মেয়েদের দোষ দিচ্ছেন কেন? প্রশংসা শুনতে আপনারা ভালোবাসেন না?
অন্যের কথা বলতে পারি না। তবে আমার প্রশংসা করলে নিশ্চয়ই আমার ভালো লাগবে কিন্তু দুঃখের কথা, কেউ আমার প্রশংসা করে না।
কেউ না?
একজন করে তবে সাক্ষাতে না।
তিনি কে?
এক কথায় জবাব দিতে পারব না।
ঠিক আছে, সবিস্তারেই বলুন।
তার কথা শুরু করলে আরো দুচারদিন আমাকে করাচি থাকতে হবে।
তাই থাকুন। কে আপনাকে চলে যেতে বলছে?
দুচারদিন থাকার পর যদি যেতে হচ্ছে না করে?
ইচ্ছে না করে থেকে যাবেন।
যদি সিরাজসায়েব আপত্তি করেন?
সে দায়িত্ব আমার।
আপনি আমার দায়িত্ব নেবেন কেন?
আমার ইচ্ছা।
আমি আর কথা বলি না। লায়লার দিকে তাকিয়ে একটু হাসি! লায়লাও হাসেন। দু জনেই দুজনকে দেখি আর হাসি।
তারপর লায়লা বললেন, আপনি ভারি মজার লোক।
কেন?
বেশ কথা বলেন।
তাই নাকি?
আপনি আমাদের রিহার্সালের ওখানে ঢুকতেই বুঝলাম, আপনি বেশ ইন্টারেস্টিং লোক।
আমি হাসি।
হঠাৎ লায়লা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, একটু বসুন। চা করে আনি।
কোনো দরকার নেই।
কেন? চা খেতে ইচ্ছে করছে না?
ইচ্ছে তো করছে কিন্তু আপনি চলে গেলে একলা একলা ঝগড়া করব কেমন করে?
লায়লা হাসতে হাসতে বললেন, আমার সঙ্গে কিচেনে চলুন।
না থাক; তাহলে আপনার সঙ্গে আরো অনেক জায়গায় যেতে ইচ্ছে করবে।
লায়লা হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন।
আমরা চা খেতে খেতেই সিরাজুল সায়েব ফিরে এলেন। অনেক গল্প হল; তবে শুধুই কলকাতার কথা। ভিক্টোরিয়া, চৌরঙ্গী, কলেজ স্কোয়ার, কফি হাউস, বসন্ত কেবিন। পুরনো বইয়ের দোকান, গানের জলসা ময়দানের ফুটবলআরো কত কি! সব কিছুর মধ্যেই কেমন একটা আবেগ, মমত্ববোধ। কী যেন হারাবার বেদনা!
কথা বলতে বলতে সিরাজুল সায়েব হঠাৎ চুপ করেন। কী যেন আপনমনে ভাবেন। নাকি মনে মনে কিছু আবৃত্তি করছেন?
আচ্ছা অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত, বিষ্ণু দে কলকাতাতেই আছেন তো? সুভাষ মুখোপাধ্যায় খুব জনপ্রিয়, তাই না?
আমাদের কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ লায়লা বললেন, দাদাও খুব ভালো কবি।
তাই নাকি?
সিরাজুল একটু হাসেন। লায়লা বলেন, দাদার তিনটে কবিতার বইও বেরিয়েছে।
আমি সিরাজুল সায়েবকে বলি, আপনি তো আচ্ছা লোক! এসব খবর আগে বলেন নি?
উনি সলজ্জভাবে বললেন, পাঁচজনকে জানানোর মতো কবিতা আমি লিখতে পারি না। তবে মাঝে মাঝে যখন মানসিক যন্ত্রণাটা অসহ্য হয়, তখন কবিতা না লিখে পারি না।
কথায় কথায় অনেক রাত হয়েছিল। তাই খেয়েদেয়েই হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেলে পৌঁছে দেবার সময় সিরাজুল সায়েব জানালেন, উনি ছুটি পাননি। রহমান সায়েবের বাড়িতে খেতে যেতে পারবেন কিনা তারও ঠিক নেই; তবে খুব চেষ্টা করবেন। আর জানালেন, লায়লা ১২টা নাগাদ আমার হোটেলে এসে আমাকে রহমান সায়েবের বাড়ি নিয়ে যাবেন। তারপর খাওয়াদাওয়ার পর লায়লাই আমাকে ক্লিফটন বীচ ঘুরিয়ে আনবেন। মনে মনে খুশি হলেও ভদ্রতার খাতিরে আপত্তি জানালাম কিন্তু সিরাজ সায়েব বললেন, না, না, আপনার দ্বিধা করার কোনো কারণ নেই। ওর একটুও কষ্ট হবে না; বরং খুশি হবে।
মনে মনে ঠিক করেছিলাম, ১০টা পর্যন্ত ঘুমব কিন্তু সাড়ে ৯টা বাজতে বাজতেই দরজায় খট খট আওয়াজ। রাত্রে তিনটে নাগাদ এয়ারপোর্ট যেতে হবে; সুতরাং রাত্রে ঘুম হবার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। তাই একটু বিরক্ত হয়েই বিছানা ছেড়ে উঠলাম। দরজা খুলে আমি হতবাক।
লায়লা!
আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি! এখন?
লায়লা দরজার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে। হাসতে হাসতে বললেন, আগে বলুন, আপনার ঘরে ঢোকার অনুমতি পাব কিনা।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
ঘরে ঢুকে আমার বিছানার দিকে একবার তাকিয়েই লায়লা প্রশ্ন করলেন, শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন?
আমি হেসে বলি, আপনাকে।
তাহলে আপনার ঘরে আমার বসার অধিকার আছে, তাই না?
একশবার।
আমি টেলিফোন করে রুম সার্ভিসকে চা পাঠাতে বলেই ওঁকে প্রশ্ন করি, হঠাৎ এখন আপনার আবির্ভাব?
অকারণেই।
সিরাজ সায়েব কী বাড়িতে?
ওকে আমি অফিসে নামিয়ে দিয়েই এখানে এসেছি।
উনি এত সকালেই অফিসে গেলেন?
হা; আজ ওর অনেকগুলো রেকর্ডিং আছে।
সেই বৃদ্ধ রুম বেয়ারা চা নিয়ে এলো। টুকটাক কথা বলে ও চলে গেল। লায়লা আমাকে চা করতে দিলেন না। বললেন, থাক। আমার সামনে আর আপনাকে চা করতে হবে না।
চা খেতে খেতে আমি আবার জানতে চাই, সত্যি বলুন তো আপনি এখন এলেন কেন? কোনো প্রোগ্রাম চেঞ্জ হয়েছে?
না, কোনো প্রোগ্রাম চেঞ্জ হয়নি।
তাহলে এখন এলেন কেন?
ইচ্ছে হলো, তাই চলে এলাম।
সত্যি?
আমি মিথ্যে কথা বলি না।
না, না, তা বলছি না। তবে ভাবছিলাম হয়তো……
কাল আপনার সঙ্গে কথা বলতে বেশ লাগছিল। তাই মনে হল, যাই আপনাকে একটু বিরক্ত করে আসি।
খবু ভালো করেছেন।
সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ, সত্যি বলছি! কৰাচিতে আসার আগে মনে মনে অনেক ভয় ছিল কিন্তু কাল এত আনন্দে কাটিয়েছি যে আপনাদের কথা কোনোদিন ভুলতে পারব না।
আমাদেরও খুব ভালো লেগেছে। কাল অনেক রাত পর্যন্ত আমি আর দাদা আপনার কথা আলোচনা করেছি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
আমি সত্যি ভাগ্যবান।
সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। লায়লা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, আপনি বেশ চট করে সবাইকে আপন করে নিতে পারেন।
আমি তো বুঝতে পারিনি, কাকে আপন করে নিলাম।
আচ্ছা ওসব কথা থাক। আপনি কিন্তু রহমান সায়েবের বাড়িতে জমে যাবেন না।