কিরীটী শান্ত গলায় বললে, ঐ আঘাতটা না দিতে পারলে—যাকে বলে অ্যাসিড টেস্ট সেটা হতো না এবং আসলে সত্যটাও প্রকাশ পেত না।
তুই তাহলে সুহাস মিত্রকে মুক্তি দিলি?
আপাতত।
আপাতত মানে?
কিরীটী সুব্রতর কথার কোন জবাব না দিয়ে উঠে গিয়ে ফোন ডায়েল করতে লাগল।
বার-দুই এনগেজ টোন হলো, তারপর অন্য প্রান্তে শোনা গেল, ও. সি. শিবুপুর পি. এস.–
সুশীলবাবু আমি কিরীটী—কোন খবর আছে?
আছে তবে ফোনে বলবো না—কাল আসুন না একবার—
যাবো—আচ্ছা মৃতের জামা ও শাড়ি–
এখনো থানাতেই আছে—একজিবিট হিসাবে–কেন বলুন তো?
ওগুলো আমি একবার দেখতে চাই—আর ঐ সঙ্গে স্পটটাও একবার ঘুরে দেখে আসবো ভাবছি। আচ্ছা তাহলে সেই কথাই রইলো।
কিরীটী অতঃপর রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিল।
কিরীটী ফিরে এসে সোফায় বসতেই সুব্রত শুধালো, স্পটটা একবার দেখবার কথা গত দুদিন ধরে আমিও ভাবছিলাম!
১৯. কিরীটীর ওখান থেকে বের
কিরীটীর ওখান থেকে বের হয়ে সুহাস মিত্র একটু অন্যমনস্ক হয়েই যেন বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগুতে থাকে। মিত্রানীর কথাই সে ভাবছিল বোধ হয়, হঠাৎ বাস স্ট্যান্ডের কাছাকাছি আসতেই কাজলের ডাক শুনে সুহাস থমকে দাঁড়াল।
সুহাস—
কে! ও তুমি! বাড়ি ফিরে যাওনি–
না। তোমার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম এতক্ষণ—
আমার অপেক্ষায়! কেন?
তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল—
কথা! কি কথা—
এই রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে কথা হতে পারে না।
কিন্তু রাত অনেক হয়েছে—তোমাকে তো আবার ফিরতে হবে ট্রেনে–
সেজন্য তোমাকে চিন্তা করতে হবে না—
কথাটা কি খুব জরুরী? জিজ্ঞাসা করলো সুহাস।
জরুরী না হলে প্রায় এক ঘণ্টা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করতাম। চল, ঐ পার্কটায় গিয়ে বসা যাক—
সুহাস একটু চুপ করে থেকে বললে, বেশ চল–
দশ পনেরো গজ দূরেই রাস্তাটা যেখানে সামান্য একটু বেঁকেছে—সেখান থেকে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গিয়েছে—একটা যাওয়ার একটা আসার—মাঝখানে ট্রামের লাইন—
একটা ট্রাম উল্টো দিকে ঘন্টি বাজাতে বাজাতে চলে গেল, একটা বাস এসে দাঁড়িয়েছে—ঐ সময়ও যাত্রীতে একেবারে যেন ঠাসাঠাসি।
দুজনে ট্রাম-রাস্তা পার হয়ে একটা পার্কের মধ্যে এসে ঢুকল। গ্রীষ্মের সময় বলেই হয়ত তখনো পার্কের মধ্যে বেশ কিছু মানুষজন রয়েছে। দুজনে এগিয়ে গেল আরো কিছুটা—একটা খালি বেঞ্চ দেখে দুজনে পাশাপাশি বসলো।
কিছুটা সময় দুজনেই চুপচাপ, দুজনেই যেন যে যার ভাবনার মধ্যে তলিয়ে আছে।
সুহাস—হঠাৎ কথা বললো কাজল, এতদিনে আমি বুঝতে পারছি—
কি বুঝতে পারছো কাজল!
আই ওয়াজ এ ফুল–নচেৎ কথাটা আমার আরো আগেই বোঝা উচিত ছিল।
কি বলতে চাও তুমি কাজল স্পষ্ট করে বল।
বলবার তো আর কিছু নেই—
কিছুই যদি নেই তো এভাবে এখানে আমাকে টেনে নিয়ে এলে কেন?
কাজল বলতে লাগল, অবিশ্যি ব্যাপারটা যে আমি একেবারে অনুমান করতে পারি নি তা নয়—কিন্তু মনকে সান্ত্বনা দিয়েছি—না, হতে পারে না। তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম——মিত্রানীর মনটা অন্য জায়গায় বাঁধা আছে—ওরা পরস্পরকে ভালবাসে যখন তখন আমি কিছুটা নিশ্চিত
কি বলছো তুমি কাজল, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। মিত্রানী কাকে ভালবাসত—আর কেই বা মিত্রানীকে ভালবাসত—
কিন্তু সে ভুল আজ আমার ভেঙে গেছে। বুঝতে পারছি মিত্রানীর আরো অ্যাডমায়ারার ছিল—তাকে ভালবাসার জন্য আরো কেউ ছিল।
কাজল, সত্যিই বলছি তোমার হেঁয়ালি আমি একটুও বুঝতে পারছি না—
এই রকম কিছু যে আজ তোমার কাছ থেকে আমায় শুনতে হবে আমি জানতাম—
কাজল, অনেক রাত হয়ে গিয়েছে—আমাকে বাসায় ফিরতে হবে—আমি চললাম—
যাবে তো নিশ্চয়ই—তোমাকে আমি আটকাবো না কিন্তু মন তোমার অনেক, আগেই অন্য জায়গায় বাঁধা পড়েছে কথাটা আমাকে এতকাল জানতে দাওনি কেন! কেন আমাকে নিয়ে তুমি খেলা করেছো?
বিরক্তিভরা কণ্ঠে সুহাস বললে, খেলা তোমাকে নিয়ে আমি কোনদিনই করিনি কাজল, বোঝবার শক্তি থাকলে তুমি অনেক আগেই সেটা বুঝতে পারতে–
তা পারতাম হয়ত কিন্তু এও তুমি জেনো সুহাসবাবু, তোমার মুখোশটা আমি খুলে দেবো–
কাজল!
হ্যাঁ—আমি যতটুকু জানি সব কিরীটীবাবুকে বলবো।
কি বলবে?
আদালতে কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ালেই সেটা বুঝতে পারবে—একটা বিষাক্ত জ্বালায় যেন কথাগুলো উচ্চারণ করে কাজল উঠে পড়ে হন হন করে গেটের দিকে এগিয়ে গেল।
আর সুহাস যেন কেমন বিমূঢ় হয়ে বেঞ্চটার উপরে বসে রইলো।
সকাল সকালই পরের দিন কিরীটী আর সুব্রত বের হলো। থানায় যখন ওরা এসে পোঁছাল, তখন সোয়া আটটা মত হল—গ্রীষ্মের তাপদাহ তখনো শুরু হয়নি। থানাতেই অপেক্ষা করছিলেন সুশীল নন্দী।
কিরীটী বললে, সুশীলবাবু, চলুন আগে বটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়ে স্পটটা ঘুরে আসি। •
বেশ চলুন—সুশীল নন্দী উঠে দাঁড়ালেন।
উইক ডে–বটানিক্যাল গার্ডেনে তেমন লোকজন বড় একটা নেই। কয়েকজন আমেরিকান টুরিস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছিল—হাতে তাদের ক্যামেরা দুজনের।
সুশীল নন্দীই সঙ্গে করে নিয়ে এলেন ওদের ঠিক যেখানে মিত্রানীর মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হয়েছিল। একটা ঝোপের মত—তারই সামনে খানিকটা খোলা জমি—কিরীটী তাকিয়ে দেখে। তারপর এক সময় সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে যায়—জায়গাটা গঙ্গার ধার থেকে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ গজ দূরে হবে। এবং গঙ্গার ধার থেকে বিশেষ করে ঐ ঝোপটার জন্য জায়গাটা নজরে পড়ে না।