কিরীটী ঘড়ি দেখে একটু দ্রুতই গঙ্গার ধার থেকে জায়গাটায় এগিয়ে গেল—ঠিক। জানবার জন্য কতক্ষণ আন্দাজ লাগতে পারে ঐখানে পৌঁছাতে।
সুশীলবাবু—
বলুন!
বায়নাকুলারটা আর বেতের টুপিটা কোথায় কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল জানেন?
সুশীল নন্দীই জায়গা দুটো দেখিয়ে দিলেন।
হুঁ। ভাঙা চুড়ির টুকরোগুলো?
ঐ যে বায়নাকুলারটা যেখানে পাওয়া যায় সেইখানেই—
কিরীটীর মনে হলো মৃতদেহটা যেখানে আবিষ্কৃত হয়, সেখান থেকে জায়গাটা হাত দশেক দূরেই হবে।
হুঁ। চলুন, এবার থানায় যাওয়া যাক।
গাড়িতে উঠে সুশীল নন্দী বললেন, জায়গাটা দেখে কিছু অনুমান করতে পারলেন?
একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে—
কি বলুন তো!
হত্যাকারী বুঝতে পেরেছিল ঐ ঝোপের দিকে আসতে হলে গঙ্গার ধার থেকে ঐ পথটাই সহজ হবে এবং সেই অনুমানেই—কিরীটী থেমে গেল হঠাৎ ঐ পর্যন্ত বলে।
সুশীল নন্দী বললেন, কিন্তু তাতে কি এসে গেল—ওরা অন্য পথও তো ধরতে পারত—-
তা পারত, তবে ঐটাই সামনে ছিল। আর সহজ পথ ছিল। কি জানেন সুশীলবাবু, সেদিনকার যাবতীয় ঘটনাই একটা অ্যাকসিডেন্ট বলতে পারেন—
মানে!
মানে অ্যাকসিডেন্টালি সব কিছুই যেন সেদিন খুনীর ফেবারে এসে গিয়েছিল–
সুব্রতর কাছে ঐ মুহূর্তে সমস্ত ব্যাপারটা যেন অকস্মাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল কিরীটীর আগের কথায় সে নিঃশব্দে কিরীটীর কথা শুনতে থাকে।
কিরীটী বলতে লাগল, প্রথমত ধরুন, সেদিনকার ধুলোর ঘূর্ণিঝড়, আবহাওয়া অফিসের সেদিনের সকালের ফোরকাস্টে অবিশ্যি ছিল বিকেলের দিকে বজ্রবিদ্যুৎসহ একপশলা ঝড়বৃষ্টি হবে—যদিও সেটা সেদিন ঠিক হয়েছিল কিন্তু নাও তো হতে পারত-সেদিক দিয়ে বিচার করে দেখতে গেলে খুনী জাস্ট টুক এ চান্স—এবং চান্সটা সে পেয়ে গেল ফোরকাস্ট মতো আবহাওয়া ঠিক মুহূর্তে তার ফেবারে পেয়ে। দ্বিতীয়ত ঐ ঘূর্ণিঝড় হবার দরুন তাকে, মানে খুনীকে আর কষ্ট করতে হলো না-মিত্রানী নিজেই তার হাতের মুঠোর মধ্যে এসে গেল। তৃতীয়ত ওরা স্থির করছিল চাদনী রাত আছে, কাজেই সন্ধ্যা উতরাবার পর তারা ওখান থেকে ফিরবে—যেমন করে হোক খুনী সেটা অনুমান করতে পেরেছিল এবং তাই যদি শেষ পর্যন্ত হতো তো সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে গঙ্গার ধার থেকে ফেরার পথে তাকে কার্যসিদ্ধি করতে হতো—
তাহলেই ভেবে দেখুন সুশীলবাবু—যদিও খুনীর সবটাই ছিল পূর্বপরিকল্পিত—এবং তার ডিটারমিনেশন—তবু সব কিছু ঘটনাচক্রে তার ফেবারে আসায় ব্যাপারটা সহজই হয়ে গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত তার কাছে—অ্যাকসিডেন্টালি সে হত্যা করবার চান্সটা পেয়ে গিয়েছিল। ভাল কথা, কাউকে এই কদিন ঐ জায়গাটার আশেপাশে দেখা গিয়েছে কি?
হ্যাঁ—গতকাল দুপুরে আমার লোকেরা যারা পালা করে সর্বক্ষণ নজর রাখছিল। নির্দেশমত—একজনকে দেখেছে–
কি রকম দেখতে লোকটা, বয়স কত–
বয়স হবে লোকটার তেত্রিশ-চৌত্রিশের মধ্যে–পরনে একটা সাদা প্যান্ট ও সিল্কের শার্ট—চোখে রঙিন কাঁচের চশমা—একটা ট্যাক্সি করে এসেছিল লোকটা—কয়েক মিনিট জায়গাটার আশেপাশে ঘুরে আবার সে ট্যাক্সি করে চলে যায়—
ট্যাক্সিট্যাক্সির নম্বরটা রেখেছিল কি আপনার লোক?
না—
পালিয়ে গেল—আপনার নাকের ডগা দিয়ে সুশীলবাবু!
কে পালিয়ে গেল নাকের ডগা দিয়ে—
হত্যাকারী। মিত্রানীর ঘোষালের হত্যাকারী—
বলেন কি?
হ্যাঁ—কিন্তু থাক—একটা ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম সুশীলবাবু হত্যাকারী ওদেরই একজন।
গাড়ি ইতিমধ্যে থানার সামনে পৌঁছে গিয়েছিল।
সুশীল নন্দী একটা সীল করা কাগজের প্যাকেট কিরীটীর সামনে টেবিলের ওপর এনে নামিয়ে রাখল। বললে, এর মধ্যে মিত্রানীর শাড়ি-সায়া-ব্রেসিয়ার-ব্লাউজ সব কিছু আছে।
প্যাকেটটা খুলতে খুলতে কিরীটী বললে, সেই বেতের টুপিটা ও বায়নাকুলারটাও আনুন—আর একবার দুটো বস্তু ভাল করে দেখবো।
সুশীলবাবু সেগুলো আলমারি থেকে বের করে এনে টেবিলের ওপর রাখলেন।
মিত্রানীর পরনে ছিল সেদিন একটা নীল রঙের মুর্শিদাবাদী সিল্কের শাড়ি। শাড়ির কিছুটা অংশ মনে হয় টানা-হাচড়াতে ফেঁসে গিয়েছে, শাড়িটা পুরোনো বলেই বোধ হয়।
ব্লাউজের বোতামগুলো একটা বাদে বাকী নেই—ব্লাউজটা দেখতে দেখতে একটা কি যেন টেনে তুললো ব্লাউজ থেকে কিরীটী।
একটা মাঝারী সাইজের কর্কশ চুল, রঙটা কটা–
চুলটা পকেট থেকে একটা ছোট লেন্সের ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে তারই সাহায্যে পরীক্ষা করতে করতে কিরীটী বললে, এক টুকরো কাগজ দেখি সুশীলবাবু
সুশীল নন্দী একটা প্যাডের কাগজ ছিড়ে দিলেন।
সেই কাগজের মধ্যে সযত্নে চুলটা রেখে কিরীটী ওদের দিকে তাকিয়ে বললে, হত্যাকারী খুবই সতর্কতা অবলম্বন করেছিল সুব্রত, এবং সব কিছু সেদিন তার ফেবারে থাকলেও নির্মম নিয়তি তাকে ফেবার করেনি শেষ পর্যন্ত।
সুব্রত হাসতে হাসতে বললে, সে তো তখুনি আমি বুঝেছিলাম কিরীটী, যখন তুই। ব্যাপারটা হাতে নিয়েছিস।
সুশীলবাবু!
কিরীটীর ডাকে সুশীল নন্দী কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে সাড়া দিলেন, বলুন—
আপনার কিছু সক্রিয় সাহায্য চাই এবার আমার—
বলুন কি করতে হবে?
আপনি আজ সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে আসুন, তখন বলবো কি সাহায্য আপনার নিকট আমি চাই—তবে এইটুকু আমি বলতে পারি—মিত্রানীর হত্যাকারী আর এখন অস্পষ্ট নেই—এবং মনে হয় রহস্যের শেষ জটটাও খুলে যাবে সহজেই
সুব্রত বললে, কিছুটা বোধ হয় আমিও অনুমান করতে পেরেছি কিরীটী। কিন্তু আমি ভাবছি–