স্নান করার জন্য টিউবওয়েলের দিকে পা বাড়াতেই কৃষ্ণা বলল, বাথরুমেই জল আছে। বাথরুমে ঢুকে দেখি, চার বালতি জল, সারান, ছোট্ট একটা তোয়ালে রাখা আছে। স্নান করে ঘরে আসতেই কৃষ্ণা আয়নাচিরুনি এগিয়ে দিল। তারপরই নিয়ে এল এক গেলাস সরবৎ। আমি প্রতিবাদ করি না। হাসি আর কৃষ্ণাকে দেখি।
তোমার মা নেই কৃষ্ণা?
না বাবুর্জী, আমার মা নেই। আমি যখন সাত সালের তখন আমার মা মারা যায়।
তুমি এখানে আছ ক বছর?
আমি যখন সাত সালের তখন থেকেই আছি।
.
আমি আর প্রশ্ন করি না। চেয়ারে বসে সরবৎ খেতে খেতে কৃষ্ণার কথা শুনি। এখন যেখানে স্টেশন, আগে এখানেই ছিল লেভেলক্রশিং। সে লেভেলক্রশিং পাহারা দিত রতিলাল। দক্ষিণ দিকে মাইলখানেক দূরে বড়ো রাস্তা তৈরি হবার পর এই লেভেলক্রশিং এর জায়গায় তৈরি হল স্টেশন। নতুন মাস্টারবাবু এলেন ভেরাবল থেকে কিন্তু পুরো দুমাস থাকলেন না। আবার মাস্টারবাবু এলেন, গেলেন। কেউই এখানে থাকতে চায় না। থাকবে কেন? পড়ালেখা জানা শহরের মানুষ কি এখানে থাকতে পারে?
কটা বছর এইভাবেই কেটে গেল। তারপর একদিন সকালবেলার গাড়িতে এই বাঙালি মাস্টারবাবু এসে হাজির। মাস্টারবাবু না পারেন রাঁধতে, না পারেন গুজরাতি বলতে; মাস্টারবাবু কোনোদিন খাওয়াদাওয়া করেন, কোনোদিন করেন না। চা আর ভাজাভুজি খেয়েই কাটিয়ে দেন। রতিলাল বজরার রুটি দিতে দ্বিধা করে। ভয়ও পায়। মাস্টারবাবু প্রায় সারা দিনরাতই স্টেশনে থাকেন। কোনো কোনোদিন রাত্রের মালগাড়ি চলে গেলে কোয়ার্টারে আসেন; তবে রোজ নয়। অফিসের টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েন। স্টেশন পাহারা দেবার কাজ খালাসী রতিলালের। সে মেঝেয় শুয়ে থাকে। কিন্তু মাস্টারবাবুর সামনে ঘুমুতে দ্বিধা করে। সময় সময় ওরা বাপরেটিতে আলোচনা করে কিন্তু ভেবে পায় না কে বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাধরে। শেষ পর্যন্ত একদিন রতিলালের কিশোরী মেয়ে মাথার ঘোমটা আরো একটু সামনে টেনে এগিয়ে এল।
বাবুজী!
কে?
আমি খালাসীর বেটি।
মাস্টারবাবু বিছানায় শুয়ে শুয়ে পুরনো শারদীয়া সংখ্যার পাতা ওলটাতে ওলটাতে মুখ তুলেই বলেন, কী চাই?
কিছু চাই না বাবুজী। আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন। আমি আপনার খানা নিয়ে এসেছি।
খানা? মাস্টারবাবু অবাক।
হ্যা বাবুজি, খানা। জলদি হাতমুখ ধুয়ে নিন। খানা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
মাস্টারবাবু বিছানায় উঠে বসে জিজ্ঞেস করেন, কে তোমাকে খানা আনতে বলল?
আগে হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিন, পরে সব জবাব দেব।
মাস্টারবাবু খেতে খেতেই রতিলালের বেটি বিছানা ঠিক করে টেবিলের ওপর এক গেলাস জল ঢেকে রাখে। মাস্টারবাবু ঘরে ঢুকতেই সে বলল, মালগাড়িকে আলো দেখাবার জন্য আপনাকে আর স্টেশনে যেতে হবে না। এখন শুয়ে পড়ুন। অনেক রাত হয়েছে।
রতিলাল কোথায়?
খেয়েদেয়ে স্টেশন চলে গেছে।
মাস্টারবাবু শুয়ে পড়েন। রতিলালের বেটি চলে যায় কিন্তু অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পরও মাস্টারবাবুর চোখে ঘুম আসে না, রতিলালের বেটির কথাই শুধু ভাবেন।
রাত আরো গম্ভীর হয়। বিছানায় শুয়ে শুয়েই মাস্টারবাবু শুনতে পান মালগাড়ি আসছে। হঠাৎ দরজার বাইরে বারান্দার কোনায় একটা ছায়ামূর্তি দেখেই চিৎকার করে ওঠেন, কে?
রতিলালের বেটি বলে, আমি।
তুমি? এত রাত্রে?
আপনি ঘুমোননি মাস্টারবাবু?
না। মাস্টারবাবু বিছানা ছেড়ে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তুমি এত রাত্রে কি করছ?
সত্যি কথা বলব?
হ্যাঁ, সত্যি কথা বল।
রাগ করবেন না?
না।
রতিলালের বেটি একটু ভেবে বলে, দেখছিলাম আপনি শুয়ে আছেন নাকি স্টেশনে গিয়েছেন।
এবার মাস্টারমশাই আর গম্ভীর থাকতে পারেন না। হেসে ওঠেন। আরো দু এক পা এগিয়ে ওর সামনে দাঁড়ান! হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করেন, তুমি ঘুমোওনি কেন?
রতিলালের বেটি আবার বলে, সত্যি কথা বলব মাস্টারবাবু?
হ্যাঁ, হ্যাঁ সত্যি কথাই বল।
শুয়ে শুয়ে আপনার কথা ভাবছিলাম।
আঁ! আমার কথা?
হ্যাঁ, আপনার কথা। রোজ রাত্রে শুয়ে শুয়ে আপনার কথা ভাবি।
মাস্টারবাবু আবার প্রশ্ন করেন, আবার জবাব দেয় রতিলালের বেটি, আপনি খাওয়া দাওয়া করেন না, সব সময় কি যেন ভাবেন, বিশেষ কথাবার্তাও বলেন না, তাই তো আপনার কথা ভাবি।
বিকেলবেলায় মাস্টারবাবুর সঙ্গে রেল লাইনের ওপর দিয়ে বজরার ক্ষেতের পাশের কালভার্টের উপর বসে কথা হচ্ছিল। তখন রতিলালের বেটির কতই বা বয়স। বড়ো জোর এগারবারো। নিতান্তই কিশোরী! তার মনেও এত প্রশ্ন? আমাকে নিয়ে এত চিন্তা? রতিলাল স্টেশনে ডিউটি দেয়। আর সে একলা ঘরে শুয়ে শুয়ে শুধু আমার কথাই ভাবে?
মাস্টারবাবু যেন থমকে দাঁড়ান। দাঁড়াবেন না? ওর জীবনে যে অনেক দুঃখ, অনেক হতাশা। বাবা টিটাগড়ের কারখানায় কাজ করতেন আর ও দেশে থাকত মার কাছে। সেই ছেলেবেলার কথা কিন্তু তবু ওর মনে আছে, বাবা বিশেষ দেশে আসতেন না। কদাচিৎ কখনও এলেও বোতল থেকে ঢেলে কি যেন খেতেন। শুরু করতেন চেঁচামেচি-মারধর।
অবোধ শিশু আর একটু বড়ো হল। বুড়ি ঠাকুমার হাত ধরে গ্রামের স্কুলে যায়, আসে। রাত্তির বেলায় হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। স্কুলের এক মাস্টারমশায়ের সঙ্গে মাকে ফিস ফিস করে গল্প করতে দেখে চমকে ওঠে। ভয় পায়। ঘুম আসে না কিন্তু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। মাঝে মাঝে চোখ খোলে। দেখে, মাস্টারমশাই আর মা খেলা করছে।
কবছর পর টিটাগড়ের কারখানা থেকে চিঠি এল, বাবা মারা গেছেন। তার কিছুদিন আগেই বুড়ি ঠাকুমা গত হয়েছেন। সাতআট বছরের শিশুপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে কাটোয়া লোক্যালে চেপে মা চলে আসেন কলকাতা। হাওড়া স্টেশনে অভ্যর্থনা জানালেন সেই মাস্টারমশাই।