জামাকাপড় আর কাগজপত্র।
যে ভদ্রলোক এতক্ষণ অসভ্যর মতো চিৎকার করছিলেন, তিনিই হঠাৎ অত্যন্ত চাপ গলায় আমার দিকে না তাকিয়েই বাংলায় প্রশ্ন করলেন, আপনি হকসায়েবের বন্ধু?
সতর্কভাবে এদিকওদিক দেখে নিয়ে বললাম, হ্যাঁ।
উনিও অত্যন্ত সতর্কভাবে একবার চারপাশে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিয়ে প্রায় আপনমনে বললেন, কে এল এমএর হোটেলেই থাকবেন তো?
মুখে না, মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ।
চলে যান। কোনো চিন্তা নেই।
মনে মনে হকসায়েবকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারলাম না।
এরপর পাশপোর্ট জমা রেখে রসিদ নিয়ে বি ও এ সির গাড়িতে চলে এলাম কে এল এমএর ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে। তখন ছটা বাজে। রাত্রে বিশেষ ঘুম হয়নি। তাই জামা কাপড় বদলে একটু শুয়ে পড়লাম।
দরজায় নক্ করার আওয়াজ হতেই ঘুম ভাঙল। ঘড়িতে দেখলাম, প্রায় সাড়ে ৯টা বাজে। দরজা খুলতেই এক বৃদ্ধ রুম বেয়ারা আমার ঘরের ভিতর ঢুকেই ডান হাত কপালের কাছে তুলে বলল, আদাব।
সেলাম আলেকুম না বলে আদাব বলতেই বুঝলাম উনি বাঙালি। একটু হেসে বললাম, আপনি বাঙালি?
হা কর্তা, আমি বাঙালি। প্যাটের দায়ে এই বিদেশে পইড়া আছি।
করাচি বিদেশ হবে কেন?
বৃদ্ধ রুম বেয়ারা একটু ম্লান হেসে বললেন, যে দেশের ভাষা, খাবার দাবার, পোশাক পরিচ্ছদ, আবহাওয়া আলাদা সে বিদেশ ছাড়া আবার কী?
বৃদ্ধের কথা শুনে আমি বিস্মিত হই না; বরং খুশি হই।
আমি কিছু বলার আগেই উনি বললেন, আপনার ঘরে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক না। আমি সবষের তেল এনে দিচ্ছি, ভালোভাবে স্নান করুন। এ শালাদের এক গাদা মশলা দেওয়া খাবারদাবার খাওয়ার দরকার নেই। আমি মাছের ঝোল ভাত এনে দেব। তাই খেয়ে বেরিয়ে পড়ুন।
বুঝলাম, পরিকল্পনা মতোই কাজ এগুচ্ছে। বৃদ্ধের কথা উপেক্ষা করলাম না, সরষের তেল মেখেই স্নান করলাম। বেশ পরিতৃপ্তির সঙ্গেই মাছের ঝোল ভাত খেলাম।
তারপর?
ঐ বৃদ্ধের নির্দেশমতো প্রিডি স্ট্রিটের কটেজ ইন্ডাস্ট্রীজ সেলস অ্যান্ড ডিসপ্লে সেন্টারের সামনে গিয়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দিলাম। দশপনের মিনিট এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির পর ডানদিকে কিছুদুর যেতেই বৃদ্ধের দেওয়া নম্বরের অষ্টিন দেখতে পেলাম। গাড়িতে কেউ ছিলেন না কিন্তু দরজা খোলা ছিল। আমি গাড়িতে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক ভদ্রলোক হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, আমি সিরাজুল ইসলাম। গাড়ি খুঁজতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?
না।
উনি সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট করলেন। একটু ফাঁকা রাস্তায় পৌঁছেই উনি বললেন, আপনি খুব ভালো দিনে এসেছেন।
কেন?
আজ আমাদের চিত্রাঙ্গদার ফাইনাল রিহার্সাল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। একসঙ্গে অনেক বাঙালির সঙ্গে আপনার আলাপ হবে।
তাহলে তো সত্যিই ভালো দিনে এসেছি।
গাড়িতে যেতে যেতেই অনেক গল্প হল। সিরাজুল ইসলাম জন্মেছেন কলকাতাষ পড়াশুনা কলকাতারই রিপন কলেজে; তবে এম এ পড়েছেন ঢাকায়। চাকরি কবে পাকিস্তান রেডিওর বাংলা বিভাগে। আমার কথাও উনি শুনলেন।
দুপাঁচ মিনিট পর সিরাজুল ইসলাম লুকিয়ে একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, কলকাতার কথা মনে পড়লে আর কিছু ভালো লাগে না।
আমি বললাম, যেখানে জন্মেছেন, যেখানে লেখাপড়া শিখেছেন, সেখানকার স্মৃতি কখনই ভোলা যায় না।
সিরাজুল হঠাৎ ডানদিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নতুন রাস্তায় পড়েই বলেন, কাজকর্মে ঝামেলায় দিনগুলো কেটে যায় ঠিকই কিন্তু কদাচিৎ কখনও কলকাতার লোকজনের সঙ্গে দেখা হলে শুধু কলকাতার কথাই মনে হয়। উনি আপন মনে একটু ম্লান হেসে বললেন কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি, আমি করাচিতে এসে রেডিও পাকিস্তানের সেবা করব।
কেন? পূর্ব পাকিস্তানের লোক হয়ে করাচিতে এসে চাকরি করা কী স্বাভাবিক ব্যাপার নয়?
সিরাজুল আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, আমাদের দেশ বসিরহাট; পূর্ব পাকিস্তান না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
তাহলে কী দাঙ্গার পরই বসিরহাট ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান?
উনি আবার একটু হাসেন। বলেন, দাঙ্গা হয়েছিল কলকাতায়, ঢাকায়, নোয়াখালিতে বসিরহাটে না।
তাহলে বসিরহাট ছাড়লেন কেন?
উনি একটা আঙুল দিয়ে কপাল দেখিয়ে বললেন, সবই কিসমতের খেল। ঢাকায় ব্যবসাঁ করতে গিয়ে বাবা মারা গেলেন; আর সেই ব্যবসা সামলাতে আমি গেলাম ঢাকায়। ব্যস এমন জড়িয়ে পড়লাম যে আর ফিরতে পারলাম না।
রহমান সায়েবের বাড়িতে ঢুকেই আমি স্তম্ভিত। চিত্রাঙ্গদা নাচছে আর গান হচ্ছে–আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি। আমি ঘরে পা দিতেই মণিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার নাচ থেমে গেল, গান বন্ধ হল। চিত্রাঙ্গদা মুহূর্তের জন্য একটু হেসে আমার দিকে তাকালেন। আমাকে অভ্যর্থনা করলেন ঘরের সবাই। আমি হাসতে হাসতে বললাম, আপনারা এমন করে অভ্যর্থনা করছে যেন ঘরে অর্জুন ঢুকলেন।
আমার কথায় ঘরের মেয়েপুরুষ সবাই হাসেন। চিত্রাঙ্গদা বললেন, কোনো দ্বিধা সঙ্কোচ না করে প্রায় অর্জুনের মতোই তো এলেন।
আমি হাসতে হাসতে বলি, তাহলে কী বলব–কাহারে হেরিলাম! আহা!
সে কি সত্য, সে কি মায়া।
ঘর ভর্তি; সবাই হাসিতে লুটিয়ে পড়লেন। হাসি থামতেই সিরাজুল ইসলাম একটি মেয়েকে বললেন, লায়লা, তুই সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দে। লায়লা আমাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর আমাকে পাশে নিয়েই বসলেন। তারপর একটু চাপা গলায় বললেন, আমি লায়লা ইসলাম, সিরাজুল ইসলামের বোন।