কোনো ট্রেনের টিকিট কাটলে?
তুমি পাঁচই এখান থেকে গীতাঞ্জলিতে যাবে। পরের দিন রাত্রে বোম্বে পৌঁছে আমাদের গেস্ট হাউসে থাকবে। তার পরদিন ভোরে গুজরাত এক্সপ্রেসে রওনা হয়ে সাড়ে বারোটায় বরোদা পৌঁছে যাবে।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, যোশী তোমাকে রিসিভ করে গেস্ট হাউসে পৌঁছে দেবে; উনিই আবার পরদিন ভোরে তোমাকে গুজরাত এক্সপ্রেসে চড়িয়ে দেবেন।
সোহিনী বললেন, ঠিক আছে কিন্তু মেয়ে-জামাইকে তো খবর দিতে হবে।
সেটা তো কোনো সমস্যা না। তুমি যদি চাও আজ রাত্রেই ওদের টেলিফোন করতে পারো; নয়তো কাল আমি অফিস থেকে..
না, না, আজই ওদের টেলিফোন করব। ওরা তো আমাদের খবর জানার জন্য হাঁ করে বসে আছে।
হ্যাঁ, সে রাত্রেই খাওয়াদাওয়ার পর সোহিনী মেয়েকে ফোন করেন। সায়ন্তনীই ফোন ধরে।
কে? মা? আমার চিঠি পেয়েছ?
হ্যাঁ, কালই পেয়েছি।
তোমরা আসছে তো?
আমি আসছি কিন্তু তোর বাবা আসতে পারছে না।…
কেন? বাবা আসবে না কেন?
তোর বাবাকে ঠিক ঐ সময় দুবাই যেতে হবে।…
দুচারদিন আগে পরে যেতে পারছে না?
তোর বাবাকে আট তারিখে দুবাই পৌঁছতেই হবে।
সোহিনী প্রায় না থেমেই বলেন, তবে দুবাই থেকে ফেরার সময় তোর বাবা তোদের ওখানে যাবে।
বাবা সত্যিই আসবে তো? নাকি আমাকে ভোলাচ্ছ?
সোহিনী একটু হেসে বলেন, নারে, সত্যি তোর বাবা আসবে। আমি তোর বাবার সঙ্গেই কলকাতা ফিরব।
সায়ন্তনী বেশ অভিমানের সঙ্গেই বলে, বাবা না এলে আমি কিন্তু তোমাকেও যেতে দেব না।
মেয়ের কথা শুনে সোহিনী না হেসে পারেন না। তারপর হাসি থামলে জিজ্ঞেস করেন, রামানুজ কি শুয়ে পড়েছে?
না, না; বাথরুমে স্নান করছে।
খাওয়াদাওয়া হয়েছে?
না, না, ও তো এই মাত্র ক্লাব থেকে ফিরল।
এতো রাত্রে ক্লাব থেকে…
মাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সায়ন্তনী বলে, টেনিসের কম্পিটিশান চলছে তো! কোনোদিনই দশটাসাড়ে দশটার আগে খেলা শেষ হয় না।
সোহিনী এবার জিজ্ঞেস করেন, তোদের আর কি খবর?
সায়ন্তনী বেশ উত্তেজিত হয়েই বলে, জানো মা, একটু আগেই ছোট মামা কায়রো থেকে ফোন করেছিলেন।
কায়রো থেকে? ওখানে কি উনি বেড়াতে গিয়েছেন?
না, না, বেড়াতে যাননি। উনি একটা কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করার জন্য কায়রো গিয়েছেন।
সায়ন্তনীয় মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, জানো মা, ছোট মামা মাঝে মাঝেই আমাকে ফোন করেন। উনি এত সুন্দর কথা বলেন যে তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, মা। ওনার কথা শুনেই আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
উনি তো ন-দশ তারিখে তোদের ওখানে আসছেন?
ছোট মামা আজই আমাকে বললেন, ওনার পেপার নিয়ে আলোচনা শেষ হলেই ওখান থেকে রওনা হবেন।
তার মানে দুচারদিন আগে বা পরে উনি আসছেন।
না, না, পরে না; বরং দুচারদিন আগেই হতে পারে।
সোহিনী একটু হেসে বলেন, ভদ্রলোকের সম্পর্কে সবাই এত প্রশংসা করে যে ওর সঙ্গে আলাপ করার জন্য আমিও হাঁ করে বসে আছি।
আমি জোর করে বলতে পারি, ছোট মামার সঙ্গে আলাপ করে তোমার খুব ভালো লাগবে।
পরের দিন দুপুর বেলায় হঠাৎ চিত্রা ফোন করেন।
মাসীমা, আপনি বরোদা যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
আমি ঠিক কলেজে বেরুচ্ছি, সেই সময় আপনার জামাই ফোন করে খবর দিল। চিত্রা মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, আপনি আজ কোথাও বেরুবেন নাকি?
না, না, কোথাও বেরুব না। তুমি আসবে?
তিনটের সময় আমার ক্লাশ শেষ হবার পরই আসছি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এসো।
চিত্রা এলেন প্রায় চারটে নাগাদ। চা-টা খেতে খেতেই কথা হয়।
মাসীমা, আমরা তো যেতে পারছি না। তাই ওদের প্রেজেনটেশনটা আপনার সঙ্গেই পাঠাবো।
হ্যাঁ, তা দিও কিন্তু তোমরা যেতে পারছে না কেন?
এখন আমাদের দুজনের কেউই ছুটি পাবো না।
সপ্তাহ খানেকের জন্যও ছুটি পাবে না?
না, মাসীমা, অসম্ভব। অনার্সের মেয়েদের এখনও কিছু কোর্স বাকি আছে। যেভাবেই হোক মাস দেড়েকের মধ্যে ওদের কোর্স কমপ্লিট করতেই হবে।
তারপর এ কথা-সে কথার পর চিত্রা বলেন, তবে ছোট মামার সঙ্গে আলাপ করে খুব আনন্দ পাবেন।
সোহিনী একটু হেসে বলেন, তোমাদের সবার কাছে ওর এত প্রশংসা শুনি যে ওর সঙ্গে আলাপ করার জন্য আমিও হাঁ করে বসে আছি।
বিশ্বাস করুন মামীমা, নিজের ছোট মামা বলে বলছি না। আজকালকার দিনে ওর মতো মানুষ সত্যি দুর্লভ।
চিত্রা মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, উনি এত বড় পণ্ডিত, বছরে লাখ লাখ টাকা আয় করেন, এত বছর ধরে আমেরিকায় আছেন অথচ ওর মতো সহজ সবল প্রাণবন্ত সাদাসিধে বাঙালি এই কলকাতা শহরেও বিশেষ দেখা যায় না।
উনি না থেমেই বেশ গম্ভীর হয়েই বলেন, তবে ছোট মামার জন্য আমরা সবাই খুব চিন্তিত।
কেন?
বছর চারেক আগে ছোট মামার বাই পাস সার্জারী হয়েছে। তারপর একলা একলা থাকেন। তাই…
সোহিনী অবাক হয়ে বলেন, আমার মেয়ে-জামাই তো এ খবর কোনোদিন জানায়নি।
ছোট মামাই চান না, ওর অসুখের খবর জানিয়ে কাউকে বিব্রত করা হোক। তাই বোধহয় আমার ভাই আপনাদের কিছু বলেনি।
যার বাই পাস সার্জারী হয়েছে, তার তো কখনই একলা থাকা উচিত না।
কিন্তু কি করা যাবে বলুন? উনি তো কিছুতেই বিয়ে করলেন না।
বিয়ে করলেন না কেন?
সোহিনী একবার নিঃশ্বাস নিয়েই আবার বলেন, ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেলে মা বাবার কাছে না থাকতে পারে কিন্তু বিয়ে করলে ওর স্ত্রী তো ওর দেখাশুনা করতে পারতেন।
এসব কথা আমরা জানি, উনিও জানেন কিন্তু উনি বিয়ে না করলে আমরা কি করতে পারি?