কেউ কি সুহাস বলে ডেকেছিল?
না, না। তারপরই একটু থেমে কাজল বোস বলতে লাগল, এগুতে যাবো কোন মতে—একটা গাছের ডাল এসে সামনে আছড়ে পড়ল, আবার একটা অস্ফুট চিৎকার কানে এলো। সুহাসই গাছের ডালের তলায় চাপা পড়েছিল, পরে বুঝেছিলাম। আর মিত্রানীকে আরো কিছুটা দূরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল–কাজেই সুহাস নয়, সে মিত্রানীকে হত্যা করতে পারে না। বলা শেষ করে কাজল যেন কিছুটা হাঁপাতে থাকে।
একটা কথা বোধ হয় আপনি জানেন না—
কি কথা?
কখনো হয়ত আজ পর্যন্ত চিন্তাও করতে পারেননি—
কি কথা? পুনরায় প্রশ্ন করলে কাজল বোস।
আপনি গত বছর সুহাসবাবুর জন্মদিনে তাকে সবুজ সুতোর নাম তুলে যে সিল্কের রুমালটা প্রেজেন্ট করেছিলেন, মিত্রানীকে সেই রুমালটার সাহায্যেই হত্যা করা হয়েছে–
কে—কে বললে?
যে রুমালটা মিত্রানীকে পেঁচিয়ে গলার ফাঁস দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সেটা সুহাসবাবুরই—তিনি ঐ কথা বলেছেন পুলিসের কাছে।
কাজল বোস যেন একেবারে বোবা। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে কিরীটীর মুখের দিকে।
সামান্য একটা রুমাল নিশ্চয়ই চুরি যায়নি—এক যদি না হত্যাকারী কৌশলে তার নিজের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য সেটা হাতিয়ে থাকে কিংবা সুহাস মিত্রই নিজে সেটা ব্যবহার না করে থাকেন!
কাজল বোস যেন পাথর।
কিরীটীর শেষ কথাটার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ কাজল বোস যেন এলিয়ে পড়ল সোফাটার ওপরে অসহায় ভাবে। কিরীটী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়, কি—কি হলো মিস বোস–সুব্রত, ভদ্রমহিলার চোখমুখে একটু জল দেবোধ হয় সংজ্ঞা হারিয়েছেন।
সুব্রত বুঝতে পেরেছিল কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়, তাই সে তাড়াতাড়ি উঠে পাশের টিপয় থেকে জলের গ্লাসটা তুলে নিয়ে হাতে গ্লাসের জল ঢেলে কাজল বোসের চোখেমুখে ঝাপটা দিতে থাকে।
মিস বোস!
চোখের পাতায় তখনো জলের কণাগুলো লেগে আছে, কাজল বোস কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সুহাস মিত্র এসে ঘরে ঢুকল।
কাজল বোস উঠে দাঁড়াল।
তুমি—তাহলে তুমিই—কাজল বললে।
কাজল! ডাকল সুহাস।
তাকে যেন একটা থাবা দিয়ে থামিয়ে দিয়ে কাজল বললে, তুমি—তুমি এত নীচ এত ছোট সুহাস?
কাজল—শোনো, শোনো—
এখনো—এখনো তুমি বলতে চাও—
কাজল!
শুনেছি—সব শুনেছি-কিরীটীবাবু আমাকে সব বলেছেন এইমাত্র, মিত্রানীকে হত্যা করবার আর কিছু তুমি খুঁজে পেলে না শেষ পর্যন্ত আমারই দেওয়া রুমালটা দিয়ে–
কাজল, এসব কি বলছো তুমি!
ঠিক বলছি-তুমিই সেদিন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলে—
আমি তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলাম! কি বলছো তুমি কি ক্ষেপে গেলে?
সুহাস, পাপ কখনো চাপা থাকে না–
কাজল বোস আর দাঁড়াল না—টলতে টলতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ঘর থেকে বের হয়ে যেতে কেউ তাকে বাধা দিল না। সুহাস তাকাল কিরাটীর মুখের দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে—তারপর বললে, কি বলে গেল কাজল কিরীটীবাবু?
নিজের কানেই তো শুনলেন আপনি ও কি বলে গেল—
শুনেছি, কিন্তু আপনি ওকে কি বলেছেন?
রুমালটার কথা বলেছি মাত্র—
কিন্তু ধাক্কা দেওয়ার কথা কি ও বলে গেল?
সেদিন কে নাকি ওকে ধাক্কা দিয়েছিল ধুলোর ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে। তারপরই একটু হেসে কিরীটী বললে, ওর কাছে আমার যা জানবার ছিল জানা হয়ে গিয়েছে—কাজল বোসকে নিয়ে যে জটটা ছিল সেটা খুলে গিয়েছে, বাকী এখন শেষ জটটি–
কিসের জট? প্রশ্ন করে সুহাস।
মিত্রানীর হত্যারহস্যকে ঘিরে তিনটে জট ছিল তার মধ্যে একটি খুলে দিয়েছেন সেদিন আপনি—আজ কাজল বোস খুলে দিয়ে গেল একটি—বাকী এখন শেষ জটটি। আশা করছি সেটাও খুলতে আর দেরি হবে না–
কিরীটীবাবু! সুহাস ডাকল।
বলুন।
সত্যিই কি আপনি মনে করেন—সুহাস ইতস্তত করে থেমে গেল।
কি, আমি!
সত্যিই কি আপনি মনে করেন—দলের মধ্যে আমিই সেদিন মিত্রানীকে হত্যা করেছি?
সে কথা থাক—আপনি আগে বলুন, সেদিন কি কাজলের সঙ্গেই আপনার ধাক্কা লেগেছিল অথচ সাড়া দেননি তার ডাকে?
না, সে কাজল নয়—
তবে কে? আমার অনুমান আপনি হয়ত তাকে চিনতে পেরেছিলেন চোখের দৃষ্টিতে নয়, হয়ত অনুভবে—স্পর্শের মধ্যে দিয়ে–
বিশ্বাস করুন তাকে আমি চিনতে পারিনি–
সুহাসবাবু, আপনারা এখনো একটা কথা জানেন না—কারণ বলা হয়নি কাউকে আপনাদের
জানি না—কি জানি না?
মিত্রানী ওয়াজ রেপড্–
সে কি! একটা অর্ধস্ফুট চিৎকার যেন বের হয়ে এলো সুহাসের কণ্ঠ চিরে।
হ্যাঁ—এবং খুব সম্ভব প্রচণ্ড ঘৃণা ও আক্রোশের বশে হত্যাকারী প্রথমে তাকে রুমালের ফাস গলায় দিয়ে হত্যা করে, তারপর তাকে রেপ করে—
আমি–-আমি কথাটা এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না কিরীটীবাবু!
হয়ত হত্যাকারীর মিত্রানীকে ঘিরে দীর্ঘদিনের অমিত লালসা শেষ পর্যন্ত তাকে পশুর পর্যায়ে টেনে এনেছিল, তাকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে ফেলেছিল–
কিরীটীবাবু!
বলুন।
এখনো আপনার ধারণা সে আমাদেরই একজন?
বলতে পারলেই আমি খুশি হতাম সুহাসবাবু কিন্তু তা পারছি না—এখনো সন্দেহের জালটা যেন আপনাদেরই কাউকে ঘিরে আছে—
সুহাস আর কোন প্রতিবাদ জানাল না। কেমন যেন মুহ্যমানের মত সোফার উপরে বসে রইলো। কারো মুখেই কোন কথা নেই, যেন একটা পাষাণ-স্তব্ধতা বিরাজ করছে। ঘরের মধ্যে—তারপরই যেন হঠাৎ একসময় উঠে দাঁড়াল সুহাস মিত্র এবং কোন রকম কিছু না বলে শ্লথ পায়ে ঘরের ভিতর থেকে বের হয়ে গেল।
সিঁড়িতে সুহাস মিত্রের পায়ের শব্দটা মিলিয়ে যাবার পর সুব্রত বললে, বেচারা মনে হলো যেন অত্যন্ত কঠিন আঘাত পেয়েছে।