হ্যাঁ।
এখন তো বুঝতে পারছেন, সকলের মধ্যে বিশেষ করে আপনারই তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবার পিছনে তার বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল—
পারছি বৈকি! কিন্তু এখনো বুঝতে পারছি না—-মিত্রানীকে তার যদি প্রয়োজনই ছিল তো সে অমন বাঁকা পথে গেল কেন?
আকর্ষণটা হয়ত ভালবাসা নয়—একটা জৈবিক আকর্ষণ মাত্র—রিপুর তাড়না!
মনে হচ্ছে—সুহাস বললে, মিত্ৰাণীও বোধ হয় ব্যাপারটা কখনো এতটুকু আঁচ করতে পারেনি!
আঁচ করতে পারলে তার ডাইরীতেই হয়ত থাকতো। কি জানেন সুহাসবাবু— আপনাদের ঐ বন্ধুটি কেবলমাত্র যে আপনার বন্ধুত্বেরই সুযোগ নিয়েছে তাই নয়–আপনার চোখের ক্ষীণ দৃষ্টিরও সুযোগ নিয়েছে—
কি বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি, এবং আপনার রুমালটার ব্যাপারেও আমার অনুমান—সেদিন অফিসে আপনাকে পিকনিকের কথা বলতে গিয়ে আপনার রুমালটা হাতসাফাই করেছিল– চোখের ক্ষীণ দৃষ্টির জন্য হয়ত ব্যাপারটা আপনার নজরে আসেনি–
ঐ রুমালটা তাহলে–
হ্যাঁ সুহাসবাবু—আপনার প্রতি পুলিসের সন্দেহটা যাতে আরো বেশী ঘনীভূত হয়-সেই কারণেই রুমালটা হাতসাফাই করেছিল–
সুব্রত এতক্ষণে কথা বললে, সবই করেছিল—প্ল্যানটা তার সাকসেসফুলও হয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্য ভদ্রলোকের যে মিত্রানী কিরীটী রায়ের মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে–
কিরীটীবাবু—
বলুন—
এখন কি তাহলে ওকে আপনি পুলিসের হাতে তুলে দেবেন?
সমাজের মধ্যে বাস করে একজন দেশের নাগরিকের সাধারণ কর্তব্যবুদ্ধি তো তাই বলে সুহাসবাবু, তবে যে মুহূর্তে আমার কাছে সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে—তখুনি মনে হয়েছে ফাঁসির দড়ি বোধ হয় ওর যোগ্য শাস্তি নয়—এক মুহূর্তেই। তো সব শেষ হয়ে যাবে—এবং সেটা ওর প্রতি অনুকম্পাই প্রকাশ করা হবে-তা আমি ঠিক চাই না—
আপনি তাহলে—
দেখি, এখনো ঠিক ভেবে উঠতে পারিনি—
কিন্তু ফাঁসিই তো ওর যোগ্য শাস্তি কিরীটীবাবু—সুহাস বললে।
ঠিক–কিন্তু প্রমাণ করবেন কি করে যে ওই হত্যাকারী! আদালত চায় প্রমাণ আইন চায় প্রমাণ, কাজেই ওর তখুনি ফাঁসি হতে পারে যদি ওর স্বীকারোক্তি পাই আমরা।
তা কি ও দেবে?
দেবে না সহজে জানি, কিন্তু তবু শেষ চেষ্টা আমি করবোই—আপনার কাছে আমার একটা বিশেষ অনুরোধ সুহাসবাবু—
বলুন—
ঘুণাক্ষরেও যেন ও নামটা কেউ না এখন জানতে পারে—
না কিরীটীবাবু, আমি কারো কাছে বলবো না।
ঠিক আছে—আমরা তাহলে এবার উঠবো।
সুহাস মিত্র কোন কথা বললো না। ওরা দুজনে উঠে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
দুটো দিন তারপর কিরীটী আর কোথাও বের হলো না। তবে মধ্যে মধ্যে দু-একজনকে ফোন করল। কয়েক জায়গা থেকে ফোনও এলো।
সুব্রত আর ফিরে যায়নি—সর্বক্ষণ কিরীটীর পাশে পাশেই রয়েছে।
কিরীটীকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করেনি—নিজেও কোন কথা বলেনি। প্রতীক্ষা করেছে কেবল কিরীটী কখন মুখ খুলবে!
তৃতীয় দিন দ্বিপ্রহরে হঠাৎ কিরীটী মুখ খুললো। বললে, পেয়েছি রে সুব্রত–পথ খুঁজে পেয়েছি–
কি—সুশীল নন্দীকে সব জানাবি?
হ্যাঁ জানাবো, তবে—
তবে?
সোজাসুজি নয়—
কিভাবে তাহলে তাকে ব্যাপারটা জানবি?
একটা চিঠি—
চিঠি। চিঠি সুশীল নন্দীকে?
না–সুশীল নন্দীকে নয়—
তবে কাকে?
হত্যাকারীকে একটা চিঠি দেবো—
হত্যাকারীকে চিঠি! কিন্তু সে চিঠি পাবার পর যদি লোকটা একেবারে উধাও হয়ে যায়?
আমার বিশ্বাস যাবে না—আর যদি যায়ই আমাদের উদ্দেশ্য পুরোপুরিই সফল হবে–
সফল হবে। নিশ্চয়ই। সে-ই যে অপরাধী সেটা তার ঐ পলায়ন থেকে প্রমাণিত হয়ে যাবে— তখনই পুলিস তাকে অনায়াসে হত্যাকারী বলে চিহ্নিতও করতে পারবে।
কিন্তু চিঠি লিখবো বললেও কিরীটী ঠিক করে উঠতে পারে না কিভাবে চিঠিটা লিখবে কোথায় তার শুরু, কোথায় তার শেষ।
মনে মনে অনেক মুসাবিদা করে কিরীটী কিন্তু কোনটাই যেন পছন্দ হয় না।
ঐদিনই মধ্যরাত্রে কিরীটী লেখার প্যাড ও কলম নিয়ে বসলো, তারপর শুরু করলো তার চিঠি–
কি ভাবে আপনাকে সম্বোধন করবো চিঠির শুরুতে তা অনেক ভেবেও স্থির করতে পারলাম না। প্রিয়বরেষুও লিখতে পারি না–সবিনয় নিবেদন দিয়েও শুরু করতে পারি না—তবু লিখতেই হবে চিঠিটা আপনাকে—তাই কোন সম্বোধন না করেই শুরু করছি চিঠি।
চিঠিটা আমি ডাকে দেবো না কারো হাত দিয়ে পৌঁছে দেবো, যাতে পথে না মারা যায় চিঠিটা।
কিরীটী লিখতে লাগল।
২৩. চিঠিটা আমার পড়তে বসে
চিঠিটা আমার পড়তে বসে চিঠির শেষে প্রেরকের নামটা যে আপনি শুরুতেই পড়ে দেখবার কৌতূহলটা দমন করতে পারবেন না সেটা আমি জানি বলেই নামটা শুরুতেই আমার জানিয়ে দিচ্ছি—আমি কিরীটী রায়।
এবারে বোধ হয় বুঝতে আর আপনার কোন অসুবিধা হবে না, হঠাৎ কিরীটী রায়ের আপনাকে চিঠি লিখবার কি এমন প্রয়োজন হলো! আর কেনই বা এই চিঠি।
চিঠির শুরুতেই আরো একটা কথা আপনার অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি, এই চিঠির অন্য দুটি কার্বন কপির একটি শিবপুর থানার ও. সি. সুশীল নন্দী ও অন্যটি কলিকাতার পুলিস কমিশনারের কাছে একই সঙ্গে যাচ্ছে। অবশ্যই স্বীকার করবো, সুশীলবাবুর সক্রিয় সাহায্য না পেলে এত তাড়াতাড়ি আপনাকে হয়ত চিহ্নিত করতে পারতাম না।
অস্বীকার করবো না, আপনার হত্যা করবার প্ল্যান বা পরিকল্পনাটা আপনি সুনিপুণভাবে নিখুঁত করবার চেষ্টা করেছিলেন একই ঢিলে দুই পাখী মারতে। এক— মিত্রানীকে হত্যা করতে ও দুই—সেই হত্যার অপরাধটা সম্পূর্ণ নির্দোষ এক তৃতীয় ব্যক্তির কাঁধে চাপিয়ে দিতে। যদিও প্রধানত উদ্দেশ্য ছিল আপনার মিত্রানীকে হত্যা করা।