ঠিক-ঠিক বলেছো কিরীটী—নচেৎ একজাকে হত্যা করে তার দেহের উপরে জঘন্য কুৎসিত অত্যাচার
আপনি—আপনি কি করে জানলেন কথাটা মাস্টারমশাই?
জেনেছি কিরীটী, প্রণবেশই আমাকে বলছিল।
ঐ মুহূর্তে কিরীটী অবিনাশ ঘোষালের কথাটার জবাব না দিতে পারলেও পরে দিয়েছিল।
কিরীটী চুপ করে থাকে এবং কিরীটীকে চুপ করে থাকতে দেখে অবিনাশ ঘোষাল বললেন, মিতা মাকে আমি আর ফিরে পাব না জানি কিন্তু তুমি যদি সেই পিশাচটাকে ধরতে পার– তাকে ক্ষমা করো না–ক্ষমা করো না কিরীটী–
কিরীটী এবারেও অবিনাশ ঘোষালের কথার জবাব দিল না–কেবল বললে, মিত্রানীর ঘরটা একবার আমি দেখে আসি মাস্টারমশাই—
অবিনাশ ঘোষাল আর কোন কথা বললেন না। বাইরের দিকে তাকিয়ে বোধ হয় প্রাণপণে নিজের বুকের অস্থিরতাটাকে দমন করবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
কিরীটী আর একবার সেই শোকে-দুঃখে মুহ্যমান মানুষটির দিকে তাকিয়ে নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল দরজার কপাট ঠেলে।
ঘরের জানালাগুলো বন্ধ ছিল। গোটা দুই জানালা খুলে দিতেই দিনের আলো অন্ধকার ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল। নিঃশব্দে একবার চারিদিকে দৃষ্টিপাত করতেই সিংগল খাটটার প্রায় কাছাকাছি, লেখাপড়ার টেবিলটার পাশে একটা ত্রিকোণ বুক-সেলফের প্রতি তার নজর পড়ল। থমকে যেন দাঁড়াল কিরীটী।
ত্রিকোণ বুক-সেলফটার উপরে একটা সুদৃশ্য ধূপধার–তার পাশেই একটি কারুকার্যখচিত ফটো-ফ্রেমের মধ্যে মিত্রানীর ফটো। মিত্রানী তারই দিকে চেয়ে যেন মৃদু মৃদু হাসছে।
কয়েকদিন আগেও মেয়েটি জীবিত ছিল–আজ আর নেই। অতীব নিষ্ঠুরভাবে একটা সাদা সিল্কের রুমাল পাকিয়ে তারই সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে।
রুমালটার কোণে সবুজ সুতো দিয়ে লেখা ইংরাজী অক্ষর টি। মনে পড়ছে ঐ সঙ্গে এক তরুণীর বুকভরা ভালবাসার উপহার তারই প্রেমাস্পদকে। কাজল বোসের দেওয়া উপহার সুহাস মিত্রকে, সুহাস মিত্র নাকি পিকনিকের—অর্থাৎ ঐ দুর্ঘটনার দিন দুই আগে কোথায় হারিয়ে ফেলে।
সুহাস মিত্র কি সত্য কথা বলেছে! যদি সত্যিই বলে থাকে তো রুমালটা হত্যাকারীর হাতে কিভাবে গেল!
তবে কি—তবে কি হত্যাকারী ইচ্ছা করেই রুমালটা চুরি করেছিল? হত্যা করবার জন্য তো সে অন্য কোন রুমালও ব্যবহার করতে পারত। এই বিশেষ রুমালটিরই বা তার প্রয়োজন হলো কেন! একটি—একটিমাত্র কারণই থাকতে পারে তার, হত্যাকারী চেয়েছিল যাতে করে মিত্রানীর হত্যার সন্দেহটা সুহাস মিত্রের উপরে গিয়ে পড়ে।
কিরীটী মনে মনে হাসে। হত্যাকারী তার পরিকল্পনা মত মিত্রানীকে যে কারণেই হোক হত্যা করতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে যেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং যেটা সে কিরীটীর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণকে এড়িয়ে যেতে পারে নি, হত্যাকারী বাইরের বা সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ নয়—সে এমন একজন যার কেবল সুহাস মিত্রের বাড়িতে অবাধ গতিবিধি ছিল তাই নয় সে সুহাসদের অনেক কথাই জানত, ওদের সকলকার ভিতরের খবর এবং সেটা একমাত্র জানা সম্ভব ছিল ঐ নয়জনেরই—হ্যাঁ, সেইখানেই কিরীটী নিঃসন্দেহ ওদের মধ্যেই কেউ একজন হত্যাকারী। গত রাত থেকেই কিরীটীর মনের মধ্যে বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। প্রবাবিলিটি, চান্স ও মোটিভের দিক থেকে ঐ নয়জনের মধ্যে কার উপরে বেশী সন্দেহ পড়ে!
কে? কে? দলের প্রত্যেকেই এক-একজন করে তার মনের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। গতকাল। আর তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিজেকে নিজে একটার পর একটা প্রশ্ন করে গিয়েছে কিরীটী।
পারে নি–এখনো পারেনি শক্ত মুঠোর মধ্যে একজনকে ধরতে।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল টেবিলটার সামনে কিরীটী। নানা ধরনের বই খাতাপত্র— বোঝা যায় রীতিমত পড়ুয়া ছিল মেয়েটি। খাতা বই ড্রয়ার প্রভৃতি ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ একটা মোটা সুদৃশ্য সবুজ মলাটের খাতা কিরীটীর হাতে এলো।
খাতার কয়েকটা পাতা উল্টোতেই কিরীটী বুঝতে পারল সেটা একটা ডাইরী। মুক্তার মত সুন্দর হাতের লেখা—পাতার পর পাতা লেখা। প্রথম দিকে বিশেষ কোন তারিখ নেই, যাও আছে দীর্ঘদিনের ব্যবধানে—কিন্তু শেষের দিকে তারিখগুলো দেওয়া আছে। একেবারে শেষ পাতার তারিখটার দিকে তাকিয়ে যেন চমকে ওঠে কিরীটী—
১০ই মে, বুধবার, রাত দশটা পঞ্চান্ন, আজ সজল হঠাৎ সকালে এসে হাজির। আশ্চর্য হইনি কিছুসজল যে একদিন আসবে জানতাম এবং সে যে প্রস্তাব করবে তাও জানতাম। আমার অনুমানটি যে মিথ্যা নয় সেটাই প্রমাণিত হলো। তার প্রশ্নের জবাবে বলতে বাধ্য হলাম তার প্রস্তাব আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আমি অন্যের বাগদত্তা কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে বললাম, মন জানাজানির পালা এখনো চলেছে। ভাবছি বলে দিলেই হতো স্পষ্ট করে, সুহাসের প্রতীক্ষায় আমি আজও আছি—তার কাছেই আমি বাগদত্তা।
ও যখন চলে যায় ওর মুখের দিকে তাকাতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু ঐ ভাবে আমাকে পীড়াপীড়ি না করলে আজ ওর কাছে যতটুকু বলেছি সেটুকুও কখনো কারো কাছে প্রকাশ করতাম না।
কিরীটী পড়ে চলে।
ঐ পর্যন্ত ঐ পাতায়। তার পরের পাতায় একেপাশে কেবল তারিখ দেওয়া আর লেখা রাত্রি, ১৩ই মে, শনিবার।
পরশুদিন সুহাস ফোন করেছিল-সকালে। সে তো কখনো আমাকে আজ পর্যন্ত ফোন করেনি–এই তার আমাকে প্রথম ফোন।
মিত্রানী—
বল।
বলছিলাম—মানে সজল কি তোমাকে কিছু বলেছে?
বুঝতে পারলাম না সুহাসকে কি জবাব দেবো, সজল গতকাল আমাকে যে কথাটা বলেছিল, সেটা কি কাউকে বলা ঠিক হবে!