সুব্রত এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল, সে এবার বললে, কিরীটী, তাহলে সুহাস মিত্র নয়?
না।
যুক্তি দিয়ে আমি যেটা খাড়া করেছিলাম, তাহলে সেটা দেখছি ভুল। তাহলে কি সেই চোখে চশমা—দাড়িওয়ালা ব্যক্তিটিই–
কিরীটী মৃদু মৃদু হাসতে থাকে সুব্রতর কথার কোন জবাব না দিয়ে।
কিন্তু একজন ছাড়া সেই ব্যক্তি আর কে হতে পারে বুঝতে পারছি না। আচ্ছা ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের মিঃ নাইড়ু কার কথা বলছিলেন তোকে ফোনে—প্যাসেঞ্জার লিস্টে কার নাম ছিল না?
সজল চক্রবর্তী।
মানে।
দুর্ঘটনার দিন সকালের ফ্লাইটে তো নয়ইনুন ফ্লাইটেও সজল চক্রবর্তীর নাম কোথাও পাওয়া যায়নি—কাজেই এটা স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার যে, তিনি আদৌ সেদিন কলকাতা ছেড়ে তার কর্মস্থলে ফিরে যাননি–
তবে ভদ্রলোক পিকনিক পার্টিতে সেদিন ওদের সঙ্গে যোগ দিল না কেন?
সে প্রশ্নের জবাব একমাত্র সজল চক্রবর্তীই দিতে পারে। আসলে তুই সেই বেতের টুপি আর বায়নাকুলার নিয়েই বেশী মাথা ঘামিয়েছিস সুব্রত–
কিন্তু–
ওই বস্তু দুটির কোন মূল্যই যে একেবারে মিত্রানীর হত্যা রহস্যের মধ্যে নেই তা আমি বলছি না–কিন্তু তার চাইতেও মূল্যবান সূত্র দুটি হয়ত তোর মনের মধ্যে ততটা রেখাপাত করেনি—
কোন্ দুটি সূত্রের কথা বলছিস?
এক নম্বর হচ্ছে মিত্রানীর ডাইরীর মধ্যে যে ফোনের সংবাদটি আছে, যেটা সে মনে করেছিল সুহাসের ফোন-সেটা এবং দুনম্বর—যেটা হচ্ছে বর্তমান হত্যা-মামলার প্রধানতম সূত্র—
কি সেটা?
একটা চশমা।
চশমা!
হ্যাঁ চশমা—হ্যাঁ সুহাসবাবুর চশমা—যে চশমাটা তার চোখ থেকে ছিটকে আশেপাশেই অকুস্থানের কোথাও পড়েছিল, কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেটা আর পাওয়া যায়নি। এবং ঐ চশমার পিছনের ইতিহাসটা হচ্ছে সুহাসবাবুর ক্ষীণদৃষ্টি—যার অ্যাডভানটেজ বা সুবিধা ব্যাপারটা জানা থাকায় হত্যাকারী পুরোপুরিই নিতে পেরেছিল।
কি রকম?
সুহাসবাবুর চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ না থাকলে হত্যাকারী তার রুমালটা অনায়াসেই সরিয়ে পকেটস্থ করতে পারত না ও হত্যার সন্দেহটা পুরোপুরি তার কাঁধে চাপিয়ে দিতে এ সহজে বোধ হয় পারত না। যাক—কথাগুলো বলতে বলতে কিরীটী সহসা দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললে, রাত নটা প্রায় বাজে–
মনে হচ্ছে কারো অপেক্ষা করছিস?
হ্যাঁ–
কার, সুশীলবাবুর?
না। সজল চক্রবর্তীর।
২১. সজল চক্রবর্তী এলোই না
কিন্তু সে রাত্রে সজল চক্রবর্তী এলোই না।
এলো পরের দিন সকাল সাড়ে-আটটা নাগাদ।
সুব্রত গতরাতে বাড়ি চলে গিয়েছিল, এখনো ফেরেনি-কিরীটী চা-পানের পর ঐদিনকার সংবাদপত্রটা নিয়ে পাতা উল্টে উল্টে দেখছিল।
জংলী এসে ঘরে ঢুকল—বাবু, সুশীলবাবু আর একজন ভদ্রলোক এসেছেন।
এ ঘরে পাঠিয়ে দে—
আসুন সুশীলবাবু—
সুশীল নন্দী বললেন, সজলবাবুকে একেবারে তার বাসা থেকেই ধরে নিয়ে এলাম—
বসুন—বসুন সজলবাবু, কিরীটী বললে।
আমাকে আজই নুন ফ্লাইটে ফিরে যেতে হবে কিরীটীবাবু, কাজেই আপনার যা বক্তব্য তা যদি একটু তাড়াতাড়ি সেরে নেন—বসতে বসতে সজল চক্রবর্তী বললে।
নিশ্চয়ই-বেশী সময় নেবো না—কয়েকটি প্রশ্নের আমি জবাব চাই মাত্র—
বলুন।
মিত্রানীদের পিকনিকের ব্যবস্থা আপনারই আগ্রহে করা হয়েছিল বিশেষ করে, তাই না?
হ্যাঁ-কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার পিকনিকে যাওয়া হয়নি—
এবং মর্নিং ফ্লাইটে আপনার যাওয়া হয়নি; তাই না?
হ্যাঁ—মানে—বিশেষ একটা কাজে সেক্রেটারিয়েটে আটকা পড়ে–
কি কাজ হঠাৎ পড়েছিল সেদিন আপনার সেক্রেটারিয়েটে এবং কার সঙ্গে কাজ ছিল—
ঐ প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারছি না—আই অ্যাম সরি।
খুব গোপনীয়—সিক্রেট বুঝি ব্যাপারটা?
ধরে নিন তাই–
পরের দিনও আপনি যাননি সকালে, তাই না—
না-যেতে পারিনি–
তাহলে নিশ্চয়ই মিত্রানীকে হত্যা করা হয়েছে, সে সংবাদটা আপনি পেয়েছিলেন?
না–না—
কিন্তু সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছিল-একদল তরুণ-তরুণী বটানিক্যাল গার্ডেনে পিকনিক করতে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে এক তরুণী রহস্যজনকভাবে নিহত হয়েছে।
হবে—আমার চোখে পড়েনি—
হ্যাঁ—আপনি কবে প্রথম সংবাদটা পান?
পরশুর আগের দিন—সজল চক্রবর্তী বললে।
কি করে পেলেন? মিত্রানীদের বাড়িতে ফোন করেছিলেন?
হ্যাঁ—ফোন করতেই প্রণবেশবাবুর মুখ থেকে সংবাদটা পাই।
তা হঠাৎ সেখানে ফোন করতে গিয়েছিলেন কেন?
ওদের পার্টি কেমন হলো সেটা জানবার জন্য—
কিরীটী মৃদু হেসে বললো, কিন্তু আমি যদি বলি মিঃ চক্রবর্তী, ব্যাপারটা আপনি ঘটনার দিনই জানতে পেরেছিলেন—
না, না—কি বলছেন আপনি!
হ্যাঁ—কারণ ছদ্মবেশে পিকনিকের দিন ইউ ওয়্যার প্রেজেন্ট অন দি স্পট।
আপনি কি পাগল হয়েছেন কিরীটীবাবু? সারাদিন আমি চীফ সেক্রেটারির কাছে ব্যস্ত ছিলাম, তার ঘরেই আমি লাঞ্চ পর্যন্ত করেছি
একটা কথা আপনাকে আমার জানানো কর্তব্য——আপনাদের বর্তমান চীফ সেক্রেটারী আমার বিশেষ বন্ধু—
আ—আপনি—
হ্যাঁ–কাজেই ব্যাপারটা সত্য-মিথ্যা এখুনি আমার কাছে যাচাই করা হয়ত খুব একটা অসুবিধা হবে না-নাউ টেল মি—বলুন কোথায় ছিলেন আপনি সারাটা দিন–
ক্ষমা করবেন—আমি বলতে পারবো না।
পারবেন না! ঠিক আছে—তবে জানবেন আপনার ঐ ইচ্ছাকৃত গোপনতা হয়ত আপনাকে ফাঁসির দড়ির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সজল তথাপি মুখ খুললো না। চুপ করে রইলো সে।
আর একটা প্রশ্নের জবাব দিন?
সজল চক্রবর্তী কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল নিঃশব্দে।—আপনি সেবার অনেক দিন পরে কলকাতায় এসে মিত্রানীর ওখানে গিয়ে তাকে বিয়ের পোপাজাল দিয়েছিলেন?