শ্যামবাজার অঞ্চলে বিরাট সেকেলে বাড়ি। তিন-চার শরিক—এক এক শরিকের এক এক মহল–একতলায় একটা বিরাট হলঘর ছিল—প্রতি রবিবার সন্ধ্যার দিকে ঐ দশজন বিদ্যুৎদের ঐ হলঘরে জমায়েত হয়ে আড্ডা জমাতো। প্রতি রবিবারের সেটা ছিল ওদের একটা বাঁধা রুটিন।
শুধু আড়াই নয়—গান-আবৃত্তিও চলতো মধ্যে মধ্যে। বিদ্যুতের মা শৈলবালা প্রচুর জলযোগের ব্যবস্থা করতেন সবার জন্য!
এক বিদ্যুৎ ছাড়া অন্য সবাই মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়ে। ওদের—মানে, ছেলেদের মধ্যে সুহাসই ছিল লেখাপড়ায় সবার সেরা এবং মেয়েদের মধ্যে ছিল মিত্রানী।
০২. সজলের একটা কমপ্লেক্স ছিল
সজলের কিন্তু একটা কমপ্লেক্স বরাবরই ছিল। সেই কমপ্লেক্সের জন্যই বোধ হয় সে অন্যান্যদের সঙ্গে ঠিক মন খুলে মিশতে পারত না। শুধু তাই নয়, জীবনটাকে বরাবরই সে একটু সিরিয়াস ভাবে নিয়েছে—ভাল চাকরি করবে–জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে—জীবনে সাচ্ছল্য আসবে এটাই ছিল তার স্বপ্ন বরাবরের। সজল চলে যেতে মিত্রানীর মনে হলো, সজল আজো তেমনি আছে—তিন বছরে কোন পরিবর্তনই হয়নি তার। জীবন সম্পর্কে আজো সে তেমনি সিরিয়াস।
মিথ্যা বলেনি সজল মিত্রানীকে, কমপিটিটিভ পরীক্ষায় পাস করে চাকরি নিয়ে কলকাতা ছাড়বার পর, বিশেষ করে গত দুই বৎসরে যে-সব চিঠি সজল তাকে লিখেছে তার মধ্যে প্রায় শেষের দিকের সবগুলো চিঠিতেই একটি কথা যেন বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিখেছে সজল তাকে। এবং তার সহজ অর্থই হচ্ছে, সজল তাকে জীবনসঙ্গিনীরূপে পেতে চায়—অবশ্য মিত্রানীর যদি আপত্তি না থাকে।
মিত্রানী সজলের সব চিঠিরই জবাব দিয়েছে কিন্তু কেন না-জানি কোন চিঠির মধ্যেই সে লিখতে পারেনি সজল যা চায় তা হতে পারে না, তার পক্ষে সজলের অনুরোধ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়—বরং কিছুটা কৌশলেই যেন সজলের প্রশ্নের জবাবটা এড়িয়েই গিয়েছে এবং এও ভেবেছে মিত্রানী, সজল হয়ত নিজে থেকেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে এবং একসময় ঐভাবেই হয়ত ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।
কিন্তু এখন বোঝা গেল তা হয়নি।
সেদিনকার মিত্রানীর মনের ঐ কথাগুলো পরে মিত্রানীর উইরীর পাতায় আরো অনেক কথার সঙ্গে একেবারে শেষের দিকে জানতে পারা গিয়েছিল।
প্রায় নিয়মিতই বলতে গেলে প্রতি রাত্রে ঘুমোতে যাবার আগে মিত্রানী ডাইরী লিখতো, কিন্তু যাক—সে তো আরো পরের কথা।
নীচের কথাগুলো মিত্রানীর ডাইরীর পাতা থেকেই জানা যায়।
বেচারী সজল। সত্যিই ওর জন্য আমি দুঃখিত। হয়ত আজ স্পষ্ট করে ওকে আমার জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল কথাটা ঃ সজল, মনে মনে আমি সুহাসের কাছে অনেকদিন থেকেই বাগদত্তা। আমি শুধু অপেক্ষা করে আছি কবে সুহাস এসে আমায় বলবে, মিতা, তোমাকে আমি ভালবাসি তোমাকেই আমি চাই।
কি জানি—পারলাম না বলতে কিছুতেই যেন কথাটা সজলকে।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা যেন কিছুতেই অমন স্পষ্ট করে ওকে জানিয়ে দিতে পারলাম না।
বুঝতে পারছি অনেকখানি আশা নিয়েই সজল আজ আমার কাছে এসেছিল।
কিন্তু কি করবো—আমি কি করবো কি আমি করতে পারি?
আচ্ছা আমি যেমন সুহাসকে ভালবাসি, সেও কি তেমনি আমায় ভালবাসে?
কি জানি বুঝতে পারি না। ও এত চাপা যে কিছুই বোঝা যায় না ওর ভিতরের কথা।
কেন যেন মিত্রানীর চোখে সেরাত্রে একেবারে ঘুম ছিল না।
পরের দিন সকালে উঠে সবে চায়ের কাপটা নিয়ে বসেছে, বাবার ঘরে টেলিফোনটা বেজে উঠলো এবং একটু পরেই বাবার গলা শোনা গেল, মিতান মা, তোমার ফোন
চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখেই মিত্রানী বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকল। মিত্রানীর বাবা অবিনাশ ঘোষাল ঐদিনকার সংবাদপত্রটা পড়ছিলেন। মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দেখে বললেন, তোমাকে এত করে বলি মিতান মা ফোনটা তোমার ঘরে নিয়ে নাও—যখন-তখন এত বিরক্ত করে—
বাড়িতে ফোন আসার কিছুদিন পর থেকেই অবিনাশ ঘোষাল এ কথা বলে আসছেন। নিজে বরাবর স্কুল-মাস্টারি করেছেন—এখনো করছেন—রিটায়ার করবার প্রায় সময় হয়ে এলো, তার এক ছেলে এক মেয়ে-ছেলে বড়, ডাক্তার-ছেলে প্রণবেশই তার নামে ফোনটা এনেছিল বছরখানেক আগে বাড়িতে—সরকারের কাছে বিশেষ আবেদন জানিয়ে। কিন্তু ফোন বাড়িতে আসার মাস তিনেকের মধ্যেই সে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছে।
অবিনাশ ঘোষাল কখনো কারো কাছে ফোন করেন না—তাঁকেও বড় একটা কেউ ফোন করে না। ফোন আসে মিত্রানীর কাছেই।
এবং মিত্রানীই ফোন করে কখনো-সখনো।
মিত্রানী রিসিভারটা তুলে নিল, হ্যালো!
মিত্রানী নাকি? আমি সুহাস।
কেন জানি সুহাসের নামটা শুনেই ধক্ করে ওঠে মিত্রানীর বুকের ভিতরটা। তাকে বন্ধু-বান্ধবরা ফোন করে, সুহাস কখনো আজ পর্যন্ত তাকে ফোন করেনি।
সুহাস অবিশ্যি সময়ই পায় না বড় একটা। এম. এ. পড়তে পড়তেই, তার বরাবর অত ভাল পরীক্ষায় রেজাল্ট হওয়া সত্ত্বেও পড়া ছেড়ে দিয়ে কোন একটা মার্চেন্ট অফিসে চাকরি নিয়েছে।
মাইনে এমন বিশেষ কিছুই নয়।
মিত্রানী চাকরির সংবাদটায় তেমন নয়, যতটা পড়া ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে বিস্মিত হয়ে শুধিয়েছিল, তা তুমি পড়া ছেড়ে দেবে কেন?
সুহাস বলেছিল, দুটো তো একসঙ্গে ম্যানেজ করা যাবে না মিত্রানী—
কিন্তু পাসটা করেই না হয় চাকরিতে ঢুকতে—অনেক ভাল চান্স হয়ত পেতে।
ঠিক, তা হয়ত পেতাম, কিন্তু সময় তো দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে না। আজকের অভাবটা হয়তো আরো তখন দুঃসহ হয়ে উঠবে।
কিন্তু এম. এ.-তে তুমি নির্ঘাত ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতে, তখন অনেক ভাল চাকরি হয়ত তোমার জুটতো।