মিত্রানী—সুহাস! কোথায় তোমরা! মিত্রানী সু-হা-স—
বিদ্যুৎই ওদের মধ্যে শেষ ঝাপসা আলোয় প্রথমটায় সুহাসকে আবিষ্কার। করেছিল—সর্বপ্রথম। অর্থাৎ ওর দৃষ্টিই সকলের আগে সুহাসের উপরে গিয়ে পড়ে।
সুহাস উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে আছে—একটা ভাঙা পত্রবহুল গাছের ডাল, তারই নীচে সুহাসের দেহের নিম্নাংশ চাপা পড়েছে।
বিদ্যুৎ আর অমিয় তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ভাঙা ডালটা টেনে সরায়—অন্যরা সুহাসের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে। কাজল ডাকে, সুহাস!
সবাই তার গলায় যেন একটা কান্নার সুর শুনছিল।
মিত্রানীর কথা ঐ মুহূর্তে আর কারো মনে ছিল না। মনেও পড়েনি কথাটা কারো যে একা সুহাসই নয়, মিত্রানীকেও পাওয়া যাচ্ছে না সুহাসকে নিয়েই সকলে তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
কাজল বসে পড়েছিল একেবারে সুহাসের মাথার সামনে। তার মাথাটা নিজের কোলের উপর তুলে নিয়ে ডাকে, সুহাস—সুহাস–
সুহাস যেন অতি কষ্টে চোখ মেলে তাকাল।
সুহাস—কাজল আরো ঝুঁকে পড়ে সুহাসের মুখের কাছে।
কে?
আ—আমি কাজল।
বিদ্যুৎ এগিয়ে এলো। সে বললে, লেগেছে কোথাও তোর সুহাস?
হ্যাঁ—মাথায়—
সত্যিই সুহাসের মাথায় আঘাতের চিহ্ন ও রক্ত।
সুহাস উঠে বসতে বসতে বললে, উঃ, ভীষণ চোট লেগেছে মাথায়। এখনো মাথার মধ্যে ঝিম ঝিম করছে, ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠে সুহাস বললে। তারপরই একটু থেমে বললে, মিত্রানী—মিত্রানী কোথায়?
বিদ্যুৎ বললে, মিত্রানীকে দেখছি না। তুই দেখেছিস তাকে?
না তো—তবে—
কি তবে? অমিয় সাগ্রহে শুধায়।
ধুলোয় ঘূর্ণির অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, সুহাস পূর্ববৎ ক্লান্ত গলায় বলতে থাকে থেমে থেমে, হঠাৎ আমার মাথায় একটা প্রচণ্ড আঘাত পেলাম পিছন থেকে—মাথাটা ঝিম্ ঝিম্ করে উঠলো—সব অন্ধকার হয়ে গেল
তারপর? বিদ্যুৎ শুধালো।
জানি না। তারপর আর কিছু জানি না।
০৫. মিত্রানীকে বেশী খুঁজতে হয়নি
মিত্রানীকে বেশী খুঁজতে হয়নি–
সুহাস যেখানে পড়ে ছিল–সেই ঝোপটারই অন্য দিকে একটা গাছের নীচে, মিত্রানীকে পাওয়া গেল–চিত হয়ে পড়ে আছে মিত্রানী। হাত দুটো ছড়ানো। বিদ্যুৎই প্রথমে দেখতে পায়।
তার পরনের নীল মুর্শিদাবাদী সিল্কের শাড়িটার আঁচল বুকের উপর থেকে সরে গিয়েছে আর শাড়ির প্রান্তভাগটা প্রসারিত হাঁটুর অনেকটা উপরে উঠে এসেছে। বাঁ দিককার জঙ্ঘা অনেকটা
গায়ের ব্লাউজের বোতামগুলো মনে হয় কেউ যেন হ্যাচকা টানে ছিড়ে ফেলেছে। তলার ব্রেসিয়ারটারও একই অবস্থা।
চোখ দুটো যেন মিত্রানীর ঠেলে বের হয়ে আসছে। যেন এক অসহ্য যন্ত্রণার স্পষ্ট চিহ্ন ওর সারা মুখে তখনো। মুখটা সামান্য হাঁ করা, উপরের পাটির দাঁতের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। বোবা—সবাই যেন বোরা হয়ে গিয়েছে।
বিদ্যুৎই সামনে মিত্রানীর মুখের উপরে ঝুঁকে পড়ে অর্ধস্ফুট একটা চিৎকার করে ওঠে।
মিত্রানী—মিত্রানী মরে গেছে—
হ্যাঁ–সত্যিই—মিত্রানী মৃত।
ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই যেন কেমন বোবা–বিমূঢ়।
সবাই একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। কেমন যেন বোবা অসহায় দৃষ্টিতে। সুহাস-বিদ্যুৎ-অমিয়-সতীন্দ্র-কাজল-পাপিয়া-মণি-ক্ষিতীশ–
ইতিমধ্যে আসন্ন সন্ধ্যায় ঝাপসা অন্ধকার কখন যেন আরো ঘন, আরো জমাট বেঁধে উঠেছে।
কেউ কাউকে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না, ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে কেবল আটটি মানুষের উপস্থিতি।
সামান্য কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তেই বাতাসে একটা আলগা ঠাণ্ডার আমেজ তখন।
মিত্রানী মৃত।
নজন এসেছিল—তাদের মধ্যে একজন থেকেও নেই-পড়ে আছে ওদের সকলের। চোখের সামনেই তার প্রাণহীন দেহটা মাত্র। মিত্রানী আর কোন দিনই কথা বলবে না—-হাসবে না, সুললিত মধুর গলায় রবীন্দ্র বা অতুলপ্রসাদের গান গেয়ে উঠবে না।
ভারী জমাট প্রাণান্তকর স্তব্ধতাটা যেন বিদ্যুতের কণ্ঠস্বরে হঠাৎ তরঙ্গায়িত হয়ে উঠলো। সকলকেই যেন সে প্রশ্ন করলো, এখন কি করি আমরা?
বিদ্যুতের প্রশ্নে সকলেই নিঃশব্দে এ ওর মুখের দিকে তাকাল। তাই তো, কি এখন করবে ওরা—কি করতে পারে ওরা?
সুহাস জবাবটা যেন দিল, মিত্রানীকে তো এইভাবে এখানে ফেলে যেতে পারি না–
বিদ্যুৎ বললে, তবে কি করবো?
ওর মৃতদেহটা চল তোমার গাড়িতে করেই—
বিদ্যুৎ বললে নিয়ে যাবো?
হ্যাঁ—
কোথায়? কোথায় নিয়ে যাব। বললে আবার বিদ্যুৎ।
ক্ষিতীশ বললে, আচ্ছা বিদ্যুৎ, এমনও তো হতে পারে এখনো ও মরে যায়নি বেঁচে আছে। আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না, হয়ত ঝড়ের মধ্যে আচমকা পড়ে গিয়ে খুব বেশী আঘাত পেয়ে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।
তাহলে? কাজল বললে।
পাপিয়া বললে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয় না—
ক্ষিতীশ বললে, হ্যাঁ সেই ভাল। চ, আমরা ওকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলি–
বিদ্যুৎ মাথার দিকে ধরলো, ক্ষিতীশ আর অমিয় দুজন পায়ের দিকে। মিত্রানীর দেহটা তুলতে গিয়েই বিদ্যুৎ যেন হাতে কিসের স্পর্শ পেয়ে তাড়াতাড়ি বললে, এই, কারো টর্চ আছে—টর্চের আলোটা ফেল তে।
টর্চের আলো ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ বললে, নামাও–
ওরা আবার একটু যেন থতমত খেয়েই বিদ্যুতের কথায় মিত্রানীর মৃতদেহটা মাটির উপরে নামাল।
দেখি সতীন্দ্র, টর্চটা–
বিদ্যুৎ সতীন্দ্রের হাত থেকে টর্চটা নিয়ে মিত্রানীর গলার কাছে ফেলতেই সর্বপ্রথম ব্যাপারটা তার নজরে পড়লো, মিত্রানীর গলায় একটা সাদা সিল্কের রুমাল পেঁচিয়ে গলার পিছন দিকে শক্ত গিঁট দিয়ে বাঁধা। অন্যান্য সকলেরও ইতিমধ্যে ঐ দিকে দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে।