রঞ্জন ও ছবি দেখতে চায়নি। ও ছবি ওর মনের মধ্যে অসংখ্য স্মৃতির মালা দিয়ে বাঁধানো আছে। তবু না দেখে পারল না। পাপিয়া!
ট্রেন মোগলসরাই স্টেশনে ঢুকছে। রঞ্জন তাড়াতাড়ি সুটকেসটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল নমস্কার।
এখানেই নামবেন?
হ্যাঁ, আমি একটু বেনারস ঘুরে যাব।
আপনার ঠিকানাটা…।
রঞ্জন হাসল, কোনো দরকার নেই। ঐ শেখ সেলিম চিস্তির সমাধিতেই দেখা হবে।
স্টপওভার : করাচি
ভারতীয় সাংবাদিকদের তখন পাকিস্তান যাবার ভিসা দেওয়া হত না। তাই চাণক্যপুরীর পাকিস্তান হাইকমিশনের দরজায় কোনো আবেদনপত্র নিয়ে হাজির হইনি কিন্তু সব সময়ই পাকিস্তান যাবার একটা অদম্য ইচ্ছা মনের মধ্যে জমা ছিল। মনে হত অমৃতসর থেকে মাত্র আধ ঘণ্টার পথ যে হোর তাকেও কী দেখতে পাব না? করাচিকে পাশে রেখে মধ্যপ্রাচ্যের কত দেশ ঘুরে চলে যাচ্ছি ইউরোপ। দেশে ফেরার পথেও করাচির সঙ্গে লুকোচুরি খেলছি। তখনও সে বোরখা পরে নিজেকে ঢেকে রেখেছে।
সেবার কমনওয়েলথ প্রাইম মিনিস্টার্স কনফারেন্স কভার করতে লন্ডন গেছি। ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট বোধহয় ইচ্ছা করেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী আর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে ক্লারিজেসএ রেখেছেন। তাই আমাকেও বার বার যেতে হয় ব্রুক স্ট্রিটের এই বিখ্যাত হোটেলে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর নানা কাজকর্মে সাহায্য করার জন্য আমাদের হাই কমিশনের বেশ কয়েকজন কর্মী ও অফিসারকে দিনরাত ওখানে থাকতে হয়। পাকিস্তান প্রেসিডেন্টকে সাহায্য করার জন্য পাকিস্তান হাইকমিশনের অনেকে ওখানে। ভাগ্যক্রমে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসএর কয়েকজন বাঙালি অফিসারের সঙ্গে ক্লারিজেসএ আমার বেশ আলাপ হল। প্রথমে নেহাতই সৌজন্যমূলক কথাবার্তা; হয়তো সামান্য হাসিঠাট্টা। তারপর একটু ঘনিষ্ঠতা। সপ্তাহের শেষে প্রাইম মিনিস্টার্স কনফারেন্স শেষ হতে না হতেই ওঁরা আমার বন্ধুস্থানীয় হয়ে গেলেন। আয়ুব খান লণ্ডন ত্যাগ করার পরের দিনই নটিংহিল এ হক সায়েবের বাড়িতে আমার নৈশভোজন।
ঐ নৈশভোজনে পাকিস্তান হাইকমিশনের চারপাঁচজন কূটনীতিবিদ সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও বি বি সি র দুচারজন বাঙালিও সস্ত্রীক আমন্ত্রিত ছিলেন। এক রাউণ্ড শেরি-শ্যাম্পেন-কনিয়াক-ভডকার পর শুরু হল গান। সবার আগে মাহমুদা বেগম গাইলেন অতুলপ্রসাদের মিছে তুই ভাবিস মন। তাই গান গেয়ে যা, গান গেয়ে যা আজীবন! তারপর আরো কতজনের কত গান। ঐ গান বাজনার মাঝে মাঝেই হাসিঠাট্টা-গল্পগুজব। হঠাৎ কি প্রসঙ্গে যেন করাচির কথা উঠতেই আমি বললাম, দিল্লি ফেরার পথে কটা দিন করাচিতে কাটাতে পারি না?
আমিন সায়েব বললেন, আপনাকে ভিসা দেওয়া যাবে না কিন্তু ভিসা ছাড়াও তো আটচল্লিশ ঘণ্টা আপনি থাকতে পারেন।
তা তো জানি কিন্তু….
হকসায়েব বললেন, ওসব কিন্তুটিন্তু ছাড়ুন; আপনি যান। আমরা সব ব্যবস্থা করে দেব।
আমি সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলাম, কোনো বিপদে পড়ব না তো?
ওরাও সোজাসুজি উত্তর দিলেন, না, বিপদে কিছু পড়বেন না, তবে টিকটিকি লেগে থাকবে।
আমি হেসে বললাম, পাকিস্তানে গেলে যে টিকটিকি পিছনে লেগে থাকবে, তা তো খুবই স্বাভাবিক।
পরের দিনই আমি রিটার্ন জার্নির প্ল্যান ঠিক করে ফেললাম। লন্ডন, প্যারিস, ফ্রাঙ্কফার্ট মিউনিক, ভিয়েনা, রোম, বেইরুট, কায়রো, করাচি, দিল্লি। হকসায়েবকে জানিয়েছিলাম, চার তারিখে লন্ডন ছাড়ছি; একুশে ভোর চারটে ত্রিশে বি ও এ সি ফ্লাইট ফাইভ জিরো ওয়ান এ করাচি পৌঁছব। থাকব কেএলএম হোটেলে। হসায়েব বললেন, সব ঠিক হোগা কোই চিন্তা নেই করনা।
আমি লন্ডন ছাড়ার আগে হকসায়েবকে আমার রোম আর কায়রোর হোটেলের নাম ঠিকানাও জানিয়ে দিলাম।
ঘুরে ফিরে এলাম রোম কিন্তু না, হকসায়েব কোনো কিছু খবর দিলেন না। কায়রোতেও তিনদিন কাটালাম। না, ওখানেও কোনো চিঠিপত্র পেলাম না। উনি প্রতিশ্রুতি না দিলেও বলেছিলেন, দরকার হলে যোগাযোগ করবেন। আমি আশা করেছিলাম, রোম বা কায়রোতে ওর কাছ থেকে একটা চিঠি বা টেলিগ্রাম পাব। তাই বেশ দুশ্চিন্তা নিয়েই কুড়ি তারিখ রাত্রে কায়রো থেকে করাচি রওনা হলাম।
প্লেন ঠিক সময়ই করাচি পৌঁছল। অবিভক্ত ভারতের বৃহত্তম এয়ারপোর্ট আমাকে মুগ্ধ করল না, বরং সূর্যোদয়ের প্রাক্কালেও এর বাতাসে প্রাণহীন রুক্ষতার স্পর্শে চমকে উঠলাম। করাচি এয়ারপোর্টে নামলেই বোঝা যায়, বেলুচিস্তানের মরুপ্রান্তর দূরে নয়।
এলাম টার্মিনাল বিল্ডিং। ইমিগ্রেশন কাউন্টারের পুলিশ কর্মচারী আমার পাশপোর্ট একটু বেশি যত্ন নিয়ে দেখে একবার ভালো করে আমার মুখখানা দেখলেন, এ্যারাইভালোও করাচি ইন্টারন্যাশনাল। ঐ স্ট্যাম্পের উপরেই সই করে তারিখ দিলেন।
একটু পরে কাস্টমস। একজন অফিসার আমার সুটকেসের উপরেই কমনওয়েলথ প্রাইম মিনিস্টার্স কনফারেন্সের ফোলিও ব্যাগটি দেখে প্রশ্ন করলেন, আর ইউ এ ডিপ্লোম্যাট?
না, আমি সাংবাদিক।
পাশপোর্ট দেখান।
ওঁকে পাশপোর্ট দেবার পর উনি আমার পরিচয়পত্রের পাতাটি ভালো করে দেখে নিয়েই একবার আমাকে দেখলেন। তারপর হঠাৎ বাঘের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, এনি ক্যামেরা? ওয়াচ? ইলেকট্রনিক…
না, ওসব কিছুই নেই।
অসভ্যর মতো চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলেন, সোনার গহনা? ফরেন কারেন্সি?
না, তাও নেই; তবে ট্রাভেলার্স চেক আছে।
আবার সেই অসভ্য চিৎকার, তবে কী আছে আপনার সুটকেশে?