কিন্তু বিয়ে করলেন না কেন?
চিত্রা এবার একটু হেসে বলেন, ঠিক জানি না; তবে ছোট মামার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে শুনেছি, উনি ওরই এক সহপাঠিনীকে ভালোবাসতেন কিন্তু ঐ ভদ্রমহিলা অন্য একজনকে বিয়ে করেন বলেই দুঃখে ও অভিমানে ছোট মামা সারাজীবনে বিয়েই করলেন না।
সোহিনীও একটু হেসে বলেন, এ ধরনের ঘটনা তো আকছার ঘটে কিন্তু তাই বলে কি সাধুসন্ন্যাসী হয়ে জীবন কাটাতে হবে?
কেনাকাটা গোছানো-গাছানো আর বাড়ি-ঘরদোরের ব্যাপারে শ্রীধরকে সব বুঝিয়ে দিতে দিতেই মাঝখানের কটা দিন যেন হাওয়ায় উড়ে যায়। তারপর সিদ্ধার্থ ওকে চড়িয়ে দেন গীতাঞ্জলিতে। ট্রেন ছাড়ার আগে সোহিনী বলেন, যদি পারো দুবাইতে পৌঁছে বরোদায় একটা ফোন করো।
হ্যাঁ, করবো
কবে তুমি বরোদায় পৌঁছবে, তাও জানিয়ে দিও।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই জানাবো।
পরের দিন ঘণ্টা খানেক লেটে গীতাঞ্জলি ভি. টি. পৌঁছয়। মিঃ যোশী হাসি মুখে অভ্যর্থনা করে সোহিনীকে গেস্ট হাউসে পৌঁছে দিয়েই বলেন, ভাবীজি, প্লীজ গেট রেডি বিফোর ফাইভ। উই মাস্ট লিভ ফর স্টেশন অ্যাট ফাইভ।
হ্যাঁ, যথা নির্দিষ্ট পৌনে ছটার গুজরাত এক্সপ্রেসে সোহিনী বরোদা রওনা হন। অনেক দিন পর মেয়ে-জামাইকে কাছে পাবার আনন্দে উত্তেজনায় কখন যে সুরাট ভারুচ পার হয়ে যায়, তা যেন উনি খেয়ালই করেন না।
বরোদা!
সোহিনী এক মুহূর্ত দেরি না করে নিজেই সুটকেশ হাতে করে প্ল্যাটফর্মে পা দিতে দিতেই সায়ন্তনী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে। প্রণাম করে। রামানুজও ছুটে এসে প্রণাম করে। সোহিনী দুহাত দিয়ে দুজনকে একসঙ্গে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেন। আদর করেন।
স্টেশন থেকে গাড়িতে রওনা হবার সঙ্গে সঙ্গেই সায়ন্তনী বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে, জানো মা, ছোট মামা এসে গিয়েছেন।
উনি কবে এলেন?
পরশু।
সায়ন্তনী মুহূর্তের জন্য না থেমেই বলে, মা, তুমি ভাবতে পারবে না, ছোট মামা কি দারুণ ভালো মানুষ। আমাকে উনি কি বলে ডাকেন জানো?
কি বলে?
মা আদরিণী!
বা! খুব সুন্দর নাম দিয়েছেন তো তোর।
সায়ন্তনী হাসতে হাসতে বলে, ছোট মামা, একটা বদ্ধ পাগল। উনি আমার জন্য একটা সুটকেশ কিনে সেটা ভর্তি করে শুধু আমারই জন্য কত কী এনেছেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
রামানুজের জন্য কিছু আনেননি?
ওর জন্য খুব সুন্দর একটা স্যুট আর দুটো পুলওভার এনেছেন।
দুএক মিনিট চুপ করে থাকার পরই সায়ন্তনী আবার হাসতে হাসতে বলে, জানো মা, ছোট মামা কাল রান্না করে খাওয়ালেন। উনি কি সুন্দর রান্না করেন, তাও তুমি ভাবতে পারবে না।
সোহিনী একটু হেসে বলেন, বেশিদিন বিদেশে থাকলে রান্না করা শিখতেই হয়।
কথায় কথায় রাস্তা ফুরিয়ে আসে। আইপিসিএল কমপ্লেক্সে গাড়ি ঢোকে। স্টাফ কোয়ার্টারগুলো বাঁ দিকে রেখে গাড়ি ডানদিকে ঢুকতেই রামানুজ বলে, মা, এই হচ্ছে আমাদের কলোনী।
সোহিনী একবার চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়েই বলেন, বাঃ! খুব সুন্দর কলোনী তো!
সায়ন্তনী সঙ্গে সঙ্গে বলে, হ্যাঁ, মা, আমাদের কলোনীটা রিয়েলী খুব সুন্দর।
গাড়িটা হঠাৎ থামতেই সায়ন্তনী ওর মার হাত ধরে আলতো করে একটু টান দিয়েই বলে, এসো, এসো; এই আমাদের কোয়ার্টার।
ও রামানুজকে বলে, তুমি মার সুটকেশটা নিয়ে এসো।
লনে পা দিয়েই সায়ন্তনী একটু গলা চড়িয়ে বলে, ছোট মামা, শিগগির দরজা খুলুন। মা এসে গিয়েছেন।
ভিতর থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসে–আসছি মা আদরিণী।
রামানুজ সুটকেশ নিয়ে পাশে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই ওর ছোট মামা দরজা খুলেই সোহিনীকে দেখে অবাক হয়ে যান। ওকে দেখে সোহিনীও বিস্মিত! কয়েকটা সোনাঝরা মুহূর্তের জন্য দুজনেই দুজনকে মুগ্ধ বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেন। তারপরই রামানুজের ছোট মামা হাসতে হাসতে বলেন, আরে সোহিনী, তুমি!
সোহিনীও হাসতে হাসতে বলেন, শান্তনু, তুমি রামানুজের ছোট মামা!
বিস্মিত রামানুজ আর সায়ন্তনীর দিকে তাকিয়ে উনি চাপা হাসি হেসে বলেন, আমরা দুজনে একসঙ্গে বি. এ আর এম. এ পড়েছি।
রামানুজ আর সায়ন্তনী আনন্দে খুশিতে হো হো করে হেসে ওঠে। দুজনেই প্রায় এক সঙ্গে বলে, মাই গড! হোয়াট এ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ।
একটু পরে চারজনে মিলে কফি খেতে বসার সঙ্গে সঙ্গেই শান্তনু সোহিনীর দিকে তাকিয়ে বলেন, আমারই ভুল হয়েছে। আমারই বোঝা উচিত ছিল, আমার মা আদরিণী শুধু তোমার পেটেই জন্মাতে পারে।
রামানুজ কফির কাপে চুমুক দিয়েই চাপা হাসি হেসে বলে, ছোট মামা, ইউ রিয়েলী থিংক সো?
অব কোর্স।
শান্তনু মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, তোর শাশুড়ি কী অসাধারণ ভালো মেয়ে, তা আমি জানি বলেই…
ওর কথার মাঝখানেই সোহিনী বলেন, হঠাৎ এই বুড়িকে নিয়ে পড়লে কেন? আমি যে কত ভালো বা মন্দ, তা কি আমার মেয়ে জামাই জানে না?
শান্তনু ওর কথার কোনো জবাব না দিয়ে সায়নীর দিকে তাকিয়ে বলেন, মা আদরিণী, একটা গোপন খবর ফাঁস করে দেব?
হ্যাঁ, ছোট মামা, বলুন বলুন।
এই পৃথিবীতে শুধু সোহিনীই জানে, শ্রেয়া আমাকে বিয়ে করলো না বলেই আমি সারাজীবন একলা একলা কাটিয়ে দিলাম।
সোহিনী বলতে পারলেন না, কালিম্পং-এর সেই অবিস্মরণীয় রাত্রে শান্তনু ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, এই পৃথিবীতে তোমার চাইতে কেউ শ্রেয় নেই বলেই আজ থেকে তোমাকে শ্রেয়া বলে ডাকবো।
উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, শান্তনু, তুমি জানো না, বিয়ের পর পরই শ্রেয়া মারা গেছে?