কাজল কিরীটীর কথার কোন জবাব দিল না—অল্প দূরে সুব্রত চুপচাপ বসে একটা পিকটোরিয়ালের পাতা উল্টাচ্ছিল, সেদিকে একবার তাকিয়ে একটা খালি সোফায় কিরীটীর মুখোমুখি বসল।
কাজলের মুখটা গম্ভীর—যেন একটা বিরক্ত-বিরক্ত ভাব।
আপনি হয়ত বিরক্ত বোধ করেছেন মিস বোস, আপনাকে আমি বেশীক্ষণ আটকাবো না।
কাজল বোস নীরব।
মিস বোস সেই দুর্ঘটনার দিন আপনি কি ধুলোর ঝড়ে বিভ্রান্ত হয়ে হঠাৎ পড়েটড়ে গিয়েছিলেন?
না তো!
তবে আপনার হাতের চুড়ি ভাঙল কি করে?
আমার হাতের চুড়ি—কেন আপনাকে তো সেদিন আমি বলেছিলাম, আমার ছোেট ভাইঝি আমার হাতের চুড়ি টানাটানি করতে গিয়ে ভেঙে ফেলে।
হ্যাঁ বলেছিলেন মনে আছে–তবে কথাটা ঠিক আমার বিশ্বাস হয়নি—
কেন? বিশ্বাস হয়নি কেন আপনার—কেন, আপনার মনে হয়েছে যে আমি মিথ্যা বলছি!
মিথ্যা বলেছেন তা আমি বলিনি—
তবে?
আপনার বাঁ হাতে ঠিক কব্জির কাছে একটা অ্যারেশন,—মানে কিছুটা ছড়ে যাওয়ার মত সেদিন দেখেছিলাম এবং তার চিহ্ন এখনো আছে, মনে হয় ওটা কিছুতে কেটে গিয়েছে—কাজেই স্বাভাবিক ভাবেই আমার মনে হয়েছে—
কি মনে হয়েছে আপনার কিরীটীবাবু?
আপনি হয়ত সেদিন পড়ে গিয়েছিলেন বা কোন কারণে হাতে আঘাত পেয়েছিলেন, যার ফলে আপনার বাঁ হাতের দু-একগাছি চুড়ি ভেঙে গিয়েছিল ও কব্জির কাছে ছড়ে গিয়েছিল সেই আঘাতে।
না, সে সব কিছুই হয়নি—আপনি যা ভাবছেন!
তবে আপনার বাঁ হাতের কব্জির কাছে ঐ আঘাতের চিহ্নটা কি করে এলো?
তা ঠিক মনে নেই—হয়ত কোন সময়ে কিছু হয়েছে—
মিস বোস, যে সত্যকে আপনি ঢাকবার চেষ্টা করছেন, তাকে আপনি ঢেকে রাখতে। পারবেন না। শুনুন, আমি যদি বলি, সেদিন ঝড় ও ধুলোর ঘূর্ণির মধ্যে কারো সঙ্গে আপনার ধাক্কা লেগেছিল!
ধাক্কা?
হ্যাঁ, কিংবা কারো সঙ্গে আপনার হাতাহাতি হয়েছিল সেই সময়ই আপনার হাতের চুড়ি ভেঙে যায়।
কি পাগলের মত যা তা বলছেন?
আমি যে পাগলের মত যা-তা বলছি না মিস বোস—তার উপযুক্ত প্রমাণ থানা। অফিসার সুশীল নন্দীর কাছে আছে—কিছু ভাঙা চুড়ির অংশ—যে অংশগুলো আপনার। হাতের ঐ চুড়ির সঙ্গে হুবহু মিলে যাবে—আর আদালত যখন সেই প্রশ্ন আপনাকে করবে—
আদালত প্রশ্ন করবে? কথাটা উচ্চারণ করতে গিয়ে মনে হলো যেন কাজল বোসের গলার স্বর কেঁপে গেল একটু।
নিশ্চয়ই। আদালতে যখন মিত্রানীর হত্যা-মামলা উঠবে—এবং ঐ চুড়ির ব্যাপারে, আপনাকে ক্রস করবে সরকারী উকিল—
আপনি-আপনি কি বলতে চান কিরীটীবাবু?
কিছুই না, কেবল সেদিন সত্য যা আপনার জ্ঞাতসারে ঘটেছিল সেইটুকুই আপনার কাছ থেকে জানতে চাই–বলুন
আ-আমি কিছু জানি না।
জানেন। বলুন কার সঙ্গে সেদিন আপনার ধাক্কা লেগেছিল–কে সে?
আমি বলতে পারবো না–পারবো না।
আপনি বলতে পারবেন না কিন্তু আমি বলছি–তিনি সুহাসবাবু, তাই না?
না, না—তাকে আমি চিনতে পারিনি বিশ্বাস করুন, তাকে আমি চিনতে পারিনি—
চিনেছিলেন—তাকে আপনি চিনেছিলেন মিস বোস, কিরীটীর গলার স্বর ঋজু ও কঠিন, বুঝতে পারছেন না কেন একজনকে বাঁচাতে গিয়ে ফাঁসির দড়ি আপনার দিকে এগিয়ে আসছে!
ফাঁসি! একটা আর্ত অস্ফুট চিৎকার যেন কাজল বোসের কণ্ঠ চিরে বের হয়ে এলো। তার দুই চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি।
একজনকে হত্যার অপরাধে ইনডিয়ান পেনাল কোর্ডের ৩০২ ধারায় সেই দণ্ডই দেওয়া হয়ে থাকে—কাজেই সুহাসবাবুর—
না, না—আপনি বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু, সুহাস নির্দোষ—সম্পূর্ণ নির্দোষ, সে মিত্রানীকে হত্যা করেনি—
তাকে ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচাবার একটি মাত্র উপায় আছে মিস বোস-অকপটে সেদিন যা যা ঘটেছিল সেইটুকু আমার কাছে প্রকাশ করে দেওয়া। কিরীটীর গলার স্বর শান্ত কিন্তু দৃঢ়। বলুন—সেদিন ঠিক কি ঘটেছিল আপনার দৃষ্টির মধ্যে ধুলোর ঘূর্ণিঝড় ওঠাবার পর–
সত্যি বলছি, আপনি বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু
আমার প্রশ্নের জবাব দিন যদি সুহাসবাবুকে বাঁচাতে চান। কেন বুঝতে পারছেন না আপনি মিস বোস—সুহাসবাবুর বাঁচবার আর কোন রাস্তা নেই বলেই আপনাকে অনুরোধ করেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য!
আমার কথা আপনি বিশ্বাস করবেন?
সত্য বললে কেন বিশ্বাস করবো না!
কাজল বোস অতঃপর নিজেকে যেন একটু গুছিয়ে নিলো। তারপর বলতে শুরু করল, হঠাৎ ধুলোর ঘূর্ণিঝড় ওঠবার পর আমরা প্রত্যেকেই সেই ধুলোর অন্ধকারে ছিটকে পড়েছিলাম—
জানি। তারপর?
ঝড়ের ঝাপটা থেকে বাঁচবার জন্য এলোমেলো ভাবে যে কোথায় চলেছি প্রথমটায় যেমন বুঝতে পারিনি তেমনি এও বুঝতে পারিনি কতদূর এগিয়েছি ঐ সময়–
একটা কথা মিস বোস, মিত্রানী আপনার কত দূরে ছিল?
ঠিক জানি না, তবে মনে হয়—
সুহাসবাবু—
হ্যাঁ, বোধ হয় আমার ঠিক আগেই ছিল সুহাস—কাজল বোস থামল।
কিরীটী বললে, বলুন, থামলেন কেন?
হঠাৎ যেন কার সঙ্গে আমার ধাক্কা লাগলো–
ধাক্কাটা লেগেছিল সামনে না পিছন থেকে, না পাশ থেকে? কিরীটীর প্রশ্ন।
মনে হয়েছিল যেন পাশ থেকেই—একটু থেমে আবার কাজল বললে, ভেবেছিলাম বুঝি সুহাসই, তাই তাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠি—কে, সুহাস—কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না—বরং যাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম সে যেন একটা ধাক্কা দিয়ে আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করলো—আমি সামলাতে পারিনি নিজেকে—পড়ে যাই
লোকটাকে আপনি ভাল করে দেখতে পাননি?
না।
তারপর?
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা অস্ফুট চিৎকার শুনতে পাই, আমি পড়ে গিয়ে ততক্ষণে আবার উঠে দাঁড়িয়েছি—একটা ঝটাপটির শব্দ—তারপরই–