বিদ্যুৎবাবু, আপনার সঙ্গে তো প্রায়ই মিত্রানীর টেলিফোনে কথাবার্তা হতো?
হ্যাঁ–মধ্যে মধ্যে হতো।
কিছুটা আপনাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও ছিল ধরে নিতে পারি বোধ হয় কিরীটী বললে।
ঘনিষ্ঠতা বলতে আপনি কি মীন করছেন জানি না কিরীটীবাবু তবে আমাদের পরস্পরের মধ্যে কিছুটা হৃদ্যতা ছিল। আমাদের কলেজ-লাইফে আরো সহপাঠিনী ছিল কিন্তু মিত্রানীকে আমার বরাবরই ভাল লাগতো ওর মিশুঁকে সরল মিষ্টি স্বভাবের জন্য মনের মধ্যে কোন মার পাঁচ ছিল না।
আচ্ছা মিত্রানীর আপনাদের ছেলেদের মধ্যে কারোর প্রতি বিশেষ কোন আকর্ষণ বা · তার প্রতি কারো ছিল বলে আপনার মনে হয়? আপনারা তো পরস্পরের অনেক দিনের পরিচিত।
মিত্রানীর ঠিক সে রকম কারোর প্রতি ছিল বলে কখনো আমার মনে হয়নি। তবে মিত্রানী বরাবর যেমন লেখাপড়ায় ভাল ছিল, আমাদের দলের সুহাসও তাই ছিলকলেজ-লাইফে লাইব্রেরীতে ওদের দুজনকে অনেক দিন বসে গভীর আলোচনারত দেখেছি—আর বিশেষ কিছু তেমন চোখে পড়েছে বলে তো মনে পড়ছে না। তারপর একটু থেমে বিদ্যুৎ বললে, তবে ইদানীং বছর তিনেকের বেশী কলেজ ছাড়বার পর বিশেষ তেমন একটা দেখাশোনা হতো না—ঐ সময়ে যদি কিছু হয়ে থাকে তো বলতে পারবো না।
আচ্ছা বিদ্যুৎবাবু, দুর্ঘটনার দিন হঠাৎ যখন ধূলোর ঝড় উঠে চারিদিক ঢেকে গেল–আপনারা সকলেই পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন কিছু সময়ের জন্য, তখন কারো কোনরকম চিৎকার বা গলার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন কি?
না তো? তবে আমার মনে হচ্ছে, একটা কথা যা সেদিন সুশীলবাবুকে বলিনি, সেটা বোব হয় আমার বলা ভাল
কি কথা?
ঝড় ওঠবার পরই যখন হাতড়াতে হাতড়াতে কোনক্রমে সেই ধুলোর ঘূর্ণির অন্ধকারের মধ্যে এগুচ্ছি, মনে হয়েছিল যেন কে আমাকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে গেল—আমি কে বলে চেঁচালাম, কিন্তু কারো সাড়া পেলাম না। তারপরই আরো কয়েক পা অন্ধের মত এগুতেই একটা যেন ঝটাপটির শব্দ আমার কানে এসেছিল, কিন্তু চোখে ধুলো ঢাকায় চোখ দুটো এত কর-কর করছিল, এত জ্বালা করছিল যে, নিজেকে নিয়েই তখন আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি
কেউ আপনাকে ধাক্কা দিয়েছিল? একটা ঝটাপটির শব্দ শুনেছিলেন?
হ্যাঁ।
ঝড় ওঠবার মুহূর্তে আপনি মিত্রানীকে দেখতে পেয়েছিলেন, সে কোথায় কত দূরে ঠিক কার পাশে ছিল?
মিত্রানী ঠিক বোধ হয় আমার পাশেই ছিল।
আর কাজল বোস?
সে বোধ হয় সুহাসের কাছাকাছিই ছিল।
আচ্ছা বিদ্যুৎবাবু, আর একটা কথা, সেদিন আপনাদের আশেপাশে মুখে চাপদাড়ি, চোখে রঙিন কাঁচের চশমা, মাথায় বেতের টুপি, হাতে বা গলায় ঝোলানো একটা বায়নাকুলার–এমন কাউকে দেখেছিলেন কি? পরনে কালো প্যান্ট, গায়ে স্ট্রাইপ দেওয়া একটা হাওয়াই শার্ট–
না–সে রকম তো কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। আমরা নিজেদের নিয়ে এত মশগুল ছিলাম যে–
বুঝেছি, আশেপাশে তাকাবার ফুরসুৎ পাননি। তাই না?
হ্যাঁ।
আপনার বায়নাকুলার আছে বিদ্যুৎবাবু?
না।
আপনাদের দলে কারোর আছে?
বলতে পারবো না।
আপনি সিগ্রেট খান?
মাঝে-মধ্যে—
কি ব্রান্ড?
কোন স্পেশ্যাল ব্রান্ড নেই–একটা হলেই হলো, ঠিক নেশায় তো ধূমপান করি না, এমনি শখ করে দু একটা খাই। তারপরই একটু থেমে বিদ্যুৎ সরকার বললে, দেখুন মিঃ রায়, আপনি মিত্রানীর মৃত্যুর ব্যাপারটা একটু আগে বলেছিলেন, হত্যাকারীর পূর্বপরিকল্পিত-সত্যিই কি আপনি তাই মনে করেন?
করি।
ও! আচ্ছা, আপনার কি আমাদের মধ্যে সত্যিই কাউকে সন্দেহ হচ্ছে—
আপনার কাছে মিথ্যা বলবো না বিদ্যুৎবাবু, সেই রকমই আমার সন্দেহ হয়।
মানে অনুমান—
আচ্ছা বিদ্যুৎবাবু, রাত অনেক হলো—এবার আমি উঠবো। চল সুব্রত—
কিরীটী হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। সুব্রতও উঠে দাঁড়ায় সঙ্গে সঙ্গে।
১২. ছুটির দিন বলেই হয়ত
ছুটির দিন বলেই হয়ত রাস্তায় অত্যন্ত ভিড়—ওদের গাড়ি কেবলই থামছিল সামনের ভিড়ের চাপে। গাড়ি এক সময় হাওড়া ব্রীজ পার হয়ে ডাইনে স্ট্র্যান্ড রোড ধরলো।
হঠাৎ কিরীটীর কথা শুনে তাকাল ওর দিকে সুব্রত।
সুব্রত!
কিছু বলছিস?
সকলের কথাই তো মোটামুটি শুনলি—
আমি সকলের কথা মন দিয়ে শুনিনি জনাতিনেক ছাড়া—মৃদুকণ্ঠে সুব্রত বললে।
তিনজন কে কে?
সুহাস মিত্র, বিদ্যুৎ সরকার ও কাজল বোস—
হুঁ। আর কারো কথাই তাহলে তুই মন দিয়ে শুনিসনি! কান দিসনি—
না।
তবে আমার মনে হয়, যা জানতে আজ আমরা ওদের ডেকেছিলাম তার মধ্যে কিছুটা হয় তো মিস করেছিস।
কি বলতে চাস তুই?
মানুষের মুখ যদি তার মনের ইনডেক্স হয়—একজনকে তুই মিস করেছিস মানে তার মনের কথাটা পাঠ করা হয়নি তোর।
যথা?
এখন আর তার কথা তুলে লাভ নেই—কারণ সেই বিশেষ ব্যক্তিটির কথাগুলো না শোনা থাকলে তার কথার তাৎপর্যই হয়ত ঠিক তুই বুঝতে পারবি না। থাক সে কথা যাদের কথা তুই মন দিয়ে শুনেছিস, মানে তোর ঐ সুহাস মিত্র, বিদ্যুৎ সরকার ও কাজল বোস, তাদের সম্পর্কে তোর কি ধারণা তাই বল।
সুহাস মনে হলো সত্যিই মিত্রানীকে ভালবাসত-মিত্রানীর মৃত্যুতে সে অত্যন্ত শক পেয়েছে।
আর কাজল বোস?
বেচারী সুহাসকে সে অন্ধের মতই ভালবাসে, অথচ সুহাস মনে হলো কাজলকে সহ্যই। করতে পারে না যেন।
ঠিক। আচ্ছা আর কেউ ওদের মধ্যে মিত্রানীকে ভালবাসতো বলে তোর মনে হয়?
সে রকম কিছু তো মনে হলো না।
কিন্তু আমার মনে হলো—
কি মনে হলো তোর?
ওদের মধ্যে আরো একজন মিত্রানীকে পেতে চেয়েছিল বোধ হয়-র্যাদার হি। গুয়ানটেড টু হ্যাভ হার।