হা যাও। কৃষ্ণা চলে যায়।
আমি এবার বাসের খোঁজ করি। মাস্টারবাবু বললেন, একটা ব্রীজ ভেঙে গেছে বলে কদিন বাস চলছে না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
তাহলে কী করে যাব?
মাস্টারবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওদিকে যাওয়া কী খুবই দরকার?
কিছুদিন আগেই কচ্ছের রণ নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ হয়ে গেল বলে এদিকে ঘুরতে বেরিয়েছি।
ভুজের দিকে গিয়েছেন কী?
হ্যাঁ, ওদিক ঘুরে এসেছি।
তাহলে এদিকে আর কী দেখবেন। সঙ্গে সঙ্গে মাস্টারবাবু হেসে বলেন, ভাগ্যক্রমে যখন আপনাকে পেয়েছি তখন দুচারদিন না রেখে ছাড়ছি না।
আমি চমকে উঠি, বলেন কী?
উনি আবার হেসে বলেন, আমি যেতে দিলেও রতিলাল বা কৃষ্ণা আপনাকে ছাড়বে না।
কেন?
ওরা মানুষ বড়ো ভালোবাসে। এক মূহুর্ত থেমে ভেবে বলি, কিন্তু…..
উনি মাথা নেড়ে বলেন, আমার আর রতিলালের কথা ছেড়েই দিলাম। আপনি কৃষ্ণাকে ছেড়ে যেতেই পারবেন না। কথাটা শুনেই খটকা লাগল। বললাম, কেন?
ও এমন আদরযত্ন করে যে ওকে ছেড়ে যাওয়া খুবই মুস্কিল।
ওর কথা শুনে আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। বলি, তাই নাকি?
একটু সলজ্জ আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে মাস্টারবাবু মুখ নিচু করে বললেন, শুধু ওর জন্যই তো আমি এখানে কটা বছর পড়ে আছি। আরো কতকাল থাকব তা ভগবানই জানেন।
শুনেও আমার মজা লাগে। ভালোও লাগে। হাসি ঠাট্টা করে বলি, তাহলে তো এখানে থাকা একদম নিরাপদ নয়।
মাস্টারবাবু হো হো হেসে ওঠেন। পর মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায় মুখের হাসি। কেমন যেন বেদনার্ত সুরে বলেন, এ সংসারে আমার আপনজন নেই বললেই চলে। পেটের দায়ে এই পাণ্ডববর্জিত দেশে পড়ে আছি। কতকাল প্রাণভরে বাংলায় কথা বলি না। এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, যখন এসেই পড়েছেন, দুএকদিন থাকুন। সত্যি খুব খুশি হব।
কথাগুলো যেন এলোমেলো হয়ে বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে কিন্তু আমার মনে বড়ো দাগ কাটল। কথাগুলোর মধ্যে ওর আন্তরিকতায় এমন স্পর্শ অনুভব করলাম যে কিছুতেই ওর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলাম না। হেসে বললাম, আজ তো ট্রেনও নেই বাসও নেই; সুতরাং আজ তো আছি। তারপর কালকের কথা কাল ভাবা যাবে।
আবার কৃষ্ণা দু কাপ চা নিয়ে হাজির। ওকে দেখেই আমি হেসে বললাম, আদর যত্ন করে তুমি কী আমাকেও এখানে বন্দী করে রাখবে?
কৃষ্ণা মুখ নিচু করে হাসতে হাসতে বলল, বাবুজী, আপনি মুসাফির। মুসাফির ঘরে এলে তাকে দেবতার মতো যত্ন করতে হয় কিন্তু আমরা তো গরিব আছে…।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না, কৃষ্ণা, ঠিক হল না। যে মানুষকে ভালোবাসতে পারে, সে তো কখনো গরিব হতে পারে না।
মাস্টারবাবু হেসে বললেন, বাঃ! ভারী সুন্দর কথা বললেন তো।
চা খেতে খেতে আমি কৃষ্ণাকে জিজ্ঞেস করি, দুপুরে কি খাওয়াবে?
বাবুজি, এখানে সবজী খুব কম পাওয়া যায়। ইঞ্জিনের ড্রাইভারবাবু মাঝে মাঝে সবজী এনে দেয়। একটু সবজী আপনাকে খাওয়াবে। মচ্ছির ঝোল হবে। আর ডালপাপর তো জরুর পাবেন।
তুমি মাছ খাও?
অত্যন্ত কুণ্ঠার সঙ্গে মুখ নিচু করে ও বলে, হ্যাঁ বাবুজী, আমি মচ্ছি খায়।
মচ্ছি না, বল মাছ।
হা, হা, মাছ। গলতি হয়ে যায়।
আমি হেসেই বলি, আর যেন গলতি না হয়।
কৃষ্ণা মুখখানা গম্ভীর করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, গলতি হলে আপনি মাফ করবেন না বাবুজী?
আমি ওর সারল্য, নিষ্পাপ মুখ দেখে যেন মুগ্ধ হয়ে যাই। এই পৃথিবীর দেশে দেশে ঘুরেও যেন এই স্নিগ্ধ পবিত্রতার মুখোমুখি হইনি কোনো মন্দিরে-মসজিদে বা গির্জায়। এ সারল্য, এ পবিত্রতা যেন শুধু কাশবনে, শুধু শরতের আকাশে, দোয়েল-কোকিলের মধ্যেই দেখা যায়। হঠাৎ মনে হল এই কিশোরীকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলি, এই পৃথিবীতে এমন কোনো পাপিষ্ঠ নেই যে তোমাকে মাপ করবে না। পারলাম না। মনের ইচ্ছা মনেই রইল। হেসে বললাম, তোমার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ের তো গলতি হওয়া উচিত নয়।
ঠিক বলেছ বাবুজী। আমার আর গলতি হবে না। আমি আর মচ্ছি বলবে না।
তবে কি বলবে?
কৃষ্ণা একটু জোরেই বলল, মাছ!
আমি আর মাস্টারবাবু হেসে উঠি।
হাসি থামতেই কৃষ্ণা মাস্টারবাবুকে বলে, বাবুজীকে ঘরে নিয়ে যাই? আর কত সময় দপ্তরে বসবেন?
আমি বললাম, না, না, আমি একলা যাব না। মাস্টারবাবুর কাজ শেষ হলেই… …
মাস্টারবাবু বললেন, আপনি স্নান করে নিন। আমি একটু কাজ সেরেই আসছি।
কৃষ্ণা আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করে না। এক হাতে আমার সুটকেস তুলে নিয়েই অন্য হাতে আমার একটা হাত ধরে টান দিয়ে বলে, চলিয়ে, চলিয়ে।
মাস্টারবাবু আবার বললেন, আপনি যান। আমি আসছি।
কী আর করব? কৃষ্ণার পিছন পিছন মাস্টারবাবুর কোয়ার্টারে গেলাম।
কোয়ার্টার মানে একখানি ঘর, একটা বারান্দা, ঐ বারান্দার এক পাশেই রান্নাঘর। ছোট্ট একটু উঠান। তার কোনায় একটু ঘেরা জায়গা। ওর নাম বাথরুম। তবে কলও নেই, পায়খানাও নেই। কোয়ার্টার আর স্টেশনের মাঝখানে একটা টিউবওয়েল আছে। প্রাকৃতিক কাজকর্মের জন্য মুক্তাঙ্গন।
তা হোক। শুধু ঘরখানি নয়, সমস্ত বাড়িটাই অত্যন্ত পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি করে সাজান গোছান। ঘরের দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের একটা ছবি। বোধহয় কোনো ক্যালেন্ডার থেকে কেটে বাঁধান। একটা চেয়ারটেবিলও আছে ঘরটার এক কোনায়। খুব পুরনো দু তিনটে শারদীয়া সংখ্যা অত্যন্ত সযত্নে রাখা আছে টেবিলের ওপর। এছাড়া দুটোএকটা ডায়েরি ও কাগজ কলম। ঘরের সব চাইতে উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য হচ্ছে, টেবিলের উপর ছোটো এক টুকরো কাঁচের তলায় কৃষ্ণার একটা ছবি। মনে মনে হাসি। ভাবি, যে মাটিতে বজরাভুট্টার চাষ করতে চাষীর প্রাণ বেরিয়ে যায়, সে মাটিতেই স্বচ্ছন্দে মানুষের মনে জন্ম নেয় সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ।