সোহিনী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, যাকগে, ওসব আলোচনা বাদ দাও। এখন তুমিও আমাকে ফেলতে পারবে না, আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না।
.
এইভাবেই দিনের পর দিন কেটে যায়। ঘুরে যায় মাসের পর মাস। গ্রীষ্মবর্ষার পর আসে শরৎ। এরই মধ্যে সায়ন্তনীর চিঠি এলে আনন্দে-খুশিতে ফেটে পড়েন ওরা দুজনে। সিদ্ধার্থ ড্রইংরুমে পা দিয়েই জিজ্ঞেস করেন, লেটার ফ্রম মাই বিলাভেড ডটার?
সোহিনী মূহুর্তের জন্য ওর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, ইয়েস, লেটার ফ্রম মাই বিলাভেড ডটার।
সিদ্ধার্থ সামনের সোফায় বসে জুতা-মোজা খুলতে খুলতে চাপা হাসি হেসে বলেন, তোমার প্রিয় মেয়ের চিঠি একটু পড়ে শোনাবে নাকি?
হ্যাঁ, শোনো।
সোহিনী সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করেন শ্রদ্ধেয়া মা, তোমরা যখন হঠাৎ আমার বিয়ে দিলে, তখন মনে মনে একটু ভয়ই পেয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, বিয়ে করার মতো আমার মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। তাছাড়া তখন আমার বয়সই বা কত! তাইতো অনেক শঙ্কা আশঙ্কা নিয়েই বিবাহিত জীবন শুরু করেছিলাম। নিজের মনেই নিজেকে বার বার প্রশ্ন করেছিপারব কি স্বামীকে সুখী করতে? স্বামী কি আমাকে সুখেশান্তিতে রাখবে? আমার দ্বারা কি সাংসারিকসামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে? আরো কত অসংখ্য প্রশ্ন প্রতি মুহূর্তে আমার মনের মধ্যে উঁকি দিয়েছে।
তারপর দেখতে দেখতে প্রায় একটা বছর কেটে গেল। সামনের বারোই আমাদের বিয়ের এক বছর পূর্ণ হবে। প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর ঠিক আগে আজ আমি মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করব, আমাদের বিবাহিত জীবন সত্যি সুখের ও আনন্দের হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, আমি আমার স্বামীর জন্য যথেষ্ট গর্বিত। আমাকে নিয়েও তার খুশির সীমা নেই।
শুধু তাই না। দাদা বোম্বে এলেই আমাদের সঙ্গে দুদিন কাটাবার পরই উনি মেয়েকে দেখতে আমেদাবাদ যান! কখনও কখনও আমরাও দাদার সঙ্গে চলে যাই। ঐ দিনগুলো যে আমাদের কি আনন্দে কাটে, তা লেখার ক্ষমতা আমার নেই। শুধু বলবো, দাদা বোধহয় তার প্রাণপ্রিয় ছোট ভাইয়ের চাইতে আমাকেই বেশি স্নেহ করেন। দাদাকে আমি ঠিক তোমাদের মতোই শ্রদ্ধা করি। এই এগারো মাসের মধ্যে দিদি আসতে না পারলেও এরই মধ্যে আমাকে দুটো সুন্দর ব্যাঙ্গালোর সিল্কের শাড়ি পাঠিয়েছেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দিদি আমাকে চিঠি লেখেন। যদি তোমাদের জামাই ছুটি পায়, তাহলে ডিসেম্বরের শেষে আমরা ব্যাঙ্গালোর যাব।
দিদি-জামাইবাবুর দু লাইনের চিঠি পেলাম। কি লিখেছেন জানো? লিখেছেন মাই ডিয়ার ডার্লিং সায়ন্তনী, চিত্রা কলেজে মাস্টারি করে যা আয় করছে, তার বারো আনাই ব্যয় করছে তোমাকে টেলিফোন করার জন্য। আজকাল আমাকে এক প্যাকেট সিগারেটও প্রেজেন্ট করে না। দিস ইজ ফর ইওর ইনফরমেশন ।ইওর বিলাভেড জামাইবাবু।..
এই ক লাইন শুনেই সিদ্ধার্থ হো হো করে হেসে ওঠে। সোহিনী বলেন, এবার চিঠির আসল অংশটা পড়ছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, পড়ো।
উনি এবার চিঠির শেষ অংশ পড়তে শুরু করেন। আমাদের দুজনের শুধু ইচ্ছা নয়, আমাদের দুজনের দাবি, আগামী বারোই আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর দিন তোমাদের দুজনকে এখানে আসতেই হবে। তোমাদের কোনো ওজরআপত্তি আমরা শুনব না। আর হ্যাঁ, ছোট মামা আমাদের বিয়ের সময় আসতে পারেননি বলে আগামী নয় বা দশ তারিখে এখানে আসছেন।…
হঠাৎ সিদ্ধার্থকে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখেই সোহিনী জিজ্ঞেস করেন, কি হল? মাথায় হাত দিয়ে বসলে কেন? মাথা ধরেছে?
সিদ্ধার্থ আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে নাড়তে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমি তো যেতে পারব না।
কেন? তোমার তো অনেক ছুটি পাওনা আছে।
উনি অত্যন্ত হতাশার সঙ্গে বলেন, দুবাইতে আমরা যে মেসিনটা পাঠিয়েছি, তার ট্রায়াল শুরু হবে দশ তারিখ। ঐ ট্রায়ালের জন্য এখান থেকে যে তিনজন এঞ্জিনিয়ারকে যেতে হবে, তার মধ্যে আমি একজন।
ইস! কি কাণ্ড! সোহিনী মুহূর্তের জন্যে থেমে জিজ্ঞেস করেন, এ খবর তুমি কবে জানতে পারলে?
দুবাই থেকে কালই ট্রায়ালের দিন জানিয়েছে। চীফ এঞ্জিনিয়ার আজই আমাদের তিন জনকে অফিসিয়ালি জানালেন।
তোমাদের কবে রওনা হতে হবে?
আট তারিখের মধ্যে আমাদের ওখানে পৌঁছতে হবে।
ফিরবে কবে?
ট্রায়াল সাকসেসফুল হলে সাতদশ দিন পরই ফিরতে পারব মনে হয়; যদি কোনো প্রবলেম দেখা দেয়, তাহলে আরো বেশি থাকতে হবে।
সিদ্ধার্থ একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, বারো তারিখে ওদের কাছে থাকতে পারব না ভেবে সত্যি খুব খারাপ লাগছে। তবে ফেরার পথে নিশ্চয়ই ওদের ওখানে যাবো।
তাহলে আমি তোমার সঙ্গেই ফিরব।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি ওখানেই থেকো। তারপর আমরা একসঙ্গে ফিরব।
সেদিন রাত্রে খেতে বসে সিদ্ধার্থ বললেন, সোহিনী, তুমি প্লেনেই যেও।
না, না প্লেনে যাব না; ট্রেনেই যাব।
একলা একলা এত লং জার্নি করা খুব বোরিং হবে।
না, না, বোরিং হবে না। সঙ্গে দুচারটে বই থাকলে সময় বেশ কেটে যাবে।
সোহিনী একটু থেমেই জিজ্ঞেস করেন, এখান থেকে তোমরা কবে রওনা হবে?
বোধহয় ছ তারিখ।
তাহলে ঐ দিনই আমিও রওনা হবো।
সেদিন রওনা হলে আমি তো তোমাকে ট্রেনেও চড়িয়ে দিতে পারব না। তুমি তার দু একদিন আগেই রওনা হবে।
ঠিক আছে তোমার যা ভালো মনে হয়, তাই করো।
পরের দিন অফিস থেকে ফিরেই সিদ্ধার্থ বললেন, সোহিনী, তোমার টিকিট হয়ে গেছে।