পারবো না কেন! মিত্রানী মৃদু মৃদু হাসে মুখের দিকে চেয়ে।
তবে?
কি তবে?
জবাব দিলে না কেন আমার প্রশ্নের?
ওসব কথা থাক সজল।
না। মুখোমুখি প্রশ্নটা যখন উঠলোই–জবাব আমি চাই—
নাই বা দিলাম জবাব!
না, বল—
আচ্ছা সজল, আমরা কি পরস্পর পরস্পরের কাছে বরাবর বন্ধুর মতই থাকতে পারি না, যেমন আমরা অনেকেই অনেকের সঙ্গে আছি আজো–
আচ্ছা মিত্রা!
বল?
তুমি অন্য কাউকে—মানে অন্য কারোর বাগদত্তা?
না–সে রকম কিছু নয়, তবে–মানে ঐ পর্যায়ে এখনো পৌঁছায়নি ব্যাপারটা—
অর্থাৎ?
অর্থাৎ মন জানাজানির পালা এখনো চলছে। যাক গে ওসব কথা। তুমি একটু বোসো। লক্ষীটি, আমি স্নান সেরে তৈরী হয়ে নিই চট করে—
মিত্রানী লঘুপদে ঘরের সংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
সজল একাকী ঘরের মধ্যে চেয়ারটার উপর বসে রইলো। মিত্রানীর শেষের কথাগুলো যেন অকস্মাৎ একটা ফুৎকারের মত ঘরের একটি মাত্র আলো নিভিয়ে দিয়ে গেল।
সব কিছুই যেন সজলের অকস্মাৎ শূন্য মিথ্যা মনে হয়, মিত্রানী ঘর থেকে বাথরুমে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। যে সন্দেহটা গত তিন বৎসর ধরে একটা ধোঁয়ার মতই তার মনের মধ্যে জমা হচ্ছিল, সেটা যেন গাঢ় কালো একটা মেঘের মত তার সমস্ত মনের মধ্যে নয়নজলে,
ছড়িয়ে পড়েছে এই মুহূর্তে।
সমস্ত সংশয় ও সন্দেহের যেন শেষ নিষ্পত্তি করে দিয়ে গেল মিত্রানী আর কত সহজেই না সেটা করে দিয়ে গেল।
আর কোন প্রশ্নেরই অবকাশ রইলো না কোথাও।
এত বছর ধরে যে আশাটা মনের মধ্যে সযত্নে সে লালন করেছে, নিজের মনে নিজেই স্বপ্ন দেখেছে, সব কিছুর উপর যেন একটা পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়ে গেল মিত্রানী সেই মুহূর্তে।
ঘরের সংলগ্ন বাথরুমে স্নান করছে মিত্রানী, শাওয়ারের ঝিরঝির বারিপতনের সঙ্গে সঙ্গে একটা গানের সুর মিশে যাচ্ছে।
বহু পরিচিত গানটা সজলের। বহুবার সজল গানটা শুনেছে মিত্রানীর কণ্ঠে। প্রথম শুনেছিল তাদের কলেজেরই একটা ফাংশানে। মিত্রানী যে গান গাইতে জানে জানা ছিল না কথাটা সজলের। সেই প্রথম ফাংশানে শুনেছিল তার গান।
একা মোর গানের তরী
ভাসিয়েছিলাম নয়নজলে,
সহসা কে এলো গো
এ তরী বাইবে বলে।
ঐ গানের মধ্যে দিয়ে যেন সেদিন সজলের মিত্রানীর সঙ্গে নতুন করে পরিচয় ঘটে। তারপর কতবার অনুরোধ করে মিত্রানাকে দিয়ে গানটা ও গাইয়েছে।
কেন মোর প্রভাত বেলায়
এলে না গানের ভেলায়,
হলে না সুখের সাথী
এ জীবনের প্রথম খেলায়।
সজল বসেই থাকে। শাওয়ারের বারিপতনের ঝিরঝির শব্দ- তার সঙ্গে সুরের গুঞ্জন। যা জানবার ছিল–যা জানবার জন্য এত বছর ধরে সে প্রতীক্ষা করেছে তা তো তার জানা হয়ে গিয়েছে, তবে কেন এখনো সে বসে আছে।
কেন মিত্রানীর ঘরের দরজার সামনে ভিক্ষুকের মত হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে এখনো, অপেক্ষায়
কিসের অপেক্ষা! আর কেনই বা এ অপেক্ষা!
এবারে তো তার চলে যাওয়াই উচিত।
মনে মনে চলে যাবার কথা ভাবলেও, কেন জানি সজল উঠতে পারল না।
ঐ সময় স্নান সেরে ভিঙে চুলের রাশ পিঠের উপর এলিয়ে দিয়ে মিত্রানী বাথরুম থেকে বের হয়ে এলো।
প্রসন্ন স্নিগ্ধ-স্নানের পর মিত্রানীর দিক থেকে যেন চোখ ফেরাতে পারে না সজল, চেয়েই থাকে।
মিত্ৰানী মৃদু হেসে বললে, কি দেখছো সজল অমন করে আমার দিকে চেয়ে! মনে হচ্ছে যেন কখনো এর আগে তুমি আমাকে দেখনি–বলতে বলতে মৃদু হাসে মিত্রানী।
তেরচাভাবে টুলটার উপরে বসে মিত্রানী—সামনের ড্রেসিং টেবিলটার আয়নার দিকে আলোকে আঁধারে তাকিয়ে চুলে চিরুনি চালাচ্ছে মিত্রানী।
মিত্রানীর গলাটা কি সুন্দর মনে হয় সজলের! কখনো ঐ গ্রীবা মিত্রানীর স্পর্শ করেনি বটে সজল কিন্তু মনে হচ্ছে পাখীর গ্রীবার মতই যেন নরম তুলতুলে ও কোমল।
তারপর চিরুনি চালাতে চালাতেই প্রশ্ন করল মিত্রানী, কদিনের ছুটি নিয়ে এসেছো সজল?
এসেছিলাম তো দিন কুড়ি ছুটি নিয়ে—তবে ভাবছি দুচার দিনের মধ্যে ফিরে যাবো।
কেন? সে কি—এত তাড়াতাড়ি ছুটি না শেষ করেই ফিরে যাবে কেন? না, না, এসেছো যখন, আমরা পুরানো বন্ধু-বান্ধবরা মিলে বেশ কটা দিন হৈ হৈ করে কাটানো যাবে। তা অন্যান্য সকলের সঙ্গে দেখা হয়েছে, ক্ষিতীশ অমিয় মণি বিদ্যুৎ সুহাস সতীন্দ্র
পাপিয়া কাজল—
না—
দেখা হয়নি কারো সঙ্গে? কারো সঙ্গে দেখা করোনি?
–আচ্ছা মিত্রানী, আমি উঠি আজ আরে বোসো বোসো—একসঙ্গেই যাবো—তুমি যাবে শ্যামবাজারের দিকে— আমারও তো কলেজ ঐদিকেই
না—আমার একটু কাজ আছে সেক্রেটারিয়েটে। আচ্ছা চলি, বলেই উঠে দাঁড়াল সজল এবং মিত্রানীকে আর কোন কথার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ঐ দশজনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটা প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল—সেই কলেজজীবনের ফার্স্ট ইয়ার থেকেই। ডিগ্রী কোর্সে সকলে এসে একসঙ্গে একই কলেজে ভর্তি হয়েছিল। এবং কলেজ-জীবনের দীর্ঘ তিন বৎসরের পরিচয়ে ও ঘনিষ্ঠতায় ওদের পরস্পরের মধ্যে একটা মধুর প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল স্বভাবতই।
সজল কিছুদিন ওদের সঙ্গে আর্টস পড়েছিল, তারপর হঠাৎ আর্টস ছেড়ে দিয়ে কমার্স নিয়েছিল। তার ক্লাস হতে সন্ধ্যার দিকে, কিন্তু তাতে করে মেলামেশার কোন অসুবিধা হয়নি। ওদের মধ্যে বিদ্যুতের বাবার অবস্থাই ছিল সবচাইতে ভাল। বনেদী ধনী বংশের ছেলে তো ছিলেনই—নিজেও ওকালতী করে সমরবাবু—বিদ্যুতের বাবা—প্রচুর উপার্জন করতেন।