উনি প্রায় না থেমেই ডান হাত এগিয়ে দিয়ে বলেন, দেখি, দেখি।
সোহিনী গম্ভীর হয়ে বলেন, এটা ওর পুরনো চিঠি।
ও!
সিদ্ধার্থ একটু হতাশ হয়েই নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যান।
সোহিনী মুখ না তুলেই একটু গলা চড়িয়ে বলেন, শ্রীধর, সাহেবকে চা দাও।
কিচেনের ভিতর থেকেই শ্রীধর জবাব দেয়, দিচ্ছি মেমসাহেব।
চা-সিগারেট খেয়ে সিদ্ধার্থ বাথরুমে যান, স্নান করেন। তারপর পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে আবার ড্রইংরুমে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ান। জিজ্ঞেস করেন, কি হল সোহিনী? কি এত চিন্তা করছ?
সোহিনী আপনমনেই একটু হেসে বলেন, ভাবছি, কিভাবে মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল।
সিদ্ধার্থ একটু হেসে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে ওর উল্টো দিকের সোফায় বসে বলেন, সত্যি! কি আশ্চর্যভাবে মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল, তা ভাবলে অবাক হয়ে যাই।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, সায়ন্তনীকে দেখে আমার কত বন্ধুবান্ধব আর সহকর্মী যে ভাই-ভাইপো বা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছে, তার ঠিকঠিকানা নেই।…
জানি।
কিন্তু আমি সবাইকে সাফ বলে দিয়েছি, মেয়ে এম. এ পাশ করুক। তারপর চিন্তা করে দেখব, কবে ওর বিয়ে দেওয়া যায়।
শ্রীধর ট্রলি-ট্রেতে হুইস্কীর বোতল, আইস বক্স, ঠাণ্ডা জলের বোতল, গেলাস আর এক প্লেট চীজ পাকৌড়া এনে সেন্টার টেবিলে সব সাজিয়ে রেখে চলে যায়। সিদ্ধার্থ গেলাসে হুইস্কি ঢেলে জল মিশিয়ে নেবার পর ঠিক দুটো আইস কিউব ফেলে এক চুমুক দিয়েই হাসতে হাসতে বলেন, প্রফেসর চিত্রা চৌধুরী এসে সব হিসেবনিকেশ উল্টেপাল্টে দিলেন।
সোহিনীও একটু হেসে বলেন, সব ব্যাপারটা ভাবলে আমার এখনও যেন মনে হয়, স্বপ্ন দেখছি।…
.
সিদ্ধার্থ ফ্যাক্টরিতে, শ্রীধর বাজারে গিয়েছিল আর সায়ন্তনী গিয়েছিল বাণীচক্রে দ্বিজেন মুখার্জীর কাছে গান শিখতে। তাইতো বেল বাজতেই সোহিনীই দরজা খুলে ভদ্রমহিলাকে দেখে অবাক হয়ে তাকায়।
ভদ্রমহিলা এক গাল হাসি হেসে হাত জোড় করে নমস্কার করে বলেন, আমি চিত্রা চৌধুরী। সায়ন্তনী আমার ছাত্রী।
সোহিনীও এক গাল হাসি হেসে বলেন, আসুন। মেমের কাছে আপনার প্রশংসা শুনি না, এমন দিন যায় না।
ঘরের মধ্যে পা দিয়েই মিসেস চৌধুরী বলেন, প্রশংসা করার তো কারণ দেখি না। তবে হ্যাঁ, আপনার মেয়েকে আমি একটু বেশি পছন্দ করি।
মিসেস চৌধুরী সোফায় বসতেই সোহিনী জিজ্ঞেস করেন, কি খাবেন বলুন। ঠাণ্ডা, নাকি গরম?
উনি একটু হেসে বলেন, আমার কথা শুনলে হয়তো আপনি আমাকে সন্দেশ রসগোল্লাও খাওয়াতে পারেন; আবার বাড়ি থেকে তাড়িয়েও দিতে পারেন।
প্লিজ, ও কথা বলবেন না।
সোহিনী মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, আপনি দয়া করে এসেছেন, এ তো আমার পরম সৌভাগ্য।
মিসেস চৌধুরী বলেন, ওসব কথা থাক। আমি কিন্তু এসেছি অনেক আশা নিয়ে। যদি দয়া করে আমার অনুরোধ রাখেন..
আপনাকে আমি দয়া করবো? কি বলছেন আপনি?
হ্যাঁ, ভাই, ঠিকই বলছি।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, সায়ন্তনীকে প্রথম দিন দেখেই মনে একটা স্বপ্ন উঁকি দিয়েছিল। তারপর গত তিন বছরে ওকে যত দেখেছি, আমার তত বেশি ভালো লেগেছে।
সোহিনীও একটু হেসে বলেন, আপনাকে ও যে কি শ্রদ্ধা করে, তা আপনি ভাবতে পারবেন না।
মিসেস চৌধুরী হাসতে হাসতে বলেন, আসল ব্যাপার হচ্ছে, আমরা দুজনেই দুজনকে ভালোবাসি।
ঠিক এই সময় শ্রীধর বাজার থেকে ফিরতেই সোহিনী বললেন, ইনি সায়ন্তনীর প্রফেসর। শিগগির চা-টা দাও।
চা-টা খেতে খেতেই মিসেস চৌধুরী বললেন, আপনি অনুমতি দিলে একটা কথা বলতাম।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন। এত দ্বিধা করছেন কেন?
মিসেস চৌধুরী আস্তে আস্তে শুরু করেন, আমার বাবা রিপন কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন; আবার ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতেও লেকচারার ছিলেন। ঠিক দশ বছর হল বাবা মারা গিয়েছেন।
মা বেঁচে আছেন?
না, না; মা অনেক দিন আগেই মারা গিয়েছেন।
উনি চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলেন, আমরা তিন ভাইবোন। সব চাইতে বড় হচ্ছেন দাদা, তারপর আমি আর আমার ছোট ভাই।
সোহিনী কোনো প্রশ্ন না করে ওর কথা শুনে যান।
দাদা ব্যাঙ্গালোর থাকেন।
উনি কি করেন?
ইন্ডিয়ান ইনিস্টিটিউট অব সায়েন্সের সিনিয়ার সাইনটিফিক অফিসার আর বৌদি একটা কলেজে পল সায়েন্সের লেকচারার।
ওদের ছেলেমেয়েরা কত বড়?
ওদের দুটি মেয়ে। বড় মেয়েটি আমেদাবাদে ন্যাশনাল ইনিস্টিটিউট অব ডিজাইনে এই বছরই ভর্তি হয়েছে আর ছোট মেয়ে নাইন-এ পড়ছে।
সোহিনী বলেন, আমার এক বন্ধুর ছেলেও এনআইডিতে গত বছরই ভর্তি হয়েছে কিন্তু সায়ন্তনীর এক বন্ধু পর পর দুবছর পরীক্ষা দিয়েও ভর্তি হতে পারলো না।
এখানে ভর্তি হওয়া সত্যি খুব কঠিন; তবে একবার ওখানে ঢুকতে পারলে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না।
হ্যাঁ, জানি।
সোহিনী মূহুর্তের জন্য থেমে একটু হেসে জিজ্ঞেস করেন, আপনার স্বামীও কি অধ্যাপনা করেন?
মিসেস চৌধুরী একটু হেসে বলেন, না, না, ও ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফাইনান্স ম্যানেজার।
ছেলেমেয়েরা কত বড়?
আমার দুটি ছেলে। বড়টি দশ বছরের আর ছোটটি নবছরের।
আপনার ছোট ভাই কী করেন?
প্রশ্নটা শুনেই মিসেস চৌধুরীর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলেন, ওর কথা বলতেই তো আপনার কাছে এসেছি।
সোহিনী কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতেই উনি বলেন, আমার ছোট ভাই ম্যাসাচুসেটইনিস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিংএ মাস্টার্স করে মাস ছয়েক আগেই ইন্ডিয়ান পেট্রোকেমিক্যালএ জয়েন করেছে।