আমি হেসে বলি, সেটা কী আমার হাতে?
হ্যাঁ, আপনার হাতে।
আমি হাসি চেপে বললাম, ঠিক আছে। ওরা কেউ থাকতে বললে বলব, আপনি বেশিক্ষণ থাকতে বারণ করেছেন।
কোনো আপত্তি নেই।
না, রহমান সায়েবের বাড়িতে সত্যি বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। ওঁদের আন্তরিকতার জন্য বারবার ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, বেশ কয়েক জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে হবে বলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও এখন আড্ডা ছেড়ে উঠছি।
লায়লা আয়েসার সঙ্গে গল্প করছিলেন। আমি ওকে বললাম উঠুন আর গল্প করলে আমাদের সব জায়গা যাওয়া হবে না।
লায়লা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি তো আপনার ড্রাইভার। হুকুম করলেই উঠব।
রহমান সায়েবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডানদিকে ঘুরেই লায়লা হাসতে হাসতে বললেন ওয়েল ডান।
কৃতিত্ব অভিনেতার নয়, পরিচালিকার
লায়লা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, আপনার সঙ্গে দিনের পর দিন কাটালেও কেউ ক্লান্ত হবে না।
গাড়ি চলছে সোজা পশ্চিমে। আরব সাগরের ঝড়ো হাওয়া উইন্ড স্ক্রীনের উপর আছডে পড়ে গাড়ির ভিতরে আশ্রয় নিচ্ছে। লায়লার চুল উড়ছে, শাড়ির আঁচল উড়ছে। আমি দেখছি। না দেখে পারছি না। হঠাৎ দেখি, আরব সাগর আমার সামনে দাঁড়িয়ে মাতলামি করছে। লায়লা অষ্টিনের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়েই বললেন, এই আমাদের ক্লিফটন বীচ।
শহরের এত কাছে?
হ্যাঁ, শহর থেকে মাত্র তিন মাইল
দুএক পা এগিয়ে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই বললাম, সত্যি অপূর্ব।
আপনি আরো দুএকদিন থাকলে মনোরা আইল্যান্ড ঘুরিয়ে আনতাম। ওটাও খুব সুন্দর জায়গা।
পরের বার যাওয়া যাবে।
আপনি কী আবার করাচি আসবেন?
আশা তো করি!
আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগুতে এগুতে লায়লা বললেন, এলে খুশি হবো কিন্তু আশা করি না
কেন?
এ সংসারে বেশি আশা করলেই বেশি দুঃখ পেতে হয়।
তা ঠিক কিন্তু আমি না এলে আপনি দুঃখ পাবেন কেন?
দুঃখ না পেলেও আশাভঙ্গ তো হবে।
ক্লিফটন বীচে আলোছায়ায় ঘোরাঘুরি করতে করতে আমরা কত কথা বলি। এলোমেলো। কখনও হাসি, কখনও গম্ভীর হয়ে ভাবি। আবার আনমনাও হই মাঝে মাঝে। তারপর অস্তগামী সূর্যের মুখোমুখি হয়ে সমুদ্রের ধারে বসি। কখনও নীরব, কখনও সরব। আবার কখনও দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকি অপলক দৃষ্টিতে; দুজনের চোখেই কত অনুক্ত প্রশ্ন।
ফেরার পথে গাড়িতে কেউই বিশেষ কথা বলি না। বলতে পারি না; বলতে মন চায় না। আনমনা হয়ে কত কী ভাবি। বোধহয় লায়লাও ভাবেন। ফিরে আসি করাচি শহরে। রেডিও স্টেশন থেকে সিরাজুল সায়েবকে তুলে নিয়ে সোজা ওঁদের বাড়ি। আম্মার সঙ্গে আবার সেই কলকাতার গল্প। সিরাজুল সায়েব আমায় তাঁর কবিতার বই ‘সাধনা, আমার সাধনা’ উপহার দেন। আমার আটচল্লিশ ঘণ্টা করাচি বাসের মেয়াদ যত কমে আসছে, ঘড়ির কাটা তত বেশি জোরে দৌড়চ্ছে। হোটেলে জিনিসপত্র গোছগাছ করার ছিল। তাই দশটার মধ্যে খাওয়াদাওয়া শেষ করার পর আর বসলাম না। ওঁরা দুভাইবোনেই আমাকে হোটেলে ছাড়তে এলেন। রাত তখন এগারোটা
আমি আর সিরাজুল সায়েব ঘরে ঢুকলেও লায়লা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন। ভিতরে আসতে বললাম কিন্তু উনি এলেন না।
ঘরে ঢুকেই সিরাজুল সাহেব বললেন, দাদা আমার একটা উপকার করবেন?
নিশ্চয়ই করব।
আপনি নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে কলকাতা যান?
হ্যা যাই।
আমার দুখানা বই আর একটা ফাউন্টেনপেন একজনকে পৌঁছে দেবেন?
আমি হেসে বললাম, সানন্দে।
উনি ব্যাগ থেকে দুকপি ‘সাধনা, আমার সাধনা’ আর একটা নতুন লেডিজ পার্কার কলম বের করে আমার হাতে দেবার পর এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিলেন। বললেন, এই কাগজে ঠিকানা লেখা আছে।
ঠিকানা পড়তে গিয়েই চমকে উঠলাম। শ্রীমতী সাধনা রায়!
আমি ওঁর দিকে তাকাতেই উনি একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ দাদা, এই সাধনাই আমার সাধনা।
আমি বিমুগ্ধ হয়ে ওঁকে একবার ভালো করে দেখেই বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম।
আমার বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়েই উনি বললেন, দাদা, কফি খাওয়াবেন না?
নিশ্চয়ই।
আপনি কফির অর্ডার দিন। আমি গাড়িটা পার্কিংএ রেখে আসি।
সিরাজসায়েব বেরিয়ে যেতেই আমি কফির অর্ডার দিলাম। আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখতেই লায়লা ধীর পদক্ষেপে ঘরে ঢুকলেন।
দাদা কোথায় গেল?
গাড়িটা পার্কিং এ রাখতে গেলেন।
লায়লা দুএক পা এগিয়ে একেবারে আমার সামনে মুখ নিচু করে দাঁড়ালেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বললেন?
লায়লা একটা ছোট্ট প্যাকেট আমার হাতে দিয়ে বললেন, কাফ লিংকটা ব্যবহার করলে খুশি হব। যদি কাফ লিংক দেখে আমার কথা মনে পড়ে তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করব।
আমি সকৃতজ্ঞ চিত্তে ওঁর উপহার গ্রহণ করে বললাম, নিশ্চয়ই করব।
এবার লায়লা কোন কথা না বলে একটা খোলা খাম আমার হাতে দিলেন। দেখি, ভিতরে রয়েছে ওঁর সুন্দর ছোট্ট একটা ছবি। ঠিক পার্সে রাখার মতো। আমি কিছুতেই বলতে পারলাম না, লায়লা, আমার পার্সে একটাই ছবি রাখা যায়। সেখানে যার স্থান আছে সেই আমার চিরদিনের, চিরকালের।
হঠাৎ দেখা
এভাবে হঠাৎ মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, তা সিদ্ধার্থ বা সোহিনী স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।
একমাত্র সন্তান বিয়ের পর সংসার করার জন্য বরোদায় চলে যাবার পর ওরা দুজনেই নীরবে এক বিচিত্র নিঃসঙ্গতার জ্বালা সহ্য করেন। তারপর আস্তে আস্তে আবার অনেকটা স্বাভাবিক হন।
সিদ্ধার্থ ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে ফ্ল্যাটে পা দিয়েই সোহিনীকে চিঠি পড়তে দেখে একটু হেসে জিজ্ঞেস করেন, সায়ন্তনীর চিঠি এসেছে?