন অবিনাশ ঘোষাল। পরনে একখানি মোটা খদ্দরের ধুতি—বক্ষে মোটা উপবীত।

মাথাভর্তি কাঁচাপাকা চুল অবিন্যস্ত। একমুখ কাঁচাপাকা দাড়িও।

চোখে মোটা কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমে পুরু লেন্সের চশমা। পায়চারি করতে করতে মধ্যে মধ্যে অবিনাশ ঘোষাল বাঁ হাতে আঙুলগুলো দিয়ে অবিন্যস্ত চুলগুলো যেন টানছেন।

ওরা যে দুজন ঘরে ঢুকেছে সেটা টেরও পান না অবিনাশ ঘোষাল। একমাত্র আদরিণী কন্যার আকস্মিক মৃত্যু যেন প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে মানুষটার ওপরে।

মাস্টারমশাই।

পায়চারি থামিয়ে ফিরে তাকালেন অবিনাশ ঘোষাল। কে?

মাস্টারমশাই আমি কিরীটী।

ওঃ কিরীটী—ও, তুমি এসেছো। জানো, জানো কিরীটী, আমার মিতু মা—

সব শুনেছি মাস্টারমশাই—

কিন্তু কেন এমন হলো বল তো! আমার মিতু মাকে কে এমন করে খুন করলো! তুমি তো জানো, তুমি তো দেখেছো আমার মিতু মাকে—এত নিরীহ, এত সরল, এত পবিত্র—আচ্ছা কিরীটী, তুমি তো অনেক কঠিন রহস্য উদ্ঘাটন করেছে—তুমি–তুমি পারবে না কিরীটী তাকে খুঁজে বের করতে, যে আমার মিতু মাকে—

পারবো মাস্টারমশাই—

পারবে!

হ্যাঁ—আপনার আশীর্বাদে নিশ্চয়ই পারবো।

জানি, জানি, তুমি পারবে—কেউ যদি তাকে খুঁজে বের করতে পারে সে একমাত্র তুমিই পারবে–আমি, তাকে শুধু একটা প্রশ্ন করবো–কেন, কি জন্য সে আমার মিতু মাকে এমন করে খুন করলো। একবারও কি হাত দুটো তার কাঁপলো না! অমন করে শ্বাসরোধ করে—না জানি মা আমার কত কষ্ট পেয়েছে। উঃ, কি নৃশংস! আমার কি মনে হয় জানো কিরীটী—

বলুন—

সেদিন যারা গার্ডেনে পিকনিকে উপস্থিত ছিল সেই বন্ধুদের মধ্যেই কেউ একজন

বাধা দিল প্রণবেশ। বললে, না, না—এ আপনি কি বলছেন বাবা, ওদের পরস্পরের মধ্যে কত দিনের বন্ধুত্ব–সেই কলেজ লাইফ থেকে। তা ছাড়া ওদের পরস্পরের প্রতি ভালবাসা–

প্রণবেশবাবু—কিরীটী বলে, মাস্টারমশাইয়ের কথাটা হয়তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একজনকে দেখে বা কিছু সময়ের জন্য মিশে তার ভিতরের কতটুকুই বা আমরা জানতে পারি, তার সত্যিকারের বা আসল চেহারার কতটুকুই বা আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয়। তাছাড়া একটা কথা ভুলে যাবেন না, ওদের সকলেরই বয়স অল্প–ঐ বয়সে সাধারণত মানুষ যতটা সেন্টিমেন্টালস্পর্শকাতর ও ভাবপ্রবণ। হয়–বয়েসটা একটু বেশী হলে ততটা হয়ত হয় না। ইমোশান বা ঝোকের মাথায় কোন বিশেষ এক মুহূর্তে এমন অনেক কিছুই হয়ত তারা করে বা করতে পারে যেটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ থিতিয়ে আসে।

কিরীটী—

বলুন মাস্টারমশাই। অবিনাশ ঘোষালের ডাকে ফিরে তাকিয়ে কিরীটী সাড়া দিল।

দোষ হয়ত আমারও আছে, সন্তানের প্রতি বাপের কর্তব্য পালনের ত্রুটি আমারও আছে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে বোধ হয় এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটতো না—

মাস্টারমশাই, একটা কথা বলবো।

বলো।

মিত্রানী কাউকে ভালবাসতো কিনা আপনি জানেন?

তুমি তো জানো কিরীটী, আমার সন্তানদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় কখনো আমি বাধা দিইনি—আমার কাছে সেটা অপরাধ বলেই বরাবর মনে হয়েছে–তাছাড়া আমাদের বাপ ও মেয়ের মধ্যে সব কথাই খোলাখুলি হতো–সে রকম কিছু থাকলে বোধ হয় আমি জানতাম।

আর একটা কথা মাস্টারমশাই, কখনো তার বিয়ের চেষ্টা করেছেন বা সে সম্পর্কে তার সঙ্গে কোন আলোচনা করেছেন?

করেছি বৈকি। কিছুদিন আগেও বিয়ের কথাটা তার কাছে তুলেছিলাম, সে তখন বলেছিল

কি বলেছিল মিত্রানী?

সময় হলেই সে আমাকে জানাবে।

কি জানাবে?

তা তো কিছু বলেনি, ঐটুকুই কেবল বলেছিল আর আমিও কিছু বলিনি।

কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার মৃদু কণ্ঠে বললে, আচ্ছা তার পুরুষ বন্ধুদের মধ্যে কারোর প্রতি

যতদূর জানি-বন্ধুদের মধ্যে সে সুহাস ছেলেটিকে একটু বেশী বোধ হয় পছন্দ করতো।

সুহাস!

ঐ যে সুহাস মিত্র। ওর কলেজের সহপাঠী। ছেলেটি শুনেছি—লেখাপড়ায় খুব ভাল ছিল বরাবরই—বি.এ.-তে ইকনমিকসে অনার্স পেয়েও আর নাকি পড়েনি, একটা বড় ফার্মে চাকরি করছে। মধ্যে মধ্যে আসতোও এখানে বেশ স্মার্ট ও ভদ্র ছেলেটি, মনে হত মিতু যেন সুহাসকে একটু বেশী পছন্দ করতো।

আর কে আসতো এখানে?

বিদ্যুৎ আসতো।

আর কেউ?

সতীন্দ্র আর সজলও কয়েকবার এসেছে। তবে ইদানীং আর সজলকে এখানে গত দুবৎসর হতে আসতে দেখিনি—তবে দিন চারেক আগে হঠাৎ এসেছিল।

অবিনাশ ঘোষালের দুচোখের কোণ বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ল।

মাস্টারমশাই, যা হয়ে গিয়েছে তা তো আর ফিরবে না। আপনি যদি এভাবে ভেঙে পড়েন—

না, না—আমার জন্য ভেবো না কিরীটী, আমি ঠিক আছি—ঠিক আছি, বলতে বলতে অবিনাশ ঘোষাল চোখের জল মুছে নিলেন।

অতঃপর কিরীটী সেদিনকার মত প্রণাম জানিয়ে বিদায় নিল।

নীচে এসে প্রণবেশের সঙ্গে তারপর অনেকক্ষণ কথা বলেছিল এবং প্রণবেশ বিদ্যুতের মুখে ও থানায় সুশীল নন্দীর কাছে যা শুনেছিল সব বললে।

প্রণবেশই একসময় অতঃপর প্রশ্ন করে, আচ্ছা কিরীটীবাবু, আপনারও কি সত্যি মনে হয় যে—

কি?

ঐ মানে মিতুর বন্ধুদের মধ্যে কেউ একজন—

নিশ্চিত হয়ে এই মুহূর্তে তা বলতে পারি না, তবে এটা ঠিক, সমস্ত ঘটনা শোনার পর যা মনে হয়—

কি! কি মনে হয় আপনার?

কিরীটী নিজেকে যেন হঠাৎ সামলে নিল। বললে, কি জানেন প্রণবেশবাবু–ইট ইজ টু আরলি টু সে এনিথিং। আচ্ছা আমি এখন চলি-মাস্টারমশাইয়ের দিকে একটু নজর রাখবেন—মিত্রানীর মৃত্যুতে একটু বেশী রকমই আঘাত পেয়েছেন বলে যেন মনে হলো—

ভাবছি কিছুদিনের জন্য বাবাকে আমি সঙ্গেই নিয়ে যাবো।

 ০৭. ঐদিনই দ্বিপ্রহরে লালবাজারে

ঐদিনই দ্বিপ্রহরে লালবাজারে গিয়ে কিরীটী পুলিশ কমিশনার মিঃ রায়চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করলো। লম্বা-চওড়া সুগঠিত চেহারা। অফিসেই ছিলেন রায়চৌধুরী, কিরীটী স্লিপ পাঠাতেই ঘরের মধ্যে ডাকলেন।

দুজনার মধ্যে পরিচয় ছিল। রায়চৌধুরী কিরীটীকে শ্রদ্ধা করতেন।

আসুন—আসুন, বসুন রায়সাহেব-হঠাৎ এখানে কি মনে করে!

কিরীটী বসে মিত্রানীর হত্যার ব্যাপারটা বললে।

সব শুনে মিঃ রায়চৌধুরী বললেন, ব্যাপারটা আমারও কানে এসেছে—আজই সকালে—

কি রকম!

হোমিসাইডাল স্কোয়াডের জ্যোতিভূষণ আমাকে বলেছিলেন—তার হাতে ইনভেসটিগেশনের ভার পড়েছে। আপনি মনে হচ্ছে বেশ একটু ইন্টারেস্টেড ব্যাপারটায়, রায়সাহেব!

একটু আগেই তো বললাম মিঃ রায়চৌধুরী, মিত্রানী, মানে যে মেয়েটিকে খুন করা হয়েছে, আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় একজন মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে–

ঠিক আছে, আমি বরং জ্যোতিবাবুকে ডাকছি—তার কাছেই আপনি সব ডিটেসে পাবেন।

জ্যোতিভূষণ চাকী—বেশ একজন কর্মঠ-উৎসাহী অফিসার। বয়েস খুব বেশী নয়, ত্রিশ থেকে বত্রিশের মধ্যে—বলিষ্ঠ দোহারা চেহারা। জ্যোতিভূষণের সরেজমিন তদন্তের রিপোর্ট থেকেই সেদিনকার দুর্ঘটনার অনেক কিছুই জানতে পারল কিরীটী। ব্যাপারটা ঘটেছে ঐদিন বিকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে কোন এক সময়ে।

মিনিট পনেরো-কুড়ির জন্য একটা প্রচণ্ড কালবৈশাখীর ঝড় ও ধুলোর ঘূর্ণি উঠেছিল। সব অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। সেই ঝড় ও ধুলোর ঘূর্ণির মধ্যে বন্ধু ও বান্ধবীরা সব চারদিকে অতর্কিতে ছিটকে পড়েছিল। দিনটি ছিল শনিবার।

কালবৈশাখীর তাণ্ডব থেমে যাওয়ার পর প্রত্যেকে প্রত্যেককে খুঁজতে শুরু করে, একে অন্যর দেখা পায় কিন্তু দুজনের দেখা পাওয়া যায় না। মিত্রানী ঘোষাল আর সুহাস মিত্র। পরের ব্যাপারটা প্রণবেশের মুখেই শুনেছিল কিরীটী। প্রণবেশ যেমনটি বলেছিল, জ্যোতিভূষণের রিপোর্টেও তাই বলে। তারপর শিবপুর থানা অফিসার সুশীল নন্দীর রিপোর্ট।

পরের দিন সকালে হোমিসাইড্যাল স্কোয়াডের সঙ্গে সুশীল নন্দী স্পটে যান। স্পটে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে ওঁরা কয়েকটি জিনিস পান।

ঠিক যেখানে মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হয়েছিল, তার হাত পাঁচেক দূরে একটা ঝোপের ধারে একটা বেতের টুপি–কয়েকটা পোড়া চারমিনার সিগারেটের শেষাংশ—এবং মৃতদেহ যেখানে পড়েছিল গতরাত্রে, তার আশেপাশে কিছু রাঙা কাঁচের চুড়ির টুকরো–আরো কিছু দূরে একটা বায়নাকুলার সুশীল নন্দী পেয়েছেন।

সত্যি কথা বলতে কি, কিরীটীর আগমনে সুশীল নন্দী যেন মনের মধ্যে একটা উত্তেজনাই বোধ করেন। তাই তিনি বিশেষ উৎসাহ নিয়েই কিরীটীকে তাঁর অনুসন্ধানের কাহিনী আদ্যোপান্ত বর্ণনা করে একে একে ঐ উপরিউক্ত জিনিসগুলো দেখালেন।

বললেন—মিঃ রায়, এই জিনিসগুলো আমি অকুস্থানে পরের দিন সকালে অনুসন্ধানে গিয়ে কুড়িয়ে পেয়েছি।

কিরীটী বললে—ভালই করেছেন মিঃ নন্দী, এগুলো হয়তো মিত্রানীর হত্যারহস্য উদঘাটনে যথেষ্ট সাহায্য করবে। ভাল কথা, ওদের আলাদা ভাবে জবানবন্দি, মানে ওদের কোন স্টেটমেন্ট নেননি?

নিয়েছি বৈকি। তবে সবাই প্রায় এক কথাই বলেছে—এবং বিশেষ কোন তাৎপর্য আমি কারোর স্টেটমেন্টেই খুঁজে পাইনি। এই দেখুন না, পর পর প্রত্যেকের স্টেটমেন্টই আমি লিখে রেখেছি ও পরে ওদের দিয়ে সই করিয়ে নিয়েছি—বলতে বলতে লম্বা খাতাটা এগিয়ে দিলেন সুশীল নন্দী কিরীটীর দিকে।

কিরীটী স্টেটমেন্টগুলো পড়তে শুরু করল।

(১) প্রথমেই বিদ্যুৎ সরকার! বাপ অ্যাডভোকেট সমর সরকার—বনেদী ধনী পরিবারের ছেলে। বি. এ. পাস করবার পর বাপের এক বন্ধু নামী চিত্রপরিচালকের অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে গত কয়েক বছর কাজ করছে। সুগঠিত ও স্বাস্থ্যবান-মিত্রানীর সঙ্গে পরিচয় অনেক দিনের-একই কলেজে তিন বৎসর ওরা পড়েছে। মধ্যে মধ্যে মিত্রানীর ওখানে যেতো—মিত্রানীও আসত-পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে টেলিফোনেও কথাবার্তা। হতো মধ্যে মধ্যে। ঝড় উঠবার পর কিছুক্ষণের জন্য দল থেকে ছিটকে পড়ে। তারপর অন্যান্য বন্ধুদের সাহায্যে যেভাবে মিত্রানীকে খুঁজে পায় তারই বর্ণনা। অবিবাহিত।

(২) সুহাস মিত্র-নিয়মিত ব্যায়াম করার ফলে সুগঠিত চেহারা, কলেজ জীবনে শুধুই যে সে একজন মেধাবী ছাত্র হিসাবেই পরিচিত ছিল তাই নয়—ভাল অ্যাথলেটও ছিল। প্রাক্তন কলেজ ব্ল। বাড়ির অবস্থা তেমন ভাল নয়, তাছাড়া বাপ পঙ্গু-বিবাহযোগ্যা দুটি বোন। তাই বি. এ. পাস করবার পরই একটা মার্চেন্ট অফিসে চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছে। তারও স্টেটমেন্ট–অনেকটা বিদ্যুৎ সরকারের মতই-অকস্মাৎ ঝড় ওঠায় দল থেকে ছিটকে পড়ে ধুলোর অন্ধকারে কিছু চোখে দেখতে পাচ্ছিল না—দুপা কোনমতে এগোয় তো পাঁচ-পা পিছিয়ে আসে এলোমেলো ঝড়ো বাতাসে–তারপরই হঠাৎ একটা ভারী গাছের ডাল মাথার উপরে ভেঙে পড়ে। মাথায় আঘাত লেগে অচৈতন্য হয়ে যায়, বন্ধুরা এসে তাকে গাছের ডাল সরিয়ে উদ্ধার করে। অন্যান্য বন্ধু ও মিত্রানীর সঙ্গে বিশেষ একটা দেখাসাক্ষাৎ হতো না—অবিবাহিত।

(৩) মণিময় দত্ত—বি. এ. পাস করে এম. এ. এক বছর পড়েছিল। ঐ সময় তার মামার সুপারিশে খিদিরপুর ডকে একটা ভাল চাকরি পেয়ে গত কয়েক বছর ধরে সেখানেই চাকরি করছে। রোগা পাতলা চেহারা—হঠাৎ ঝড় ওঠায় দল থেকে ছিটকে পড়ে। তারপর ঝড় থামলে প্রথমেই সে বিদ্যুৎকে দেখতে পায়—তখন দুজনে খুঁজতে খুঁজতে অন্য সকলের দেখা পায়–সুহাস আর মিত্রানী বাদে-তারপর তার স্টেটমেন্ট বিদ্যুতেরই অনুরূপ। তারও অন্যান্য বন্ধুদের ও মিত্রানীর সঙ্গে বিশেষ একটা দেখাসাক্ষাৎ হতো না। বিবাহিত। একটা সন্তানের বাপ।

(৪) ক্ষিতীশ চাকী—বি. এ. পরীক্ষা দুবার দিয়ে পাস না করতে পেরে পড়া ছেড়ে দেয়–কোন বিশেষ রাজনৈতিক পার্টির সভ্য-সক্রিয় সভ্য। পার্টির কাজকর্ম নিয়েই সে সর্বদা ব্যস্ত থাকে—বাকী স্টেটমেন্ট তার অন্যান্যদেরই অনুরূপ। বিবাহিত।

(৫) অমিয় রায়-বি. এ. পাস করবার পর ওকালতি পাস করে আলিপুর কোর্টে নাম লিখিয়ে প্র্যাকটিস করছে বাপের জুনিয়ার হয়ে। সেও ঘটনার যা স্টেটমেন্ট দিয়েছে অন্যান্যদেরই অনুরূপ। বন্ধুদের সঙ্গে মধ্যে মধ্যে তার দেখা হতো। বিবাহিত—গত ফাল্গুনে বিবাহ করেছে।

(৬) সতীন্দ্র সান্যাল-আবলুশ কাঠের মত গাত্রবর্ণ। গোলগাল চেহারা। বাপ কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদস্থ অফিসার এবং বেশীরভাগই দেশে-বিদেশে চাকরির ব্যাপারে ঘুরতে হয় বলে—ওরা দুই বোন, এক ভাই ও মা কলকাতাতেই থাকেন। ফুড ডিপার্টমেন্টে ভাল চাকরি করে। অবিবাহিতবাকী স্টেটমেন্ট অন্যান্যদেরই অনুরূপ। বিবাহ হয়নি বটে এখনো, তবে স্থির হয়ে গিয়েছে।

(৭) কাজল বোস। দেখতে কালো। রোগা। বি. এ., বি. টি. পাস করে একটা স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড-মিসট্রেস—বাপ নেই—মামা-মামীর কাছে মানুষ——স্কুল বোর্ডিংয়েই থাকে আগরপাড়ায়। বিবাহ হয়নি। কলকাতার বাইরে থাকায় বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে বিশেষ একটা দেখা হতো না–কদাচিৎ কখনো কালে-ভদ্রে, একমাত্র সুহাস মিত্র ছাড়া। সুহাসের সঙ্গে প্রায়ই তার দেখা হয়–বাকী ঘটনার স্টেটমেন্ট অন্য সকলের মতই।

(৮) পাপিয়া চক্রবর্তী। বি. এ. পাস এবং ভাল এ্যাথলেট। জীবনে অনেক কাপ মেডেল শীল্ড পেয়েছে। গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম, অত্যন্ত স্মার্ট চেহারা, স্লিম ফিগার, কলকাতার একটা বড় অফিসে রিসেপশনিস্ট—ভাল মাইনে। অবিবাহিতা। সকলের সঙ্গেই মধ্যে মধ্যে দেখা হতো, বিশেষ করে মিত্রানী ও সুহাস মিত্রের সঙ্গে। তার বাকী স্টেটমেন্ট অন্যান্যদেরই অনুরূপ।

কিরীটী সকলেরই স্টেটমেন্ট বা জবানবন্দিগুলো পড়লো। তারপর একসময় সুশীল নন্দীর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বললে, এদের মধ্যে পাঁচজনের স্টেটমেন্টের কোন গুরুত্ব নেই–

সুশীল নন্দী বললেন, কার কার কথা বলছেন? মণিময়, ক্ষিতীশ, অমিয়, সতীন্দ্র আর পাপিয়া

হ্যাঁ, মণিময় দত্ত, ক্ষিতীশ চাকী, অমিয় রায়, সতীন্দ্র সান্যাল আর পাপিয়া চক্রবর্তী। —কিরীটী বললে।

কেন? প্রশ্নটা করে তাকালেন সুশীল নন্দী কিরীটীর মুখের দিকে।

কারণ, আমার মনে হয়—কিরীটী ধীরে ধীরে বলতে লাগল, যাদের কথা একটু আগে বলছিলাম, সেই পাঁচজনের সেদিনকার পিকনিকে উপস্থিতিটা নিছক একটা উপস্থিতি-বা অন্যান্যদের সঙ্গে অনেক দিন পরে একটা মিলনের আনন্দ বলে বোধ হয় ধরে নিতে পারেন। কেন এই কথাটা বলছি, আবার একটু পরিষ্কার করে বলি। তারপর একটু যেন থেমে পুনরায় তার অধসমাপ্ত কথার জের টেনে কিরীটী বলতে লাগল, দলের মধ্যে সেদিন ঐভাবে মিত্রানীর মৃত্যুর ব্যাপারটা রীতিমত রহস্যে ঘেরা এবং সে মৃত্যু স্বাভাবিক নয়-কেউ তাকে রুমালের ফাস গলায় দিয়ে হত্যা করেছে ঝড় ও ধুলোর ঘূর্ণির মধ্যে অন্যান্যদের অগোচরে।

হত্যা যখন করা হয়েছে, তখন নিশ্চয়ই কেউ না কেউ তাকে হত্যা করেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রশ্ন জাগে—কে? কে তাকে হত্যা করলো! বা কে তাকে হত্যা করতে পারে! হয় তো বাইরের কেউ ঐ সময় তাকে হত্যা করেছে গলায় রুমালের ফাঁস দিয়ে, না হয় যারা ঐ মুহূর্তে ঐখানে উপস্থিত ছিল, তাদেরই মধ্যে কেউ। তাই নয় কি?

হ্যাঁ, মৃদু গলায় সুশীল নন্দী বললেন, কিন্তু

জানি। আপনি হয়তো বলতে চাইছেন, তারা দীর্ঘদিনের পরিচিত ও পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। কথাটা ঠিক এবং সেক্ষেত্রে কারোর প্রতি কারোর আক্রোশ থাকলে হয়তো অনেক আগেই তাকে হত্যা করত, সে ধরনের সুযোগ পেতে তার কোন অসুবিধা ছিল না। তবে ঐদিনই বা হত্যা করলো কেন! তাই নয় কি?

হ্যাঁ।

দেখুন, আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবেন হত্যা দুই রকমের হয়—এক দীর্ঘ দিনের হত্যালিঙ্গা-হত্যাকারী একটা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে সেটা হচ্ছে পূর্বপরিকল্পিত হত্যা—আর একটা হচ্ছে সাডেন পোভোকেশন-জনিত হত্যা। এখন কথা হচ্ছে মিত্রানীর ক্ষেত্রে কোন্টা হয়েছে! যদি প্রথমটাই ধরে নিই—তাহলে স্বভাবতই যে কথাটা আমাদের মনে হওয়া স্বাভাবিক, সেটা হচ্ছে হয়তো সেই হত্যাকারী মিত্রানীর পূর্ব-পরিচিত ছিল এবং সেই পরিচয়ের মধ্যে দিয়েই কোন কারণে সে মিত্রানীর প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে এবং সেই বিরূপতা হয়তো এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছিল—যার ফলে ঐ নিষ্ঠুর হত্যা সংঘটিত হয়েছে।

তাহলে আপনি বলতে চান মিঃ রায়—মিত্রানীর পরিচিত জনেদের মধ্যে কেউ ঠিক তাই—আর সেই পরিচিত জনদের কথা ভাবতে গেলে প্রথমেই ঐ বন্ধুদের কথাই মনে পড়া স্বাভাবিক নয় কি?

তা অবিশ্যি—

অবশ্যই ওরা ছাড়াও মিত্রানীর আরো পরিচিতজন থাকতে পারে—সেটা তখনই আমরা ভাববো, যখন সেদিন যারা উপস্থিত ছিল, তারা প্রত্যেকে সন্দেহের তালিকা থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু আগেই যে পাঁচজনের নাম করেছি তারা সেই তালিকা থেকে আমার মতে বাদ পড়ে।

কেন?

আপনার নেওয়া জবানবন্দি বা স্টেটমেন্টগুলো ভাল করে পরীক্ষা করে দেখুন, তাহলেই আপনার প্রশ্নের জবাব পাবেন,-মণিময়, ক্ষিতীশ, সতীন্দ্র ও পাপিয়া এরা একমাত্র পাপিয়া ব্যতীত–সকলেই যে যার জীবনে প্রতিষ্ঠিত, বিবাহিত, সংসারধর্ম করছে–এদের পক্ষে ঐ ধরনের একটা নৃশংস হত্যার ব্যাপারে লিপ্ত হওয়া স্বাভাবিক কি?

কেন? ওদের মধ্যেও তো কোন আক্রোশ বা ঈর্ষার কারণ থাকতে পারে মিত্রানীকে কেন্দ্র করে–সুশীল নন্দী বললেন।

তা থাকতে পারে হয়ত এবং যদি থাকেই, স্বভাবতই যে প্রশ্নটা আমার মনে হচ্ছে—কি কারণে আক্রোশ বা ঈর্ষা—

কত কারণ তো থাকতে পারে—সুশীল নন্দী বললেন।

কথাটা মিথ্যা বলেননি আপনি—তবু একটা কিন্তু থেকে যায়—

কিসের কিন্তু–

কিন্তুটা হচ্ছে মিত্রানী কি তাহলে তার কিছুটা অন্তত আভাস পেত না। শুধু তাই নয়—ওদের জবানবন্দি থেকেও হয়ত তার কিছুটা ইঙ্গিত আমরা পেতাম—যেটা বাকী দুজনার জবানবন্দি থেকে অর্থাৎ সুহাস মিত্র ও কাজল বোসের স্টেটমেন্ট থেকে আমরা পেতে পারি–কিন্তু সে কথা আমরা পরে ভাববো। তার আগে আমি আপনার একটু সাহায্য চাই–

বলুন কি সাহায্য চান?

আমি ওদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে কথা বলতে চাই—

বেশ তো। সে আর এমন কঠিন কি! আমি ব্যবস্থা করবো।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব—

তাই হবে—

তাহলে আজ আমি উঠি। কি

রীটী বিদায় নিল। জ্যোতিভূষণও কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে এলেন।

বেলা তখন অনেকটা গড়িয়ে গিয়েছে, বৈশাখের সূর্য মধ্য-গগনে প্রখর তাপ ছড়াচ্ছে।

গাড়িতে উঠতে হীরা সিং শুধায়, কিধার জায়গা সাব?

লালবাজার হয়ে চল—বাবুকে নামিয়ে দিয়ে যাবো।

গাড়ি চলেছে কলকাতার পথে–চলমান গাড়ির খোলা জানালাপথে আগুনের হল্কার মত তপ্ত হাওয়া যেন এসে চোখমুখ ঝলসে দিচ্ছে।

গাড়িতে উঠে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করে কিরীটী। থানায় জ্যোতিভূষণ একটা কথাও বলেননি, দুজনের কথাবার্তা শুনে যাচ্ছিলেন।

কিরীটীর দিকে একবার তাকালেন জ্যোতিভূষণ, সিগার মুখে গাড়ির ব্যাক সীটে হেলান দিয়ে অন্যমনস্কভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

মিঃ রায়!

কিছু বলছিলেন জ্যোতিবাবু?

আচ্ছা, মিত্রানীর হত্যার ব্যাপারটা আপনার কি মনে হচ্ছে পূর্ব-পরিকল্পিত না সাড়ন প্রোভোকেশন!

অবশ্যই পূর্ব-পরিকল্পিত বলেই মনে হচ্ছে—কিন্তু এক জায়গায় ব্যাপারটা যেন ঠিক মিলছে না—

কি রকম? প্রশ্নটা করে তাকালেন জ্যোতিভূষণ কিরীটীর মুখের দিকে।

ধরুন যদি পূর্বপরিকল্পিত হয়—হত্যাকারীর পক্ষে চান্স পাওয়াটা যেন ফিফটিফিফটি হচ্ছে, অর্থাৎ যদি ঝড় ও ধুলোর আঁধি না উঠতো, চারিদিক একটা অন্ধকারের যবনিকায় না ঢেকে যেতো, হত্যাকারী হত্যা করবার সুযোগই পেতো না, অবিশ্যি যদি হত্যাকারী মিত্রানীর পরিচিত জনেদের মধ্যেই কেউ হয়ে থাকে।

আমার মনে আছে মিঃ রায়, সেদিনকার কাগজেও আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দেখেছিলাম বিকালের দিকে বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনার কথাটা। এবং পর পর কয়েকদিনই বিকেলের দিকে সে সময় ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। হত্যাকারী হয়ত সেইটুকুর উপরেই ভরসা করে প্রস্তুত হয়েছিল।

হতে পারে—তাহলে চান্স পাওয়াটা হত্যাকারীর পক্ষে ফিফটি-ফিফটিই থেকে যাচ্ছে—অর্থাৎ চান্স না পেলে সেদিন সে মিত্রানীকে হত্যা করতে পারতো না—মিত্রানী খুন হতো না। ভাল কথা, ময়না তদন্তের রিপোর্টটা কবেক পাওয়া যাবে? পেলেই আমাকে একটু জানাবেন। আমি বাড়িতেই থাকবো।

 

জ্যোতিভূষণকে লালবাজারে নামিয়ে কিরীটী ফিরে এলো। এবং সারাটা দিন কিরীটী আর কোথাও বের হলো না।

লালবাজার থেকে ফোন এলো সন্ধ্যের দিকে।

কিরীটী কৃষ্ণা আর সুব্রত বসে বসে চা পান করছিল।

কিছুক্ষণ পূর্বে সুব্রত এসেছে।

ফোনের রিং হতেই কিরীটী বললে, দেখ তো সুব্রত, বোধ হয় লালবাজার থেকে জ্যোতিবাবু ফোন করছেন!

সুব্রত ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল, হ্যালো—

কিরীটীবাবু আছেন?

আছে।

বলুন লালবাজার থেকে জ্যোতিভূষণ কথা বলছি।

এগিয়ে গিয়ে ফোনটা সুব্রতর হাত থেকে নিল কিরীটী। কিরীটী কথা বলছি, তারপর পেলেন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট?

হ্যাঁ।

শ্বাসরোধ করে মৃত্যু ছাড়া দেহে আর কিছু পাওয়া গিয়েছে কি?

মিঃ রায়, মনে হচ্ছে আপনি যেন আরো কিছু আশা করছেন!

করেছিলাম বলেই তো আই অ্যাম ইগারলি ওয়েটিং ফর দি রিপোর্ট!

শি ওয়াজ রেপড। হাউ হরিবল!

হরি তো বটেই, তবে আমি ছায়ার পিছনে যেন কায়ার আভাস পাচ্ছি—দি ম্যান বিহাইন্ড দি কারটেন, আর এখন অত অস্পষ্ট মনে হচ্ছে না–ঠিক আছে, থ্যাঙ্ক ইউ।

রিপোর্টটা কি আপনি দেখতে চান?

পরে দরকার হলে আপনাকে জানাব।

ফোনটা নামিয়ে রেখে কিরীটী আবার এসে সোফায় বসল।

প্রশ্ন করে কৃষা, ময়না তদন্তের রিপোর্ট পেলে?

হ্যাঁ।

সুব্রত বললে, কার-মিত্রানী দেবীর?

হ্যাঁ, তার উপর বলাৎকার করা হয়েছিল—

তাহলে—সুব্রত যেন কি বলতে চায় কিন্তু তার বলা হলো না—

কিরীটী কতকটা যেন তাকে থামিয়ে দিয়েই বললে, তুই তো সব শুনেছিস সুব্রত—এবারে তোর কি মনে হয়, বাইরের কেউ, না ঐ মিত্রানীর পরিচিত জনদের মধ্যেই কেউ–

কৃষ্ণা জবাবটা দিল, বাইরের কেউও-তো হতে পারে।

কৃষ্ণা, না—গণ্ডিটা অত্যন্ত ছোট—মিত্রানীর পরিচিত জনদের মধ্যেই কেউ এবং সম্ভবত যারা ঐদিন ঐসময় ঐখানে উপস্থিত ছিল তাদেরই মধ্যে একজন—যার তিনটি বস্তুই ছিল, অর্থাৎ সুবিধা সুযোগ ও হত্যার উদ্দেশ্য!

কি উদ্দেশ্য হতে পারে? কৃষ্ণার প্রশ্ন।

ব্যর্থ প্রেমের আক্রোশ বা বহুদিন ধরে অবদমিত কামভাব, ঠিক প্যাশান নয়, মিত্রানীর প্রতি একটা লালসা—যে কারণে প্রথমে ঐ অকস্মাৎ হাতের মুঠোয় আসা সুযোগকে যেমন সে নষ্ট হতে দেয়নি, তেমনি বহুদিনের লালসার পরিতৃপ্তি সাধন করতেও সে এতটুকু পশ্চাদপদ হয়নি। কিঙ হার বাই থ্রোটিং অ্যান্ড দেন রেপড হার।

পর পর হত্যা ও ধর্ষণ—বিশেষ করে হত্যার নিষ্ঠুর পদ্ধতি দেখে সেটাই বেশী করে মনে হয়!

 

দিন দুই পরে শনিবার সুশীল নন্দীর ফোন এলো।

মিঃ রায়–কাল সকলে বিকালের দিকে আমার এখানে আসছে আপনি যেমন বলেছিলেন—

কিরীটী জবাবে বলেছিল, ঠিক আছে। আমি যাবো, কটার সময় তারা আসছে? এই ধরুন পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে। আমার কথা কিছু তাদের বলছেন?

না, আমিই তাদের সঙ্গে আরো কিছু আলোচনা করতে চাই এইটুকুই বলেছি। সুশীল নন্দী বললেন।

ধন্যবাদ জানিয়ে অতঃপর কিরীটী ফোনের রিসিভারটা সবে নামিয়ে রেখেছে, সুব্রত এসে ঘরে ঢুকল।

এই যে সুব্রত–এসে গেছিস তুই, ভালই হলো, নচেৎ একটু পরেই হয়ত তোকে। ফোন করতাম।

সুব্রত কোন কথা না বলে একটা খালি সোফার উপরে উপবেশন করলো।

কিরীটীই বললে, কাল শনিবার সুশীল নন্দীর ওখানে একবার যাবো বিকেলের দিকে, তুইও থাকবি আমার সঙ্গে

মিত্রানীর বন্ধু ও বান্ধবীদের সঙ্গে কথা বলবি? সুব্রত শুধাল।

হ্যাঁ।

কিন্তু পাঁচজনকে তো আগেই লিস্ট থেকে বাদ দিয়েছিস তুই!

তা দিয়েছি ঠিকই, তবু সকলেরই মুখোমুখি একবার আমি হতে চাই—তাতে করে মিত্রানীর মৃত্যুতে কার মনে কি রকম রেখাপাত করেছে, কিছুটা অন্তত তার আভাস পাবো হয়তো।

কিন্তু ওরাই তো সব নয়—একজন তো বাকী থেকে যাচ্ছে, যদিও সে ঘটনার দিন স্পটে উপস্থিত ছিল না–

সজল চক্রবর্তী?

হ্যাঁ।

কথাটা যে আমার মনে হয়নি সুব্রত তা নয়, ঘটনার সময় সেদিনকার স্পটে সে না থাকলেও মিত্রানীর পরিচিত জনদের মধ্যে সেও একজন। সে নিশ্চয়ই এতদিনে ব্যাপারটা জানতে পেরেছে—কাজেই তার মনে মিত্রানীর হত্যার ব্যাপারটা কতখানি রেখাপাত করেছে তাও জানা প্রয়োজন তো বটেই, তাছাড়া মিত্রানী সম্পর্কে কোন নতুন তথ্যও হয়ত সে দিতে পারে।

কৃষ্ণা এতক্ষণ ঘরের এক কোণে বসে গভীর মনোযোগের সঙ্গে একখানা বই পড়ছিল, দুই বন্ধুর আলোচনায় কোন সাড়া দেয়নি, সে এবারে বললে, দেখো, একটা কথা তোমাকে গতকাল থেকেই বলবো ভাবছিলাম!

কি বল তো? স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল।

দলের মেয়ে দুটিকেই বোধ হয় তুমি তোমার বাদের মানে অমিশনের লিস্টে যোগ করে নিতে পারো–

তুমি বোধ হয় পোস্টমর্টেমের রিপোর্টটার কথাই ভাবছো কৃষ্ণা, কিন্তু এটা তো স্বীকার করবে ঐ চরম ঘটনাটা ঘটাবার আগে বিক্ষিপ্ত কোন ইতিহাস বা ঘটনা ঐ ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।

তা যে পারে না আমি বলছি না, তবে

তাছাড়া এটাও তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে কৃষ্ণা, রহস্য উদঘাটনের ব্যাপারে এমন অনেক কিছু আপাতদৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় মনে হলেও, পরে কোন এক সময় সেটা কোন মূল্যবান সূত্র হয়ে দাঁড়াতে পারে! কি জানো কৃষা, ঠিক সেই কারণে ঐ দশটি নরনারীর পরিচয়ের ইতিহাস যতটা সম্ভব আমি জানতে চাই—যদি কোথাও কিছু এমন খোঁজ পাই যেটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে এগুতে পারব।

কৃষ্ণা আর কথা বাড়াল, সোফা থেকে উঠে পড়ে বললে, বোসো তোমরা, আমি চা নিয়ে আসি।

কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

০৮. ওদের সকলের পৌঁছাবার আগেই

ওদের সকলের পৌঁছাবার আগেই কিরীটী সুশীল নন্দীর ওখানে পৌঁছে গিয়েছিল। কিরীটী সুশীল নন্দীকে আগেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল, থানার মধ্যে নয়—সম্ভব হলে ঐ বিলডিংয়েরই দোতলায় সুশীল নন্দীর কোয়ার্টার্স-এ সে সকলের সঙ্গে দেখা করতে চায়। সুশীল নন্দী বলেছিল, তাতে কোন অসুবিধা হবে না, কারণ তার স্ত্রী কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি গিয়েছেন–তার কোয়াটার্স খালি।

কিরীটী ও সুব্রত সুশীল নন্দীর দোতলার বসবার ঘরে ঢুকে দেখলো—দুটি যুবকের সঙ্গে বসে সুশীল নন্দী কি সব আলোচনা করছেন!

কিরীটীদের ঘরে ঢুকতে দেখে সুশাল নন্দী বললেন, আসুন মিঃ রায়, সকলে এখনো এসে পৌঁছাননি, মাত্র দুজন এসেছেন—মণিময়বাবু, ক্ষিতীশবাবু—ইনি কিরীটী রায়, সরকারের পক্ষ থেকেই উনি আপনাদের সকলের সঙ্গে মিত্রানী দেবীর হত্যার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান।

মণিময় দত্ত ও ক্ষিতীশ চার্ক যুগপৎ একসঙ্গে সুশীল নন্দার কথায় কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল, কিরীটীও ওদের দিকে তাকিয়েই আছে তখন, দুজনারই বয়স বত্রিশ থেকে চৌত্রিশের মধ্যে। মণিময়ের গায়ের রংটা কালো হলেও চোখে মুখে একটা আলগা শ্ৰী আছে—বেশ বলিষ্ঠ, সুগঠিত চেহারা। উচ্চতায় মাঝারি। মাথায় বড় বড় চুল। ঘাড়ের . দিকে যেন একটু বেশীই, লংস ও একটা হাওয়াই শার্ট পরনে। পায়ে কালো চপ্পল।

ক্ষিতীশ চাকী একটু বেঁটেই-তবে রোগা পাতলা চেহারার জjj তেমন বেঁটে মনে হয় না, গায়ের রং তামাটে, মনে হয় কোন এক সময় গৌর ছিল, এখন রোদে জলে ঘুরে ঘুরে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে, তৈলহীন রুক্ষ একমাথা চুল–কিছু কিছু চুলে পাক ধরেছে। ইতিমধ্যে। নাকটা একটু চাপা, ছোট কপাল, গালের হাড় দুটো প্রকট। বুদ্ধিদীপ্ত চঞ্চল দুটো চোখের দৃষ্টি।

কথা বললে ক্ষিতীশ চাকীই, সুশীলবাবু একটু আগেই বলছিলেন, আপনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান বলেই বিশেষ করে আমাদের সকলকে আজ এখানে ডাকা হয়েছে। কিন্তু আমরা যা জানি সবাই তো সেদিনই বলে ওর খাতায় সই করে দিয়েছি! কথার মধ্যে একটা ঝাঁঝ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

কিরীটী মৃদু হেসে বললো, ঠিকই ক্ষিতীশবাবু, আমি ঠিক সেজন্য আপনাদের এখানে আজ আসবার জন্য ওঁকে বলতে বলিনি–

তবে? ক্ষিতীশের প্রশ্ন।

দেখুন আমি একটু ভিতরের কথা জানতে চাই। কিরীটী বললে।

ভিতরের কথা মানে? প্রশ্নটা করে ক্ষিতীশ চাকী কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

আপনাদের সকলের পরস্পরের সঙ্গে তো দীর্ঘদিনের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা—তাই—

কি তাই? বলুন, থামলেন কেন?

মিত্রানী সম্পর্কে আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত এমন অনেক কথা জানেন যেটা জানাতে পারলে আপনাদের কাছ থেকে মিত্রানীর হত্যারহস্য উদঘাটনের ব্যাপারে আমার কিছুটা সাহায্য হতে পারে। যেমন ধরুন মিত্ৰানী এতদিন বিয়ে করেনি কেন? তার বাবাকে বিয়ের কথায় সে বলেছে সময় হলে জানাবো

ক্ষিতীশ চাকী বললে, তাই নাকি-তা সেরকম কিছু আমি শুনিনি। তাছাড়া ওটা তার তো পার্সোনাল ব্যাপার–

ঠিকই—আমার জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, কিরীটী বললে, মিত্রানী কাউকে ভালবাসত কিনা জানেন? কিংবা অন্য কেউ মানে আপনাদের মধ্যে তাকে কেউ ভালবাসত কিনা বা তার। প্রতি কোনরকম দুর্বলতা ছিল কিনা কারো

ক্ষিতীশ চাকী বললে, কাউকে মিত্রানী ভালবাসতো কি বাসত না আমি জানি না—তা নিয়ে কোনদিন আমার কোন মাথাব্যথা ছিল না। আর দুর্বলতার কথা যদি বলেন, আমার তার প্রতি এতটুকুও দুর্বলতা ছিল না, কলেজ ছাড়বার পরও বড় একটা দেখাসাক্ষাৎ-ই হতো না।

আচ্ছা ক্ষিতীশবাবু, ক্ষি তীশের কথাগুলো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন প্রশ্নটা করলো হঠাৎ কিরীটী-মিত্রানীর হত্যার ব্যাপারে কাউকে আপনি সন্দেহ করেন?

ব্যাপারটা এত অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর যে, ঐ ব্যাপারে কোন কিছু মাথায়ই এখনো আসছে না। না মশাই, কাউকে আমি সন্দেহ করি না!

আচ্ছা ক্ষিতীশবাবু, আপনাকে আর আমাদের প্রয়োজন নেই। আপনি যেতে পারেন।

ধন্যবাদ। ক্ষিতীশ চাকী সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল এবং দরজার দিকে এগুতেই কিরীটীর শেষ কথাটা তার কানে এলো।

পুলিসের কিন্তু ধারণা—আপনাদেরই মধ্যেই একজন সেদিন—

কি, কি বললেন! চকিতে ঘুরে দাঁড়ায় ক্ষিতীশ।

কিরীটী কথাটা তার শেষ করে, মিত্রানীকে—না—কিছু না-আপনি যান।

ইউ মীন সাম ওয়ান অব আস মিত্রানীকে হত্যা করেছি!

তাই।

বলিহারি বুদ্ধি! বরাবরই আমার ধারণা, বেশীর ভাগ পুলিসের লোকেরই বুদ্ধি বলে কোন পদার্থ নেই। এখন দেখছি–

সুশীল নন্দী বাধা দিলেন গম্ভীর গলায়—ক্ষিতীশবাবু, আপনি যেতে পারেন।

প্রথমে সুশীল নন্দী ও পরে কিরীটীর প্রতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হেনে ক্ষিতীশ চাকী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

মণিময় এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। এবারে সে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, সত্যি কিরীটীবাবু! তার গলায় রীতিমত একটা উদ্বেগ যেন প্রকাশ পেল।

কি সত্যি মণিময়বাবু? মৃদু হেসে কিরীটী প্রশ্ন করে। বস্তুত এতক্ষণ সে মৃদু মৃদু . হাসছিল।

ঐ যে ক্ষিতীশ বলে গেল, আ–আপনাদের তাই ধারণা নাকি?

কিরীটী শান্ত গলায় এবারে জবাব দিল, তা যদি ধরুন হয়ই, সেটা কি খুব একটা অপ্রত্যাশিত কিছু–

না, না—কিরীটীবাবু, এ হতেই পারে না, আপনি বিশ্বাস করুন।

আপাতত ঐ কথা থাক, আগে আমার প্রশ্নটার জবাব দিন। মিত্রানীকে আপনাদের মধ্যে কেউ ভালবাসততা কি না আপনি কিছু জানেন? বা তার আপনাদের কারোর প্রতি কোন আকর্ষণ বা দুর্বলতা ছিল কিনা—

দেখুন কিরীটীবাবু, আমি ঠিক জানি না—আমি তার সঙ্গে কখনো সেরকম ভাবে মিশিনিসহপাঠিনী হিসাবে সামান্য যা পরিচয়—

মণিময়ের কথা শেষ হলো না, সিঁড়িতে অনেকগুলো পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেরই দৃষ্টি একসঙ্গেই যেন খোলা দরজার উপর গিয়ে পড়লো। অমিয় রায়, সতীন্দ্র সান্যাল সর্বপ্রথমে এবং তাদের পশ্চাতে কাজল বোস, পাপিয়া চক্রবর্তী ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলো।

সুশীল নন্দীই সকলকে আহ্বান জানালেন—আসুন আসুন, তা বিদ্যুৎবাবু আর সুহাসবাবুকে দেখছি না! তারা এলেন না?

জবাব দিল সতীন্দ্র সান্যাল, তাদেরও আসার কথা নাকি!

হ্যাঁ—আমি তো সকলকেই লোক মারফৎ চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছি আলাদা আলাদা ভাবে আসবার জন্য।

কিন্তু চিঠিতে তো সে কথা লেখা ছিল না, শুধু আমাকেই আসবার কথা লেখা ছিল, সতীন্দ্র বললে।

সুশীল নন্দী বললেন, তা আপনারা সব একত্রে এলেন কি করে?

সুশীল নন্দীর কথায় ওরা সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। তখন অমিয়ই বললে, হাওড়া ব্রীজের কাছে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে বিশ্রী জ্যাম হয়েছে—তাই সকলেই আমরা যে যার যানবাহন ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে ব্রীজের উপর দিয়ে একে অন্যের দেখা পাই—পরে ব্রীজ পার হয়ে হাওড়া ময়দান পর্যন্ত হেঁটে এসে সকলে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে আসছি–

ও তাই বলুন—তা আপনারা দাঁড়িয়ে কেন, বসুন—

সকলের দৃষ্টিই তখন মণিময়ের প্রতি নিবন্ধ—মনে হচ্ছে সকলের মনের মধ্যেই যেন একটা সংশয় দেখা দিয়েছে, কিন্তু কেউ কিছু বললো না, ঘরের মধ্যে সকলের জন্যই আসনের ব্যবস্থা ছিল, একে একে সব চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

০৯. সুব্রত এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি

সুব্রত এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি—নীরব দর্শকের মত কিরীটীর পাশে নিঃশব্দে বসে ওদের সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। এদেরও সকলের বয়েস অন্য দুইজনার মতই, অমিয়র চেহারার মধ্যে কোন বিশেষত্ব নেই—সাধারণ একজন যুবক, একজোড়া গোঁফ আছে—পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে সরু শৌখিন ফ্রেমের চশমা চোখের দৃষ্টিটা যেন কেমন একটু বোজ-বোজা।

সতীন্দ্র সান্যালের কালো আবলুস কাঠের মত গায়ের রঙ। বেশ মোটা-সোটা, মুখটা লাগাল—পুরুষ্টু। জামা কাপড় চেহারা দেখে মনে হয় বেশ সুখী ব্যক্তি। আর হবেই বা কেন, কিরীটীর মনে পড়লো সুশীল নন্দীর খাতায় লেখা আছে ওর সম্পর্কে, ফুড ডিপার্টমেন্টে ওর বড় চাকুরে বাপের দৌলতে ভাল চাকরি একটা করছে। সুশীল নন্দী সতীন্দ্র সম্পর্কে যেন ঠিক-ঠিকই লিখেছেন। কাজল বোস—একেবারে টিপিক্যাল একজন স্কুল মিসট্রেসের মতন চেহারা। কালো, রোগা ঠিক না বলে বলা উচিত যৌবন-রস যেন ওর দেহ থেকে অনেকখানি নিংড়ে নেওয়া হয়েছে। চোখেমুখে ও চেহারায় যেন একটা হতাশা–একটা ক্লান্তির স্পষ্ট ইঙ্গিত।

আর পাপিয়া চক্রবর্তী। হ্যাঁ—উজ্জ্বল শ্যাম—স্লিম ফিগার—ঠিক যেন আজকের দিনের যে সব তরুণীদের পথেঘাটে চোখে পড়ে নিজেকে আকর্ষণের বস্তু করে তোলার উগ্র প্রচেষ্টা, পাপিয়া যেন তাদেরই সমগোত্রীয়। পাপিয়ার মত মেয়েরা অন্তরের সঙ্গে কখনো কোন পুরুষের কাছে ধরা দিতে পারে না—কতকটা যেন আত্মকেন্দ্রিক।

কথা বললো পাপিয়াই চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে, কিন্তু ব্যাপারটা কি বলুন তো সুশীলবাবু, হঠাৎ এভাবে আবার আমাদের তলব পাঠিয়েছেন কেন?

মণিময় ও ক্ষিতীশকে যা বলেছিলেন সুশীল নন্দী, কিরীটীকে দেখিয়ে ওদেরও তাই বললেন। সকলেই তাঁর কথায় একেবারে কিরীটীর দিকে তাকাল!

পাপিয়াই আবার বললে, আপনাকে যেন চিনি বলে মনে হচ্ছে—নন্দী সাহেব, উনি কি সত্যসন্ধানী কিরীটী রায়?

ঠিকই ধরেছেন মিস চক্রবর্তী।

হুঁ। এখন তাহলে বুঝতে পারছি, আজকে আমাদের ডাকার আসল উদ্দেশ্যটা। আর

উনি বোধ হয় সুব্রতবাবু, ওঁর পাশে বসে!

হ্যাঁ, সুব্রত রায়। সুশীল নন্দী আবার বললেন।

কিরীটী কথা বললে এবারে, দেখুন মিস চক্রবর্তী আপনারা সকলেই মিত্রানীর বন্ধু-সহপাঠীও, তাই মিত্রানী সম্পর্কে দুটো-একটা প্রশ্ন আমি করতে চাই—

সতীন্দ্র বলেন, কি প্রশ্ন?

মিত্রানীর প্রতি দলের কারো কোন দুর্বলতা ছিল কিনা—কিংবা মিত্রানীর আপনাদের কারোর প্রতি–

সবাই চুপ। একেবারে যেন বোবা! অকস্মাৎ যেন সকলেই কেমন একটা অস্বস্তিকর পরিবেশের মধ্যে থমকে দাঁড়িয়েছে।

বুঝতে পারছি আমার প্রশ্নে আপনারা সকলেই একটু অস্বস্তিবোধ করছেন। সুশীলবাবু—

বলুন—

আপনার পাশের ঘরটা আমরা একটু ব্যবহার করতে পারি?

নিশ্চয়ই–

তাহলে আমি আর সুব্রত পাশের ঘরে যাচ্ছি, আপনি এক-একজন করে এঁদের ঐ ঘরে পাঠান–

বলা বাহুল্য, সেই মতই ব্যবস্থা হলো।

প্রথমেই এলো অমিয় রায়। সে এক কথাতেই জবাব দিল, কলেজ ছাড়ার পর মিত্রানীর সঙ্গে তার বিশেষ কোন সম্পর্কই ছিল না—কচিৎ কখনো দেখা হতো—তাও দু-একটা সাধারণ কুশল প্রশ্ন ছাড়া ওদের মধ্যে আর কোন কথা বড় একটা হতো না– কাজেই মিত্রানী সম্পর্কে সে বিশেষ কোন খবরই রাখে না।

অমিয়কে কিরীটী বিদায় দিল।

অমিয়র পর এলো সতীন্দ্র। তারও জবাব অমিয়র মতই।

কিরীটী মৃদু হেসে তাকেও বিদায় দিল।

অতঃপর এলো পাপিয়া চক্রবর্তী।

সে কিরীটীর প্রশ্নের জবাবে বললে, মিত্রানী ওয়াজ এ টিপিক্যাল অধ্যাপিকা। স্ট্যঞ্চ মরালিস্ট অ্যান্ড নেভার সোস্যাল। ঐ টাইপের মেয়েরা প্রেম করলেও কখনো তা কি প্রকাশ করে–করে না! কাজেই, তার সম্পর্কে ঐ ধরনের প্রশ্ন উঠতেই পারে না। আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না–মিত্রানী সম্পর্কে আমার ধারণা, প্রেম-ট্রেমের ব্যাপারে তার বোধ হয় একটা নশিয়াই ছিল। বলে পাপিয়া মৃদু হাসলো। কিরীটী মৃদু হেসে তাকেও বিদায় দিল।

সর্বশেষ এলো কাজল বোস।

দুই চোখে ঐ মুহূর্তে তার, কিরীটীর মনে হয়, কেমন যেন একটা ভয় ও সংশয়। দাঁড়িয়ে থাকে সে, বসে না।

বসুন মিস্ বোস–কিরীটী বললে।

কিন্তু আমার যা বলবার ছিল তা তো সেইদিনই থানার অফিসারকে বলেছি কিরীটীবাবু।

জানি বলেছেন। দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন!

একটু দ্বিধা, একটু সঙ্কোচ নিয়েই যেন কাজল চেয়ারটার উপরে বসলো। সোজাসুজি কিরীটীর চোখের দিকে যেন সে তাকাতে পারছে না।

বলুন তো মিস্ বোস, আপনার বান্ধবী মিত্রানী আপনাদের বন্ধু-ছেলেদের মধ্যে কাউকে কি ভালবাসতো।

ঠিক জানি না। তার সঙ্গে আমার বড় একটা দেখা হতো না কলেজ ছাড়ার পর। তাছাড়া সে ছিল নামকরা একটি কলেজের প্রাফেসার, আর আমি সাধারণ একজন স্কুলমিসট্রেস–

কিরীটী বুঝলো কাজলের মধ্যে একটা ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স আছে মিত্রানী সম্পর্কে।

কিরীটী একটু যেন সজাগ হয়ে নড়েচড়ে বসলো।

আপনি মনে হচ্ছে মিত্রানীকে তেমন বোধ হয় একটা খুব পছন্দ করতেন না!

না, না—তা নয়—

তবে?

ওর বরাবরই ভাল ছাত্রী ও অধ্যাপিকা বলে মনের মধ্যে একটা ভ্যানিটি ছিল। অন্যান্যেরা টের না পেলেও আমি টের পেতাম।

আচ্ছা আপনাদের দলের পুরুষদের কারো উপরই কি মিত্রানীর কোন দুর্বলতা ছিল না? আবার আগের প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি করলো কিরীটী, আপনার দৃষ্টিতে না পড়লে দলের অন্য কারো মুখেও কি কিছু শোনেন নি?

না। তবে সুহাস যেন একদিন আমাকে কথায় কথায় বলেছিল—

কি বলেছিলেন সুহাসবাবু?

মিত্রানীর সুহাসের প্রতি ব্যবহারটা যেন একটু কেমন কেমন ছিল। আর মনে হয়, আবার সুহাসেরও বোধ হয় মিত্রানীর প্রতি একটা দুর্বলতা ছিল। আচ্ছা কিরীটীবাবু

বলুন।

সত্যিই কি পুলিশের ধারণা হয়েছে যে, আমাদের মধ্যেই কেউ সেদিন মিত্রানীকে—

সেটাই তো স্বাভাবিক মিস বোস।

কেন—কেন?

মনে করুন, আপনারা ছাড়া সে সময় সেখানে কেউ বাইরের লোক ছিল না—সেও একটা কথা এবং আপনাদের কারো পক্ষে সেদিন ঐখানে মিত্রানীকে হত্যা করার যে রকম সুবিধা ছিল, ততটা আর কারোর পক্ষেই ছিল না।

কিন্তু–

কিরীটী বলতে লাগল, তাছাড়া ধরুন যদি কোনা তৃতীয় ব্যক্তিরই কাজ হবে—-সে নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথাও ছিল যেটা আপনাদের অতগুলো মানুষের কারো না কারো চোখে পড়তই, সেরকম কাউকে কি সেদিন আপনাদের আশেপাশে সুযোগের অপেক্ষায় ঘুরঘুর করতে দেখেছিলেন তপনাদের কেউ

না, সে রকম কাউকেই দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।

আচ্ছা মিস্ বোস!

বলুন।

আপনাদের মধ্যে কেউ সেদিন বেতের টুপি মাথায় দিয়ে গিয়েছিলেন?

না তো!

আচ্ছা আপনাদের দলের মধ্যে কে কে সিগ্রেট খায়?

সুহাস, অমিয় আর বিদ্যুৎ–আরো একজন চেইন স্মােকার সজল চক্রবর্তী। সে তো সেদিন আসেইনি

কে কি ব্রান্ড খায় জানেন?

বিদ্যুৎ আর সজলের কথা জানি না-তবে সুহাস আর অমিয় দুজনে চার্মিনার হয়।

হুঁ। কে বেশী খায় সিগ্রেট ওদের দুজনের মধ্যে?

সুহাসই মনে হয় বেশী খায়।

আপনারা কেউ সেদিন একটা বায়নাকুলার নিয়ে গিয়েছিলেন?

বায়নাকুলার! না তো!

কারো কাছেই বায়নাকুলার ছিল না?

না।

আচ্ছা মিত্রানীর হাতে কি সবুজ রঙের কাঁচের চুড়ি ছিল? আপনার হাতেও তো দেখছি কাঁচের চুড়ি রয়েছে—

হ্যাঁ—এটা আমার শখ। মিত্রানীকে কখনো কাঁচের চুড়ি ব্যবহার করতে দেখিনি। আর কাঁচের চুড়ি ব্যবহার সে করতেই বা যাবে কোন্ দুঃখে–এত টাকা মাইনে পেত।

টাকার জন্যই কি কেউ কাঁচের চুড়ি ব্যবহার করে! আপনার মত শখ থাকলে অনেক বড়লোকের মেয়েও হাতে কাঁচের চুড়ি পরেন। আচ্ছা আপনি সেদিন পড়ে-টড়ে গিয়েছিলেন নাকি?

কই না তো!

দেখছি আপনার ডান হাতে তিনটি, অন্য হাতে একটি চুড়ি—

আমার এক ছোট ভাইঝি আছে, সে ভেঙে ফেলেছে।

আচ্ছা মিস বোস, এবারে আপনি যেতে পারেন।

কাজল উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

 

সুব্রত!

কি?

কাজল বোসের বাঁ হাতটায় কব্জির কাছে লক্ষ্য করেছিলি—একটা অ্যাবরেশন মার্ক আছে।

দেখেছি—মনে হয় সব কথা উনি স্পষ্ট করে বললেন না।

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, আর কিছু মনে হলো তোর ঐ মহিলা সম্পর্কে?

মনে হলো নিজের অসুন্দর চেহারার জন্য যেন একটা মানসিক দৈন্যে ভুগছেন।

ঠিক। আর কিছু?

আর তো কিছু মনে হলো না।

সুহাসবাবুর প্রতি বোধ হয় ঐ ভদ্রমহিলার কিছুটা দুর্বলতা আছে।

ঐ সময় সুশীল নন্দী এসে ঘরে ঢুকলেন—-মিঃ রায়!

বলুন।

আরো দুজন এসেছেন।

কে কে? কিরীটী শুধাল।

সুহাস মিত্র আর সজল চক্রবর্তী। মানে সেই ভদ্রলোক যার অনুরোধেই সেদিন ওদের বটানিক্স-এ পিকনিকের প্রোগ্রাম হয়েছিল। কিন্তু সজলবাবু তো সেদিন পিকনিকে উপস্থিত ছিলেন না। তার সঙ্গেও কথা বলতে চান নাকি?

ঘটনাচক্রে এসেই পড়েছেন যখন তখন আলাপ করতে দোষ কি! দিন না—তাকেই আগে পাঠিয়ে দিন।

সুশীল নন্দী চলে গেলেন এবং একটু পরে সজল চক্রবর্তী এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। চেহারায় ও পোশাকে বেশ স্মার্ট। বেশ লম্বা সুগঠিত চেহারা। গাত্রবর্ণ শ্যামই বলা চলে। ছোট কপাল, নাকটা একটু চাপা—চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত। পরনে দামী স্যুট–

আপনার নাম—

সজল চক্রবর্তী।

বসুন।

সজল বসতে বসতে বললে, আজই এগারোটা নাগাদ মর্নিং ফ্লাইটে কলকাতায় এসেছি —মিত্রানীর বাসায় ফোন করেছিলাম—প্রণবেশবাবুর মুখেই সব শুনলাম। সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, আমি তো একেবারে হতবাক। ব্যাপারটা তো বিশ্বাসই করতে পারিনি—সঙ্গে সঙ্গে সুহাসের ওখানে আমি ছুটে যাই-অ্যান্ড হি অলসো রিপিটেড দি সেম স্টোরি! সে-ই বললে থানা অফিসার নাকি আজ তাকে বিকেলের দিকে এখানে আসতে বলেছেন কি সব আলোচনার জন্য—আমিও তাই ওর সঙ্গে চলে এলাম।

বেশ করেছেন। ভালই করেছেন। আপনিও তো মিত্রানীর বন্ধু-সহপাঠী! আপনি নিশ্চয়ই তাঁর সম্পর্কে অনেক কথাই জানেন।

কি আর, কতটুকুই বা জানতে পারি বলুন—এইটুকু বলতে পারি—শী ওয়াজ ভেরি নাইস-ভেরি সোস্যাল।

কিন্তু কাজল বোস বলছিলেন—

কি? কি বলছিল কাজল?

মিত্রানী ওয়াজ রাদার আনসোস্যাল।

বরং ঠিক উল্টোটাই—

আচ্ছা মিঃ চক্রবর্তী—মিত্রানীর কোন লাভ-অ্যাফেয়ার ছিল বলে জানেন?

তা বোধ হয় ছিল—

আপনাদের মধ্যে কি কেউ—

ইফ আই অ্যাম নট রং, ঐ সুহাস—

সুহাস মিত্র?

মনে হয়।

আপনি শুনেছেন কিনা জানি না, পুলিসের একটা ধারণা, আপনাদের দলের মধ্যেই কেউ তাকে হত্যা করেছে—-

কি বলছেন আপনি মিঃ রায়? আই মাস্ট সে দে আর ফুলস! আমাদের মধ্যেই কেউ মিত্রানীকে হত্যা করতে যাবে কেন?

ঈর্ষার তাড়নায়ও তাকে কেউ আপনাদের মধ্যে হত্যা করে থাকতেও তো পারে।

ঈর্ষা! কিসের ঈর্ষা! না, না—অসম্ভব।

আপনি তো সকলেরই মনের কথা জানেন না মিঃ চক্রবর্তী। তাছাড়া সব সময় নিজের মনের কথাই কি আপনি জানতে পারেন? থাক সে কথা—আপনার কোন বায়নাকুলার আছে?

বায়নাকুলার!

হ্যাঁ।

কই না!

নেই?

না।

তা আপনি এই সেদিন কলকাতায় এসেছিলেন—হঠাৎ দুদিন পরেই যে আবার কলকাতায় এলেন?

একটা অফিসিয়াল কাজে আসতে হলো।

কালই বোধ হয় আবার চলে যাবেন?

না–দিন দুই আছি।

আপনি থাকেন কোথায়?

কলুটোলায়।

বাড়িতে কে কে আছেন?

বাবা মা আর এক ছোট বোন। ছোট বোন কলেজে পড়ে। সেকেন্ড ইয়ার।

কলুটোলায় আপনাদের নিজেদের বাড়ি?

না মিঃ রায়, ভাড়াটে বাড়ি! বাবা আমার সামান্য জজ কোর্টের কেরানী ছিলেন। অবশ্যি আমি এখন যাকে আপনারা বলেন মোটা মাইনে তাই পাই, কিন্তু বাবা আমার অর্থসাহায্য নেবেন না। এ পিকিউলিয়ার টাইপ।

 ১০. সজল চক্রবর্তীর পর এলো সুহাস মিত্র

সজল চক্রবর্তীর পর এলো সুহাস মিত্র। নিয়মিত ব্যায়াম করলে যেমনটি হয়, তেমনি সুগঠিত চেহারা, পরনে ধুতি পাঞ্জাবি। কালোর উপর সব কিছু মিলিয়ে সুহাস মিত্রের চেহারাটা যাকে বলে সুশ্রী তাই। সমস্ত মুখে একটা আত্মবিশ্বাস ও বুদ্ধির ছাপ।

বসুন সুহাসবাবু–কিরীটী বললে।

সুশীলবাবু বলছিলেন, আপনি নাকি কি সব আলোচনা করতে চান।

হ্যাঁ—দু-একটা প্রশ্ন আর কি মিত্রানী সম্পর্কে।

ক্ষণকাল সুহাস মিত্র কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো–তারপর শান্ত গলায় বললে, তা শুনতে পারি কি কি প্রশ্ন আপনার মিত্রানী সম্পর্কে : অবিশ্যি উত্তর আমার জানা থাকলে নিশ্চয়ই পাবেন।

ধন্যবাদ।

কিন্তু কিরীটীবাবু, কি হবে আর তার কথা জেনে। সে তো আজ অতীত। কোনদিনই সে ফিরে আসবে না।

শেষের দিকে কিরীটীর যেন মনে হলো, সুহাস মিত্রের গলাটা যেন কেমন রুদ্ধ হয়ে এলো।

সুহাসবাবু, আপনি তো তার একসময় সহপাঠী ছিলেন—অনেক দিনের পরিচয় আপনাদের ছিল—কিছুটা হয়ত ঘনিষ্ঠতাও ছিল—

না। পরিচয় ছিল ঠিকই—তবে ঘনিষ্ঠতা বলতে যা বোঝায় সে রকম কিছুই ছিল না।

আপনি তাকে–মানে মিত্রানীকে ভালবাসতেন?

সাধারণ একজন মার্চেন্ট অফিসের কেরানীর ভালবাসা কি আজকের দিনে ভালবাসা!

টাকা-পয়সা-মান-সম্পদ বা মর্যাদা দিয়ে তো ভালবাসার বিচার হয় না। যাক সে কথা, আপনি কি কখনো তাকে আপনার মনের কথা জানিয়েছেন?

না।

কেন?

প্রয়োজন বোধ করিনি শেষ পর্যন্ত—

কে প্রয়োজন বোধ করেননি?

কখনো কখনো মনে হতো বলি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন জানতে পারলাম—সে অন্য একজনকে ভালবাসে–

কি করে জানলেন? নিশ্চয়ই কেউ আপনাকে বলেছিল?

ধরে নিন তাই!

কিন্তু সে যে সত্য বলেছে তার প্রমাণ কি আপনি কিছু পেয়েছিলেন?

সত্য যা তার কি আবার কোন প্রমাণের দরকার হয় কিরীটীবাবু! ও-কথা থাক। আর কি আপনার জানবার আছে বলুন।

সেদিন যখন ঝড় ও ধুলোর অন্ধকারে সকলের কাছ থেকে ছিটকে পড়ে অন্ধের মত পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন আপনার আশেপাশে আর কারো গলা শুনছিলেন বা আর কারোর সাড়া পেয়েছিলেন কিংবা কারো কোনরকম চিৎকার বা আর্তনাদ আপনার কানে এসেছিল সুহাসবাবু? এ

না, তাছাড়া আপনি শুনেছেন নিশ্চয়ই একটা ভারী গাছের ডালের তলায় অকস্মাৎ আমি চাপা পড়েছিলাম, সব অন্ধকার হয়ে যায়—আমি জ্ঞান হারাই।

আচ্ছা ঠিক যে মুহূর্তে ঝড়টা ওঠে, তখন আপনার আশেপাশে কারা ছিল মনে আছে?

হাত দুয়েকের মধ্যে ছিল বিদ্যুৎ, আর তারই পাশে ছিল বোধ হয় মিত্রানী—

তার কাজল বোস?

ঠিক মনে নেই—তবে কাজল বোধ হয় আমার কাছাকাছিই ছিল।

হুঁ। আর একটা কথা। সেদিন যতক্ষণ গার্ডেনে ছিলেন, দূরে বা কাছে কোন তৃতীয় কাউকে আপনার নজরে পড়েছিল কি—যার মাথায় ধরুন একটা বেতের টুপি ছিল আর হাতে বা গলায় একটা বায়নাকুলার ঝোলানো ছিল?

বায়নাকুলার—বায়নাকুলার, হা হ্যাঁ, মনে পড়েছে—-খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা সকলে যখন গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি, যেন একজনকে মুখে চাপদাড়ি, চোখে রঙিন চশমা, পরনে কালো প্যান্ট ও গায়ে স্ট্রাইপ দেওয়া একটা হাওয়াই শার্ট দেখেছিলাম বার দুই ভদ্রলোক বায়নাকুলার দিয়ে গঙ্গার মধ্যে যেন কি দেখছিলেন—আমাদের কিছুটা দূরেই–

আপনার পরিচিত কেউ নন?

না। তাছাড়া পরিচিত হলে তো আমাদের কাছে বসতো।

ঝড়টা যখন ওঠে তখন তাকে দেখেছিলেন?

ঠিক তেমন নজর করিনি—নিজেরাই হঠাৎ ধুলোয় পড়ে বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম

আচ্ছা সুহাসবাবু, আপনি নিশ্চয় রুমাল ব্যবহার করেন? কিরীটীর প্রশ্ন।

করি বৈকি।

সেদিন নিশ্চয়ই আপনার পকেটে রুমাল ছিল?

ছিল। সিলকের রুমাল ছিল কি সেটা?

না মশাই, সাধারণ ক্যালিকোর রুমাল একটা-সাদা।

আপনার রুমালের কোণে নাম লেখা থাকত বা কোন চিহ্ন?

হ্যাঁ–আমার ডাক নাম টুটু ইংরাজীতে টি অক্ষরটা লেখা থাকত।

হঠাৎ পকেট থেকে একটা সিল্কের রুমাল বের করলো কিরীটী—সাধারণ জেন্টস রুমালের সাইজের থেকে সামান্য একটু বড়-তার এক কোণে ইংরাজী টি অক্ষরটা সবুজ সুতো দিয়ে বোনা। বললে, দেখুন তো, এই রুমালটা একবার!

দেখি রুমালটা, রুমালটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে সুহাস বললে, আশ্চর্য!

কি হলো?

রুমালটা আমারই মনে হচ্ছে—কিন্তু–, রুমালটা কিরীটীর হাতে আবার ফিরিয়ে দিল সুহাস।

আপনারই রুমাল! এটা তো সিল্কের?

হ্যাঁ  গত বছর কাজল আমার জন্মদিনে সবুজ সুতো দিয়ে টি লিখে এই রুমালটাই আমাকে উপহার দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ পিকনিকের দিন দুই আগে কোথায় যে রুমালটা ফেললাম আর খুঁজে পাই নি, অথচ মনে আছে সেটা অফিসে আমার পকেটেই ছিল।

ঠিক বলেছেন—ঠিক চিনতে পেরেছেন ওটা আপনারই রুমাল?

হ্যাঁ—তাছাড়া দেখুন ওর এক কোণে লাল কালির একটা দাগ আছে—

কথাটা মিথ্যা নয়, কিরীটী দেখতে পেল, সত্যিই এক কোণে একটা লাল কালির দাগ আছে রুমালটায়।

কিন্তু এটা—এটা আপনি পেলেন কোথায় কিরীটীবাবু? ব্যগ্র কণ্ঠেই প্রশ্ন করে সুহাস মিত্র কিরীটীকে।

এই রুমালটাই পাকিয়ে ফাঁস দিয়ে মিত্রানীকে সেদিন–

না-না-না—একটা যেন চাপা আর্তনাদ করে ওঠে সুহাস, না, না, না।

কিরীটী তাড়াতাড়ি রুমালটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। তারপর শান্ত গলায় ডাকল, সুহাসবাবু?

আঁ।

আপনার ফেবারিট ব্রান্ড সিগারেট চার্মিনার, তাই না?

হ্যাঁ—

দিনে কতগুলো সিগারেট খান?

তিন-চার প্যাকেট।

আচ্ছা আপনি মিত্রানীর হত্যার ব্যাপারে দলের মধ্যে কাউকে সন্দেহ করেন?

আমাদের দলের মধ্যে-না, না—এ অসম্ভব—

কিন্তু পুলিশের ধারণা, সেদিন আপনাদের মধ্যেই কেউ–

হরিবল! কি বলছেন আপনি?

আমার কি ধারণা জানেন?

কি?

ঐ ধুলোর ঝড় আর অন্ধকারের ভেতরেও আপনাদের মধ্যে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ কিছু অস্পষ্টভাবে দেখেছেন বা শুনেছেন, যেটা সেদিন আপনাদের জবানবন্দিতে কেউই আপনারা সুশীল নন্দীর কাছে প্রকাশ করেননি–অথচ যে কথাটা জানতে পারলে মিত্রানীর হত্যাকারীকে ধরার ব্যাপারে হয়ত অনেক সাহায্য পেতো পুলিস!

আমি-আমি—আমার কথা আমি বলতে পারি—অন্তত আমি কিছু আপনাদের কাছে গোপন করিনি—সুহাস মিত্র বলে উঠলো জবাবে—

কিরীটী তার কথাটার আর জের টানলো না। সে সম্পূর্ণ অন্য এক প্রশ্ন করলো। বললে, আচ্ছা সুহাসবাবু, কাজল বোস সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

সুহাস মিত্র প্রথমটায় কিছু সময় চুপ করে রইলো তারপর ধীরে ধীরে বললে, মিত্রানীকে ও বোধ হয় একটু হিংসা করতে

সেটা ওর সঙ্গে আমি কথা বলেই বুঝতে পেরেছি—তা নয়, আমার প্রশ্ন আপনি নিশ্চয়ই জানেন।

কি?

উনি আপনাকে ভালবাসেন!

জানি।

ওঁর প্রতি আপনার মনোভাবটা বোধ হয় বিপরীত?

আমি ওকে ঠিক পছন্দ করি না।

তার কোন কারণ আছে?

আসলে ও দেহে মেয়েছেলে হলেও মনের গঠনের দিক দিয়ে ঠিক যেন তা নয়— র্যাদার ওর মধ্যে একটা যেন পুরুষালী ভাব আছে

মৃদু হেসে কিরীটী বললে, আপনি যে মিত্রানীকে মনে মনে ভালবেসেছিলেন, সেটা বোধ হয় উনি অনুমান করতে পেরেছিলেন!

মিত্রানীর প্রতি আমার মনোভাব তো কখনো ঘুণাক্ষরেও কারো কাছে আমি প্রকাশ করিনি—

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, ভালবাসার ব্যাপারটা মুখ ফুটে প্রকাশ না করলেও মেয়েদের কাছে অস্পষ্ট থাকে না সুহাসবাবু।

১১. কিরীটী আর সুব্রত সেদিন

কিরীটী আর সুব্রত সেদিন যখন উঠবে-উঠবে করছে, বিদ্যুৎ সরকার এলো।

সবাই তখন চলে গিয়েছে।

বিদ্যুৎ ঘরে ঢুকে বললে, সুশীলবাবু, আমি অত্যন্ত দুঃখিত—বিশেষ কাজে আটকা পড়ায় আসতে দেরী হয়ে গেল।

সুশীল নন্দী বললেন, ঠিক আছে, বসুন—আলাপ করিয়ে দিন—ইনি—বিদ্যুৎ সরকার আর বিদ্যুৎবাবু, এঁকে চাক্ষুষ দেখেছেন কিনা জানি না, তবে নিশ্চয়ই এঁর নাম শুনেছেন–কিরীটী রায়।

নমস্কার। ওঁর নাম আমি বহুবার শুনেছি মিত্রানীর মুখে। আজই সকালে মিত্রানীর দাদা প্রণবেশবাবুর সঙ্গে টেলিফোনে যখন কথা হচ্ছিল, উনি বললেন, মিত্রানার মৃত্যুর ব্যাপারটা উনি তদন্ত করছেন।

কিরীটী বললে, মিত্রানীর বাবা অবিনাশবাবুর কাছে একসময় আমি পড়েছি–স্কুলে উনি আমাদের অঙ্কের মাস্টার ছিলেন।

বিদ্যুৎ সরকার কিরীটীর মুখোমুখি একটা খালি চেয়ার টেনে নিয়ে বসল, উঃ, কি প্রচণ্ড গরম–

কিরীটী বললে, আজও সকালবেলায় কাগজে ছিল সন্ধ্যার দিকে বজ্রবিদ্যুৎসহ এক পশলা ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে–

বিদ্যুৎ বললে, ছিল নাকি! আমি দেখিনি। সচরাচর ওদের আবহাওয়ার পূর্বাভাস বড় একটা মেলে না বলে আমি কখনো ও-সব দেখি না বা থাকলেও গুরুত্ব দিই না।

একেবারে যে মেলে না তা নয়, কিরীটী বললে, সেদিন কিন্তু পূর্বাভাস ঠিক মিলে গিয়েছিল—আর তাতেই হত্যাকারীর পূর্ব পরিকল্পনা সাকসেসফুলও হয়েছিল।

চকিতে বিদ্যুৎ সরকার কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

কিরীটী একটা সিগার ধরানোর ব্যাপারে ঐ মুহূর্তে ব্যস্ত থাকায় ব্যাপারটা তার নজরে পড়লেও সুব্রতর দৃষ্টি কিন্তু এড়ায় না।

আরো কিছুক্ষণ পরে কিরীটী ও বিদ্যুৎ সরকারের মধ্যে কথা হচ্ছিল। বিদ্যুৎ সরকার যে অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে, সেটা তার চেহারা ও পোশাকেই কিছুটা যেন ধরা যায়। যেমন গাত্রবর্ণ, তেমনি সুন্দর স্বাস্থ্যবান চেহারা। চেহারার মধ্যে একটা যেন বনেদী ছাপ আছে।

বিদ্যুৎবাবু, আপনার সঙ্গে তো প্রায়ই মিত্রানীর টেলিফোনে কথাবার্তা হতো?

হ্যাঁ–মধ্যে মধ্যে হতো।

কিছুটা আপনাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও ছিল ধরে নিতে পারি বোধ হয় কিরীটী বললে।

ঘনিষ্ঠতা বলতে আপনি কি মীন করছেন জানি না কিরীটীবাবু তবে আমাদের পরস্পরের মধ্যে কিছুটা হৃদ্যতা ছিল। আমাদের কলেজ-লাইফে আরো সহপাঠিনী ছিল কিন্তু মিত্রানীকে আমার বরাবরই ভাল লাগতো ওর মিশুঁকে সরল মিষ্টি স্বভাবের জন্য মনের মধ্যে কোন মার পাঁচ ছিল না।

আচ্ছা মিত্রানীর আপনাদের ছেলেদের মধ্যে কারোর প্রতি বিশেষ কোন আকর্ষণ বা · তার প্রতি কারো ছিল বলে আপনার মনে হয়? আপনারা তো পরস্পরের অনেক দিনের পরিচিত।

মিত্রানীর ঠিক সে রকম কারোর প্রতি ছিল বলে কখনো আমার মনে হয়নি। তবে মিত্রানী বরাবর যেমন লেখাপড়ায় ভাল ছিল, আমাদের দলের সুহাসও তাই ছিলকলেজ-লাইফে লাইব্রেরীতে ওদের দুজনকে অনেক দিন বসে গভীর আলোচনারত দেখেছি—আর বিশেষ কিছু তেমন চোখে পড়েছে বলে তো মনে পড়ছে না। তারপর একটু থেমে বিদ্যুৎ বললে, তবে ইদানীং বছর তিনেকের বেশী কলেজ ছাড়বার পর বিশেষ তেমন একটা দেখাশোনা হতো না—ঐ সময়ে যদি কিছু হয়ে থাকে তো বলতে পারবো না।

আচ্ছা বিদ্যুৎবাবু, দুর্ঘটনার দিন হঠাৎ যখন ধূলোর ঝড় উঠে চারিদিক ঢেকে গেল–আপনারা সকলেই পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন কিছু সময়ের জন্য, তখন কারো কোনরকম চিৎকার বা গলার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন কি?

না তো? তবে আমার মনে হচ্ছে, একটা কথা যা সেদিন সুশীলবাবুকে বলিনি, সেটা বোব হয় আমার বলা ভাল

কি কথা?

ঝড় ওঠবার পরই যখন হাতড়াতে হাতড়াতে কোনক্রমে সেই ধুলোর ঘূর্ণির অন্ধকারের মধ্যে এগুচ্ছি, মনে হয়েছিল যেন কে আমাকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে গেল—আমি কে বলে চেঁচালাম, কিন্তু কারো সাড়া পেলাম না। তারপরই আরো কয়েক পা অন্ধের মত এগুতেই একটা যেন ঝটাপটির শব্দ আমার কানে এসেছিল, কিন্তু চোখে ধুলো ঢাকায় চোখ দুটো এত কর-কর করছিল, এত জ্বালা করছিল যে, নিজেকে নিয়েই তখন আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি

কেউ আপনাকে ধাক্কা দিয়েছিল? একটা ঝটাপটির শব্দ শুনেছিলেন?

হ্যাঁ।

ঝড় ওঠবার মুহূর্তে আপনি মিত্রানীকে দেখতে পেয়েছিলেন, সে কোথায় কত দূরে ঠিক কার পাশে ছিল?

মিত্রানী ঠিক বোধ হয় আমার পাশেই ছিল।

আর কাজল বোস?

সে বোধ হয় সুহাসের কাছাকাছিই ছিল।

আচ্ছা বিদ্যুৎবাবু, আর একটা কথা, সেদিন আপনাদের আশেপাশে মুখে চাপদাড়ি, চোখে রঙিন কাঁচের চশমা, মাথায় বেতের টুপি, হাতে বা গলায় ঝোলানো একটা বায়নাকুলার–এমন কাউকে দেখেছিলেন কি? পরনে কালো প্যান্ট, গায়ে স্ট্রাইপ দেওয়া একটা হাওয়াই শার্ট–

না–সে রকম তো কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। আমরা নিজেদের নিয়ে এত মশগুল ছিলাম যে–

বুঝেছি, আশেপাশে তাকাবার ফুরসুৎ পাননি। তাই না?

হ্যাঁ।

আপনার বায়নাকুলার আছে বিদ্যুৎবাবু?

না।

আপনাদের দলে কারোর আছে?

বলতে পারবো না।

আপনি সিগ্রেট খান?

মাঝে-মধ্যে—

কি ব্রান্ড?

কোন স্পেশ্যাল ব্রান্ড নেই–একটা হলেই হলো, ঠিক নেশায় তো ধূমপান করি না, এমনি শখ করে দু একটা খাই। তারপরই একটু থেমে বিদ্যুৎ সরকার বললে, দেখুন মিঃ রায়, আপনি মিত্রানীর মৃত্যুর ব্যাপারটা একটু আগে বলেছিলেন, হত্যাকারীর পূর্বপরিকল্পিত-সত্যিই কি আপনি তাই মনে করেন?

করি।

ও! আচ্ছা, আপনার কি আমাদের মধ্যে সত্যিই কাউকে সন্দেহ হচ্ছে—

আপনার কাছে মিথ্যা বলবো না বিদ্যুৎবাবু, সেই রকমই আমার সন্দেহ হয়।

মানে অনুমান—

আচ্ছা বিদ্যুৎবাবু, রাত অনেক হলো—এবার আমি উঠবো। চল সুব্রত—

কিরীটী হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। সুব্রতও উঠে দাঁড়ায় সঙ্গে সঙ্গে।

১২. ছুটির দিন বলেই হয়ত

ছুটির দিন বলেই হয়ত রাস্তায় অত্যন্ত ভিড়—ওদের গাড়ি কেবলই থামছিল সামনের ভিড়ের চাপে। গাড়ি এক সময় হাওড়া ব্রীজ পার হয়ে ডাইনে স্ট্র্যান্ড রোড ধরলো।

হঠাৎ কিরীটীর কথা শুনে তাকাল ওর দিকে সুব্রত।

সুব্রত!

কিছু বলছিস?

সকলের কথাই তো মোটামুটি শুনলি—

আমি সকলের কথা মন দিয়ে শুনিনি জনাতিনেক ছাড়া—মৃদুকণ্ঠে সুব্রত বললে।

তিনজন কে কে?

সুহাস মিত্র, বিদ্যুৎ সরকার ও কাজল বোস—

হুঁ। আর কারো কথাই তাহলে তুই মন দিয়ে শুনিসনি! কান দিসনি—

না।

তবে আমার মনে হয়, যা জানতে আজ আমরা ওদের ডেকেছিলাম তার মধ্যে কিছুটা হয় তো মিস করেছিস।

কি বলতে চাস তুই?

মানুষের মুখ যদি তার মনের ইনডেক্স হয়—একজনকে তুই মিস করেছিস মানে তার মনের কথাটা পাঠ করা হয়নি তোর।

যথা?

এখন আর তার কথা তুলে লাভ নেই—কারণ সেই বিশেষ ব্যক্তিটির কথাগুলো না শোনা থাকলে তার কথার তাৎপর্যই হয়ত ঠিক তুই বুঝতে পারবি না। থাক সে কথা যাদের কথা তুই মন দিয়ে শুনেছিস, মানে তোর ঐ সুহাস মিত্র, বিদ্যুৎ সরকার ও কাজল বোস, তাদের সম্পর্কে তোর কি ধারণা তাই বল।

সুহাস মনে হলো সত্যিই মিত্রানীকে ভালবাসত-মিত্রানীর মৃত্যুতে সে অত্যন্ত শক পেয়েছে।

আর কাজল বোস?

বেচারী সুহাসকে সে অন্ধের মতই ভালবাসে, অথচ সুহাস মনে হলো কাজলকে সহ্যই। করতে পারে না যেন।

ঠিক। আচ্ছা আর কেউ ওদের মধ্যে মিত্রানীকে ভালবাসতো বলে তোর মনে হয়?

সে রকম কিছু তো মনে হলো না।

কিন্তু আমার মনে হলো—

কি মনে হলো তোর?

ওদের মধ্যে আরো একজন মিত্রানীকে পেতে চেয়েছিল বোধ হয়-র্যাদার হি। গুয়ানটেড টু হ্যাভ হার।

কে, কার কথা বলছিস?

সজল চক্রবর্তী-কাজেই দুজনার আকর্ষণ একজনের বিকর্ষণের মধ্যে দিয়ে একটা জটিল ত্রিকোণ গড়ে উঠেছিল হয়ত।

জটিল ত্রিকোণ!

হ্যাঁ—আকর্ষণ ও বিকর্ষণের ত্রিকোণ! আর সেই আকর্ষণ ও বিকর্ষণেরই ফল আমার মনে হচ্ছে এখন ঐ নিষ্ঠুর হত্যা। কিংবা বলা চলে ঐ আকর্ষণ বিকর্ষণের মধ্যেই মিত্রানীর নিষ্ঠুর হত্যার বীজটি রোপিত হয়েছিল। এখন কথা হচ্ছে, মিত্রানী ব্যাপারটা জানত কিনা। এবং যদি জেনে থাকত, সে কিভাবে ব্যাপারটা নিয়েছিল।

আরো একটু স্পষ্ট করে বল কিরীটী।

আপাতদৃষ্টিতে ভালবাসা ও ঘৃণা যদিও দুটি বিপরীত বস্তু-তাহলেও দেখা যায়, ভালবাসা থেকে যেমন ঘৃণার জন্ম হতে পারে, তেমনি ঘৃণারও পিছনে অনেক সময় অবচেতন মনে থাকে ঐ ভালবাসাই। এখন কথা হচ্ছে দুজনের ভালবাসাই শেষ পর্যন্ত ভালবাসাই ছিল, না ক্রমশ একদিন ঘৃণায় পর্যবসিত হয়েছিল। অথবা প্রথম থেকেই জন্ম নিয়েছিল ঘৃণা এবং সেই ঘৃণাই হয়েছিল ভালবাসা! পরস্পর-বিরোধী দুটি বস্তু ভালবাসা ও ঘৃণা। তাই প্রথমটায় মিত্রানীর হত্যার ব্যাপারটা যতটা কঠিন বা জটিল ভাবিনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বেশ জটিল।

মনে হচ্ছে হত্যাকারী তোর কাছে এখন খুব একটা অস্পষ্ট নেই।

অস্পষ্ট না থাকলেও এখনো খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। সুহাস মিত্রের কথা যদি সত্য হয়, কাকে সে সেদিন দেখেছিল কিছুদূরে মুখে চাপদাড়ি, চোখে রঙিন চশমা, মাথায় বেতের টুপি, পরনে কালো প্যান্ট ও স্ট্রাইপ দেওয়া হাওয়াই শার্ট, হাতে বায়নাকুলার এবং যে বায়নাকুলার ও বেতের টুপি অকুস্থলে পাওয়া গিয়েছে সেগুলোর সঙ্গে সেই ব্যক্তির কোন সম্পর্ক আছে কিনা! তোর কি মনে হয়? সম্পর্ক আছে?

যদি থাকেই তো ব্যাপারটা ঠিক মেলাতে পারছি না—বেতের টুপিটা মাথা থেকে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে হয়ত উড়ে যেতে পারে, কিন্তু বায়নাকুলারটি—সেটা—সেটাই বা ওখানে, মানে ঐ স্পটে এলো কি করে? ব্যাপারটা কি একটা অসাবধানতা না ইচ্ছাকৃত, অসাবধানতা হওয়া এক্ষেত্রে উচিত নয়, আর ইচ্ছাকৃত যদি হয়েই থাকে তাহলে

নিজের অপরাধের দায়িত্বটা কারো কাধে চাপানোর ইচ্ছা ছিল হয়ত তার।

ঠিক, কিন্তু কার কাঁধে—কিরীটী কথাগুলো বলতে বলতেই যেন কেমন চুপ করে যায়।

গাড়ি তখন রেড রোড ধরে ছুটে চলেছে।

হু-হু করে গাড়ির খোলা জানালা পথে হাওয়া ঢুকছে।

কিরীটীর গলার স্বর আবার শোনা যায়, প্রবাবিলিটি মোটিভ কাকে সব চাইতে বেশী ফিট ইন করে—

তোর কি তাহলে স্থির ধারণা কিরীটী—ওদেরই মধ্যে একজন

আগে সন্দেহ থাকলেও এখন সন্দেহ মাত্র নেই সুব্রত—ওয়ান অফ দেম-হ্যাঁ, ওদেরই মধ্যে একজন।

কে?

কে তা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না বটে সুব্রত এবং মণিমঃ ও, ক্ষিতীশ চাকী, অমিয় রায়, সতী সান্যাল ও পাপিয়া চক্রবর্তীকে আমি বাদ দিয়েছি–এবং ওদের বাদ দেওয়ার কারণও আমি আজই ব্যাখ্যা করেছি, শুনেছিস–

হ্যাঁ–তাহলে—বাকী তিনজনের মধ্যেই—

তিনজন তো ঠিক নয়!

তবে?

বল চারজন—বিদ্যুৎ সরকার, সুহাস মিত্র, কাজল বোস আর–

আর আবার কে? তুমি কি তাহলে সজল চক্রবর্তীকেও ঐ লিস্টে ফেলতে চাও? কিন্তু সে তো ঐ দিন কলকাতাতেই ছিল না—ভোরের প্লেনেই ফ্লাই করে চলে গিয়েছিল।

জানি, তবে সেটা এলিবিও হতে পারে–কিন্তু আমি ঠিক এই মুহূর্তে তার কথা ভাবছি না—ভাবছি সেই মুখে চাপদাড়ি, রঙিন চশমা চোখে, মাথায় বেতের টুপি, পরনে কালো প্যান্ট ও স্ট্রাইপ দেওয়া হাওয়াই শার্ট ও গলায় বা হাতে বায়নাকুলার–যাকে সুহাস মিত্র দেখেছিল–কিরীটী একটু থেমে যেন বলতে লাগল—

কে? কে সে? তার উপস্থিতিটা ঐদিন একটা নিছক ঘটনাই, না উদ্দেশ্য প্রণোদিত—

তোর মাথায় দেখছি ঐ অজ্ঞাত ব্যক্তিটির ভূত চেপেছে!

ভূত নয় সুব্রত ভূত নয়, আমার মন বলছে–মিত্রানীর ঐ ত্রিকোণের সঙ্গে কথাও ঐ মুখে চাপদাড়ি, রঙিন চশমাধারীর অদৃশ্য যোগাযোগ রয়েছে-হয়ত বা রহস্যের সেই নিউক্লিয়াস।

গাড়িটা ঐ সময় ধীরে ধীরে থেমে গেল।

কিরীটী আর সুব্রত দেখলো, গাড়ি বাড়ির দরজায় পৌঁছে গিয়েছে।

১৩. পরের দিন ভোরবেলাতেই

পরের দিন ভোরবেলাতেই কিরীটী মিত্রানীদের ওখানে গিয়ে হাজির হলো। গতরাত থেকেই তার মনে হয়েছে মিত্রানীর ঘরটা একবার তার দেখা দরকার।

দোতলায় উঠতেই মাস্টারমশাই অবিনাশ ঘোষালের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। অবিনাশ ঘোষাল বারান্দায় পায়চারি করছিলেন।

কিরীটী—

মাস্টারমশায় আমি একবার মিত্রানীর ঘরটা দেখবো বলে এলাম।

বেশ তো। যাও–ঐ যে সামনের ঘরটাই, দরজা ভেজানো আছে মাত্র, সে চলে যাওয়ার পর থেকে কেউ আর ঐ ঘরে ঢোকেনি। কিরীটী—

বলুন মাস্টারমশাই–

তুমি তো আজন্ম জটিল রহস্যের মীমাংসা করছো। জীবনে অনেক গর্হিততম অপরাধের সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে

হ্যাঁ  মাস্টারমশাই—আমাদের চারপাশের মানুষগুলো যাদের আমরা নিত্য দেখি—যাদের সঙ্গে হয়ত কথা বলি, হৃদ্যতা করি, ভালবাসি–তাদেরই মধ্যে কেউ কেউ ঘৃণ্যতম অপরাধে যখন চিহ্নিত হয়, আমরা বিস্মিত হই, আঘাত পাই–কিন্তু বিচার করে দেখতে গেলে আঘাত পেলেও বিস্ময়ের তো কিছু নেই মাস্টারমশাই–

নেই বলছো?

না, কারণ আমাদের পরিচয় মানুষের বাইরের জগতের সঙ্গেই তার মনোজগতের বিশেষ করে অবচেতন মনের খবর আমরা কিছুই তো পাই না। সেখানে কার মন কোন পথে চলেছে, কোন জটিল আবর্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সেটির সংবাদ তো আমরা পাই না। এই মুহূর্তে আমার মনের কথাটা কি আপনার জানা সম্ভব।

ঠিক-ঠিক বলেছো কিরীটী—নচেৎ একজাকে হত্যা করে তার দেহের উপরে জঘন্য কুৎসিত অত্যাচার

আপনি—আপনি কি করে জানলেন কথাটা মাস্টারমশাই?

জেনেছি কিরীটী, প্রণবেশই আমাকে বলছিল।

ঐ মুহূর্তে কিরীটী অবিনাশ ঘোষালের কথাটার জবাব না দিতে পারলেও পরে দিয়েছিল।

কিরীটী চুপ করে থাকে এবং কিরীটীকে চুপ করে থাকতে দেখে অবিনাশ ঘোষাল বললেন, মিতা মাকে আমি আর ফিরে পাব না জানি কিন্তু তুমি যদি সেই পিশাচটাকে ধরতে পার– তাকে ক্ষমা করো না–ক্ষমা করো না কিরীটী–

কিরীটী এবারেও অবিনাশ ঘোষালের কথার জবাব দিল না–কেবল বললে, মিত্রানীর ঘরটা একবার আমি দেখে আসি মাস্টারমশাই—

অবিনাশ ঘোষাল আর কোন কথা বললেন না। বাইরের দিকে তাকিয়ে বোধ হয় প্রাণপণে নিজের বুকের অস্থিরতাটাকে দমন করবার চেষ্টা করতে লাগলেন।

কিরীটী আর একবার সেই শোকে-দুঃখে মুহ্যমান মানুষটির দিকে তাকিয়ে নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল দরজার কপাট ঠেলে।

ঘরের জানালাগুলো বন্ধ ছিল। গোটা দুই জানালা খুলে দিতেই দিনের আলো অন্ধকার ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল। নিঃশব্দে একবার চারিদিকে দৃষ্টিপাত করতেই সিংগল খাটটার প্রায় কাছাকাছি, লেখাপড়ার টেবিলটার পাশে একটা ত্রিকোণ বুক-সেলফের প্রতি তার নজর পড়ল। থমকে যেন দাঁড়াল কিরীটী।

ত্রিকোণ বুক-সেলফটার উপরে একটা সুদৃশ্য ধূপধার–তার পাশেই একটি কারুকার্যখচিত ফটো-ফ্রেমের মধ্যে মিত্রানীর ফটো। মিত্রানী তারই দিকে চেয়ে যেন মৃদু মৃদু হাসছে।

কয়েকদিন আগেও মেয়েটি জীবিত ছিল–আজ আর নেই। অতীব নিষ্ঠুরভাবে একটা সাদা সিল্কের রুমাল পাকিয়ে তারই সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে।

রুমালটার কোণে সবুজ সুতো দিয়ে লেখা ইংরাজী অক্ষর টি। মনে পড়ছে ঐ সঙ্গে এক তরুণীর বুকভরা ভালবাসার উপহার তারই প্রেমাস্পদকে। কাজল বোসের দেওয়া উপহার সুহাস মিত্রকে, সুহাস মিত্র নাকি পিকনিকের—অর্থাৎ ঐ দুর্ঘটনার দিন দুই আগে কোথায় হারিয়ে ফেলে।

সুহাস মিত্র কি সত্য কথা বলেছে! যদি সত্যিই বলে থাকে তো রুমালটা হত্যাকারীর হাতে কিভাবে গেল!

তবে কি—তবে কি হত্যাকারী ইচ্ছা করেই রুমালটা চুরি করেছিল? হত্যা করবার জন্য তো সে অন্য কোন রুমালও ব্যবহার করতে পারত। এই বিশেষ রুমালটিরই বা তার প্রয়োজন হলো কেন! একটি—একটিমাত্র কারণই থাকতে পারে তার, হত্যাকারী চেয়েছিল যাতে করে মিত্রানীর হত্যার সন্দেহটা সুহাস মিত্রের উপরে গিয়ে পড়ে।

কিরীটী মনে মনে হাসে। হত্যাকারী তার পরিকল্পনা মত মিত্রানীকে যে কারণেই হোক হত্যা করতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে যেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং যেটা সে কিরীটীর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণকে এড়িয়ে যেতে পারে নি, হত্যাকারী বাইরের বা সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ নয়—সে এমন একজন যার কেবল সুহাস মিত্রের বাড়িতে অবাধ গতিবিধি ছিল তাই নয় সে সুহাসদের অনেক কথাই জানত, ওদের সকলকার ভিতরের খবর এবং সেটা একমাত্র জানা সম্ভব ছিল ঐ নয়জনেরই—হ্যাঁ, সেইখানেই কিরীটী নিঃসন্দেহ ওদের মধ্যেই কেউ একজন হত্যাকারী। গত রাত থেকেই কিরীটীর মনের মধ্যে বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। প্রবাবিলিটি, চান্স ও মোটিভের দিক থেকে ঐ নয়জনের মধ্যে কার উপরে বেশী সন্দেহ পড়ে!

কে? কে? দলের প্রত্যেকেই এক-একজন করে তার মনের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। গতকাল। আর তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিজেকে নিজে একটার পর একটা প্রশ্ন করে গিয়েছে কিরীটী।

পারে নি–এখনো পারেনি শক্ত মুঠোর মধ্যে একজনকে ধরতে।

পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল টেবিলটার সামনে কিরীটী। নানা ধরনের বই খাতাপত্র— বোঝা যায় রীতিমত পড়ুয়া ছিল মেয়েটি। খাতা বই ড্রয়ার প্রভৃতি ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ একটা মোটা সুদৃশ্য সবুজ মলাটের খাতা কিরীটীর হাতে এলো।

খাতার কয়েকটা পাতা উল্টোতেই কিরীটী বুঝতে পারল সেটা একটা ডাইরী। মুক্তার মত সুন্দর হাতের লেখা—পাতার পর পাতা লেখা। প্রথম দিকে বিশেষ কোন তারিখ নেই, যাও আছে দীর্ঘদিনের ব্যবধানে—কিন্তু শেষের দিকে তারিখগুলো দেওয়া আছে। একেবারে শেষ পাতার তারিখটার দিকে তাকিয়ে যেন চমকে ওঠে কিরীটী—

১০ই মে, বুধবার, রাত দশটা পঞ্চান্ন, আজ সজল হঠাৎ সকালে এসে হাজির। আশ্চর্য হইনি কিছুসজল যে একদিন আসবে জানতাম এবং সে যে প্রস্তাব করবে তাও জানতাম। আমার অনুমানটি যে মিথ্যা নয় সেটাই প্রমাণিত হলো। তার প্রশ্নের জবাবে বলতে বাধ্য হলাম তার প্রস্তাব আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আমি অন্যের বাগদত্তা কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে বললাম, মন জানাজানির পালা এখনো চলেছে। ভাবছি বলে দিলেই হতো স্পষ্ট করে, সুহাসের প্রতীক্ষায় আমি আজও আছি—তার কাছেই আমি বাগদত্তা।

ও যখন চলে যায় ওর মুখের দিকে তাকাতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু ঐ ভাবে আমাকে পীড়াপীড়ি না করলে আজ ওর কাছে যতটুকু বলেছি সেটুকুও কখনো কারো কাছে প্রকাশ করতাম না।

কিরীটী পড়ে চলে।

ঐ পর্যন্ত ঐ পাতায়। তার পরের পাতায় একেপাশে কেবল তারিখ দেওয়া আর লেখা রাত্রি, ১৩ই মে, শনিবার।

পরশুদিন সুহাস ফোন করেছিল-সকালে। সে তো কখনো আমাকে আজ পর্যন্ত ফোন করেনি–এই তার আমাকে প্রথম ফোন।

মিত্রানী—

বল।

বলছিলাম—মানে সজল কি তোমাকে কিছু বলেছে?

বুঝতে পারলাম না সুহাসকে কি জবাব দেবো, সজল গতকাল আমাকে যে কথাটা বলেছিল, সেটা কি কাউকে বলা ঠিক হবে!

চুপ করে আছ কেন মিত্রানী, সজল তোমাকে কিছু বলেছিল?

বললাম, না—মানে বলছিলাম হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?

সুহাস আবারও তার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলো, বল না সজল তোমাকে কিছু বলেনি?

বললাম—হ্যাঁ, মিথ্যাই বললাম—না তো, সেরকম কিছু তো আমার মনে পড়ছে না সুহাস, তবে কি ঠিক তুমি জানতে চাও যদি বলতে–

আশ্চর্য-তারপরই তার প্রশ্ন : আচ্ছা মিত্রানী, সজল কি তোমাকে বলেছিল, সে তোমাকে ভালবাসে—সে তোমাকে বিয়ে করতে চায়? তার জবাবে তাকে তুমি বলেছিলে তা সম্ভব নয়—কারণ তুমি অন্য একজনকে ভালবাস?

জিজ্ঞাসা করলাম, সজল তোমাকে ঐ কথা বলেছে?

সুহাস ফোনে আবার বললে, নচেৎ আমি জানবো কি করে বল! সজলের কাছে অবিশ্যি তুমি তার নামটা বলোনি—এড়িয়ে গেছে, কিন্তু আমাকে তুমি বলতে পার কে সে–আমাদের মধ্যেই কেউ কি–

আশ্চর্য! এরপর আর কি বলতে পারি—বললাম, কি হবে নামটা জেনে তোমার?

তবু সে পীড়াপীড়ি করতে লাগল—আমি চুপ করে রইলাম। আশ্চর্য, সত্যিই কি আজো বুঝতে পারেনি সুহাস কোথায় আমার মনটা বাঁধা পড়েছে।

ফোনটা নামিয়ে রেখে চলে এলাম ঘর থেকে।

এর পরে মাত্র দুটি লাইন লেখা ডায়েরীর শেষ পৃষ্ঠায়। তারিখ নেই তবে পড়ে মনে হয় ঠিক পরের দিনই বিকেলের দিকে আবার সজল এসেছিল—-

সজল এসেছিল—

যাক, সজলের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, সজল বোধ হয় শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা সহজ ভাবেই নিয়েছে। সজল বললে সে চায় পুরাতন বন্ধু-বান্ধবরা সকলে মিলে–বিদ্যুৎকে সে নাকি কথাটা বলেছে। যাবার আগে সজল একটা অদ্ভুত ব্যাপার করলো–ভাবতেও হাসি পাচ্ছে। সুহাসকে ওর চোখ দিয়ে আজ আমাকে চিনতে হবে—হায় রে—

কিরীটী ডাইরাটা একপাশে রেখে আরো কিছুক্ষণ বই ও খাতাপত্র ঘাঁটলো, তারপর একসময় জানালা দুটো বন্ধ করে ঘর থেকে বের হয়ে এলো।

অবিনাশ ঘোষাল তখনো আগের মতই পায়চারি করছিলেন—

মাস্টারমশাই–

অবিনাশ ঘোষাল কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।

মাস্টারমশাই, মিত্রানীর ডাইরীটা আমি নিয়ে যাচ্ছি!

মিত্রানীর ডাইরী? অবিনাশ ঘোষাল শুধালেন।

হ্যাঁ।

কোথায় পেলে?

ওর ড্রয়ারে—

ও, আচ্ছা। যাও নিয়ে।

১৪. ডাইরীখানা নিয়ে

ডাইরীখানা নিয়ে রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর বসবার ঘরের সোফায় গিয়ে বসল কিরীটী একটা চুরেট ধরিয়ে।

বেশী দিন নয়–বৎসর খানেক আগের তারিখ থেকে ডাইরী লেখার শুরু, তাহলেও প্রথম পাতাতেই লিখেছে মিত্রানী—ডাইরা লিখতাম সেই কবে থেকে–কিন্তু মাঝখানে কয়েক বৎসর লিখিনি, লিখতে ইচ্ছাও হয়নি কিন্তু অার থেকে আবার লিখবো ভাবছি। চমৎকার ভাইরাটী পাঠিয়েছে সজল–এমন সুন্দর মরা লেদারে বাঁধানো ডাইরীটা– দেখলেই কিছু লিখতে লোভ জাগে মনে। কিন্তু কি লিখি! কাকে নিয়ে শুরু করি আমার এই ভাইরা–দৈনন্দিন জাব-কথা! ত্রিশ বৎসর বয়স হলে– অধ্যাপনা করছি। কলেজে যাই, মেয়েদের পড়াই, অবসর সময়টা বেশীর ভাগই বই নিয়ে কাটি-একা, বড় একা লাগে। মধ্যে মধ্যে মনে হয় যেন এক মরুভূমির মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি। এ যাত্রার শেষ কোথায় কে জানে?

সুহাস–সুহাস কি আজও বুঝতে পারেনি কি বুক ভরা ভালবাসা নিয়ে তারই প্রতীক্ষায় প্রহর গুনে চলেছি! যার জন্য অপেক্ষা করে আছি তার সাড়া নেই-অথচ যার কথা মনে পড়ে না ভুলেও কখনো, সে একটার পর একটা চিঠি লিখে চলেছে।

সজল, আমি বুঝি, তুমি স্পষ্ট করে না লিখলেও বুঝতে পারি, তোমার ঐ কথার গাঁথুনির ফাকে ফাকে বিশেষ কোন কথার্টি তোমার মনের মধ্যে উঁকি দিতে চাইছে।

কিন্তু আমি যে অনেক আগেই দেউলিয়া হয়ে বসে আছি। কাউকেই আর দেবার মত যে অবশিষ্ট কিছুই নেই। বাবা এতদিন পর্যন্ত কখনো আমার বিয়ের কথা বলেননি—কিন্তু গতরাত্রে বলছিলেন, একটি ভাল পাত্রের সন্ধান পেয়েছি মা–সন্ধানও ঠিক নয়, পাত্রপক্ষই এগিয়ে এসেছে, তোর যদি কোন আপত্তি না থাকে তো কথা বলতে পারি।

বললাম, না বাবা—

ছেলেটি ভাল—

আমি তোমাকে ঠিক সময়ে জানাবো বাবা।

বাবা আর কোন কথাই বললেন না। অসন্তুষ্ট হলেন কিনা কে জানে! আশ্চর্য! সুহাস, এখনো তোমার সময় হলো না!

 

কয়েক পৃষ্ঠা পরে—

বিদ্যুতের সঙ্গে সেদিন হঠাৎ দেখা–সে বললে, কেমন আছো মিত্রানী?

ভাল।

ভাবছিলাম একদিন তোমাকে ফোন করবো—

করেছিলে নাকি?

না।

করলেও কথা হতো না—আমার সাড়া পেতে না।

কেন?

ফোনটা আজ দশদিন আউট অফ অর্ডার হয়ে আছে।

বিদ্যুৎ হো হো করে হেসে উঠলো।

তা আমার কথা হঠাৎ মনে পড়লো কেন বিদ্যুৎ?

আমার নায়িকার সন্ধানে–মানে আমার পরের বইতে মনে হচ্ছিল তোমাকে চমৎকার ফিট ইন করবে।

এবার হেসে উঠলাম আমি।

হাসলে যে?

শেষ পর্যন্ত আর মেয়ে খুঁজে পেলে না? আমার কথা ভাবছিলে?

সত্যি বল না, করবে অভিনয়?

না।

কেন?

আমি বিয়ে করবো—

সে তো অভিনয় করলেও বিয়ে করা যায়–

না, স্ত্রী আর অভিনেত্রী একসঙ্গে হওয়া যায় না।

কিন্তু তোমাকে অনেক উদাহরণ দিতে পারি

পারো হয়ত, কিন্তু অভিনেত্রীদের স্বামীর ঘর–কোনদিনই স্বামীর ঘর হয়ে ওঠে না, একটার গ্ল্যামার অন্যটার শান্তসুন্দর জীবনের গলা টিপে ধরতে শুরু করে পদে। পদে–যার ফলে বিক্ষোভ-অশান্তি—তারপর—

কি তারপর?

হয় দুঃসহ এক জীবন-যন্ত্রণা—না হয় অকস্মাৎ একদিন পরিসমাপ্তি। না বিদ্যুৎ, মেয়ে। হয়ে জন্মেছি—আমি মেয়ে হয়েই বেঁচে থাকতে চাই। গৃহিণী, সন্তানের জননী–

তা বসে আছো কেন আজো?

বসে আছি পথ চেয়ে—

কার পথ চেয়ে আমার নয় তো!

না—সে নহ তুমি—সে নহ তুমি—

তবে? কে সে ভাগ্যবান মিত্রা?

আচ্ছা বিদ্যুৎ–

বল।

সুহাসের খবর কি? তার সঙ্গে দেখা হয় তোমার?

হয় কদাচিৎ কখনো। জানোই তো, নিদারুণ সিরিয়াস টাইপের ছেলে সে।

অমন ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করলো বি. এ.-তে অথচ এম. এ.-টা পড়লো না, কি এক সামান্য চাকরিতে ঢুকে গেল সাততাড়াতাড়ি।

তার সংসারের কথা তো তুমি জানো না–বাবা চাকরি করতে করতে হঠাৎ সেরিব্রাল অ্যাটাকে পঙ্গু হয়ে গিয়েছেন—দুটি বিবাহযোগ্যা বোন—একটিরও বিয়ে দিতে পারেনি, গায়ের রঙের জন্য বিয়ের বাজারে বিকোয়নি বলে তাদের পড়াচ্ছে—চাকরি করা ছাড়াও গোটা দুই টিউশনী করছে।

সত্যিই আমি জানতাম না ব্যাপারটা।

১৫. কিরীটী পাতার পর পাতা পড়ে চলে

কিরীটী পাতার পর পাতা পড়ে চলে ডাইরীর।

বাবা আর আমার বিয়ের কথা বলেননি। বলবেনও না জানি। বুঝি বাবা জানতে চান কোথায় আমার মন বাঁধা পড়েছে। কিন্তু কি বলবো তাকে? যাকে মন দিলাম তারই যে সাড়া নেই!

আজ হঠাৎ সুহাসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল—কলেজ স্ট্রীটের একটা বইয়ের দোকানে। ও আমাকে দেখতে পায়নি—আমিই ওকে দেখতে পেয়ে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ডাকলাম, সুহাস!

চমকে ও ফিরে তাকাল, মিত্রানী—

হ্যাঁ—চিনতে পেরেছো তাহলে!

চিনতে পারবো না হঠাৎ একথা তোমার মনে হলো কেন মিত্রানী? সুহাস বললে।

মিত্রানীকে মনে আছে আজো তোমার?

প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসলো সুহাস। কোন কথা বললো না।

বই কেনা হলো?

না।

কেন?

টাকা নেই।

আমার কাছে আছে নাও না, দেবো?

না। ধন্যবাদ।

নিতে বাধা আছে বুঝি?

তা নয়–

তবে?

পাওয়াটা যেখানে সুনিশ্চিত, সেখানে হাত বাড়ানোর মধ্যে যে কতখানি লজ্জা–থাক, সে তুমি বুঝবে না।

তা তুমি এখানে এসেছিলে কোন নতুন বই কিনতে বুঝি?

হ্যাঁ—এসেছিলাম কিন্তু বইটা আসেনি এখনো।

দুজনে একসঙ্গে দোকান থেকে বের হয়ে এলাম। পাশাপাশি হেঁটে চলেছি—সন্ধ্যা হয়ে গেলেও ঐখানে তখনো বেশ ভিড়।

কফি খাবে সুহাস?

মন্দ কি, চলো।

দুজনে গিয়ে কফি হাউসে ঢুকলাম।

কতদিন পরে আবার কফি হাউসে এলাম।

কফি হাউসটা তখন গমগম করছে। এক কোণে কয়েকজন কলেজেরই ছাত্রছাত্রী মনে হলো, একটা টেবিলে বসে জোর গলায় তর্কাতর্কি করছে। কোনমতে একটা নিরিবিলি টেবিলে গিয়ে দুজনে মুখোমুখি বসলাম। কফির অর্ডার দিলাম।

বললাম, বেশ ছিলাম কলেজ-জীবনে, তাই না!

সুহাস হাসলো নিঃশব্দে।

বরাবরই ও কথা কম বলতো—আজ যেন মনে হলো আরো গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। কফি খেতে খেতে একসময় বললাম, আচ্ছা সুহাস, তুমি কোন কমপিটিটিভ পরীক্ষা দিলে না কেন?

দিলেও হতো না।

সজল পাস করলো, আর তুমি পারতে না?

সকলের দ্বারা তো সব কিছু হয় না মিত্রানী। যা হয়েছে তাতেই আমি খুশি। কি জানো মিত্রানী, যোগ্যতার বাইরে কখনো লোভের হাত প্রসারিত করতে হয় না। এতে করে কেবল দুঃখই বাড়ে—ওসব কথা থাক—অনেকদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে সত্যি খুব ভাল লাগছে

সত্যি বলছো?

বাঃ, মিথ্যা বলবো কেন।

তা ইচ্ছে করলেই তো মধ্যে মধ্যে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ হতে পারে—

কি হবে—তার চাইতে আজকের মত হঠাৎ দেখা হয়ে যায় যদি সেই ভাল। আকস্মিকতার যে আনন্দ আছে, নিত্যনৈমিত্তিকতার মধ্যে তা থাকে না।

সামনে শুক্রবার আমার জন্মদিন—প্রতি বছরই তোমাকে নিমন্ত্রণ করি, তুমি আসনি আজ পর্যন্ত—শুক্রবার আসবে?

গেলে তুমি খুশি হবে?

খুশির আমার অন্ত থাকবে না।

বেশ যাবো।

সত্যি বলছ?

হ্যাঁ, যাবে।

 

আজ শুক্রবার আমার জন্মদিন ছিল।

সজল আর সুহাস বাদে সবাই এসে হৈ-হৈ করে চলে গেল। সজল আসতে পারবে। জানি, সে দিল্লীতে ট্রেনিং-এ আছে–কিন্তু সুহাস কেন কথা দিয়েও কথা রাখলো না!

শেষ পর্যন্ত রাত নটা নাগাদ সুহাস এলো–হাতে একগোছা রজনীগন্ধা।

এতক্ষণে সময় হলো?

কি করি বললা, টিউশনী সেরে আসতে হলো। রাগ করেছো?

না। আজকের দিনটি টিউশনী না হয় নাই করতে।

ছেলেটার ক্ষতি হতো—সামনে তার ফাইনাল পরীক্ষা।

সুহাসকে প্লেট ভরে খাবার দিলাম—সব সে খেল। যাবার সময় আমার হাতে একটা মুখবন্ধ খাম দিয়ে বললে, পরে পড়ো।

বুকটার মধ্যে সে আমার কি ধুকপুকুনি। সুহাস চলে যাবার পর কম্পিত হাতে খামটা খুললাম। এক টুকরো সাদা কাগজে লেখা–রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন :

স্বপন-পারের ডাক শুনেছি, জেগে তাই তো ভাবি
কেউ কখনো খুঁজে কি পায় স্বপ্নলোকের চাবি।।
নয়তো সেথায় যাবার তরে নয় কিছু তো পাবার তরে,
নাই কিছু তার দাবি–
বিশ্ব হতে হারিয়ে গেছে স্বপ্নলোকের চাবি।।

গানটা আমার জানা। গুনগুনিয়ে উঠল যেন সুর আর কথাগুলো আমার বুকের মধ্যে।

চাওয়া-পাওয়ার বুকের ভিতর না-পাওয়া ফুল ফোটে,
দিশেহারা গন্ধে তারি আকাশ ভরে ওঠে।

রাত্রি বারোটা–আমার জন্মদিন। ঘুম কেন আসছে না চোখে–সুহাস-সুহাস–

১৬. দিন দুই আর কিরীটী কোথাও বেরই হলো না

দিন দুই আর কিরীটী কোথাও বেরই হলো না। মিত্রানীর হত্যারহস্যটা যেন ক্রমশ জট পাকিয়ে পাকিয়ে জটিল হতে জটিলতর হয়ে উঠছে। সূত্রগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

ফোন এলে পর্যন্ত কিরীটী ফোন ধরে না। ফোনে কেউ ডাকলেও সাড়া দেয় না।

সারাদিন প্রচণ্ড গরমের পর কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে কয়েক ফোঁটা। বৃষ্টি হওয়ায় প্রখর তাপ-দাহ কিছুটা কমেছে।

কৃষ্ণা একটা সোফার ওপরে বসে একটা বই পড়ছে আর কিরীটী সোফার গায়ে হেলান দিয়ে সামনের ছোট টেবিলটার ওপর পা দুটো তুলে দিয়ে চোখ বুজে পড়ে আছে।

বই পড়লেও কৃষার মনটা বইয়ের পাতার মধ্যে ঠিক ছিল না——সে মধ্যে মধ্যে চোখ তুলে স্বামীর দিকে তাকাচ্ছিল।

বুঝতে পারছিল কৃষ, মিত্রানীর মৃত্যুরহস্যের কোন সমাধানে কিরীটী পৌঁছতে পারেনি—তাই তার ঐ নিঃশব্দতা। বাইরের চেহারাটা যতই শান্ত হোক, ভিতরে ভিতরে তার একটা অস্থির আলোড়ন চলেছে।

চা খাবে? কৃষ্ণা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললে।

চা!

হ্যাঁ, চা করে আনি—

নিয়ে এসো!

কৃষ্ণা একপাশে বইটা রেখে ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই একটু পরে সুব্রত এসে ঘরে ঢুকল দরজা ঠেলে।

সুব্রতকে ঘরে ঢুকতে দেখে কিরীটী ওর দিকে তাকাল চোখ তুলে—আচ্ছা সুব্রত।

কি?

মিত্রানী সেদিন অকস্মাৎ আক্রান্ত হবার পর নিশ্চয়ই চিৎকার করে উঠেছিল–

সেটাই তো স্বাভাবিক মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শেষ প্রতিরোধ যেমন মানুষ করে তেমনি শেষ একটা ভয়ার্ত চিৎকারও সে করে ওঠে।

তাহলে—

কি তাহলে?

কাজল বোস নিশ্চয়ই সে চিৎকার শুনেছিল—

কাজল বোস!

হ্যাঁ, সে যে ঠিক সেই মুহূর্তে মিত্রানী ও আক্রান্তকারীর আশেপাশেই ছিল সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ—আর তার প্রমাণ হচ্ছে কাজলেরই ভাঙা চুড়ির কয়েকটি টুকরো মৃতদেহের অনতিদূরে, যেগুলো সুশীল নন্দী পরের দিন কুড়িয়ে পেয়েছেন। কাজল বোস আমাদের কাছে সে কথা চেপে গিয়েছে কিন্তু কেন? হোয়াট ইজ হার মোটিভ বিহাইন্ড? কি উদ্দেশ্যে?

হয়ত হত্যার ব্যাপারে জড়িয়ে যাবার ভয়ে সে মুখ খোলেনি—

হতে পারে—তবে এও হতে পারে–সে কাউকে শিল্ড করবার চেষ্টা করছে।

তোমার তাই মনে হয়?

অনুমান—অনুমান মাত্র আমার—

অসম্ভব নয় হয়তো, কিন্তু সে কে। কাকে সে আড়াল করার চেষ্টা করছে–

কাজল বোসের একমাত্র ইন্টারেস্ট সুহাস মিত্র তার প্রেমাস্পদ—কিন্তু ঐখানেই। আমার যোগফলটা মিলছে না সুব্রত

কিন্তু সুহাসই যদি হত্যা করে থাকে মিত্রানীকে—একটা বলিষ্ঠ অ্যাথলেট মানুষ

ঠিক, ঠিক। কিন্তু সে সত্যিই ভালবাসতো মিত্রানীকে। যোগফলটা ঐখানেই বিয়োগফলে দাঁড়াচ্ছে। দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ হয়ে চার হচ্ছে না—দুই থেকে বাদ গিয়ে

শূন্য দাঁড়াচ্ছে। না—ঠিক মিলছে না।

সুব্রত বললে, তবে আর কে হতে পারে?

কেন, বিদ্যুৎ সরকার—

বিদ্যুৎ সরকার–

হ্যাঁ, তুই ভেবে দেখ—বিদ্যুৎ সরকারই সুহাসকে প্রথম আবিষ্কার করেছিল। এবং সুহাস যেখানে গাছের ডাল চাপা পড়েছিল তারই কাছাকাছি মিত্রানীর মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হয়—আর বিদ্যুৎই সেটা দেখতে পায় প্রথম। একমাত্র ঐ বিদ্যুৎ সরকারেরই যোগাযোগ ছিল মিত্রানীর সঙ্গে–

কিন্তু তাকে তো তুই প্রথম থেকেই বাদ দিয়েছিস—

কিরীটী বললে, দিয়েছি ঠিকই কিন্তু যুক্তিরও সেটাই শেষ কথা নয়—হতেও পারে না তা।

কৃষ্ণা ঐ সময় দুকাপ চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললে, কখন এলে?

এই–

কিরীটী ও সুব্রতর দিকে দুকাপ চা এগিয়ে দিল কৃষ্ণা।

তুমি খাবে না? সুব্রত শুধায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।

তোমার জুতোর শব্দ আমি পেয়েছিলাম, কৃষ্ণা হাসতে হাসতে বললে, আর এক কাপ তৈরী করেছি, তোমরা শুরু কর, আমারটা আমি নিয়ে আসছি—

কিছুক্ষণ পরে, তখনো চায়ের কাপ কারো নিঃশেষ হয়নি–

সুব্রত এক সময় বললে, তোর কথায় মনে হচ্ছে কিরীটী, সুহাস মিত্র আর কাজল বোস মিত্রানীর হত্যারহস্যের মধ্যে বেশ জটিলভাবে জড়িয়ে আছে—যেহেতু ওরা দুর্ঘটনাটা যখন ঘটে তখন খুবই কাছাকাছি ছিল—

শুধু তাই নয় সুব্রত।

তবে—

সুহাসকে মিত্রানী যেমন ভালবাসত, সুহাসও তেমনি ভালবাসত মিত্রানীকে। সেদিক থেকে একমাত্র সুহাসের প্রতি কিছুটা যে সন্দেহ জাগে না তা নয় কিন্তু মজা হচ্ছে কেউ কাউকে সে কথাটা ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয়নি কিন্তু কেন? পরস্পরকে পরস্পরের ভালবাসা জানাবার সত্যিই কি কোথায়ও বাধা ছিল?

কৃষ্ণা বললে, হয়ত কোন তৃতীয় ব্যক্তি সজল চক্রবর্তীর মত মিত্রানীর দিক থেকে যেমন ছিল—সুহাসের দিক থেকেও তেমনি ছিল—

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকাল, আশ্চর্য কৃষ্ণা, ঐ। কথাটা তো একবারও আমার মনে হয়নি—ঠিক—তৃতীয় ব্যক্তি—তৃতীয় ব্যক্তি…

সুব্রত বললে, মিত্রানীর ব্যাপারে না হয় সজল চক্রবর্তী ছিল কিন্তু সুহাসের বেলায় : কে ছিল তবে?

কৃষ্ণা শান্ত গলায় বললে, তোমার ঐ প্রশ্নের জবাব একমাত্র একজনই দিতে বোধ হয় পারে

কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, তুমি বোধ হয় সুহাসের কথা বলছে কৃষ্ণা!

হ্যাঁ—

জংলী এসে ঐ সময় ঘরে ঢুকল।

বাবু—

জংলীর দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণা বললে, কে এসেছে?

সুহাসবাবু বলে এক ভদ্রলোক।

কৃষ্ণা হেসে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললে, যাক-দেখো মেঘ না চাইতেই জল স্বয়ং এসে হাজির একেবারে তোমার দরজায়।

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এখন জলটা ভালো ভাবে বর্ষিত হলেই হয়। এই জংলী যা, বাবুকে এই ঘরে নিয়ে আয়—

কৃষ্ণা উঠে দাঁড়াল-সুব্রত, রাত্রে এখানে তুমি খেয়ে যাবে কিন্তু—

ঠিক আছে। সুব্রত জবাব দেয়।

কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে যাবার একটু পরেই সুহাস মিত্র এসে কিরীটীর ঘরে ঢুকল।

আসুন সুহাসবাবু—একটু আগে আপনার কথাই ভাবছিলাম।

সুহাস মিত্র বসতে বসতে বললে, জানি কেন ভাবছিলেন।

জানেন? কথাটা বলে কিরীটী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুহাস মিত্রের মুখের দিকে তাকাল!

হ্যাঁ—আমি সেদিন আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বাড়িতে ফেরা অবধি একটি কথাই ভেবেছি—আপনার কাছে তো অজ্ঞাত কিছুই থাকবে না কিরীটীবাবু, পেটের কথা আপনি ঠিকই বের করবেন, তার চাইতে যা সেদিন বলতে পারিনি—ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, সেটা আপনার কাছে প্রকাশ করে দেওয়াই ভাল। কিন্তু তাহলেও বলবো। কিরীটীবাবু, সত্যি কথা বলতে কি ব্যাপারটা এখনো আমার কাছে যেন খুব একটা তেমন স্পষ্ট নয়—হয়ত সেই ঝড়ের শব্দের মধ্যে ভুল শুনেছি—

আমার অনুমান আপনি সেদিন কিছু শুনে থাকলে ভুল শোনেননি ঠিকই শুনেছেন, বলুন এবারে ব্যাপারটা কি!

সুহাস মিত্র বলতে লাগল,ঝড় আর ধুলোর ঘূর্ণির অন্ধকারের মধ্যে প্রথমটা আচমকা এমন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম যে, কোথায় কোন্ দিকে এগোচ্ছি বুঝতেই পারছিলাম না—তাছাড়া ঐ সময় আমার চোখ থেকে চশমাটা হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ায় কোথায় ছিটকে পড়ে গিয়েছিল।

হুঁ, সেদিন আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় আপনার চোখে চশমা দেখে সত্যিই একটু খটকা লেগেছিল এবং আপনার চশমার লেন্সের দিকে তাকিয়েই বুঝেছিলাম একটু যেন বেশীই মাইনাস পাওয়ারের চশমা আপনার—অথচ সুশীল নন্দীর রিপোর্টে আপনার চশমার কথা কিছুই ছিল না। ভেবেছিলাম হয়তো সেটা সুশীল নন্দীর আপনার বর্ণনায় একটা সাধারণ অমিশন মাত্র।

না—চশমা ছাড়াই আমি থানায় গিয়েছিলাম—যদিও দূরের সব কিছু দেখতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল।

চোখ কি আপনার অনেক দিন থেকেই খারাপ?

হ্যাঁ—ছোটবেলার একটা ইনজুরির জন্য বাঁ চোখের দৃষ্টিটা বরাবরই কিছুটা খারাপ ছিল—ডান চোখেও হায়ার সেকেন্ডারি দেবার আগে থাকতেই চোখের এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে দৃষ্টিশক্তির বিপর্যয় শুরু হয়—মানে দু চোখের দৃষ্টিই ক্ষীণ হয়ে আসে।

কি রোগ?

গ্র্যাজুয়াল অপটিক নার্ভ অ্যাট্রোফি—ডান চোখের দৃষ্টিবাহী স্নায়ু আমার ক্রমশ শুকিয়ে আসছে, সঙ্গে সঙ্গে বাঁ চোখটাও আরও দুর্বল হয়ে আসছে—অনেকেই জানত না সে কথাটা—বি. এ.-তে ভাল রেজাল্ট করা সত্ত্বেও যে আমি আই. এ. এস. দিই না এটাই ছিল তার মুখ্য কারণ, মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেট আমি পেতাম না। অবিশ্যি বন্ধুবান্ধবরা ধরে নিয়েছিল আমার আত্মবিশ্বাসের অভাব-ভীরুতা——কেউ বলেছে এসকেপিস্ট মেন্টালিটি—কাউকেই মুখ ফুটে আমি তবু বলতে পারিনি—আমার জীবনটাই ড়ুমড়—একদিন একটু একটু করে দুচোখের দৃষ্টির উপরে চিরঅন্ধকার নেমে আসবে—অন্ধকার—ছেদহীন অন্ধকার।

সুহাস মিত্রর গলাটা যেন শেষের দিকে রুদ্ধ হয়ে এলো।

সুহাস মিত্র একটু যেন থেমে বলতে লাগল আবার,ভগবানই যে আমার জীবনের অগ্রগতির পথে কাঁটা দিয়ে সব শেষ করে দিয়েছেন

আর কাউকে না বলেছিলেন না বলেছিলেন সুহাসবাবু, মিত্রানীকে কেন বললেন না কথাটা, কিরীটী শান্ত গলায় বললে।

কি হতো বলে কথাটা তাকে কিরীটীবাবু, কেবল দুঃখই দেওয়া হতো তাকে—মিত্রানী যে কি গভীর ভালবাসত আমায় আমি কি তা জানতাম না কিরীটীবাবু, জানতাম, আর জানতাম বলেই কখনো তার ডাকে সাড়া দিইনি ভেবেছি আমার নীরবতায় যদি ক্রমশ একটু একটু করে মনটা তার অন্যদিকে ঘুরে যায়—তাই যাক।

সুহাসবাবু, সত্যিকারের ভালবাসা কি অত সহজে ভিন্নমুখী হয়? হয় না—

আগে সে কথাটা একবারও মনে হয়নি—কিন্তু মিত্রানীর মৃত্যুর পর কেবলই কি মনে হচ্ছে জানেন?

কি?

সেদিন আমাকেই হয়ত যদি সে ধুলোর ঘূর্ণি ও ঝড়ের মধ্যে অন্ধকারে খুঁজতে খুঁজতে পাগলের মত না হয়ে উঠতো তবে হয়ত অমন করে আমার কাছে থেকেই মৃত্যুকে বরণ করতে হতো না—আমার সবচাইতে বড় দুঃখ কি জানেন কিরীটীবাবু, সে জানতেও পারেনি ঐ মুহূর্তে তার অত কাছে থেকেও চশমা হারিয়ে আমি একপ্রকার ব্লাইন্ড–অন্ধ—আমি নিরুপায়—

উত্তেজিত কণ্ঠে কিরীটী প্রশ্ন করে, তা হলে আপনি কারো গলা বা চিৎকার শুনেছিলেন!

শুনেছিলাম—

কার—কার গলা শুনেছিলেন-চিনতে পেরেছিলেন সে কার গলা?

হ্যাঁ—

কার গলা?

মিত্রানীর গলা—

কি? কি বলেছিল সে?

কে? কে—আঃ ছাড়ো-সুহাস-সুহাস—তারপরই গোঁ গোঁ অস্পষ্ট একটা চাপা শব্দ–কিছু দেখতে পাচ্ছি না তখন তবু মরীয়া হয়ে সামনে এগুবার চেষ্টা করে দুপাও এগোয়নি—একটা গাছের ডাল এসে মাথায় হঠাৎ হুড়মুড় করে পড়ল, আমি জ্ঞান হারালাম।

আর কারো গলা আপনি শোনেননি সুহাসবাবু? কিরীটী আবার শুধাল।

১৭. মিত্রানীর হত্যা-রহস্যের একটা জট

সুহাসবাবু!

বলুন।

মিত্রানীর হত্যা-রহস্যের একটা জট আমি কিছুতেই খুলতে পারছিলাম না— আপনার স্বীকারোক্তি সেই জটটা খুলে দিল। আচ্ছা সুহাসবাবু, একটা কথা

বলুন—

মিত্রানীর প্রতি সজলবাবু যে আকৃষ্ট ছিলেন সে কথাটা কি আপনি বুঝতে পেরেছিলেন কখনো?

জানতাম–

জানতেন? কি করে জানলেন?

বিদ্যুৎ একদিন আমাকে বলেছিল—

বিদ্যুৎবাবু আপনাকে কথাটা বলেছিলেন?

হ্যাঁ। কথাটা শুনে আমি, বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু, সুখীই হয়েছিলাম। সজল জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—মিত্রানীকে সে বিয়ে করলে মিত্রানী সুখীই হবে। এ

আচ্ছা ঐ দুর্ঘটনার আগে এবং গার্ডেনে সকলে মিলিত হবার পূর্বে শেষ কার কার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল বন্ধুদের মধ্যে?

সকালে বাড়িতে এসেছিল সজল এবং বিদ্যুৎ—সে এসেছিল অফিসে আমায় পিকনিকের কথাটা জানাতে পরের দিন দুপুরে।

ভাল কথা, কিরীটী বললে, দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল—১৪ মে, শনিবার—তাই না?

হ্যাঁ, তারিখটা আমার চিরকাল মনে থাকবে কিরীটীবাবু।

তারপর একটু থেমে বললে সুহাস, সেদিনটা—সরকারী এবং বেসরকারী অফিস সব বন্ধ ছিল–তাই তো শনিবার পিকনিকের জন্য স্থির করেছিল বিদ্যুৎ

আচ্ছা বৃহস্পতিবার সকালের দিকে আপনি মিত্রানীকে ফোন করেছিলেন!

আমি মিত্রানীকে ফোন করেছি—কে বললে একথা!

মিত্রানীর ডাইরীতেই কথাটা লেখা আছে—

মিত্রানী তার ডাইরীতে লিখেছে, আমি বৃহস্পতিবার সকালে তাকে ফোন করেছিলাম?

হ্যাঁ—

আশ্চর্য! আমি তাকে জীবনে কখনো ফোন করিনি—

আপনি জানতেন তার বাড়িতে ফোন ছিল?

জানতাম বৈকি।

কি করে জানলেন?

মিত্রানীই কলেজে একদিন আমাকে কথাটা বলেছিল।

তাহলে ১২ই মে সকালে আপনি মিত্রানীকে ফোন করেননি সুহাসবাবু?

না।

সকাল সাতটা থেকে আটটার মধ্যে সেদিন আপনি কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন?

দোতলায় আমাদের বাসাবাড়ির বাড়িওয়ালার ছেলেকে পড়াচ্ছিলাম। মঙ্গল, বৃহস্পতি হপ্তায় দুদিন তাকে আমি পড়াই কিন্তু সত্যিই অবাক লাগছে, মিত্রানী তার ডায়েরীতে ঐ কথা লিখলো কেন? মিত্রানী তো কখনো মিথ্যা বলতো না—

হয়ত এমনও হতে পারে—

কি?

আপনার নাম করে অন্য কেউ তাকে ফোন করেছিল?

কিন্তু তাই বা কেউ করতে যাবে কেন?

আপনার ঐ প্রশ্নের জবাব হয়ত কয়েক দিনের মধ্যেই আমি দিতে পারবো সুহাসবাবু —কারণ অন্ধকার অনেকটা কেটে গিয়েছে–

কি বলছেন আপনি আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কিরীটীবাবু—

কিরীটী হেসে বললে, কথামালা পড়েছিলেন ছোটবেলায়?

পড়েছি—

কথামালায় সেই নীলবর্ণ শৃগালের গল্পটা নিশ্চয়ই মনে আছে?

আছে—

শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। ধোপার গামলায় পড়ে সেই ধূর্ত শৃগালের গায়ে যে রং লেগেছিল–তার সেই নীলবর্ণ বনের অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারদের মনের মধ্যে প্রথমটায় একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করলেও অনতিকাল পরে অকস্মাৎ দৈবচক্রে তার কণ্ঠের চিরাচরিত হুক্কাহুয়া ধ্বনিই তার আসল স্বরূপটি উঘাটিত করে দিয়েছিল। তবে হ্যাঁ, ঐ শৃগালের ব্যাপারটা ছিল আকস্মিকই একটা ঘটনা মাত্র কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা আকস্মিক নয়, সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত এবং স্থির মস্তিষ্কের কাজ।

কতকটা বোকার মতই যেন সুহাস কেমন অসহায় ভাবে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে।

কিরীটী স্মিতহাস্যে বললে, বুঝলেন না তো সুহাসবাবু?

না–মানে—

আমি বলতে চাই, কিরীটী শান্ত গলায় বললে, নো ক্রাইম ইজ পারফেক্ট!

 

কিছুক্ষণ হলো সুহাস মিত্র বিদায় নিয়েছে।

কিরীটী সুব্রত ও কৃষ্ণা দ্বিতীয় প্রস্থ চা নিয়ে বসেছিল। সুব্রত এতক্ষণ নির্বাক শ্রোতা ছিল, একটি কথাও বলেনি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে এক সময় সুব্রত বললে, কিরীটী, মনে হচ্ছে কাজল বোসের ভূতটা বোধ হয় তোর কাঁধ থেকে নেমে গেছে

কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানাল, না, না—আদৌ নয়—মোক্ষম তিনটি জটের একটি জট যেটা সুহাস মিত্রকে নিয়ে ছিল সেই জটটিই মাত্র খুলেছে, কিন্তু এখনো দুটো জট রয়ে গিয়েছে—

তার মধ্যে একটি বোধ হয় কাজল বোস!

হ্যাঁ—

আর বাকীটা?

সেটা হত্যাকারীকে চিহ্নিত করবার মধ্যে শেষ জট। তোকে বলেছিলাম সেদিন সুশীল নন্দীর ওখান থেকে গাড়িতে আসতে আসতে—একটা কথা নিশ্চয়ই তোর মনে আছে– মিত্রানীকে কেন্দ্র করে একটি জটিল ত্রিকোণের সৃষ্টি হয়েছিল দুটি পুরুষের আকর্ষণ ও বিকর্ষণে–

মনে আছে।

এ আমি বলেছিলাম মিত্রানীর হত্যার মূলে ঐ আকর্ষণ ও বিকর্ষণই—

হ্যাঁ—এবং এও বলেছিলাম, আপাতদৃষ্টিতে ভালবাসা ও ঘৃণা দুটি বিপরীত বস্তু হলেও ভালবাসা থেকে যেমন ঘৃণার জন্ম হতে পারে তেমনি ঘৃণার মূলে অনেক সময় থাকে ভালবাসা।

তুই ঠিক কি বলতে চাস কিরীটী?

বলতে চাই ঐ জটটি এখনো আমার কাছে খুলে যায়নি—আর সেটা যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ হত্যাকারীর চেহারাটাও স্পষ্ট হয়ে উঠবে না।

তবে কি এখনো–

না সুব্রত, হত্যাকারী এখনো কিছুটা ঝাপসা—কিছুটা ধোঁয়া তাই ভাবছিলাম, দেখি যদি কাজল বোসের কাছ থেকে কিছুটা সাহায্য পাই–

কৃষ্ণা ঐ সময় বলে উঠল, কিছুই পাবে না।

কেন?

ভুলো না, সুহাস মিত্রের মতো পুরুষ নয় সে-নারী।

সুব্রত বললে, ঠিকই বলেছে কৃষ্ণা—ওদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না।

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, ঠিক—তবে যুধিষ্ঠিরের সেই তার মাকে অভিশাপ, কোন নারীর পেটে কোন কথা থাকবে না। তাছাড়া আমার তূণে আছে মোক্ষম অস্ত্র–

যথা? প্রশ্নটা করে সুব্রত কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

আমাদের সুহাস মিত্র—

সুহাস মিত্র?

হ্যাঁ–ভুলে যাচ্ছিস কেন সুব্রত, সুহাসের জন্য কাজল প্রাণও দিতে পারে—

কিরীটীর কথার সঠিক তাৎপর্যটা ঐদিন সুব্রত ঠিক উপলব্ধি করতে পারেনি পেরেছিল দিন দুই বাদে।

সুহাসের সাহায্যেই কিরীটী কাজল বোসকে তার বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিল। সুব্রত বুঝতে পারেনি কিরীটীর প্ল্যানটা।

কিরীটী পরের দিন দুপুরে নিজেই গিয়েছিল সুহাস মিত্রের অফিসে।

সুহাস মিত্র কিরীটীকে দেখে অবাক।

কিরীটীবাবু আপনি!

একটা কাজ করতে হবে আপনাকে সুহাসবাবু—

বলুন কি কাজ?

আপনাদের বান্ধবী–কাজল বোসের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই–

সে তো আপনিই তাকে ডেকে পাঠিয়ে—মানে সুশীলবাবুকে বললেই তিনি ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।

তা পারবেন জানি, আমি তা চাই না। আমার ইচ্ছা আপনি তাকে কাল বা পরশু আমার ওখানে একটিবার যদি আসতে বলেন—

আমাকেই বলতে হবে,

হ্যাঁ—কারণ আপনাকে দিয়ে বলানোর মধ্যে আমার একটা উদ্দেশ্য আছে—

সুহাস যেন কি ভাবলো, তারপর বললে, বেশ তাই হবে—তবে আজ তো হবে না— কাল শনিবার আছে, দুটোয় অফিসের ছুটির পর আমি তার ওখানে যাবো—রবিবার আসতে বলবো–

খুব ভাল।

 ১৮. রবিবার সকালের দিকে

রবিবার সকালের দিকে কাজল বোস এলো।

কিরীটী কাজল বোসের অপেক্ষাতেই ছিল—এবং জংলীকে বলে রেখেছিল কাজল বোস এলে যেন সে তাকে তার ঘরে পৌঁছে দেয়।

জংলীর সঙ্গে কাজল বোস ঘরে ঢুকতেই কিরীটী বললে, আসুন, মিস বোস–কতকগুলো ব্যাপার আপনার সঙ্গে আমি আলোচনা করতে চাই, তাই আপনাকে কষ্ট দিতে হলো, বসুন।

কাজল কিরীটীর কথার কোন জবাব দিল না—অল্প দূরে সুব্রত চুপচাপ বসে একটা পিকটোরিয়ালের পাতা উল্টাচ্ছিল, সেদিকে একবার তাকিয়ে একটা খালি সোফায় কিরীটীর মুখোমুখি বসল।

কাজলের মুখটা গম্ভীর—যেন একটা বিরক্ত-বিরক্ত ভাব।

আপনি হয়ত বিরক্ত বোধ করেছেন মিস বোস, আপনাকে আমি বেশীক্ষণ আটকাবো না।

কাজল বোস নীরব।

মিস বোস সেই দুর্ঘটনার দিন আপনি কি ধুলোর ঝড়ে বিভ্রান্ত হয়ে হঠাৎ পড়েটড়ে গিয়েছিলেন?

না তো!

তবে আপনার হাতের চুড়ি ভাঙল কি করে?

আমার হাতের চুড়ি—কেন আপনাকে তো সেদিন আমি বলেছিলাম, আমার ছোেট ভাইঝি আমার হাতের চুড়ি টানাটানি করতে গিয়ে ভেঙে ফেলে।

হ্যাঁ  বলেছিলেন মনে আছে–তবে কথাটা ঠিক আমার বিশ্বাস হয়নি—

কেন? বিশ্বাস হয়নি কেন আপনার—কেন, আপনার মনে হয়েছে যে আমি মিথ্যা বলছি!

মিথ্যা বলেছেন তা আমি বলিনি—

তবে?

আপনার বাঁ হাতে ঠিক কব্জির কাছে একটা অ্যারেশন,—মানে কিছুটা ছড়ে যাওয়ার মত সেদিন দেখেছিলাম এবং তার চিহ্ন এখনো আছে, মনে হয় ওটা কিছুতে কেটে গিয়েছে—কাজেই স্বাভাবিক ভাবেই আমার মনে হয়েছে—

কি মনে হয়েছে আপনার কিরীটীবাবু?

আপনি হয়ত সেদিন পড়ে গিয়েছিলেন বা কোন কারণে হাতে আঘাত পেয়েছিলেন, যার ফলে আপনার বাঁ হাতের দু-একগাছি চুড়ি ভেঙে গিয়েছিল ও কব্জির কাছে ছড়ে গিয়েছিল সেই আঘাতে।

না, সে সব কিছুই হয়নি—আপনি যা ভাবছেন!

তবে আপনার বাঁ হাতের কব্জির কাছে ঐ আঘাতের চিহ্নটা কি করে এলো?

তা ঠিক মনে নেই—হয়ত কোন সময়ে কিছু হয়েছে—

মিস বোস, যে সত্যকে আপনি ঢাকবার চেষ্টা করছেন, তাকে আপনি ঢেকে রাখতে। পারবেন না। শুনুন, আমি যদি বলি, সেদিন ঝড় ও ধুলোর ঘূর্ণির মধ্যে কারো সঙ্গে আপনার ধাক্কা লেগেছিল!

ধাক্কা?

হ্যাঁ, কিংবা কারো সঙ্গে আপনার হাতাহাতি হয়েছিল সেই সময়ই আপনার হাতের চুড়ি ভেঙে যায়।

কি পাগলের মত যা তা বলছেন?

আমি যে পাগলের মত যা-তা বলছি না মিস বোস—তার উপযুক্ত প্রমাণ থানা। অফিসার সুশীল নন্দীর কাছে আছে—কিছু ভাঙা চুড়ির অংশ—যে অংশগুলো আপনার। হাতের ঐ চুড়ির সঙ্গে হুবহু মিলে যাবে—আর আদালত যখন সেই প্রশ্ন আপনাকে করবে—

আদালত প্রশ্ন করবে? কথাটা উচ্চারণ করতে গিয়ে মনে হলো যেন কাজল বোসের গলার স্বর কেঁপে গেল একটু।

নিশ্চয়ই। আদালতে যখন মিত্রানীর হত্যা-মামলা উঠবে—এবং ঐ চুড়ির ব্যাপারে, আপনাকে ক্রস করবে সরকারী উকিল—

আপনি-আপনি কি বলতে চান কিরীটীবাবু?

কিছুই না, কেবল সেদিন সত্য যা আপনার জ্ঞাতসারে ঘটেছিল সেইটুকুই আপনার কাছ থেকে জানতে চাই–বলুন

আ-আমি কিছু জানি না।

জানেন। বলুন কার সঙ্গে সেদিন আপনার ধাক্কা লেগেছিল–কে সে?

আমি বলতে পারবো না–পারবো না।

আপনি বলতে পারবেন না কিন্তু আমি বলছি–তিনি সুহাসবাবু, তাই না?

না, না—তাকে আমি চিনতে পারিনি বিশ্বাস করুন, তাকে আমি চিনতে পারিনি—

চিনেছিলেন—তাকে আপনি চিনেছিলেন মিস বোস, কিরীটীর গলার স্বর ঋজু ও কঠিন, বুঝতে পারছেন না কেন একজনকে বাঁচাতে গিয়ে ফাঁসির দড়ি আপনার দিকে এগিয়ে আসছে!

ফাঁসি! একটা আর্ত অস্ফুট চিৎকার যেন কাজল বোসের কণ্ঠ চিরে বের হয়ে এলো। তার দুই চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি।

একজনকে হত্যার অপরাধে ইনডিয়ান পেনাল কোর্ডের ৩০২ ধারায় সেই দণ্ডই দেওয়া হয়ে থাকে—কাজেই সুহাসবাবুর—

না, না—আপনি বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু, সুহাস নির্দোষ—সম্পূর্ণ নির্দোষ, সে মিত্রানীকে হত্যা করেনি—

তাকে ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচাবার একটি মাত্র উপায় আছে মিস বোস-অকপটে সেদিন যা যা ঘটেছিল সেইটুকু আমার কাছে প্রকাশ করে দেওয়া। কিরীটীর গলার স্বর শান্ত কিন্তু দৃঢ়। বলুন—সেদিন ঠিক কি ঘটেছিল আপনার দৃষ্টির মধ্যে ধুলোর ঘূর্ণিঝড় ওঠাবার পর–

সত্যি বলছি, আপনি বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু

আমার প্রশ্নের জবাব দিন যদি সুহাসবাবুকে বাঁচাতে চান। কেন বুঝতে পারছেন না আপনি মিস বোস—সুহাসবাবুর বাঁচবার আর কোন রাস্তা নেই বলেই আপনাকে অনুরোধ করেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য!

আমার কথা আপনি বিশ্বাস করবেন?

সত্য বললে কেন বিশ্বাস করবো না!

কাজল বোস অতঃপর নিজেকে যেন একটু গুছিয়ে নিলো। তারপর বলতে শুরু করল, হঠাৎ ধুলোর ঘূর্ণিঝড় ওঠবার পর আমরা প্রত্যেকেই সেই ধুলোর অন্ধকারে ছিটকে পড়েছিলাম—

জানি। তারপর?

ঝড়ের ঝাপটা থেকে বাঁচবার জন্য এলোমেলো ভাবে যে কোথায় চলেছি প্রথমটায় যেমন বুঝতে পারিনি তেমনি এও বুঝতে পারিনি কতদূর এগিয়েছি ঐ সময়–

একটা কথা মিস বোস, মিত্রানী আপনার কত দূরে ছিল?

ঠিক জানি না, তবে মনে হয়—

সুহাসবাবু—

হ্যাঁ, বোধ হয় আমার ঠিক আগেই ছিল সুহাস—কাজল বোস থামল।

কিরীটী বললে, বলুন, থামলেন কেন?

হঠাৎ যেন কার সঙ্গে আমার ধাক্কা লাগলো–

ধাক্কাটা লেগেছিল সামনে না পিছন থেকে, না পাশ থেকে? কিরীটীর প্রশ্ন।

মনে হয়েছিল যেন পাশ থেকেই—একটু থেমে আবার কাজল বললে, ভেবেছিলাম বুঝি সুহাসই, তাই তাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠি—কে, সুহাস—কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না—বরং যাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম সে যেন একটা ধাক্কা দিয়ে আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করলো—আমি সামলাতে পারিনি নিজেকে—পড়ে যাই

লোকটাকে আপনি ভাল করে দেখতে পাননি?

না।

তারপর?

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা অস্ফুট চিৎকার শুনতে পাই, আমি পড়ে গিয়ে ততক্ষণে আবার উঠে দাঁড়িয়েছি—একটা ঝটাপটির শব্দ—তারপরই–

কেউ কি সুহাস বলে ডেকেছিল?

না, না। তারপরই একটু থেমে কাজল বোস বলতে লাগল, এগুতে যাবো কোন মতে—একটা গাছের ডাল এসে সামনে আছড়ে পড়ল, আবার একটা অস্ফুট চিৎকার কানে এলো। সুহাসই গাছের ডালের তলায় চাপা পড়েছিল, পরে বুঝেছিলাম। আর মিত্রানীকে আরো কিছুটা দূরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল–কাজেই সুহাস নয়, সে মিত্রানীকে হত্যা করতে পারে না। বলা শেষ করে কাজল যেন কিছুটা হাঁপাতে থাকে।

একটা কথা বোধ হয় আপনি জানেন না—

কি কথা?

কখনো হয়ত আজ পর্যন্ত চিন্তাও করতে পারেননি—

কি কথা? পুনরায় প্রশ্ন করলে কাজল বোস।

আপনি গত বছর সুহাসবাবুর জন্মদিনে তাকে সবুজ সুতোর নাম তুলে যে সিল্কের রুমালটা প্রেজেন্ট করেছিলেন, মিত্রানীকে সেই রুমালটার সাহায্যেই হত্যা করা হয়েছে–

কে—কে বললে?

যে রুমালটা মিত্রানীকে পেঁচিয়ে গলার ফাঁস দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সেটা সুহাসবাবুরই—তিনি ঐ কথা বলেছেন পুলিসের কাছে।

কাজল বোস যেন একেবারে বোবা। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে কিরীটীর মুখের দিকে।

সামান্য একটা রুমাল নিশ্চয়ই চুরি যায়নি—এক যদি না হত্যাকারী কৌশলে তার নিজের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য সেটা হাতিয়ে থাকে কিংবা সুহাস মিত্রই নিজে সেটা ব্যবহার না করে থাকেন!

কাজল বোস যেন পাথর।

কিরীটীর শেষ কথাটার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ কাজল বোস যেন এলিয়ে পড়ল সোফাটার ওপরে অসহায় ভাবে। কিরীটী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়, কি—কি হলো মিস বোস–সুব্রত, ভদ্রমহিলার চোখমুখে একটু জল দেবোধ হয় সংজ্ঞা হারিয়েছেন।

সুব্রত বুঝতে পেরেছিল কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়, তাই সে তাড়াতাড়ি উঠে পাশের টিপয় থেকে জলের গ্লাসটা তুলে নিয়ে হাতে গ্লাসের জল ঢেলে কাজল বোসের চোখেমুখে ঝাপটা দিতে থাকে।

মিস বোস!

চোখের পাতায় তখনো জলের কণাগুলো লেগে আছে, কাজল বোস কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সুহাস মিত্র এসে ঘরে ঢুকল।

কাজল বোস উঠে দাঁড়াল।

তুমি—তাহলে তুমিই—কাজল বললে।

কাজল! ডাকল সুহাস।

তাকে যেন একটা থাবা দিয়ে থামিয়ে দিয়ে কাজল বললে, তুমি—তুমি এত নীচ এত ছোট সুহাস?

কাজল—শোনো, শোনো—

এখনো—এখনো তুমি বলতে চাও—

কাজল!

শুনেছি—সব শুনেছি-কিরীটীবাবু আমাকে সব বলেছেন এইমাত্র, মিত্রানীকে হত্যা করবার আর কিছু তুমি খুঁজে পেলে না শেষ পর্যন্ত আমারই দেওয়া রুমালটা দিয়ে–

কাজল, এসব কি বলছো তুমি!

ঠিক বলছি-তুমিই সেদিন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলে—

আমি তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলাম! কি বলছো তুমি কি ক্ষেপে গেলে?

সুহাস, পাপ কখনো চাপা থাকে না–

কাজল বোস আর দাঁড়াল না—টলতে টলতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ঘর থেকে বের হয়ে যেতে কেউ তাকে বাধা দিল না। সুহাস তাকাল কিরাটীর মুখের দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে—তারপর বললে, কি বলে গেল কাজল কিরীটীবাবু?

নিজের কানেই তো শুনলেন আপনি ও কি বলে গেল—

শুনেছি, কিন্তু আপনি ওকে কি বলেছেন?

রুমালটার কথা বলেছি মাত্র—

কিন্তু ধাক্কা দেওয়ার কথা কি ও বলে গেল?

সেদিন কে নাকি ওকে ধাক্কা দিয়েছিল ধুলোর ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে। তারপরই একটু হেসে কিরীটী বললে, ওর কাছে আমার যা জানবার ছিল জানা হয়ে গিয়েছে—কাজল বোসকে নিয়ে যে জটটা ছিল সেটা খুলে গিয়েছে, বাকী এখন শেষ জটটি–

কিসের জট? প্রশ্ন করে সুহাস।

মিত্রানীর হত্যারহস্যকে ঘিরে তিনটে জট ছিল তার মধ্যে একটি খুলে দিয়েছেন সেদিন আপনি—আজ কাজল বোস খুলে দিয়ে গেল একটি—বাকী এখন শেষ জটটি। আশা করছি সেটাও খুলতে আর দেরি হবে না–

কিরীটীবাবু! সুহাস ডাকল।

বলুন।

সত্যিই কি আপনি মনে করেন—সুহাস ইতস্তত করে থেমে গেল।

কি, আমি!

সত্যিই কি আপনি মনে করেন—দলের মধ্যে আমিই সেদিন মিত্রানীকে হত্যা করেছি?

সে কথা থাক—আপনি আগে বলুন, সেদিন কি কাজলের সঙ্গেই আপনার ধাক্কা লেগেছিল অথচ সাড়া দেননি তার ডাকে?

না, সে কাজল নয়—

তবে কে? আমার অনুমান আপনি হয়ত তাকে চিনতে পেরেছিলেন চোখের দৃষ্টিতে নয়, হয়ত অনুভবে—স্পর্শের মধ্যে দিয়ে–

বিশ্বাস করুন তাকে আমি চিনতে পারিনি–

সুহাসবাবু, আপনারা এখনো একটা কথা জানেন না—কারণ বলা হয়নি কাউকে আপনাদের

জানি না—কি জানি না?

মিত্রানী ওয়াজ রেপড্‌–

সে কি! একটা অর্ধস্ফুট চিৎকার যেন বের হয়ে এলো সুহাসের কণ্ঠ চিরে।

হ্যাঁ—এবং খুব সম্ভব প্রচণ্ড ঘৃণা ও আক্রোশের বশে হত্যাকারী প্রথমে তাকে রুমালের ফাস গলায় দিয়ে হত্যা করে, তারপর তাকে রেপ করে—

আমি–-আমি কথাটা এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না কিরীটীবাবু!

হয়ত হত্যাকারীর মিত্রানীকে ঘিরে দীর্ঘদিনের অমিত লালসা শেষ পর্যন্ত তাকে পশুর পর্যায়ে টেনে এনেছিল, তাকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে ফেলেছিল–

কিরীটীবাবু!

বলুন।

এখনো আপনার ধারণা সে আমাদেরই একজন?

বলতে পারলেই আমি খুশি হতাম সুহাসবাবু কিন্তু তা পারছি না—এখনো সন্দেহের জালটা যেন আপনাদেরই কাউকে ঘিরে আছে—

সুহাস আর কোন প্রতিবাদ জানাল না। কেমন যেন মুহ্যমানের মত সোফার উপরে বসে রইলো। কারো মুখেই কোন কথা নেই, যেন একটা পাষাণ-স্তব্ধতা বিরাজ করছে। ঘরের মধ্যে—তারপরই যেন হঠাৎ একসময় উঠে দাঁড়াল সুহাস মিত্র এবং কোন রকম কিছু না বলে শ্লথ পায়ে ঘরের ভিতর থেকে বের হয়ে গেল।

সিঁড়িতে সুহাস মিত্রের পায়ের শব্দটা মিলিয়ে যাবার পর সুব্রত বললে, বেচারা মনে হলো যেন অত্যন্ত কঠিন আঘাত পেয়েছে।

কিরীটী শান্ত গলায় বললে, ঐ আঘাতটা না দিতে পারলে—যাকে বলে অ্যাসিড টেস্ট সেটা হতো না এবং আসলে সত্যটাও প্রকাশ পেত না।

তুই তাহলে সুহাস মিত্রকে মুক্তি দিলি?

আপাতত।

আপাতত মানে?

কিরীটী সুব্রতর কথার কোন জবাব না দিয়ে উঠে গিয়ে ফোন ডায়েল করতে লাগল।

বার-দুই এনগেজ টোন হলো, তারপর অন্য প্রান্তে শোনা গেল, ও. সি. শিবুপুর পি. এস.–

সুশীলবাবু আমি কিরীটী—কোন খবর আছে?

আছে তবে ফোনে বলবো না—কাল আসুন না একবার—

যাবো—আচ্ছা মৃতের জামা ও শাড়ি–

এখনো থানাতেই আছে—একজিবিট হিসাবে–কেন বলুন তো?

ওগুলো আমি একবার দেখতে চাই—আর ঐ সঙ্গে স্পটটাও একবার ঘুরে দেখে আসবো ভাবছি। আচ্ছা তাহলে সেই কথাই রইলো।

কিরীটী অতঃপর রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিল।

কিরীটী ফিরে এসে সোফায় বসতেই সুব্রত শুধালো, স্পটটা একবার দেখবার কথা গত দুদিন ধরে আমিও ভাবছিলাম!

 ১৯. কিরীটীর ওখান থেকে বের

কিরীটীর ওখান থেকে বের হয়ে সুহাস মিত্র একটু অন্যমনস্ক হয়েই যেন বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগুতে থাকে। মিত্রানীর কথাই সে ভাবছিল বোধ হয়, হঠাৎ বাস স্ট্যান্ডের কাছাকাছি আসতেই কাজলের ডাক শুনে সুহাস থমকে দাঁড়াল।

সুহাস—

কে! ও তুমি! বাড়ি ফিরে যাওনি–

না। তোমার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম এতক্ষণ—

আমার অপেক্ষায়! কেন?

তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল—

কথা! কি কথা—

এই রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে কথা হতে পারে না।

কিন্তু রাত অনেক হয়েছে—তোমাকে তো আবার ফিরতে হবে ট্রেনে–

সেজন্য তোমাকে চিন্তা করতে হবে না—

কথাটা কি খুব জরুরী? জিজ্ঞাসা করলো সুহাস।

জরুরী না হলে প্রায় এক ঘণ্টা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করতাম। চল, ঐ পার্কটায় গিয়ে বসা যাক—

সুহাস একটু চুপ করে থেকে বললে, বেশ চল–

দশ পনেরো গজ দূরেই রাস্তাটা যেখানে সামান্য একটু বেঁকেছে—সেখান থেকে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গিয়েছে—একটা যাওয়ার একটা আসার—মাঝখানে ট্রামের লাইন—

একটা ট্রাম উল্টো দিকে ঘন্টি বাজাতে বাজাতে চলে গেল, একটা বাস এসে দাঁড়িয়েছে—ঐ সময়ও যাত্রীতে একেবারে যেন ঠাসাঠাসি।

দুজনে ট্রাম-রাস্তা পার হয়ে একটা পার্কের মধ্যে এসে ঢুকল। গ্রীষ্মের সময় বলেই হয়ত তখনো পার্কের মধ্যে বেশ কিছু মানুষজন রয়েছে। দুজনে এগিয়ে গেল আরো কিছুটা—একটা খালি বেঞ্চ দেখে দুজনে পাশাপাশি বসলো।

কিছুটা সময় দুজনেই চুপচাপ, দুজনেই যেন যে যার ভাবনার মধ্যে তলিয়ে আছে।

সুহাস—হঠাৎ কথা বললো কাজল, এতদিনে আমি বুঝতে পারছি—

কি বুঝতে পারছো কাজল!

আই ওয়াজ এ ফুল–নচেৎ কথাটা আমার আরো আগেই বোঝা উচিত ছিল।

কি বলতে চাও তুমি কাজল স্পষ্ট করে বল।

বলবার তো আর কিছু নেই—

কিছুই যদি নেই তো এভাবে এখানে আমাকে টেনে নিয়ে এলে কেন?

কাজল বলতে লাগল, অবিশ্যি ব্যাপারটা যে আমি একেবারে অনুমান করতে পারি নি তা নয়—কিন্তু মনকে সান্ত্বনা দিয়েছি—না, হতে পারে না। তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম——মিত্রানীর মনটা অন্য জায়গায় বাঁধা আছে—ওরা পরস্পরকে ভালবাসে যখন তখন আমি কিছুটা নিশ্চিত

কি বলছো তুমি কাজল, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। মিত্রানী কাকে ভালবাসত—আর কেই বা মিত্রানীকে ভালবাসত—

কিন্তু সে ভুল আজ আমার ভেঙে গেছে। বুঝতে পারছি মিত্রানীর আরো অ্যাডমায়ারার ছিল—তাকে ভালবাসার জন্য আরো কেউ ছিল।

কাজল, সত্যিই বলছি তোমার হেঁয়ালি আমি একটুও বুঝতে পারছি না—

এই রকম কিছু যে আজ তোমার কাছ থেকে আমায় শুনতে হবে আমি জানতাম—

কাজল, অনেক রাত হয়ে গিয়েছে—আমাকে বাসায় ফিরতে হবে—আমি চললাম—

যাবে তো নিশ্চয়ই—তোমাকে আমি আটকাবো না কিন্তু মন তোমার অনেক, আগেই অন্য জায়গায় বাঁধা পড়েছে কথাটা আমাকে এতকাল জানতে দাওনি কেন! কেন আমাকে নিয়ে তুমি খেলা করেছো?

বিরক্তিভরা কণ্ঠে সুহাস বললে, খেলা তোমাকে নিয়ে আমি কোনদিনই করিনি কাজল, বোঝবার শক্তি থাকলে তুমি অনেক আগেই সেটা বুঝতে পারতে–

তা পারতাম হয়ত কিন্তু এও তুমি জেনো সুহাসবাবু, তোমার মুখোশটা আমি খুলে দেবো–

কাজল!

হ্যাঁ—আমি যতটুকু জানি সব কিরীটীবাবুকে বলবো।

কি বলবে?

আদালতে কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ালেই সেটা বুঝতে পারবে—একটা বিষাক্ত জ্বালায় যেন কথাগুলো উচ্চারণ করে কাজল উঠে পড়ে হন হন করে গেটের দিকে এগিয়ে গেল।

আর সুহাস যেন কেমন বিমূঢ় হয়ে বেঞ্চটার উপরে বসে রইলো।

 

সকাল সকালই পরের দিন কিরীটী আর সুব্রত বের হলো। থানায় যখন ওরা এসে পোঁছাল, তখন সোয়া আটটা মত হল—গ্রীষ্মের তাপদাহ তখনো শুরু হয়নি। থানাতেই অপেক্ষা করছিলেন সুশীল নন্দী।

কিরীটী বললে, সুশীলবাবু, চলুন আগে বটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়ে স্পটটা ঘুরে আসি। •

বেশ চলুন—সুশীল নন্দী উঠে দাঁড়ালেন।

উইক ডে–বটানিক্যাল গার্ডেনে তেমন লোকজন বড় একটা নেই। কয়েকজন আমেরিকান টুরিস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছিল—হাতে তাদের ক্যামেরা দুজনের।

সুশীল নন্দীই সঙ্গে করে নিয়ে এলেন ওদের ঠিক যেখানে মিত্রানীর মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হয়েছিল। একটা ঝোপের মত—তারই সামনে খানিকটা খোলা জমি—কিরীটী তাকিয়ে দেখে। তারপর এক সময় সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে যায়—জায়গাটা গঙ্গার ধার থেকে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ গজ দূরে হবে। এবং গঙ্গার ধার থেকে বিশেষ করে ঐ ঝোপটার জন্য জায়গাটা নজরে পড়ে না।

কিরীটী ঘড়ি দেখে একটু দ্রুতই গঙ্গার ধার থেকে জায়গাটায় এগিয়ে গেল—ঠিক। জানবার জন্য কতক্ষণ আন্দাজ লাগতে পারে ঐখানে পৌঁছাতে।

সুশীলবাবু—

বলুন!

বায়নাকুলারটা আর বেতের টুপিটা কোথায় কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল জানেন?

সুশীল নন্দীই জায়গা দুটো দেখিয়ে দিলেন।

হুঁ। ভাঙা চুড়ির টুকরোগুলো?

ঐ যে বায়নাকুলারটা যেখানে পাওয়া যায় সেইখানেই—

কিরীটীর মনে হলো মৃতদেহটা যেখানে আবিষ্কৃত হয়, সেখান থেকে জায়গাটা হাত দশেক দূরেই হবে।

হুঁ। চলুন, এবার থানায় যাওয়া যাক।

গাড়িতে উঠে সুশীল নন্দী বললেন, জায়গাটা দেখে কিছু অনুমান করতে পারলেন?

একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে—

কি বলুন তো!

হত্যাকারী বুঝতে পেরেছিল ঐ ঝোপের দিকে আসতে হলে গঙ্গার ধার থেকে ঐ পথটাই সহজ হবে এবং সেই অনুমানেই—কিরীটী থেমে গেল হঠাৎ ঐ পর্যন্ত বলে।

সুশীল নন্দী বললেন, কিন্তু তাতে কি এসে গেল—ওরা অন্য পথও তো ধরতে পারত—-

তা পারত, তবে ঐটাই সামনে ছিল। আর সহজ পথ ছিল। কি জানেন সুশীলবাবু, সেদিনকার যাবতীয় ঘটনাই একটা অ্যাকসিডেন্ট বলতে পারেন—

মানে!

মানে অ্যাকসিডেন্টালি সব কিছুই যেন সেদিন খুনীর ফেবারে এসে গিয়েছিল–

সুব্রতর কাছে ঐ মুহূর্তে সমস্ত ব্যাপারটা যেন অকস্মাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল কিরীটীর আগের কথায় সে নিঃশব্দে কিরীটীর কথা শুনতে থাকে।

কিরীটী বলতে লাগল, প্রথমত ধরুন, সেদিনকার ধুলোর ঘূর্ণিঝড়, আবহাওয়া অফিসের সেদিনের সকালের ফোরকাস্টে অবিশ্যি ছিল বিকেলের দিকে বজ্রবিদ্যুৎসহ একপশলা ঝড়বৃষ্টি হবে—যদিও সেটা সেদিন ঠিক হয়েছিল কিন্তু নাও তো হতে পারত-সেদিক দিয়ে বিচার করে দেখতে গেলে খুনী জাস্ট টুক এ চান্স—এবং চান্সটা সে পেয়ে গেল ফোরকাস্ট মতো আবহাওয়া ঠিক মুহূর্তে তার ফেবারে পেয়ে। দ্বিতীয়ত ঐ ঘূর্ণিঝড় হবার দরুন তাকে, মানে খুনীকে আর কষ্ট করতে হলো না-মিত্রানী নিজেই তার হাতের মুঠোর মধ্যে এসে গেল। তৃতীয়ত ওরা স্থির করছিল চাদনী রাত আছে, কাজেই সন্ধ্যা উতরাবার পর তারা ওখান থেকে ফিরবে—যেমন করে হোক খুনী সেটা অনুমান করতে পেরেছিল এবং তাই যদি শেষ পর্যন্ত হতো তো সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে গঙ্গার ধার থেকে ফেরার পথে তাকে কার্যসিদ্ধি করতে হতো—

তাহলেই ভেবে দেখুন সুশীলবাবু—যদিও খুনীর সবটাই ছিল পূর্বপরিকল্পিত—এবং তার ডিটারমিনেশন—তবু সব কিছু ঘটনাচক্রে তার ফেবারে আসায় ব্যাপারটা সহজই হয়ে গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত তার কাছে—অ্যাকসিডেন্টালি সে হত্যা করবার চান্সটা পেয়ে গিয়েছিল। ভাল কথা, কাউকে এই কদিন ঐ জায়গাটার আশেপাশে দেখা গিয়েছে কি?

হ্যাঁ—গতকাল দুপুরে আমার লোকেরা যারা পালা করে সর্বক্ষণ নজর রাখছিল। নির্দেশমত—একজনকে দেখেছে–

কি রকম দেখতে লোকটা, বয়স কত–

বয়স হবে লোকটার তেত্রিশ-চৌত্রিশের মধ্যে–পরনে একটা সাদা প্যান্ট ও সিল্কের শার্ট—চোখে রঙিন কাঁচের চশমা—একটা ট্যাক্সি করে এসেছিল লোকটা—কয়েক মিনিট জায়গাটার আশেপাশে ঘুরে আবার সে ট্যাক্সি করে চলে যায়—

ট্যাক্সিট্যাক্সির নম্বরটা রেখেছিল কি আপনার লোক?

না—

পালিয়ে গেল—আপনার নাকের ডগা দিয়ে সুশীলবাবু!

কে পালিয়ে গেল নাকের ডগা দিয়ে—

হত্যাকারী। মিত্রানীর ঘোষালের হত্যাকারী—

বলেন কি?

হ্যাঁ—কিন্তু থাক—একটা ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম সুশীলবাবু হত্যাকারী ওদেরই একজন।

গাড়ি ইতিমধ্যে থানার সামনে পৌঁছে গিয়েছিল।

সুশীল নন্দী একটা সীল করা কাগজের প্যাকেট কিরীটীর সামনে টেবিলের ওপর এনে নামিয়ে রাখল। বললে, এর মধ্যে মিত্রানীর শাড়ি-সায়া-ব্রেসিয়ার-ব্লাউজ সব কিছু আছে।

প্যাকেটটা খুলতে খুলতে কিরীটী বললে, সেই বেতের টুপিটা ও বায়নাকুলারটাও আনুন—আর একবার দুটো বস্তু ভাল করে দেখবো।

সুশীলবাবু সেগুলো আলমারি থেকে বের করে এনে টেবিলের ওপর রাখলেন।

মিত্রানীর পরনে ছিল সেদিন একটা নীল রঙের মুর্শিদাবাদী সিল্কের শাড়ি। শাড়ির কিছুটা অংশ মনে হয় টানা-হাচড়াতে ফেঁসে গিয়েছে, শাড়িটা পুরোনো বলেই বোধ হয়।

ব্লাউজের বোতামগুলো একটা বাদে বাকী নেই—ব্লাউজটা দেখতে দেখতে একটা কি যেন টেনে তুললো ব্লাউজ থেকে কিরীটী।

একটা মাঝারী সাইজের কর্কশ চুল, রঙটা কটা–

চুলটা পকেট থেকে একটা ছোট লেন্সের ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে তারই সাহায্যে পরীক্ষা করতে করতে কিরীটী বললে, এক টুকরো কাগজ দেখি সুশীলবাবু

সুশীল নন্দী একটা প্যাডের কাগজ ছিড়ে দিলেন।

সেই কাগজের মধ্যে সযত্নে চুলটা রেখে কিরীটী ওদের দিকে তাকিয়ে বললে, হত্যাকারী খুবই সতর্কতা অবলম্বন করেছিল সুব্রত, এবং সব কিছু সেদিন তার ফেবারে থাকলেও নির্মম নিয়তি তাকে ফেবার করেনি শেষ পর্যন্ত।

সুব্রত হাসতে হাসতে বললে, সে তো তখুনি আমি বুঝেছিলাম কিরীটী, যখন তুই। ব্যাপারটা হাতে নিয়েছিস।

সুশীলবাবু!

কিরীটীর ডাকে সুশীল নন্দী কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে সাড়া দিলেন, বলুন—

আপনার কিছু সক্রিয় সাহায্য চাই এবার আমার—

বলুন কি করতে হবে?

আপনি আজ সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে আসুন, তখন বলবো কি সাহায্য আপনার নিকট আমি চাই—তবে এইটুকু আমি বলতে পারি—মিত্রানীর হত্যাকারী আর এখন অস্পষ্ট নেই—এবং মনে হয় রহস্যের শেষ জটটাও খুলে যাবে সহজেই

সুব্রত বললে, কিছুটা বোধ হয় আমিও অনুমান করতে পেরেছি কিরীটী। কিন্তু আমি ভাবছি–

কি?

তাহলে কি সবটাই অভিনয়–

না—অভিনয় নয়, সত্য। চল্ এবার ওঠা যাক।

সুব্রত বুঝলো এখনো মীমাংসার শেষ সূত্রটি কিরীটী তার হাতের মধ্যে পায়নি। যদিও হত্যাকারী একটা স্পষ্ট আকার নিয়েছে তার মনের মধ্যে, কিরীটী মুখ খুলতে চায় না।

২০. বাড়িতে ফিরে সারাটা দিন

বাড়িতে ফিরে সারাটা দিন কিরীটী পেসেন্স খেলেই কাটিয়ে দিল একা একা আপন মনে—কেবল মধ্যে দুচার জায়গায় ফোন করেছিল।

সুব্রত আর বাড়িতে ফিরে যায়নি, সে ঐখানেই ছিল। আহারাদির পর কিরীটী যখন তাসের প্যাকেট নিয়ে বসলো, সে একটা উপন্যাস নিয়ে বসেছিল।

 

বেলাশেষের আলো ইতিমধ্যে একটু একটু করে মুছে এসেছে যেন কখন–বাইরে বোধ হয় মেঘ করেছে ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে।

কৃষ্ণা জংলীর হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল।

চা—কৃষ্ণা প্রথম সুব্রতকে একটা কাপ দিয়ে দ্বিতীয় কাপটা স্বামীর দিকে এগিয়ে দিল। কিরীটী হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললে, আচ্ছা কৃষ্ণা, তোমার কি মনে হয়–মিত্রানী জানতে পারেনি কখনো যে কাজল বোসও সুহাসকে ভালবাসত?

আমার মনে হয়-কৃষ্ণা বললে, কাজল বোস যেমন জানত মিত্রানী সুহাসবাবুকে ভালবাসে, তেমনি মিত্রানীও বুঝতে পেরেছিল তারই মত কাজলও সুহাসবাবুকে ভালবাসত–

তাই যদি হতো–তার ডাইরীর মধ্যে কোথাও সেই সম্পর্কে এতটুকু ইঙ্গিতমাত্রও নেই কেন?

তার কারণ হয়ত–

কি?

মিত্রানীর নিজের ভালবাসার উপর এতখানি স্থির বিশ্বাস ছিল যে, সে ওটা চিন্তা করবারও প্রয়োজনবোধ করেনি—অথবা সুহাসবাবুর দিক থেকে তার কোন উদ্বেগের কারণ আছে বলেই মনে করেনি

কিরীটী কি যেন বলতে উদ্যত হয়েছিল জবাবে—কিন্তু বলা হলো না, ঠিক ঐ সময় ঘরের টেলিফোনটা বেজে উঠলো।

কিরীটী উঠে গিয়ে ফোনটা ধরলো—কিরীটী রায়—

রায়সাহেব, আমি নাইড়ু, ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনস্‌-এর–

নমস্কার। যা জানতে চেয়েছিলাম জানতে পেরেছেন?

হ্যাঁ—ঐ নামে কোন প্যাসেঞ্জার সেদিনের মর্নিং ফ্লাইটে বা নুন ফ্লাইটে ছিল না। রিজার্ভেশন লিস্টে।

কিছুক্ষণ অতঃপর দুজনের মধ্যে মিনিট পনেরো ধরে টেলিফোনে কথা হলো। সুব্রত লক্ষ্য করে, কিরীটীর চোখে-মুখে যেন একটা আনন্দের আভাস।

থ্যাংকু মিঃ নাইড়ু-থ্যাংকু—বলে কিরীটী টেলিফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।

কিরীটী ফিরে এসে সোফায় বসতেই জংলী এসে ঘরে ঢুকল।

বাবু, সেদিন যে ভদ্রমহিলা এসেছিলেন, তিনি এসেছেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান—

সুব্রত বললে, নাম বলেনি?

জবাব দিল কিরীটী, যা, এ-ঘরে পাঠিয়ে দে। তারপর সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললে, কাজল বোস।

সত্যিই কাজল বোস। কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়। কাজল বোস এসে ঘরে ঢুকল।

আসুন মিস বোস—

সেদিন একটা কথা আপনাকে আমি গোপন করে গিয়েছি কিরীটীবাবু কাজল বোস বললে।

বসুন। দাঁড়িয়ে কেন। কিরীটী বললে।

কাজল বোস বললে, আপনি সেদিন আমার চোখে আঙুল দিয়ে না দেখিয়ে দিলে কোনদিনই হয়ত আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুলটা ভাঙতো না। তারপরই একটু থেমে কাজল বললে, আশ্চর্য! আমি এত বছর ধরে বুঝতেই পারিনি যে, ওর সমস্ত মন জুড়ে রয়েছে আর একজন—ছিঃ ছিঃ, আর আমি কিনা হ্যাংলার মত ওর পিছনে পিছনে এতদিন ছুটে বেড়িয়েছি–

কিরীটী শান্ত গলায় বললে, ঐ আঘাতটা আপনার প্রয়োজন ছিল বলেই কালকে ইঙ্গিতটা আমি আপনাকে দিয়েছিলাম মিস বোস। হ্যাঁ—সত্য যে সুহাসবাবু মিত্রানীকে ভালবাসতেন, কিন্তু সে ভালবাসা জানবেন কোনদিনই তার প্রকাশ পেতো না—

না, না—আপনি জানেন না। ও, এত ছোট–এত নীচ।

না মিস বোস—মানুষ হিসেবে অন্তত আমি তাকে ঐ বিশেষণগুলো দিতে পারছি, না—আপনি জানেন না একটা কথা—ওর দুটো চোখের দৃষ্টি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। এবং একদিন তার দুচোখে চির অন্ধকার নেমে আসবে–

কি বলছেন আপনি—

তার চশমার পুরো লেন্স দেখেও কি কখনো আপনার কথাটা মনে হয়নি—

না—

হওয়া কিন্তু উচিত ছিল। আমি জানি, কোন্ কথাটা আমাকে আজ বলবার জন্য আপনি ছুটে এসেছেন–

জানেন! বিস্ময়ে তাকাল কাজল বোস কিরীটীর মুখের দিকে।

যার সঙ্গে আপনার ধাক্কা লেগেছিল—সেদিন ধুলো-ঘূর্ণির ঝড়ের মধ্যে—কে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল–

সে সুহাস—এখন আমি বুঝতে পেরেছি সে সুহাস—

না। মিস বোস—তিনি সুহাসবাবু নন। শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় কিরীটী প্রতিবাদ জানাল।

হ্যাঁ আমি বলছি—সে সুহাস ছাড়া আর কেউ হতে পারে না—আর কেউ হতেই পারে —তবু বলে কাজল বোস।

না। আমি বলছি শুনুন, তিনি সুহাসবাবু নন মিস বোস।

তবে—তবে সে কে?

আমার অনুমান যদি মিথ্যে না হয়—সে-ই হত্যা করেছিল সেদিন মিত্রানীকে।

কে! কে হত্যা করেছিল সেদিন মিত্রানীকে?

যার সঙ্গে আপনার ধাক্কা লাগবার পর তাকে আপনি দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিলেন এবং যে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল—

কে সে?

পূর্ববং শান্ত গলায় কিরীটী বললে, এইমাত্র বললাম আপনাকে সে-ই মিত্রানীর হত্যাকারী—

তাহলে সে সুহাস নয়?

না। তবে আপনাদের মধ্যেই একজন।

কাজল বোস অতঃপর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো মাথা নীচু করে। তারপর যখন। মুখ তুললো, কাজলের দুচোখে জল টলটল করছে। কাজল ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল তারপর বললে, আমি তাহলে যাই কিরীটীবাবু—

আসুন—

মাথাটা নীচু করে উপচীয়মান অশ্রুকে যেন রোধ করতে করতে কাজল বোস ক্লান্ত পা দুটো টেনে টেনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বললে, পুওর গার্ল!

সুব্রত এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল, সে এবার বললে, কিরীটী, তাহলে সুহাস মিত্র নয়?

না।

যুক্তি দিয়ে আমি যেটা খাড়া করেছিলাম, তাহলে সেটা দেখছি ভুল। তাহলে কি সেই চোখে চশমা—দাড়িওয়ালা ব্যক্তিটিই–

কিরীটী মৃদু মৃদু হাসতে থাকে সুব্রতর কথার কোন জবাব না দিয়ে।

কিন্তু একজন ছাড়া সেই ব্যক্তি আর কে হতে পারে বুঝতে পারছি না। আচ্ছা ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের মিঃ নাইড়ু কার কথা বলছিলেন তোকে ফোনে—প্যাসেঞ্জার লিস্টে কার নাম ছিল না?

সজল চক্রবর্তী।

মানে।

দুর্ঘটনার দিন সকালের ফ্লাইটে তো নয়ইনুন ফ্লাইটেও সজল চক্রবর্তীর নাম কোথাও পাওয়া যায়নি—কাজেই এটা স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার যে, তিনি আদৌ সেদিন কলকাতা ছেড়ে তার কর্মস্থলে ফিরে যাননি–

তবে ভদ্রলোক পিকনিক পার্টিতে সেদিন ওদের সঙ্গে যোগ দিল না কেন?

সে প্রশ্নের জবাব একমাত্র সজল চক্রবর্তীই দিতে পারে। আসলে তুই সেই বেতের টুপি আর বায়নাকুলার নিয়েই বেশী মাথা ঘামিয়েছিস সুব্রত–

কিন্তু–

ওই বস্তু দুটির কোন মূল্যই যে একেবারে মিত্রানীর হত্যা রহস্যের মধ্যে নেই তা আমি বলছি না–কিন্তু তার চাইতেও মূল্যবান সূত্র দুটি হয়ত তোর মনের মধ্যে ততটা রেখাপাত করেনি—

কোন্ দুটি সূত্রের কথা বলছিস?

এক নম্বর হচ্ছে মিত্রানীর ডাইরীর মধ্যে যে ফোনের সংবাদটি আছে, যেটা সে মনে করেছিল সুহাসের ফোন-সেটা এবং দুনম্বর—যেটা হচ্ছে বর্তমান হত্যা-মামলার প্রধানতম সূত্র—

কি সেটা?

একটা চশমা।

চশমা!

হ্যাঁ চশমা—হ্যাঁ  সুহাসবাবুর চশমা—যে চশমাটা তার চোখ থেকে ছিটকে আশেপাশেই অকুস্থানের কোথাও পড়েছিল, কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেটা আর পাওয়া যায়নি। এবং ঐ চশমার পিছনের ইতিহাসটা হচ্ছে সুহাসবাবুর ক্ষীণদৃষ্টি—যার অ্যাডভানটেজ বা সুবিধা ব্যাপারটা জানা থাকায় হত্যাকারী পুরোপুরিই নিতে পেরেছিল।

কি রকম?

সুহাসবাবুর চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ না থাকলে হত্যাকারী তার রুমালটা অনায়াসেই সরিয়ে পকেটস্থ করতে পারত না ও হত্যার সন্দেহটা পুরোপুরি তার কাঁধে চাপিয়ে দিতে এ সহজে বোধ হয় পারত না। যাক—কথাগুলো বলতে বলতে কিরীটী সহসা দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললে, রাত নটা প্রায় বাজে–

মনে হচ্ছে কারো অপেক্ষা করছিস?

হ্যাঁ–

কার, সুশীলবাবুর?

না। সজল চক্রবর্তীর।

 ২১. সজল চক্রবর্তী এলোই না

কিন্তু সে রাত্রে সজল চক্রবর্তী এলোই না।

এলো পরের দিন সকাল সাড়ে-আটটা নাগাদ।

সুব্রত গতরাতে বাড়ি চলে গিয়েছিল, এখনো ফেরেনি-কিরীটী চা-পানের পর ঐদিনকার সংবাদপত্রটা নিয়ে পাতা উল্টে উল্টে দেখছিল।

জংলী এসে ঘরে ঢুকল—বাবু, সুশীলবাবু আর একজন ভদ্রলোক এসেছেন।

এ ঘরে পাঠিয়ে দে—

আসুন সুশীলবাবু—

সুশীল নন্দী বললেন, সজলবাবুকে একেবারে তার বাসা থেকেই ধরে নিয়ে এলাম—

বসুন—বসুন সজলবাবু, কিরীটী বললে।

আমাকে আজই নুন ফ্লাইটে ফিরে যেতে হবে কিরীটীবাবু, কাজেই আপনার যা বক্তব্য তা যদি একটু তাড়াতাড়ি সেরে নেন—বসতে বসতে সজল চক্রবর্তী বললে।

নিশ্চয়ই-বেশী সময় নেবো না—কয়েকটি প্রশ্নের আমি জবাব চাই মাত্র—

বলুন।

মিত্রানীদের পিকনিকের ব্যবস্থা আপনারই আগ্রহে করা হয়েছিল বিশেষ করে, তাই না?

হ্যাঁ-কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার পিকনিকে যাওয়া হয়নি—

এবং মর্নিং ফ্লাইটে আপনার যাওয়া হয়নি; তাই না?

হ্যাঁ—মানে—বিশেষ একটা কাজে সেক্রেটারিয়েটে আটকা পড়ে–

কি কাজ হঠাৎ পড়েছিল সেদিন আপনার সেক্রেটারিয়েটে এবং কার সঙ্গে কাজ ছিল—

ঐ প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারছি না—আই অ্যাম সরি।

খুব গোপনীয়—সিক্রেট বুঝি ব্যাপারটা?

ধরে নিন তাই–

পরের দিনও আপনি যাননি সকালে, তাই না—

না-যেতে পারিনি–

তাহলে নিশ্চয়ই মিত্রানীকে হত্যা করা হয়েছে, সে সংবাদটা আপনি পেয়েছিলেন?

না–না—

কিন্তু সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছিল-একদল তরুণ-তরুণী বটানিক্যাল গার্ডেনে পিকনিক করতে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে এক তরুণী রহস্যজনকভাবে নিহত হয়েছে।

হবে—আমার চোখে পড়েনি—

হ্যাঁ—আপনি কবে প্রথম সংবাদটা পান?

পরশুর আগের দিন—সজল চক্রবর্তী বললে।

কি করে পেলেন? মিত্রানীদের বাড়িতে ফোন করেছিলেন?

হ্যাঁ—ফোন করতেই প্রণবেশবাবুর মুখ থেকে সংবাদটা পাই।

তা হঠাৎ সেখানে ফোন করতে গিয়েছিলেন কেন?

ওদের পার্টি কেমন হলো সেটা জানবার জন্য—

কিরীটী মৃদু হেসে বললো, কিন্তু আমি যদি বলি মিঃ চক্রবর্তী, ব্যাপারটা আপনি ঘটনার দিনই জানতে পেরেছিলেন—

না, না—কি বলছেন আপনি!

হ্যাঁ—কারণ ছদ্মবেশে পিকনিকের দিন ইউ ওয়্যার প্রেজেন্ট অন দি স্পট।

আপনি কি পাগল হয়েছেন কিরীটীবাবু? সারাদিন আমি চীফ সেক্রেটারির কাছে ব্যস্ত ছিলাম, তার ঘরেই আমি লাঞ্চ পর্যন্ত করেছি

একটা কথা আপনাকে আমার জানানো কর্তব্য——আপনাদের বর্তমান চীফ সেক্রেটারী আমার বিশেষ বন্ধু—

আ—আপনি—

হ্যাঁ–কাজেই ব্যাপারটা সত্য-মিথ্যা এখুনি আমার কাছে যাচাই করা হয়ত খুব একটা অসুবিধা হবে না-নাউ টেল মি—বলুন কোথায় ছিলেন আপনি সারাটা দিন–

ক্ষমা করবেন—আমি বলতে পারবো না।

পারবেন না! ঠিক আছে—তবে জানবেন আপনার ঐ ইচ্ছাকৃত গোপনতা হয়ত আপনাকে ফাঁসির দড়ির দিকে ঠেলে দিতে পারে।

সজল তথাপি মুখ খুললো না। চুপ করে রইলো সে।

আর একটা প্রশ্নের জবাব দিন?

সজল চক্রবর্তী কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল নিঃশব্দে।—আপনি সেবার অনেক দিন পরে কলকাতায় এসে মিত্রানীর ওখানে গিয়ে তাকে বিয়ের পোপাজাল দিয়েছিলেন?

কে বললে আপনাকে?

মিত্রানীর ডাইরীতে তাই লেখা আছে।

হ্যাঁ, দিয়েছিলাম। আমি জানতাম না যে সে সুহাসকে ভালবাসে মনে মনে—তাহলে কখনোই তাকে ঐ ধরনের পোপোজাল দিতাম না।

আপনি জানলেন কি করে সে কথা যে মিত্রানী মনে মনে সুহাসকে ভালবাসত? জানতে পেরেছি— কি করে জানলেন? মিত্রানী কি সে কথা আপনাকে বলেছিলেন সেদিন?

না।

তবে?

জেনেছিলাম।

তাকে ফোন করেছিলেন পরের দিন, তাই না?

ফোন?

হ্যাঁ। ফোন করেছিলেন আপনি তাকে–সুহাসের নাম করে—মানে যে সন্দেহটা আপনার জেগেছিল সেটা মেটাবার জন্য।

সুহাসের নাম করে আমি তাকে ফোন করতে যাবো কেন?

করেছিলেন তাই বলছি বলুন, কেন নিজের নাম না করে সুহাসের নাম করেছিলেন—

বললাম তো–সুহাসের নাম করে তাকে আমি ফোন করিনি।

সজলবাবু, আপনি সাপ নিয়ে খেলা করছেন—

ভয় দেখাচ্ছেন?

না, ভয়। আদালতে যা সত্য তা যখন প্রমাণ হবে—

আপনার আর কোন কথা আছে?

না! কিন্তু সজলবাবু এখনো আপনি ভেবে দেখুন, মিত্রানীর হত্যার ব্যাপারে আপনি বিশ্রীভাবে জড়িয়ে পড়ছেন—এখনো যা সত্য, অকপটে তা বলুন-নচেৎ আপনার চাকরি তো যাবেই—অপমানের চূড়ান্ত হবেন।

ঠিক আছে—ধরুন আমিই না হয় ফোন করেছিলাম—

আসল ব্যাপারটা জানার জন্য—

ধরুন তাই—

কোথা থেকে ফোনটা করেছিলেন—

পাবলিক বুথ থেকে–

না। আচ্ছা আর একটা কথা—

আমি আর আপনার কোন কথার জবাব দেবো না। দরকার যদি হয়ই তো আদালতেই দেবো–

তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে–

আমি উঠলাম—বলে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল সজল এবং আর দ্বিতীয় কোন বাক্য উচ্চারণ না করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতা ভঙ্গ করে সুশীল নন্দীই কথা বললেন, আশ্চর্য! ভদ্রলোক একজন দায়িত্বশীল অফিসার হয়ে এমন ব্যবহার করলেন কি করে—আগাগোড়া একেবারে মিথ্যা স্টেটমেন্ট দিয়ে গিয়েছেন—

আরো কিছু আছে সুশীলবাবু, মিত্রানীর হত্যাকারীকে কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করাতে গেলে আমাকে আরো কিছু প্রমাণ জোগাড় করতে হবে।

আপনি মিত্রানীর হত্যাকারীকে তাহলে ধরতে পেরেছেন?

পেরেছি সুশীলবাবু। তবে প্রমাণ, আরো কিছু প্রমাণ চাই—কেবলমাত্র অনুমানের উপর নির্ভর করে অত বড় অভিযোগটা একজনের উপর চাপানো যায় না। তাছাড়া আপনি তো জানেন-আদালত অনুমান চায় না—চায় প্রমাণ-অকাট্য প্রমাণ।

আচ্ছা কিরীটীবাবু, আপনার কি ধারণা সেদিন গার্ডেনে সজলবাবু উপস্থিত ছিলেন?

শুধু উপস্থিত থাকলেই তো হবে না সুশীলবাবু—ঘটনার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ও সক্রিয় যোগাযোগ থাকা চাই—সে-রকম কিছু যতক্ষণ না আপনার হাতের মুঠোয় আপনি পাচ্ছেন, তাকে আপনি স্পর্শ করতে পারবেন না। আইনের ফাঁক দিয়ে তিনি গলে বের হয়ে যাবেন।

আমার কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কিরীটীবাবু-সুশীল নন্দী বলতে গিয়ে যেন কেমন ইতস্তত করেন।

কি মনে হচ্ছে সুশীলবাবু?

সেই চোখে রঙিন চশমা, মুখে দাড়ি, হাতে বায়নাকুলার, মাথায় বেতের টুপি, পরনে কালো প্যান্ট ও স্ট্রাইপ দেওয়া হাওয়াই শার্ট—যাকে সুহাসবাবু সেদিন দেখেছিলেন গার্ডেনে তাদের কিছু দূরে—

আমি যদি বলি সুহাসবাবু যাকে সেদিন দেখেছিলেন গার্ডেনে অল্প দূরে, সে ব্যক্তির সঙ্গে মিত্রানীর হত্যাকাণ্ডের কোন সম্পর্ক নেই—

সম্পর্ক নেই!

না।

কিন্তু তাহলে অকুস্থানে ঐ বেতের টুপি ও বায়নাকুলার যা পাওয়া গিয়েছে সেটা ব্যাখ্যা কি করবেন কিরীটীবাবু?

হয়ত ঘটনাচক্রে ঐ হঠাৎ ধুলোর ঘূর্ণিঝড়ে বায়নাকুলারটা তার হাত থেকে পড়ে যায় ও সেই সঙ্গে মাথার বেতের টুপিটা–

সুব্রত ঐ সময় বললে, কিন্তু এমনও হতে পারে কিরীটী—

কি? কিরীটী সহাস্যে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল—

সম্পূর্ণ তৃতীয় ব্যক্তি একজন সেদিন ঐ গার্ডেনে ওদেরই মত হাজির হয়েছিল, তারপর বিকেলের দিকে অকস্মাৎ ধুলোর ঘূর্ণিঝড় ওঠায় দৈবক্রমে ঐ দলের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে–

বল—থামলি কেন? তারপর?

তারপর হয়ত মিত্রানীর মৃত্যুর ব্যাপারটা জানতে পেরে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা পলিসি নিয়েছে—কে চায় ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে বল্?

আমারও অনুমান ঠিক তাই সুব্রত—কাজেই ঐ ব্যক্তিটির আদি মধ্য ও শেষ জানতেই হবে যেমন করে থোক এবং সেইটাই আমার তৃতীয় জট মিত্রানীর হত্যা-রহস্যের।

সুশীল নন্দী কোন কথা বলেন না। কেমন যেন একটু বিব্রতভাবেই চুপ করে বসে থাকেন।

সুশীলবাবু—

বলুন—কিরীটীর ডাকে সুশীল নন্দী ওর দিকে তাকালেন।

আমাদের দৃঢ় ধারণা ওদের মধ্যে কেউ না কেউ ঐ ব্যক্তিটির পরিচয় ও সমস্ত রহস্য জানেন—

তাহলে ওদের সকলকে ডেকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয়—

হবে না। কোন ফল হবে তাতে করে—

তাহলে?

তা হলেও ভয় নেই! তাকে আমরা খুঁজে বের করবোই।

কেমন করে?

আপাতত এই মুহূর্তে সেটা আপনাকে বলতে পারছি না। তবে একটা কথা এর মধ্যে আছে—একমাত্র সুহাসবাবু ছাড়া কেউ তাকে দেখেননি অথচ সুহাসবাবুর চোখের দৃষ্টি তেমন প্রখর ছিল না–তার চোখের ব্যাধির জন্য কাজেই আমার মনে হচ্ছে অ্যাকচুয়ালি সুহাসবাবু নয়—অন্য কেউ লোকটিকে দেখেছিল—সে-ই এক সময় সুহাসবাবুকে কথাটা বলায় সুহাসবাবু হয়ত তাকিয়ে দেখেছিলেন

কিন্তু কথাটা তাহলে সুহাসবাবু একবারও বললেন না কেন?

সুহাসবাবুকে যতটুকু আমি স্টাডি করতে পেরেছি সুশীলবাবু, যাকে বলে সত্যিকারের ভদ্রলোক, তাই তিনি—তিনি হয়ত পরে ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরে মুখটা বন্ধ করে রেখেছেন, পাছে কেউ বিশ্রীভাবে জড়িয়ে পড়ে ঐ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে। কিন্তু আমি বের করে নেবো তার মুখ থেকে কথাটা—তারপর একটু থেমে বললে কিরীটী, ঐ রুমাল-রহস্যটা আমার কাছে অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে—

রুমাল রহস্য? শুধালেন সুশীল নন্দী।

হ্যাঁ, যে রুমালের সাহায্যে মিত্রানীকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল।

রুমালটা একমাত্র সুহাসবাবুকে কাজল বোস প্রেজেন্ট করেছিল, তারপর রুমালটা খোয়া যায়, এইটুকুই তো মাত্র আমরা জানতে পেরেছি আজ পর্যন্ত–

ঐটুকুই নয়—আরো কিছু আছে, যদি সেই ব্যক্তি ওদের কারো পরিচিত জনই হয় তাহলে আমাদের একান্তই জানা দরকার কেন সেদিন সে ঐখানে এসেছিল–তার আসার কি উদ্দেশ্য ছিল।

সমস্ত ব্যাপারটা যেন ক্রমশ আরো জটিল হয়ে উঠছে কিরীটীবাবু—সুশীল নন্দী বললেন।

ভয় নেই সুশীলবাবু, জটিলতা যাই হোক, আশা করছি সুহাসবাবুর সাহায্য আমরা পাবো। আপনি কাল বাদে পরশু আসবেন—বোধ হয় সে সময় এ রহস্যের মেঘনাদকে আপনার সামনে উপস্থাপিত করতে পারবো–

সুশীল নন্দী অতঃপর বিদায় নিলেন।

কিরীটী সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, শুভস্য শীঘ্রম—চল্ সুব্রত একটু ঘুরে আসা যাক—

কোথায় যাবি?

সুহাসবাবুর ওখানে এখন হয়ত তাকে তার অফিসেই পাওয়া যাবে—

কিন্তু সেখানে—

সে একটা ব্যবস্থা হবে, চল–ওঠ।

২২. সুহাস মিত্রকে তার অফিসে পাওয়া গেল না

সুহাস মিত্রকে তার অফিসে পাওয়া গেল না। সুহাস সেদিন অফিসেই আসেনি। কিরীটী আর সুব্রত তখন সোজা তার কলুটোলার বাড়িতে গেল।

সুহাস বাড়িতেই ছিল। বাইরের ঘরে জানালা দরজা সব বন্ধ করে একটা টেবিল ফ্যান চালিয়ে দিয়ে-পরনে একটা লুঙ্গি আর ছেড়া ময়লা গেঞ্জি—সুহাস শুয়ে ছিল।

বাচ্চা চাকরটা খবর দিতে তাড়াতাড়ি সে উঠে বসল–আসুন—কে!

চশমাটা চোখে ছিল না, পাশেই ছিল, তাড়াতাড়ি চশমাটা তুলে সুহাস চোখে পরে নিল, কিরীটীবাবু, সুব্রতবাবু—আপনারা—

আপনাকে একটু বিরক্ত করতে এলাম সুহাসবাবু, কিরীটী বললে।

না, না, বিরক্তির কি আছে, বসুন। কিন্তু হঠাৎ আমার কাছে—

কিরীটী আর সুব্রত বসলো চৌকিটার উপরেই, কারণ বসবার আর কোন জায়গা ছিল।

বলুন কি ব্যাপার?

সেই পুরোনো প্রশ্নটাই আবার করছি সুহাসবাবু, কিরীটী বললে, কার কাছে আপনি শুনেছিলেন মিত্রানী অন্য কাউকে ভালবাসে? আপনাদের বন্ধু সজল চক্রবর্তী কি?

না।

তবে?

সে কথা আর কেন কিরীটীবাবু, যা চিরদিনের মতই চুকেবুকে গিয়েছে—যা অতীত, তাকে আজ আর বর্তমানে টেনে এনে লাভ কি?

লাভ আপনার দিকে কিছু না হলেও, ব্যাপারটা জানতে পারলে আমার পক্ষে মিত্রানীর হত্যা-রহস্যের শেষ জটটি খুলতে হয়ত অনেকটা সুবিধা হতে পারে। তাছাড়া মিত্রানীকে তো আপনি সত্যিই ভালবাসতেন সুহাসবাবু, আপনি কি চান না তার হত্যাকারী শুধু হত্যাকারীই নয়, যে তার মৃতদেহটার উপর জঘন্য অত্যাচার করতে পর্যন্ত এতটুকু দ্বিধা বোধ করেনি সে ধরা পড়ক!

সুহাস চুপ করে রইলো।

বলুন সুহাসবাবু, মিত্রানীর প্রতি আপনার ভালবাসার কি কোন দায়িত্বই নেই?

কিরীটীবাবু, আমাকে অনুরোধ করবেন না–

বেশ—একখণ্ড কাগজে আমি নামটা লিখে এনেছি সেটা দেখুন একটিবার—বলতে বলতে কিরীটী পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা ছোট কাগজ বের করে সুহাসের দিকে এগিয়ে দিল, দেখুন তো নামটা মেলে কিনা

সুহাস কাগজের ভাঁজ খুলে নামটা পড়ে যেন একেবারে বোবা হয়ে বসে রইলো, তার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হয় না। কাগজটা হাতেই ধরা থাকে তার।

বুঝেছি আর আপনাকে বলতে হবে না—দিন কাগজটা-বলে সুহাসের হাত কাগজটা নিয়ে কিরীটী কাগজটা সুব্রতর দিকে এগিয়ে দিল, পুড়ে দেখ সুব্রত নামটা—এই মিত্রানীর হত্যাকারী–

সুব্রতও যেন নামটা পড়ে একেবারে বোবা হয়ে যায়।

সে শুধু অস্ফুট কণ্ঠে একটি মাত্র শব্দই উচ্চারণ করলো, আশ্চর্য!

ভাবতেই পারিসনি বোধ হয় ব্যাপারটা–কিরীটী বললে—

না।

কিন্তু তিনটি কারণে তোরও সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল—প্রথমত ঝড় ঠিক ওঠবার মুখে ঐ লোকটিই ছিল মিত্রানীর একেবারে কাছের জন—দুই রুমালটা-তিন ওরই। পরামর্শে সম্ভব সজল চক্রবর্তী সেদিন সুহাসের পরিচয়ে মিত্রানীকে ফোন করেছিল। আর সর্বশেষ যেটা, কেউ ভাবেনি কখনো—মিত্রানীর প্রতি মানুষটার লোভ থাকতে পারে—সে যে কথাটা প্রকাশ করেনি, কারণ সে ভাল ভাবেই জানত মিত্রানী সুহাসবাবুকে গভীরভাবে ভালবাসে-তাই নিজেকে কখনো প্রকাশ করেনি মিত্রানীর কাছে যেমন—তেমনি শেষ চালে সুহাসবাবুকেও ধ্বংস করতে চেয়েছিল।

সুহাস কথা বললে, সত্যি সত্যি বলছেন আপনি কিরীটীবাবু!

হ্যাঁ। আশ্চর্য—এখনো যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না—

শুনলে ব্যাপারটা আপনাদের মত সকলেই বিস্মিত হবে—কিন্তু জানেন তো টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন বলে একটি চলতি প্রবাদ আছে! কিন্তু সে যাই হোক, সত্যটা জানবার পর এখন তো বুঝতে পারছেন, আপনাদের দুজনার প্রতিই তার প্রচণ্ড ঘৃণা কি ভাবে এক নিষ্ঠুর আক্রোশে পরিবর্তিত হয়েছিল, যে আক্রোশের জন্য মিত্রানীকে নিষ্ঠুর মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে এবং আপনিও এগিয়ে এসেছিলেন ফাঁসির দড়ির দিকে।

সুহাস স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। কিরীটী আবার বললে, এবারে বলুন তো সুহাসবাবু, আপনি কি সেদিন সত্যি সত্যিই স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন, সেই বেতের টুপি মাথায়-মুখে দাড়ি চোখে রঙিন চশমা লোকটাকে, না কেউ আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করায় সেদিকে আপনার নজর পড়েছিল।

সুহাস চুপ করে থাকে।

আমার অনুমান কিন্তু, আপনার নজরে আসেনি প্রথমে এবং আপনার ঐ বন্ধুই সেই দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল—তাই নয় কি?

হ্যাঁ।

এখন তো বুঝতে পারছেন, সকলের মধ্যে বিশেষ করে আপনারই তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবার পিছনে তার বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল—

পারছি বৈকি! কিন্তু এখনো বুঝতে পারছি না—-মিত্রানীকে তার যদি প্রয়োজনই ছিল তো সে অমন বাঁকা পথে গেল কেন?

আকর্ষণটা হয়ত ভালবাসা নয়—একটা জৈবিক আকর্ষণ মাত্র—রিপুর তাড়না!

মনে হচ্ছে—সুহাস বললে, মিত্ৰাণীও বোধ হয় ব্যাপারটা কখনো এতটুকু আঁচ করতে পারেনি!

আঁচ করতে পারলে তার ডাইরীতেই হয়ত থাকতো। কি জানেন সুহাসবাবু— আপনাদের ঐ বন্ধুটি কেবলমাত্র যে আপনার বন্ধুত্বেরই সুযোগ নিয়েছে তাই নয়–আপনার চোখের ক্ষীণ দৃষ্টিরও সুযোগ নিয়েছে—

কি বলছেন আপনি?

ঠিকই বলছি, এবং আপনার রুমালটার ব্যাপারেও আমার অনুমান—সেদিন অফিসে আপনাকে পিকনিকের কথা বলতে গিয়ে আপনার রুমালটা হাতসাফাই করেছিল– চোখের ক্ষীণ দৃষ্টির জন্য হয়ত ব্যাপারটা আপনার নজরে আসেনি–

ঐ রুমালটা তাহলে–

হ্যাঁ  সুহাসবাবু—আপনার প্রতি পুলিসের সন্দেহটা যাতে আরো বেশী ঘনীভূত হয়-সেই কারণেই রুমালটা হাতসাফাই করেছিল–

সুব্রত এতক্ষণে কথা বললে, সবই করেছিল—প্ল্যানটা তার সাকসেসফুলও হয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্য ভদ্রলোকের যে মিত্রানী কিরীটী রায়ের মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে–

কিরীটীবাবু—

বলুন—

এখন কি তাহলে ওকে আপনি পুলিসের হাতে তুলে দেবেন?

সমাজের মধ্যে বাস করে একজন দেশের নাগরিকের সাধারণ কর্তব্যবুদ্ধি তো তাই বলে সুহাসবাবু, তবে যে মুহূর্তে আমার কাছে সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে—তখুনি মনে হয়েছে ফাঁসির দড়ি বোধ হয় ওর যোগ্য শাস্তি নয়—এক মুহূর্তেই। তো সব শেষ হয়ে যাবে—এবং সেটা ওর প্রতি অনুকম্পাই প্রকাশ করা হবে-তা আমি ঠিক চাই না—

আপনি তাহলে—

দেখি, এখনো ঠিক ভেবে উঠতে পারিনি—

কিন্তু ফাঁসিই তো ওর যোগ্য শাস্তি কিরীটীবাবু—সুহাস বললে।

ঠিক–কিন্তু প্রমাণ করবেন কি করে যে ওই হত্যাকারী! আদালত চায় প্রমাণ আইন চায় প্রমাণ, কাজেই ওর তখুনি ফাঁসি হতে পারে যদি ওর স্বীকারোক্তি পাই আমরা।

তা কি ও দেবে?

দেবে না সহজে জানি, কিন্তু তবু শেষ চেষ্টা আমি করবোই—আপনার কাছে আমার একটা বিশেষ অনুরোধ সুহাসবাবু—

বলুন—

ঘুণাক্ষরেও যেন ও নামটা কেউ না এখন জানতে পারে—

না কিরীটীবাবু, আমি কারো কাছে বলবো না।

ঠিক আছে—আমরা তাহলে এবার উঠবো।

সুহাস মিত্র কোন কথা বললো না। ওরা দুজনে উঠে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

দুটো দিন তারপর কিরীটী আর কোথাও বের হলো না। তবে মধ্যে মধ্যে দু-একজনকে ফোন করল। কয়েক জায়গা থেকে ফোনও এলো।

সুব্রত আর ফিরে যায়নি—সর্বক্ষণ কিরীটীর পাশে পাশেই রয়েছে।

কিরীটীকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করেনি—নিজেও কোন কথা বলেনি। প্রতীক্ষা করেছে কেবল কিরীটী কখন মুখ খুলবে!

তৃতীয় দিন দ্বিপ্রহরে হঠাৎ কিরীটী মুখ খুললো। বললে, পেয়েছি রে সুব্রত–পথ খুঁজে পেয়েছি–

কি—সুশীল নন্দীকে সব জানাবি?

হ্যাঁ জানাবো, তবে—

তবে?

সোজাসুজি নয়—

কিভাবে তাহলে তাকে ব্যাপারটা জানবি?

একটা চিঠি—

চিঠি। চিঠি সুশীল নন্দীকে?

না–সুশীল নন্দীকে নয়—

তবে কাকে?

হত্যাকারীকে একটা চিঠি দেবো—

হত্যাকারীকে চিঠি! কিন্তু সে চিঠি পাবার পর যদি লোকটা একেবারে উধাও হয়ে যায়?

আমার বিশ্বাস যাবে না—আর যদি যায়ই আমাদের উদ্দেশ্য পুরোপুরিই সফল হবে–

সফল হবে। নিশ্চয়ই। সে-ই যে অপরাধী সেটা তার ঐ পলায়ন থেকে প্রমাণিত হয়ে যাবে— তখনই পুলিস তাকে অনায়াসে হত্যাকারী বলে চিহ্নিতও করতে পারবে।

কিন্তু চিঠি লিখবো বললেও কিরীটী ঠিক করে উঠতে পারে না কিভাবে চিঠিটা লিখবে কোথায় তার শুরু, কোথায় তার শেষ।

মনে মনে অনেক মুসাবিদা করে কিরীটী কিন্তু কোনটাই যেন পছন্দ হয় না।

ঐদিনই মধ্যরাত্রে কিরীটী লেখার প্যাড ও কলম নিয়ে বসলো, তারপর শুরু করলো তার চিঠি–

কি ভাবে আপনাকে সম্বোধন করবো চিঠির শুরুতে তা অনেক ভেবেও স্থির করতে পারলাম না। প্রিয়বরেষুও লিখতে পারি না–সবিনয় নিবেদন দিয়েও শুরু করতে পারি না—তবু লিখতেই হবে চিঠিটা আপনাকে—তাই কোন সম্বোধন না করেই শুরু করছি চিঠি।

চিঠিটা আমি ডাকে দেবো না কারো হাত দিয়ে পৌঁছে দেবো, যাতে পথে না মারা যায় চিঠিটা।

কিরীটী লিখতে লাগল।

২৩. চিঠিটা আমার পড়তে বসে

চিঠিটা আমার পড়তে বসে চিঠির শেষে প্রেরকের নামটা যে আপনি শুরুতেই পড়ে দেখবার কৌতূহলটা দমন করতে পারবেন না সেটা আমি জানি বলেই নামটা শুরুতেই আমার জানিয়ে দিচ্ছি—আমি কিরীটী রায়।

এবারে বোধ হয় বুঝতে আর আপনার কোন অসুবিধা হবে না, হঠাৎ কিরীটী রায়ের আপনাকে চিঠি লিখবার কি এমন প্রয়োজন হলো! আর কেনই বা এই চিঠি।

চিঠির শুরুতেই আরো একটা কথা আপনার অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি, এই চিঠির অন্য দুটি কার্বন কপির একটি শিবপুর থানার ও. সি. সুশীল নন্দী ও অন্যটি কলিকাতার পুলিস কমিশনারের কাছে একই সঙ্গে যাচ্ছে। অবশ্যই স্বীকার করবো, সুশীলবাবুর সক্রিয় সাহায্য না পেলে এত তাড়াতাড়ি আপনাকে হয়ত চিহ্নিত করতে পারতাম না।

অস্বীকার করবো না, আপনার হত্যা করবার প্ল্যান বা পরিকল্পনাটা আপনি সুনিপুণভাবে নিখুঁত করবার চেষ্টা করেছিলেন একই ঢিলে দুই পাখী মারতে। এক— মিত্রানীকে হত্যা করতে ও দুই—সেই হত্যার অপরাধটা সম্পূর্ণ নির্দোষ এক তৃতীয় ব্যক্তির কাঁধে চাপিয়ে দিতে। যদিও প্রধানত উদ্দেশ্য ছিল আপনার মিত্রানীকে হত্যা করা।

হত্যার উদ্দেশ্য বা মোটিভ কিন্তু পোস্টমর্টেম বা ময়না তদন্তের রিপোর্টটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

মৃতদেহের উপরে হত্যাকারী তার যৌন লালসা মিটিয়েছে যখনই জানতে পারলাম তখন আর বুঝতে আবার বাকী ছিল না—হত্যাকারীর মিত্রানীর দেহকে ঘিরে ছিল একটা দীর্ঘদিন ধরে যৌনলালসা—যেটা পরিতৃপ্তির কোন পথ না খুঁজে পেয়ে তার রক্তের মধ্যে যেমন একটা ঘূর্ণি সৃষ্টিই যে করেছিল তা নয়, সেই সঙ্গে ঐ নিষ্কলঙ্কতাকে ঘিরে জন্মেছিল একটা দুর্নিবার আক্রোশ এবং ঐ দুটিরই বহিঃপ্রকাশ প্রথমে হত্যা ও পরে ধর্ষণের মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

হয়তো আপনার পরিকল্পনা বা প্ল্যানটা এত সহজে বানচাল হয়ে যেতো না, যদি না আপনার ক্রুয়েল ডেস্টিনির অলিখিত নির্দেশ আমাকে ঘটনাচক্রে টেনে না নিয়ে আসতে মিত্রানীর হত্যার ব্যাপারে। মিত্রানীর বাবা আমার পরম শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই শ্ৰীযুক্ত অবিনাশ ঘোষালের মুখের দিকে তাকিয়েই আমি হত্যা-রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারটা হাতে তুলে নিয়েছিলাম।

আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না—সেই নিরীহ, একান্ত শান্তিপ্রিয় অজাতশত্রু বৃদ্ধ মানুষটির বুকে কি নির্মম আঘাতই না আপনি হেনেছেন, মিত্রানীর দেহকে ঘিরে আপনার দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত লালসা ও তাকে পরিতৃপ্ত করবার কোন পথ না খুঁজে পেয়ে সেই আক্রোশে অন্ধ হয়ে।

আপনাকে আমি সত্যি বলছি, যে মুহূর্তে হত্যার মোটিভটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম এই কথা ভেবে যে মানুষ তার গোপন লালসার তাগিদে কোন্ গভীর ভয়াবহ অন্ধকারে নেমে যেতে পারে।

সত্যি আমার ভাবতেও দুঃখ লাগে, মিত্রানীর মত অমন একটি মেয়ের মধ্যে আর কিছুই আপনি খুঁজে পেলেন না পেলেন কেবল তার দেহটাকে ঘিরে একটা জঘন্য কুৎসিত যৌনলালসা দীর্ঘদিনের পরিচয়ে! একবারও কি আপনার মনে হয়নি, তার দেহের স্থূল যৌন আকর্ষণের চাইতে তার সুন্দর পবিত্র মনের আকর্ষণ অনেক বেশী সুষমাকে ছেড়ে আপনি নরকের দুর্গন্ধ কাদা নিয়ে ঘাঁটলেন।

যখনই ভাবি মানুষ কোন্ স্তরে নামলে ঐভাবে একজনের কোমল গলায় রুমালের মৃত্যু-ফাস দিতে পারে, আমি যেন ক্ষমার কথাই ভুলে যাই।

মিত্রানীকে যে আপনি কোনদিনই পাবেন না, সে সুহাসকে ভালবাসে এবং সুহাসও তাকে ভালবাসে বুঝতে পেরেই বোধ হয় শেষ পর্যন্ত মরীয়া হয়ে উঠেছিলেন—

কিন্তু সেই সঙ্গে যখন ভাবি নিরপরাধ সুহাসকে আপনি ফাঁসিকাঠের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন, একটা প্রায় দৃষ্টিহীন লোককে আপনি কি চরম দুর্গতির দিকে ঠেলে দিতে উদ্যত হয়েছিলেন তখন আপনার যোগ্য বিশেষণ কি খুঁজে পাই না—

(১) আপনি ভেবেছিলেন সুহাস জীবনে যখন কখনো মিত্রানীকে ফোন করেনি, সে সুনিশ্চিত তার গলাটা চিনতে পারবে না—অন্যের গলাকে ফোনে সুহাসের গলা বলেই ভুল করবে-তাতে করে আপনার উদ্দেশ্যও সফল হবে—সজলকে দিয়ে মিত্রানীকে ফোন করালে।

অস্বীকার করবো না—সফল হয়েছিলেন মিত্রানীও ভুলই করেছিল, কিন্তু অমন সুষ্ঠু প্ল্যানটা বানচাল হয়ে গেল মিত্রানীর ডাইরী থেকে। সে ডাইরীতে ঐ ফোনের কথা লিখে রাখবে আপনি কল্পনাও করতে পারেননি। আর সেই ডাইরীটা আবার একদিন আপনার মৃত্যুবাণ হয়ে আমারই হাতে আসবে—

(২) তারপর ঐ সিল্কের রুমালটা। সুহাসবাবুর যে ক্ষীণদৃষ্টির সুযোগ নিয়ে সেদিন তার অফিসে পিকনিকের কথা বলতে গিয়ে নিঃশব্দে হাতসাফাই করেছিলেন—আপনি কল্পনাও করতে পারেননি সুহাসবাবুর সেই ক্ষীণদৃষ্টিই আপনার মৃত্যুবাণ হয়ে আপনার দিকেই ফিরে আসবে। একেই বলে অদৃষ্টের পরিহাস।

(৩) সুহাসবাবুর দুচোখের ঐ ক্ষীণদৃষ্টি আপনার পরিকল্পনার বা সুষ্ঠু প্ল্যানের আরো একটা ব্যাপার বানচাল করে দিয়েছে সেটা হচ্ছে সেই চোখে চশমা, মুখে দাড়ি, মাথায় বেতের টুপি পরা ভদ্রলোকটি—যাকে আপনিই সাজিয়ে এনেছিলেন ঐদিন বটানিক্যাল গার্ডেনে এবং সম্ভবত আপনার ইচ্ছা ছিল সেই লোকটির প্রতি সুহাসবাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কানের কাছে কথাটা বলে করেছিলেন তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ।

কেবলমাত্র দলের মধ্যে সুহাসবাবুকেই সেই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার পিছনে আপনার প্ল্যান ছিল—পুলিসের দৃষ্টি যাতে সেই অজ্ঞাত পরিচয়নামার প্রতি পড়ে। সকলকে সে কথা বলেননি—ঝামেলা এড়াবার জন্য আপনার কথামতই সুহাসবাবু পুলিসের কাছে লোকটির বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাও প্রথমটায় নয়, আমার প্রশ্নের জবাবে সেদিন থানায়। কাজেই বুঝতে পারছেন সুহাসবাবুর ব্যাপারটা মনে ছিল না–মনে থাকবার কথাও নয়।

কিন্তু আপনি আবারও ভুল করে বসলেন—মারাত্মক ভুল, যেটা আমার কাছে অস্পষ্ট থাকেনি—সুহাসবাবুর দৃষ্টি এত ক্ষীণ ছিল যে দূর থেকে সেই আপনার সাজানো ব্যক্তিকে দেখে তার নিখুঁত একটা বর্ণনা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না—তিনি যা বলেছেন আমার কাছে সেটা আপনারই লোকটির সম্পর্কে বিবরণের কেবল পুনরাবৃত্তি মাত্র। তারপর সেই টুপি ও বায়নাকুলার—আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় সেও আপনিই লোকটিকে সাপ্লাই করেছিলেন। আপনি একজন ফিল্মের নামী ডিরেক্টরের প্রধান অ্যাসিস্ট্যান্ট-অনেক একস্ট্রা নিয়ে আপনার কাজ-কারবার যেমন, তেমনি অনেকেই ফিল্মে একটু চান্স পাওয়ার জন্য হয়ত আপনার আশেপাশে ঘুরঘুর করে তোষামোদ করে, তাদেরই একজনকে ঐভাবে সেদিন মেকআপ দিয়ে বেগার দেওয়াতে আপনার অসুবিধা হবার কথা নয়—কিন্তু সেখানেও আবার ভুল করলেন আপনি, অকুস্থানে তার টুপি ও বায়নাকুলারটা তাকে দিয়ে ফেলে রেখে। সে আপনার কথা মতই কাজ করেছে—সেগুলো ফেলে পালিয়েছে—আর অন্য দিকে আপনার তৈরী ফাদে আপনিই আটকা পড়ে গেলেন।

তার নিজের যদি ঐ বায়নাকুলারটা হতো–তাহলে সে অত দামী জিনিসটা ঐভাবে ফেলে পালাত না—তাছাড়া লোকটা পরে নিজের বিপদের সম্ভাবনা দেখেই থানায় সুশীলবাবুর কাছে অকপটে সেদিনকার কথাটা প্রকাশ করে দিত না, বুঝেছেন তো—আবার সেই ভাগ্যের পরিহাস!

(৪) এবারে আসবো সেই মুহূর্তের ঘটনায়। এ কথা সত্যি, আপনি একটা সুযোগ পেয়ে তা ব্যবহার করেছেন এবং সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য দুই বলবো আপনার—সেদিনকার সংবাদপত্রের ফোরকাস্ট-মত ঠিক সময়ে ধুলোর ঝড় উঠলো—আপনার হাতের মধ্যে এসে গেল সুযোগ—আপনি হত্যা করলেন মিত্রানীকে

(৫) কিন্তু আপনার প্রতিদিনকার লালসা, মিত্রানীকে ঘিরে যা আপনাকে ক্ষিপ্ত করেছিল—সেই লালসাতেই আপনি সেই মৃতদেহের উপরই ঝাপিয়ে পড়লেন। মার্ডারার সাধারণত দুই রকমের হয়—একটা হয় হ্যাবিচুয়াল মার্ডারার-যারা কোন স্বার্থে বা উদ্দেশ্যে হত্যা করে—আর এক শ্রেণীর খুনী হচ্ছে যারা লুনাটিক ম্যানিয়াক—আপনি শেষোক্ত শ্রেণীর—লালসা আপনাকে উন্মাদ করে তুলেছিল।

(৬) প্রোবাবিলিটি ও চান্সের দিক দিয়ে আপনাকেই আমি চিহ্নিত করেছি, কারণ আপনিই ছিলেন ধুলোর ঘূর্ণিঝড় ওঠবার পূর্বমুহূর্তে মিত্রানীর একেবারে ঠিক পাশেই এবং মোটিভের কথা তো আগেই বলেছি আপনার। তবু অদৃষ্টের পরিহাস আপনাকে দিয়ে মোক্ষম ভুলটি করিয়ে নিয়েছিল—আপনার মাথার চুলই দলের মধ্যে একমাত্র কটা—সেই রকম একটি চুলই নিহত ও পরে ধর্ষিতা মিত্রানীর ব্লাউজের মধ্যে আটকে ছিল। কাজেই হত্যা করবার পর যদি তাকে না ধর্ষণের চেষ্টা করতেন, ঐ চুলটা তার ব্লাউজে যদি না। আটকে থাকতো আপনাকে সনাক্ত করা কিছুটা কঠিন হতো। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন তো, ধর্ষণটা আপনার কত বড় মারাত্মক ভুল হয়েছিল এবং যেটা আপনার আসল এবং আদি ও অকৃত্রিম চেহারাটা আমার চোখের সামনে স্পষ্ট করে তুলেছে।

২৪. থানায় বসে সুশীল নন্দী

থানায় বসে সুশীল নন্দীও ঐ রাত্রেই কিরীটীর লোক মারফৎ প্রেরিত চিঠিটা পড়ছিলেন। চিঠি যত এগিয়ে চলেছে ততই যেন তাকে কি এক আকর্ষণে টেনে নিয়ে চলছে।

বস্তুত কিরীটী যে জোর গলায় বলেছে অনেকবার, মিত্রানীর হত্যাকারী তাদের দলেরই একজন—পরিচিতদেরই একজন—তিনি যেন ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি, কিন্তু আজ কিরীটীর চিঠিখানা পড়তে পড়তে বিস্ময়ের সঙ্গে যেন বিশ্বাস তার মনের মধ্যে দৃঢ়বদ্ধ হয়ে উঠছে।

 

সুশীল নন্দী পড়তে লাগলেন–

তবে ঐ সঙ্গে এও আমি স্বীকার করব, সেদিনকার ফোরকাস্ট আবহাওয়া সম্পর্কে ঠিকমত সত্য হয়ে যাওয়ায় আপনি যে সুযোগটা পেয়েছিলেন সেটা আপনার নির্দোষিতার পক্ষেই গিয়েছিল। আকাশের চাঁদ হঠাৎ ঢাকা পড়লে অন্ধকার হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু পরমুহূর্তেই মেঘ অপসারিত হলে যেমন আবার আলো দেখা দেয়—আপনার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ধুলোর ঘূর্ণিঝড় ওঠা সত্ত্বেও আপনার অপকীর্তি চাপা থাকেনি। আপনার ভুলগুলো—যা মরা পাখীর পালকের মত চারিদিকে ছড়িয়ে ছিল, সেগুলোই আপনার মিত্রানীকে হত্যার সাক্ষী দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রমাণগুলোর কথা আগেই বলেছি, এবার শেষ কথায় আসছি।

(৭) আমার প্রথম থেকেই ধারণা হয়েছিল এবং আপনাদেরও বলেছি যে আপনাদের মধ্যেই কেউ সেদিন ঐভাবে মিত্রানীকে হত্যা করেছেন কিন্তু কেন—কেন আমার এ ধারণা হলো। প্রথমত আপনারা যে সেদিন গার্ডেনে পিকনিক করতে যাবেন—বাইরের কেউ সে কথা জানত না একমাত্র আপনারা কজন ছাড়া দ্বিতীয়ত সেই চশমাধারী দাড়িওয়ালাকে দিয়ে যে গোলকধাঁধার সৃষ্টি করেছিলেন—সেটা তাহলে একমাত্র ক্ষীণদৃষ্টি সুহাসবাবুরই নজরে পড়তো না এবং সেটা পড়েছিল আপনিই সে কথাটা একসময় সুহাসবাবুকে বলায়—আর আপনি জানতেন সুহাসবাবুর ক্ষীণদৃষ্টির কথা। তৃতীয়ত ঝড় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আপনি মিত্রানীকে অনুসরণ করেন এবং যেতে যেতে দুজনকে আপনি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন সুহাসবাবু ও কাজল বোসকে। চতুর্থত আপনিই মিত্রানীর মৃতদেহটার প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন—যেহেতু আপনিই একমাত্র ব্যাপারটা তখন পর্যন্ত জানতেন। এবং সেটা অবিলম্বে প্রকাশ হওয়ার একান্ত প্রয়োজন ছিল।

(৮) আপনার এটাও নিশ্চয়ই ভুল হবে না—মিত্রানীর মৃত্যুটা যে স্বাভাবিক নয় তখনো সেটা কেউ জানতে পারেনি এবং মৃতদেহ তোলবার সময় আপনিই তার গলায় রুমালের ফাসটা প্রথমে দেখতে পেয়ে অস্ফুট চিৎকার করে ওঠেন সকলের জবানবন্দী মত।

দেখুন কেমন করে আবার অদৃষ্টের পরিহাস আপনাকে দিয়েই আপনার পাপাচারের কথাটা ঘোষিত করালো! একবারও তখন আপনার মনে হয়নি বিদ্যুৎবাবু

ধক করে উঠলো যেন সুশীল নন্দীর এতক্ষণ পরে চিঠির মধ্যে ঐ নামটা পড়ে। বিদ্যুৎ বিদ্যুৎ সরকারই তাহলে?

কয়েকটা মুহূর্ত বিহুল বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে থাকেন সুশীল নন্দী। তারপর আবার পড়তে শুরু করেন

হ্যাঁ একবারও আপনার ঐ মুহূর্তে মনে হয়নি সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে তার গলায় চেপে বসা রুমালের ফাসটা অত সহজে কারো চোখে পড়ার কথা নয়, তাছাড়া আপনিই মাথার দিকটা ধরেছিলেন তার ইচ্ছা করে—ঐ কথাটা সকলকে জানাবার জন্য—আবার। সেই অদৃষ্টের পরিহাস, আপনি টর্চের আলোয় ব্যাপারটা সকলের দৃষ্টিগোচর করলেন! আপনি একবারও হয়ত ভাবেননি বিদ্যুৎবাবু, হত্যা মানেই পুলিস অনুসন্ধান ও সর্বশেষে আদালতের কাঠগড়া!

যাক—আমার যা বলবার ছিল বললাম। এবার আপনি কি করবেন না করবেন নিজেই ভেবে দেখবেন—তবে জানবেন—ভোর হওয়ার আগেই হয়ত পুলিস আপনার ওখানে হানা দেবে, কারণ আমি তো আগেই বলেছি-আপনাকে লেখা এই চিঠির আরো দুটো কপি একটি সুশীল নন্দীকে ও অন্যটি পুলিস কমিশনারকে একই সঙ্গে পাঠালাম।

আমার কাজ শেষ।

আপনাদের কিরীটী রায়।

 

তখনো ভাল করে প্রথম ভোরের আলো ফুটে ওঠেনি—শেষ রাতের আকাশে তখনও চাঁদের আলোর খানিকটা আভাস লেগে আছে।

পর পর দুখানা পুলিসের জীপ সেই বিরাট বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল।

বাড়ির লোকজনদের জাগিয়ে পুলিস অফিসারদের ভিতরে ঢুকতে কিছুটা সময় লাগলো। বাড়ির লোক সকলে স্তম্ভিত বিমূঢ়।

দোতলার একটা ঘর বাড়ির লোকেরা অফিসারদের দেখিয়ে দিল দরজাটা বন্ধ ছিল—

ধাক্কা দেওয়া সত্ত্বেও যখন ভিতর থেকে কেউ খুললো না—দরজা ভেঙে ফেলল। এবং ঘরে পা দিয়েই ওরা থমকে দাঁড়াল।

মানুষটি বসে আছে চেয়ারে—হাতে ধরা তার কিরীটীর চিঠির শেষ পৃষ্ঠাটা ও বাকী দুটো পায়ের কাছে পড়ে আছে।

বিদ্যুৎবাবু—আমরা থানা থেকে আসছি!

কেমন যেন শূন্য বোবা দৃষ্টিতে বিদ্যুৎ তাকাল অফিসারের মুখের দিকে।

Exit mobile version