আমার অনুমান আপনি সেদিন কিছু শুনে থাকলে ভুল শোনেননি ঠিকই শুনেছেন, বলুন এবারে ব্যাপারটা কি!
সুহাস মিত্র বলতে লাগল,ঝড় আর ধুলোর ঘূর্ণির অন্ধকারের মধ্যে প্রথমটা আচমকা এমন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম যে, কোথায় কোন্ দিকে এগোচ্ছি বুঝতেই পারছিলাম না—তাছাড়া ঐ সময় আমার চোখ থেকে চশমাটা হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ায় কোথায় ছিটকে পড়ে গিয়েছিল।
হুঁ, সেদিন আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় আপনার চোখে চশমা দেখে সত্যিই একটু খটকা লেগেছিল এবং আপনার চশমার লেন্সের দিকে তাকিয়েই বুঝেছিলাম একটু যেন বেশীই মাইনাস পাওয়ারের চশমা আপনার—অথচ সুশীল নন্দীর রিপোর্টে আপনার চশমার কথা কিছুই ছিল না। ভেবেছিলাম হয়তো সেটা সুশীল নন্দীর আপনার বর্ণনায় একটা সাধারণ অমিশন মাত্র।
না—চশমা ছাড়াই আমি থানায় গিয়েছিলাম—যদিও দূরের সব কিছু দেখতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল।
চোখ কি আপনার অনেক দিন থেকেই খারাপ?
হ্যাঁ—ছোটবেলার একটা ইনজুরির জন্য বাঁ চোখের দৃষ্টিটা বরাবরই কিছুটা খারাপ ছিল—ডান চোখেও হায়ার সেকেন্ডারি দেবার আগে থাকতেই চোখের এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে দৃষ্টিশক্তির বিপর্যয় শুরু হয়—মানে দু চোখের দৃষ্টিই ক্ষীণ হয়ে আসে।
কি রোগ?
গ্র্যাজুয়াল অপটিক নার্ভ অ্যাট্রোফি—ডান চোখের দৃষ্টিবাহী স্নায়ু আমার ক্রমশ শুকিয়ে আসছে, সঙ্গে সঙ্গে বাঁ চোখটাও আরও দুর্বল হয়ে আসছে—অনেকেই জানত না সে কথাটা—বি. এ.-তে ভাল রেজাল্ট করা সত্ত্বেও যে আমি আই. এ. এস. দিই না এটাই ছিল তার মুখ্য কারণ, মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেট আমি পেতাম না। অবিশ্যি বন্ধুবান্ধবরা ধরে নিয়েছিল আমার আত্মবিশ্বাসের অভাব-ভীরুতা——কেউ বলেছে এসকেপিস্ট মেন্টালিটি—কাউকেই মুখ ফুটে আমি তবু বলতে পারিনি—আমার জীবনটাই ড়ুমড়—একদিন একটু একটু করে দুচোখের দৃষ্টির উপরে চিরঅন্ধকার নেমে আসবে—অন্ধকার—ছেদহীন অন্ধকার।
সুহাস মিত্রর গলাটা যেন শেষের দিকে রুদ্ধ হয়ে এলো।
সুহাস মিত্র একটু যেন থেমে বলতে লাগল আবার,ভগবানই যে আমার জীবনের অগ্রগতির পথে কাঁটা দিয়ে সব শেষ করে দিয়েছেন
আর কাউকে না বলেছিলেন না বলেছিলেন সুহাসবাবু, মিত্রানীকে কেন বললেন না কথাটা, কিরীটী শান্ত গলায় বললে।
কি হতো বলে কথাটা তাকে কিরীটীবাবু, কেবল দুঃখই দেওয়া হতো তাকে—মিত্রানী যে কি গভীর ভালবাসত আমায় আমি কি তা জানতাম না কিরীটীবাবু, জানতাম, আর জানতাম বলেই কখনো তার ডাকে সাড়া দিইনি ভেবেছি আমার নীরবতায় যদি ক্রমশ একটু একটু করে মনটা তার অন্যদিকে ঘুরে যায়—তাই যাক।
সুহাসবাবু, সত্যিকারের ভালবাসা কি অত সহজে ভিন্নমুখী হয়? হয় না—
আগে সে কথাটা একবারও মনে হয়নি—কিন্তু মিত্রানীর মৃত্যুর পর কেবলই কি মনে হচ্ছে জানেন?
কি?
সেদিন আমাকেই হয়ত যদি সে ধুলোর ঘূর্ণি ও ঝড়ের মধ্যে অন্ধকারে খুঁজতে খুঁজতে পাগলের মত না হয়ে উঠতো তবে হয়ত অমন করে আমার কাছে থেকেই মৃত্যুকে বরণ করতে হতো না—আমার সবচাইতে বড় দুঃখ কি জানেন কিরীটীবাবু, সে জানতেও পারেনি ঐ মুহূর্তে তার অত কাছে থেকেও চশমা হারিয়ে আমি একপ্রকার ব্লাইন্ড–অন্ধ—আমি নিরুপায়—
উত্তেজিত কণ্ঠে কিরীটী প্রশ্ন করে, তা হলে আপনি কারো গলা বা চিৎকার শুনেছিলেন!
শুনেছিলাম—
কার—কার গলা শুনেছিলেন-চিনতে পেরেছিলেন সে কার গলা?
হ্যাঁ—
কার গলা?
মিত্রানীর গলা—
কি? কি বলেছিল সে?
কে? কে—আঃ ছাড়ো-সুহাস-সুহাস—তারপরই গোঁ গোঁ অস্পষ্ট একটা চাপা শব্দ–কিছু দেখতে পাচ্ছি না তখন তবু মরীয়া হয়ে সামনে এগুবার চেষ্টা করে দুপাও এগোয়নি—একটা গাছের ডাল এসে মাথায় হঠাৎ হুড়মুড় করে পড়ল, আমি জ্ঞান হারালাম।
আর কারো গলা আপনি শোনেননি সুহাসবাবু? কিরীটী আবার শুধাল।
১৭. মিত্রানীর হত্যা-রহস্যের একটা জট
সুহাসবাবু!
বলুন।
মিত্রানীর হত্যা-রহস্যের একটা জট আমি কিছুতেই খুলতে পারছিলাম না— আপনার স্বীকারোক্তি সেই জটটা খুলে দিল। আচ্ছা সুহাসবাবু, একটা কথা
বলুন—
মিত্রানীর প্রতি সজলবাবু যে আকৃষ্ট ছিলেন সে কথাটা কি আপনি বুঝতে পেরেছিলেন কখনো?
জানতাম–
জানতেন? কি করে জানলেন?
বিদ্যুৎ একদিন আমাকে বলেছিল—
বিদ্যুৎবাবু আপনাকে কথাটা বলেছিলেন?
হ্যাঁ। কথাটা শুনে আমি, বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু, সুখীই হয়েছিলাম। সজল জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—মিত্রানীকে সে বিয়ে করলে মিত্রানী সুখীই হবে। এ
আচ্ছা ঐ দুর্ঘটনার আগে এবং গার্ডেনে সকলে মিলিত হবার পূর্বে শেষ কার কার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল বন্ধুদের মধ্যে?
সকালে বাড়িতে এসেছিল সজল এবং বিদ্যুৎ—সে এসেছিল অফিসে আমায় পিকনিকের কথাটা জানাতে পরের দিন দুপুরে।
ভাল কথা, কিরীটী বললে, দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল—১৪ মে, শনিবার—তাই না?
হ্যাঁ, তারিখটা আমার চিরকাল মনে থাকবে কিরীটীবাবু।
তারপর একটু থেমে বললে সুহাস, সেদিনটা—সরকারী এবং বেসরকারী অফিস সব বন্ধ ছিল–তাই তো শনিবার পিকনিকের জন্য স্থির করেছিল বিদ্যুৎ
আচ্ছা বৃহস্পতিবার সকালের দিকে আপনি মিত্রানীকে ফোন করেছিলেন!
আমি মিত্রানীকে ফোন করেছি—কে বললে একথা!
মিত্রানীর ডাইরীতেই কথাটা লেখা আছে—
মিত্রানী তার ডাইরীতে লিখেছে, আমি বৃহস্পতিবার সকালে তাকে ফোন করেছিলাম?
হ্যাঁ—
আশ্চর্য! আমি তাকে জীবনে কখনো ফোন করিনি—