চুপ করে আছ কেন মিত্রানী, সজল তোমাকে কিছু বলেছিল?
বললাম, না—মানে বলছিলাম হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
সুহাস আবারও তার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলো, বল না সজল তোমাকে কিছু বলেনি?
বললাম—হ্যাঁ, মিথ্যাই বললাম—না তো, সেরকম কিছু তো আমার মনে পড়ছে না সুহাস, তবে কি ঠিক তুমি জানতে চাও যদি বলতে–
আশ্চর্য-তারপরই তার প্রশ্ন : আচ্ছা মিত্রানী, সজল কি তোমাকে বলেছিল, সে তোমাকে ভালবাসে—সে তোমাকে বিয়ে করতে চায়? তার জবাবে তাকে তুমি বলেছিলে তা সম্ভব নয়—কারণ তুমি অন্য একজনকে ভালবাস?
জিজ্ঞাসা করলাম, সজল তোমাকে ঐ কথা বলেছে?
সুহাস ফোনে আবার বললে, নচেৎ আমি জানবো কি করে বল! সজলের কাছে অবিশ্যি তুমি তার নামটা বলোনি—এড়িয়ে গেছে, কিন্তু আমাকে তুমি বলতে পার কে সে–আমাদের মধ্যেই কেউ কি–
আশ্চর্য! এরপর আর কি বলতে পারি—বললাম, কি হবে নামটা জেনে তোমার?
তবু সে পীড়াপীড়ি করতে লাগল—আমি চুপ করে রইলাম। আশ্চর্য, সত্যিই কি আজো বুঝতে পারেনি সুহাস কোথায় আমার মনটা বাঁধা পড়েছে।
ফোনটা নামিয়ে রেখে চলে এলাম ঘর থেকে।
এর পরে মাত্র দুটি লাইন লেখা ডায়েরীর শেষ পৃষ্ঠায়। তারিখ নেই তবে পড়ে মনে হয় ঠিক পরের দিনই বিকেলের দিকে আবার সজল এসেছিল—-
সজল এসেছিল—
যাক, সজলের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, সজল বোধ হয় শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা সহজ ভাবেই নিয়েছে। সজল বললে সে চায় পুরাতন বন্ধু-বান্ধবরা সকলে মিলে–বিদ্যুৎকে সে নাকি কথাটা বলেছে। যাবার আগে সজল একটা অদ্ভুত ব্যাপার করলো–ভাবতেও হাসি পাচ্ছে। সুহাসকে ওর চোখ দিয়ে আজ আমাকে চিনতে হবে—হায় রে—
কিরীটী ডাইরাটা একপাশে রেখে আরো কিছুক্ষণ বই ও খাতাপত্র ঘাঁটলো, তারপর একসময় জানালা দুটো বন্ধ করে ঘর থেকে বের হয়ে এলো।
অবিনাশ ঘোষাল তখনো আগের মতই পায়চারি করছিলেন—
মাস্টারমশাই–
অবিনাশ ঘোষাল কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
মাস্টারমশাই, মিত্রানীর ডাইরীটা আমি নিয়ে যাচ্ছি!
মিত্রানীর ডাইরী? অবিনাশ ঘোষাল শুধালেন।
হ্যাঁ।
কোথায় পেলে?
ওর ড্রয়ারে—
ও, আচ্ছা। যাও নিয়ে।
১৪. ডাইরীখানা নিয়ে
ডাইরীখানা নিয়ে রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর বসবার ঘরের সোফায় গিয়ে বসল কিরীটী একটা চুরেট ধরিয়ে।
বেশী দিন নয়–বৎসর খানেক আগের তারিখ থেকে ডাইরী লেখার শুরু, তাহলেও প্রথম পাতাতেই লিখেছে মিত্রানী—ডাইরা লিখতাম সেই কবে থেকে–কিন্তু মাঝখানে কয়েক বৎসর লিখিনি, লিখতে ইচ্ছাও হয়নি কিন্তু অার থেকে আবার লিখবো ভাবছি। চমৎকার ভাইরাটী পাঠিয়েছে সজল–এমন সুন্দর মরা লেদারে বাঁধানো ডাইরীটা– দেখলেই কিছু লিখতে লোভ জাগে মনে। কিন্তু কি লিখি! কাকে নিয়ে শুরু করি আমার এই ভাইরা–দৈনন্দিন জাব-কথা! ত্রিশ বৎসর বয়স হলে– অধ্যাপনা করছি। কলেজে যাই, মেয়েদের পড়াই, অবসর সময়টা বেশীর ভাগই বই নিয়ে কাটি-একা, বড় একা লাগে। মধ্যে মধ্যে মনে হয় যেন এক মরুভূমির মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি। এ যাত্রার শেষ কোথায় কে জানে?
সুহাস–সুহাস কি আজও বুঝতে পারেনি কি বুক ভরা ভালবাসা নিয়ে তারই প্রতীক্ষায় প্রহর গুনে চলেছি! যার জন্য অপেক্ষা করে আছি তার সাড়া নেই-অথচ যার কথা মনে পড়ে না ভুলেও কখনো, সে একটার পর একটা চিঠি লিখে চলেছে।
সজল, আমি বুঝি, তুমি স্পষ্ট করে না লিখলেও বুঝতে পারি, তোমার ঐ কথার গাঁথুনির ফাকে ফাকে বিশেষ কোন কথার্টি তোমার মনের মধ্যে উঁকি দিতে চাইছে।
কিন্তু আমি যে অনেক আগেই দেউলিয়া হয়ে বসে আছি। কাউকেই আর দেবার মত যে অবশিষ্ট কিছুই নেই। বাবা এতদিন পর্যন্ত কখনো আমার বিয়ের কথা বলেননি—কিন্তু গতরাত্রে বলছিলেন, একটি ভাল পাত্রের সন্ধান পেয়েছি মা–সন্ধানও ঠিক নয়, পাত্রপক্ষই এগিয়ে এসেছে, তোর যদি কোন আপত্তি না থাকে তো কথা বলতে পারি।
বললাম, না বাবা—
ছেলেটি ভাল—
আমি তোমাকে ঠিক সময়ে জানাবো বাবা।
বাবা আর কোন কথাই বললেন না। অসন্তুষ্ট হলেন কিনা কে জানে! আশ্চর্য! সুহাস, এখনো তোমার সময় হলো না!
কয়েক পৃষ্ঠা পরে—
বিদ্যুতের সঙ্গে সেদিন হঠাৎ দেখা–সে বললে, কেমন আছো মিত্রানী?
ভাল।
ভাবছিলাম একদিন তোমাকে ফোন করবো—
করেছিলে নাকি?
না।
করলেও কথা হতো না—আমার সাড়া পেতে না।
কেন?
ফোনটা আজ দশদিন আউট অফ অর্ডার হয়ে আছে।
বিদ্যুৎ হো হো করে হেসে উঠলো।
তা আমার কথা হঠাৎ মনে পড়লো কেন বিদ্যুৎ?
আমার নায়িকার সন্ধানে–মানে আমার পরের বইতে মনে হচ্ছিল তোমাকে চমৎকার ফিট ইন করবে।
এবার হেসে উঠলাম আমি।
হাসলে যে?
শেষ পর্যন্ত আর মেয়ে খুঁজে পেলে না? আমার কথা ভাবছিলে?
সত্যি বল না, করবে অভিনয়?
না।
কেন?
আমি বিয়ে করবো—
সে তো অভিনয় করলেও বিয়ে করা যায়–
না, স্ত্রী আর অভিনেত্রী একসঙ্গে হওয়া যায় না।
কিন্তু তোমাকে অনেক উদাহরণ দিতে পারি
পারো হয়ত, কিন্তু অভিনেত্রীদের স্বামীর ঘর–কোনদিনই স্বামীর ঘর হয়ে ওঠে না, একটার গ্ল্যামার অন্যটার শান্তসুন্দর জীবনের গলা টিপে ধরতে শুরু করে পদে। পদে–যার ফলে বিক্ষোভ-অশান্তি—তারপর—
কি তারপর?
হয় দুঃসহ এক জীবন-যন্ত্রণা—না হয় অকস্মাৎ একদিন পরিসমাপ্তি। না বিদ্যুৎ, মেয়ে। হয়ে জন্মেছি—আমি মেয়ে হয়েই বেঁচে থাকতে চাই। গৃহিণী, সন্তানের জননী–
তা বসে আছো কেন আজো?
বসে আছি পথ চেয়ে—
কার পথ চেয়ে আমার নয় তো!