রুমাল রহস্য? শুধালেন সুশীল নন্দী।
হ্যাঁ, যে রুমালের সাহায্যে মিত্রানীকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল।
রুমালটা একমাত্র সুহাসবাবুকে কাজল বোস প্রেজেন্ট করেছিল, তারপর রুমালটা খোয়া যায়, এইটুকুই তো মাত্র আমরা জানতে পেরেছি আজ পর্যন্ত–
ঐটুকুই নয়—আরো কিছু আছে, যদি সেই ব্যক্তি ওদের কারো পরিচিত জনই হয় তাহলে আমাদের একান্তই জানা দরকার কেন সেদিন সে ঐখানে এসেছিল–তার আসার কি উদ্দেশ্য ছিল।
সমস্ত ব্যাপারটা যেন ক্রমশ আরো জটিল হয়ে উঠছে কিরীটীবাবু—সুশীল নন্দী বললেন।
ভয় নেই সুশীলবাবু, জটিলতা যাই হোক, আশা করছি সুহাসবাবুর সাহায্য আমরা পাবো। আপনি কাল বাদে পরশু আসবেন—বোধ হয় সে সময় এ রহস্যের মেঘনাদকে আপনার সামনে উপস্থাপিত করতে পারবো–
সুশীল নন্দী অতঃপর বিদায় নিলেন।
কিরীটী সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, শুভস্য শীঘ্রম—চল্ সুব্রত একটু ঘুরে আসা যাক—
কোথায় যাবি?
সুহাসবাবুর ওখানে এখন হয়ত তাকে তার অফিসেই পাওয়া যাবে—
কিন্তু সেখানে—
সে একটা ব্যবস্থা হবে, চল–ওঠ।
২২. সুহাস মিত্রকে তার অফিসে পাওয়া গেল না
সুহাস মিত্রকে তার অফিসে পাওয়া গেল না। সুহাস সেদিন অফিসেই আসেনি। কিরীটী আর সুব্রত তখন সোজা তার কলুটোলার বাড়িতে গেল।
সুহাস বাড়িতেই ছিল। বাইরের ঘরে জানালা দরজা সব বন্ধ করে একটা টেবিল ফ্যান চালিয়ে দিয়ে-পরনে একটা লুঙ্গি আর ছেড়া ময়লা গেঞ্জি—সুহাস শুয়ে ছিল।
বাচ্চা চাকরটা খবর দিতে তাড়াতাড়ি সে উঠে বসল–আসুন—কে!
চশমাটা চোখে ছিল না, পাশেই ছিল, তাড়াতাড়ি চশমাটা তুলে সুহাস চোখে পরে নিল, কিরীটীবাবু, সুব্রতবাবু—আপনারা—
আপনাকে একটু বিরক্ত করতে এলাম সুহাসবাবু, কিরীটী বললে।
না, না, বিরক্তির কি আছে, বসুন। কিন্তু হঠাৎ আমার কাছে—
কিরীটী আর সুব্রত বসলো চৌকিটার উপরেই, কারণ বসবার আর কোন জায়গা ছিল।
বলুন কি ব্যাপার?
সেই পুরোনো প্রশ্নটাই আবার করছি সুহাসবাবু, কিরীটী বললে, কার কাছে আপনি শুনেছিলেন মিত্রানী অন্য কাউকে ভালবাসে? আপনাদের বন্ধু সজল চক্রবর্তী কি?
না।
তবে?
সে কথা আর কেন কিরীটীবাবু, যা চিরদিনের মতই চুকেবুকে গিয়েছে—যা অতীত, তাকে আজ আর বর্তমানে টেনে এনে লাভ কি?
লাভ আপনার দিকে কিছু না হলেও, ব্যাপারটা জানতে পারলে আমার পক্ষে মিত্রানীর হত্যা-রহস্যের শেষ জটটি খুলতে হয়ত অনেকটা সুবিধা হতে পারে। তাছাড়া মিত্রানীকে তো আপনি সত্যিই ভালবাসতেন সুহাসবাবু, আপনি কি চান না তার হত্যাকারী শুধু হত্যাকারীই নয়, যে তার মৃতদেহটার উপর জঘন্য অত্যাচার করতে পর্যন্ত এতটুকু দ্বিধা বোধ করেনি সে ধরা পড়ক!
সুহাস চুপ করে রইলো।
বলুন সুহাসবাবু, মিত্রানীর প্রতি আপনার ভালবাসার কি কোন দায়িত্বই নেই?
কিরীটীবাবু, আমাকে অনুরোধ করবেন না–
বেশ—একখণ্ড কাগজে আমি নামটা লিখে এনেছি সেটা দেখুন একটিবার—বলতে বলতে কিরীটী পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা ছোট কাগজ বের করে সুহাসের দিকে এগিয়ে দিল, দেখুন তো নামটা মেলে কিনা
সুহাস কাগজের ভাঁজ খুলে নামটা পড়ে যেন একেবারে বোবা হয়ে বসে রইলো, তার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হয় না। কাগজটা হাতেই ধরা থাকে তার।
বুঝেছি আর আপনাকে বলতে হবে না—দিন কাগজটা-বলে সুহাসের হাত কাগজটা নিয়ে কিরীটী কাগজটা সুব্রতর দিকে এগিয়ে দিল, পুড়ে দেখ সুব্রত নামটা—এই মিত্রানীর হত্যাকারী–
সুব্রতও যেন নামটা পড়ে একেবারে বোবা হয়ে যায়।
সে শুধু অস্ফুট কণ্ঠে একটি মাত্র শব্দই উচ্চারণ করলো, আশ্চর্য!
ভাবতেই পারিসনি বোধ হয় ব্যাপারটা–কিরীটী বললে—
না।
কিন্তু তিনটি কারণে তোরও সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল—প্রথমত ঝড় ঠিক ওঠবার মুখে ঐ লোকটিই ছিল মিত্রানীর একেবারে কাছের জন—দুই রুমালটা-তিন ওরই। পরামর্শে সম্ভব সজল চক্রবর্তী সেদিন সুহাসের পরিচয়ে মিত্রানীকে ফোন করেছিল। আর সর্বশেষ যেটা, কেউ ভাবেনি কখনো—মিত্রানীর প্রতি মানুষটার লোভ থাকতে পারে—সে যে কথাটা প্রকাশ করেনি, কারণ সে ভাল ভাবেই জানত মিত্রানী সুহাসবাবুকে গভীরভাবে ভালবাসে-তাই নিজেকে কখনো প্রকাশ করেনি মিত্রানীর কাছে যেমন—তেমনি শেষ চালে সুহাসবাবুকেও ধ্বংস করতে চেয়েছিল।
সুহাস কথা বললে, সত্যি সত্যি বলছেন আপনি কিরীটীবাবু!
হ্যাঁ। আশ্চর্য—এখনো যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না—
শুনলে ব্যাপারটা আপনাদের মত সকলেই বিস্মিত হবে—কিন্তু জানেন তো টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন বলে একটি চলতি প্রবাদ আছে! কিন্তু সে যাই হোক, সত্যটা জানবার পর এখন তো বুঝতে পারছেন, আপনাদের দুজনার প্রতিই তার প্রচণ্ড ঘৃণা কি ভাবে এক নিষ্ঠুর আক্রোশে পরিবর্তিত হয়েছিল, যে আক্রোশের জন্য মিত্রানীকে নিষ্ঠুর মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে এবং আপনিও এগিয়ে এসেছিলেন ফাঁসির দড়ির দিকে।
সুহাস স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। কিরীটী আবার বললে, এবারে বলুন তো সুহাসবাবু, আপনি কি সেদিন সত্যি সত্যিই স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন, সেই বেতের টুপি মাথায়-মুখে দাড়ি চোখে রঙিন চশমা লোকটাকে, না কেউ আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করায় সেদিকে আপনার নজর পড়েছিল।
সুহাস চুপ করে থাকে।
আমার অনুমান কিন্তু, আপনার নজরে আসেনি প্রথমে এবং আপনার ঐ বন্ধুই সেই দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল—তাই নয় কি?