হয়ত নাও জুটতে পারতো, তাছাড়া–
কি?
তুমি যা বলছে—এম. এ.-র রেজাল্টটা ভাল হলে এবং সেরকম চাকরি না পেলে ব্যর্থতাটা হয়ত আরো বেশী পীড়া দিত মিত্রানী, এই বরং ভাল করেছি–
তোমার এত ভাল কেরিয়ার, মিত্রানী তবু যেন বোঝাবার চেষ্টা করেছে সুহাসকে।
সুহাস বলেছে, মাইনেটা কিন্তু নেহাৎ কম নয়—ডি. এ.. নিয়ে প্রায় তিনশর মতো পাবো–তারপর উন্নতি করতে পারলে
কি জানি, মিত্রানী বলেছে, আমার যেন মনে হচ্ছে তুমি বোধ হয় ভুল করলে সুহাস।
আরে আমরা তো জন্ম-মুহূর্তেই ভুল করে বসে আছি—
মানে?
এই প্রচণ্ড স্ট্রাগলের জমানায় মধ্যবিত্ত ঘরে জন্মানোটাই তো একটা ভুল—পথ সী, সব পথে কাঁটা—দুপা এগুতে গেলেই হোঁচট খেতে হবে।
সুহাস আর সজল যেন একে অন্যের সম্পূর্ণ বিপরীত! মিথ্যে নয়, মিত্রানীর কত সময় পরবর্তীকালে মনে হয়েছে সজলের মতো সুহাস কেন মনের মধ্যে সাহস পেল না! মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে তো দুজনাই—অথচ সুহাস লেখাপড়ায় কত ভাল ছেলে!
এম. এ.-টা পাস করতে পারলে সে অনায়াসেই একটা ভাল কলেজে কাজ পেয়ে যেতো–তা না একটা সামান্য কেরানীগিরিতে ঢুকে গেল, যার কোন ভবিষ্যৎ নেই–যে চাকরি-জীবনে কোন উত্তরণ নেই! বস্তুত বন্ধুদের মধ্যে সুহাসই প্রথমে চাকরিতে ঢুকেছিল।
তারপর কমপিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে সজল চাকরিতে ঢুকলো, সুহাস চাকরিতে ঢোকার পর যেন অন্য সকলের কাছ থেকে কেমন একটু দূরেই চলে গিয়েছিল। ডিগ্রী কোর্স শেষ হবার পর থেকেই ওদের বিদ্যুতের বাড়ির আভড়ায় সমাপ্তি ঘটেছিল। তাহলেও মধ্যে মধ্যে পরস্পরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হতো। তবে ঐ দেখাসাক্ষাৎ হওয়া পর্যন্তই, আগের মতো আড্ডা দেওয়া আর হয়ে ওঠেনি। প্রত্যেকে প্রত্যেকের খোঁজখবর অবিশ্যি পেতো এ ওর কাছ থেকে মধ্যে মধ্যে।
সকলেই যে যার ধান্ধায় ব্যস্ত। সকলেই চাকরি করে, একমাত্র বিদ্যুৎ ছাড়া।
যাদের বাড়িতে ফোন আছে, যেমন বিদ্যুৎ, কাজল, মণি এবং মিত্রানী-তারা পরস্পর পরস্পরকে মধ্যে মধ্যে ফোন করতে।
সুহাস কখনো তাকে ফোন করেনি। আর মিত্রানীও কখনো আজ পর্যন্ত সুহাসকে ফোন করেনি—বিশেষ করে তাই মিত্রানী একটু যেন বিস্মিতই হয়েছিল সুহাসের ফোন পেয়ে।
সুহাস ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আবার বললে, আমি সুহাস!
কি খবর সুহাস-হঠাৎ ফোন করছো?
সজল কলকাতায় এসেছে জানো? সুহাস মিত্রানীর প্রশ্নের জবাবে বললো।
জানি। পরশু সে আমার এখানে এসেছিল।
কয়েকটা মুহূর্ত অতঃপর স্তব্ধতা, তারপর সুহাসের গলা শোনা গেল, মিত্রানী!
বল।
বলছিলাম–মানে, সজল তোমাকে কিছু বলেছে?
মিত্রানী ভেবে পায় না সুহাসের প্রশ্নের কি জবাব দেবে। সজল সেদিন তাকে যে কথাটা বলেছিল সেটা কি কাউকে বলা ঠিক হবে! বিশেষ করে সুহাসকে!
চুপ করে আছো কেন মিত্রানী, সজল তোমাকে কিছু বলেছিল?
না—মানে বলছিলাম, হঠাৎ ঐ প্রশ্ন কেন?
সুহাস আবারও তার প্রশ্নটায় পুনরাবৃত্তি করলো, বল না, সজল তোমাকে কিছু বলেছিল?
না তো সেরকম কিছু তো আমার মনে পড়ছে না সুহাস-তবে কি তুমি ঠিক জানতে চাও যদি বলতে–
আচ্ছা মিত্রানী, সজল কি তোমাকে বলেছিল যে সে তোমাকে ভালবাসে—সে তোমাকে বিয়ে করতে চায়? আর জবাবে তাকে তুমি বলেছিলে, তা সম্ভব নয়—কারণ তুমি অন্য একজনকে ভালবাসো?
তোমাকে—মানে সজল তোমাকে ঐ কথা বলেছে? মিত্রানীর কণ্ঠস্বরে খানিকটা বিস্ময় যেন ফুটে ওঠে।
সুহাস তখন আবার বললে, নচেৎ আমি জানবো কি করে, বল! সজলের কাছে। অবিশ্যি তুমি তার নামটা বললানি—তাকে এড়িয়ে গিয়েছে, কিন্তু আমাকে তো তুমি বলতে পার—কে সে? আমাদের বন্ধুদের মধ্যেই কেউ কি?
কি হবে নামটা জেনে তোমার?
বস্তুত মিত্রানীর যেন কিছুটা অভিমানই হয়। সবার মধ্য থেকে শেষ পর্যন্ত সুহাসই কিনা তাকে আজ নামটা জিজ্ঞাসা করছে! আজও কি সে তাহলে বুঝতে পারেনি মিত্রানীর মনটা কোথায় বাঁধা পড়েছে!
কি হলো মিত্রানী, বলো?
মিত্রানী আর কোন কথা বলেনি ফোনে—নিঃশব্দে সে ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখেছিল। ঐ তারিখের মিত্রানীর ডাইরীর পাতায়—ঐ ঘটনার কথাটা লিখবার পর সে লিখেছে? আজ বুঝতে পারলাম, এতদিন যা ভেবে এসেছি তা মিথ্যা। সেই সঙ্গে বুঝতে পারলাম, সুহাসের মনের মধ্যে কোথাও আমি নেই।
০৩. ঐ ঘটনারই পরের দিন
ঐ ঘটনারই পরের দিন সজল আবার হঠাৎ এলো বিকেলের দিকে মিত্রানীদের ওখানে। শেষের ক্লাস দুটো মিত্ৰানীকে নিতে হয়নি বলে একটু আগেই কলেজ থেকে চলে এসেছিল ও। গতকালের ঘটনার পর থেকেই মনটা তার ভাল ছিল না, টেলিফোনে সুহাসের কথাগুলোই যেন কেবল তার মনে পড়ছিল। মুখে কোনদিন কথাটা সে প্রকাশ না করলেও –সুহাস কেন বুঝতে পারলো না মনটা তার এত বছর ধরে কোথায় বাঁধা পড়েছে।
নিজের ঘরে ক্যামবিশের আরাম-কেদারাটার উপরে গা ঢেলে দিয়ে চোখ বুজে পড়ে ছিল মিত্রানী-সজলের জুতোর শব্দটা পর্যন্ত তার কানে প্রবেশ করেনি সজলের কণ্ঠস্বরে
সে চোখ মেলে তাকাল।
মিত্রানী!
কে? ও সজল, এসো,–মিত্রানী উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। কিন্তু সজল তাকে বাধা দিয়ে বললে, আর ব্যস্ত হতে হবে না তোমাকে, বসো বসো-বলতে বলতে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সজল ওর মুখোমুখি বসে পড়ল।
মিত্রানী ভেবেছিল সেদিনকার তার ঐ স্পষ্ট কথার পর সজল বোধ হয় জীবনে আর তার সামনে এসে দাঁড়াবে না। কথাটা ভেবে তার একটু কষ্টও হয়েছিল, এখন সজলকে আসতে দেখে সে যেন একটু খুশিই হয়। শুধু তাই নয়, ঐ মুহূর্তে সজলের চোখমুখের ভাব দেখে মিত্রানীর মনেও হলো না, তার সেদিনকার সেই কথায় সজল এতটুকু অসন্তুষ্ট হয়েছে বা সে কথাগুলো তার মনে আছে!