এ ঘরের অর্ধেকের বেশিই তো রেডিও টিভিতে আছেন। আপনিও কী রেডিও বা টিভিতে আছেন?
না, না, আমি পড়াশুনা করছি।
কী পড়ছেন? এম এ।
লায়লা একটু হেসে জবাব দিলেন, বছর দুই আগে এম এ পাশ করেছি।
তাহলে রিসার্চ করছে?
হ্যাঁ, তা বলতে পারেন।
ঐ সামান্য বিরতির মধ্যেই চা আর চিড়ের পোলাও এলো। মিসেস রহমান নিজে আমাকে চা দিলেন। লায়লা এগিয়ে দিলো এক প্লেট চিড়ের পোলাও। একটু হাসিঠাট্টা গল্পগুজবের পর আবার রিহার্সাল শুরু হল।
নাচগানের মধ্যে যেন নিমেষেই সময়টা কেটে গেল। রিহার্সাল শেষ হবার পর আবার চাকফি আর হিংয়ের কচুরি। নানাজনের সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব। এবার আস্তে আস্তে সবাই বিদায় নিতে শুরু করলেন। হঠাৎহুদাসায়েব আমার কাছে এসে বললেন, হাজার হোক আপনি ইন্ডিয়ান জার্নালিস্ট। পুলিশ নিশ্চয়ই একটু খেয়াল রাখছে কিন্তু যদি কোথাও কোনো অসুবিধা হয় তাহলে আমাকে ফোন করবেন।
আমি মিঃ হুদার টেলিফোন নম্বরের কাগজটা হাতে নিয়ে বললাম, কোনো অঘটন ঘটার সম্ভাবনা আছে নাকি?
উনি হেসে বললেন, না, না, কিছু ঘটবে না। আমি ঘন্টাখানেক আগেই টেলিফোন করেছি।
সিরাজুল ইসলাম পাশেই ছিলেন। উনি আমাকে বললেন, হুদা সায়েব আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর। তার চাইতে বড়ো কথা উনি কলকাতায় থাকার সময় পঙ্কজ মল্লিকের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন।
আমি হুদা সায়েবকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই। তারপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি সিরাজুল আর লায়লার সঙ্গে ওঁদের বাড়ি রওনা হলাম।
বাড়ি ফেরার পথে সিরাজুল আমাকে প্রায় সারা শহরটা ঘুরিয়ে দেখাবার পর বললেন, আপনার মতো লোকের কাছে এ শহরে দেখার কিছু নেই; তবে কাল যদি আপনাকে ক্লিফটন বীচ দেখাতে পারি, তাহলে নিশ্চয়ই আপনার ভালো লাগবে।
হ্যাঁ, ক্লিফটন বীচের কথা অনেকের কাছেই শুনেছি।
কাল যদি ছুটি নিতে পারি তাহলে আমিই নিয়ে যাব; নয়তো লায়লা আপনাকে ঘুরিয়ে আনবে।
আমি বললাম, কাজকর্মের ক্ষতি করে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবার দরকার নেই।
লায়লা বললেন, আপনাকে একটু ঘুরিয়ে আনলে আমাদের কারুরই কোনো কাজের ক্ষতি হবে না। দাদা ছুটি না পেলে আমিই আপনাকে ঘুরিয়ে আনব।
ঘুরেফিরে সিরাজুলের বাড়িতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ওদের মা দরজা খুলে দিয়েই বললেন, একটু আগেই রহমান সায়েবের কুঠী থেকে ফোন এসেছিল। তার আগে তোর অফিস থেকে দুবার ফোন এসেছে।
সিরাজুল প্রথমেই ওঁর অফিসে ফোন করলেন। সহকর্মী নরুল হাসানের খুব জ্বর। সুতরাং একটু পরেই ওঁকে রেডিওতে ছুটতে হবে।
এরপর রহমান সাহেবের বাড়িতে ফোন করে জানালেন, আমার আপত্তি না থাকলে আগামীকাল দুপুরে আমাকে ওরা খাওয়াতে চান। মিসেস রহমান আমার সঙ্গেও কথা বললেন, আজ তো আপনার সঙ্গে ভালো করে কথাই বলতে পারলুম না। তাই কাল দুপুরে আসুন। সবাই মিলে একটু গল্প করা যাবে।
আমি সানন্দে স্বীকৃতি জানালাম।
সিরাজুল একটু পরেই রেডিও স্টেশনে চলে গেলেন। যাবার সময় বললেন, আপনি আম্মা আর লায়লার সঙ্গে গল্প করুন। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসছি।
সিরাজুলের মার সঙ্গেও অনেক গল্প হল। উনি কাটোয়ার মেয়ে। ম্যাট্রিক পাশ করেছেন কলকাতার শাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল থেকে। ভিক্টোরিয়াতে আইএ ক্লাসএ ভর্তি হবার পরই বিয়ে হয়। উনি বললেন, আমাদের সব আত্মীয়স্বজনই পশ্চিমবাংলায়। শুধু বড়ো মেয়ে আর জামাই ছাড়া ঢাকায় আমাদের আর কোনো আত্মীয় নেই। আত্মীয়স্বজন ছেড়ে এত দূর দেশে পড়ে থাকতে একটুও ভালো লাগে না। সব শেষে উনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কোথা দিয়ে যে কি ঘটে গেল, তা ভাবতেও অবাক লাগে।
আমি চুপ করে ওঁর কথা শুনি। লায়লা স্নান করতে গেছেন। ঘরে শুধু আমরা দুজন। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর হঠাৎ উনি প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বাবা, শনিবারের চিঠি এখন বেরোয়?
না।
তাই নাকি? অত সুন্দর কাগজটা বন্ধ হয়ে গেল?
হ্যাঁ।
ভারতবর্ষপ্রবাসী তো চলছে?
না, ওগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে।
কী আশ্চর্য! তাহলে লোকে পড়ে কী?
এখন নতুন নতুন অনেক কাগজ বেরিয়েছে।
কিন্তু বাবা, সেগুলোতো ভারতবর্ষপ্রবাসী হতে পারে না।
না, তা কী সম্ভব?
বৃদ্ধা আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সব কিছুই এমনভাবে বদলে যাচ্ছে যে আমাদের সব কিছুই বেসুরো মনে হয়।
লায়লা স্নান করে আসতেই উনি বললেন, তোরা গল্প কর। আমি শুতে যাই। পায়ে বড় ব্যথা করছে।
লায়লা আমাকে বললেন, আম্মা বাতের ব্যথায় বড়ো কষ্ট পাচ্ছেন। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেন না।
আমি বললাম, আমি তো অনেকক্ষণ আপনাকে আটকে রেখেছি। আপনি এবারে বিশ্রাম করুন।
বৃদ্ধা চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে লায়লাকে বললেন, একে দেখেশুনে খেতে দিস। লায়লা হাসতে হাসতে বললেন, কেন, তোমার কলকাতার লোক বলে?
তাই তো!
ওঁর মা ভিতরে চলে যেতেই লায়লা জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের রিহার্সাল কেমন লাগল?
খুব ভালো।
কী ভালো লাগল?
নাচগান, আপনাকে, আপনার দাদাকে, রহমান সাহেবকে..
আমি আপনার সামনে বসে আছি বলে আমাকে খুশি করার কোনো দরকার নেই।
ঠিক তো?
অবশ্যই।
তাহলে বলি, আপনি ছাড়া আর সবাইকে ভালো লেগেছে।
আর আমাকে?
একটুও ভালো লাগেনি
কেন?
আপনার রূপ নেই, গুণ নেই, আপনাকে ভালো লাগবে কেন?
ঠিক বলেছেন।
দুজনেই হাসি।
এবার আমি প্রশ্ন করি, আচ্ছা মেয়েরা কি সব সময়ই নিজেদের প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে?