কে, কার কথা বলছিস?
সজল চক্রবর্তী-কাজেই দুজনার আকর্ষণ একজনের বিকর্ষণের মধ্যে দিয়ে একটা জটিল ত্রিকোণ গড়ে উঠেছিল হয়ত।
জটিল ত্রিকোণ!
হ্যাঁ—আকর্ষণ ও বিকর্ষণের ত্রিকোণ! আর সেই আকর্ষণ ও বিকর্ষণেরই ফল আমার মনে হচ্ছে এখন ঐ নিষ্ঠুর হত্যা। কিংবা বলা চলে ঐ আকর্ষণ বিকর্ষণের মধ্যেই মিত্রানীর নিষ্ঠুর হত্যার বীজটি রোপিত হয়েছিল। এখন কথা হচ্ছে, মিত্রানী ব্যাপারটা জানত কিনা। এবং যদি জেনে থাকত, সে কিভাবে ব্যাপারটা নিয়েছিল।
আরো একটু স্পষ্ট করে বল কিরীটী।
আপাতদৃষ্টিতে ভালবাসা ও ঘৃণা যদিও দুটি বিপরীত বস্তু-তাহলেও দেখা যায়, ভালবাসা থেকে যেমন ঘৃণার জন্ম হতে পারে, তেমনি ঘৃণারও পিছনে অনেক সময় অবচেতন মনে থাকে ঐ ভালবাসাই। এখন কথা হচ্ছে দুজনের ভালবাসাই শেষ পর্যন্ত ভালবাসাই ছিল, না ক্রমশ একদিন ঘৃণায় পর্যবসিত হয়েছিল। অথবা প্রথম থেকেই জন্ম নিয়েছিল ঘৃণা এবং সেই ঘৃণাই হয়েছিল ভালবাসা! পরস্পর-বিরোধী দুটি বস্তু ভালবাসা ও ঘৃণা। তাই প্রথমটায় মিত্রানীর হত্যার ব্যাপারটা যতটা কঠিন বা জটিল ভাবিনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বেশ জটিল।
মনে হচ্ছে হত্যাকারী তোর কাছে এখন খুব একটা অস্পষ্ট নেই।
অস্পষ্ট না থাকলেও এখনো খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। সুহাস মিত্রের কথা যদি সত্য হয়, কাকে সে সেদিন দেখেছিল কিছুদূরে মুখে চাপদাড়ি, চোখে রঙিন চশমা, মাথায় বেতের টুপি, পরনে কালো প্যান্ট ও স্ট্রাইপ দেওয়া হাওয়াই শার্ট, হাতে বায়নাকুলার এবং যে বায়নাকুলার ও বেতের টুপি অকুস্থলে পাওয়া গিয়েছে সেগুলোর সঙ্গে সেই ব্যক্তির কোন সম্পর্ক আছে কিনা! তোর কি মনে হয়? সম্পর্ক আছে?
যদি থাকেই তো ব্যাপারটা ঠিক মেলাতে পারছি না—বেতের টুপিটা মাথা থেকে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে হয়ত উড়ে যেতে পারে, কিন্তু বায়নাকুলারটি—সেটা—সেটাই বা ওখানে, মানে ঐ স্পটে এলো কি করে? ব্যাপারটা কি একটা অসাবধানতা না ইচ্ছাকৃত, অসাবধানতা হওয়া এক্ষেত্রে উচিত নয়, আর ইচ্ছাকৃত যদি হয়েই থাকে তাহলে
নিজের অপরাধের দায়িত্বটা কারো কাধে চাপানোর ইচ্ছা ছিল হয়ত তার।
ঠিক, কিন্তু কার কাঁধে—কিরীটী কথাগুলো বলতে বলতেই যেন কেমন চুপ করে যায়।
গাড়ি তখন রেড রোড ধরে ছুটে চলেছে।
হু-হু করে গাড়ির খোলা জানালা পথে হাওয়া ঢুকছে।
কিরীটীর গলার স্বর আবার শোনা যায়, প্রবাবিলিটি মোটিভ কাকে সব চাইতে বেশী ফিট ইন করে—
তোর কি তাহলে স্থির ধারণা কিরীটী—ওদেরই মধ্যে একজন
আগে সন্দেহ থাকলেও এখন সন্দেহ মাত্র নেই সুব্রত—ওয়ান অফ দেম-হ্যাঁ, ওদেরই মধ্যে একজন।
কে?
কে তা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না বটে সুব্রত এবং মণিমঃ ও, ক্ষিতীশ চাকী, অমিয় রায়, সতী সান্যাল ও পাপিয়া চক্রবর্তীকে আমি বাদ দিয়েছি–এবং ওদের বাদ দেওয়ার কারণও আমি আজই ব্যাখ্যা করেছি, শুনেছিস–
হ্যাঁ–তাহলে—বাকী তিনজনের মধ্যেই—
তিনজন তো ঠিক নয়!
তবে?
বল চারজন—বিদ্যুৎ সরকার, সুহাস মিত্র, কাজল বোস আর–
আর আবার কে? তুমি কি তাহলে সজল চক্রবর্তীকেও ঐ লিস্টে ফেলতে চাও? কিন্তু সে তো ঐ দিন কলকাতাতেই ছিল না—ভোরের প্লেনেই ফ্লাই করে চলে গিয়েছিল।
জানি, তবে সেটা এলিবিও হতে পারে–কিন্তু আমি ঠিক এই মুহূর্তে তার কথা ভাবছি না—ভাবছি সেই মুখে চাপদাড়ি, রঙিন চশমা চোখে, মাথায় বেতের টুপি, পরনে কালো প্যান্ট ও স্ট্রাইপ দেওয়া হাওয়াই শার্ট ও গলায় বা হাতে বায়নাকুলার–যাকে সুহাস মিত্র দেখেছিল–কিরীটী একটু থেমে যেন বলতে লাগল—
কে? কে সে? তার উপস্থিতিটা ঐদিন একটা নিছক ঘটনাই, না উদ্দেশ্য প্রণোদিত—
তোর মাথায় দেখছি ঐ অজ্ঞাত ব্যক্তিটির ভূত চেপেছে!
ভূত নয় সুব্রত ভূত নয়, আমার মন বলছে–মিত্রানীর ঐ ত্রিকোণের সঙ্গে কথাও ঐ মুখে চাপদাড়ি, রঙিন চশমাধারীর অদৃশ্য যোগাযোগ রয়েছে-হয়ত বা রহস্যের সেই নিউক্লিয়াস।
গাড়িটা ঐ সময় ধীরে ধীরে থেমে গেল।
কিরীটী আর সুব্রত দেখলো, গাড়ি বাড়ির দরজায় পৌঁছে গিয়েছে।
১৩. পরের দিন ভোরবেলাতেই
পরের দিন ভোরবেলাতেই কিরীটী মিত্রানীদের ওখানে গিয়ে হাজির হলো। গতরাত থেকেই তার মনে হয়েছে মিত্রানীর ঘরটা একবার তার দেখা দরকার।
দোতলায় উঠতেই মাস্টারমশাই অবিনাশ ঘোষালের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। অবিনাশ ঘোষাল বারান্দায় পায়চারি করছিলেন।
কিরীটী—
মাস্টারমশায় আমি একবার মিত্রানীর ঘরটা দেখবো বলে এলাম।
বেশ তো। যাও–ঐ যে সামনের ঘরটাই, দরজা ভেজানো আছে মাত্র, সে চলে যাওয়ার পর থেকে কেউ আর ঐ ঘরে ঢোকেনি। কিরীটী—
বলুন মাস্টারমশাই–
তুমি তো আজন্ম জটিল রহস্যের মীমাংসা করছো। জীবনে অনেক গর্হিততম অপরাধের সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে
হ্যাঁ মাস্টারমশাই—আমাদের চারপাশের মানুষগুলো যাদের আমরা নিত্য দেখি—যাদের সঙ্গে হয়ত কথা বলি, হৃদ্যতা করি, ভালবাসি–তাদেরই মধ্যে কেউ কেউ ঘৃণ্যতম অপরাধে যখন চিহ্নিত হয়, আমরা বিস্মিত হই, আঘাত পাই–কিন্তু বিচার করে দেখতে গেলে আঘাত পেলেও বিস্ময়ের তো কিছু নেই মাস্টারমশাই–
নেই বলছো?
না, কারণ আমাদের পরিচয় মানুষের বাইরের জগতের সঙ্গেই তার মনোজগতের বিশেষ করে অবচেতন মনের খবর আমরা কিছুই তো পাই না। সেখানে কার মন কোন পথে চলেছে, কোন জটিল আবর্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সেটির সংবাদ তো আমরা পাই না। এই মুহূর্তে আমার মনের কথাটা কি আপনার জানা সম্ভব।