ঘনিষ্ঠতা মানে?
যতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া সম্ভব।
তুই তো শুধু বড়লোকের মেয়ে না, একমাত্র সন্তান। তোর পক্ষে তো সব কিছুই সম্ভব ছিল।
ইন্দ্রানী চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলে, তা ঠিক; কিন্তু নিছক ভয়েব জন্য অনেক চুযোগেরই ষোলআনা ব্যবহার করতে পারিনি।
কে যেন প্রশ্ন করল, এখন আফসোস হয় না?
হাসতে হাসতেই এলা বলল, আমার তো ভীষণ আফসোস হয়।
এক একদিন এক একজনের প্রেমের কাহিনি শুনতে শুনতেই কেজি সেকশনের টির ঘণ্টা পড়ে। ওরা যে যার ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি চলে যান।
একদিন মলিনাদি আসরের শুরুতেই ফতোয়া জারি করলেন, আজ মানসীর পালা
মানসী এক গাল হাসি হেসে বলল, আমি আর নতুন করে কী বলব? ঐ একই ব্যাপার। একটু হাসি, একটু ইসারা। দুচারটে চিঠিপত্রের লেনদেন..
আর?
আর দুর্গাপুজোর সময় একটু এদিকওদিক ঘোরাঘুরি।
আর?
ঐ সুবর্ণরেখার ধারে পাশাপাশি বসে দুচারটে মনের কথা বলা।
মলিনাদি ঠোঁট উল্টে বললেন, ব্যস। সুবর্ণরেখার ধারে গিয়েও শুধু পাশাপাশি বয়ে থাকা! অসম্ভব।
চাপা হাসি হেসে মানসী বলল, সত্যি বলছি।
ন্যাকামি করিস নে মানসী। যে খোকাখুকু সবার চোখে ধুলো দিয়ে নির্জন সুবর্ণরেখার পাড়ে চলে যায়, তারা শুধু মনের কথা বলার পাত্রপাত্রী হতে পারে না
তিনচারজন একসঙ্গে বলল, ঠিক বলেছেন।
মেয়েরা পুরুষদের কাছ থেকে অনেক কিছু লুকিয়ে রাখে, রাখতে পারে কিন্তু মেয়ের মেয়েদের কাছে হেরে যাবেই। কেউ স্বেচ্ছায় সানন্দে নিজের জীবনের গোপনতম কাহিনি প্রকাশ করে, কেউ কেউ ঘটনাচক্রে প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। হ্যাঁ, মানসীও স্বীকার না করে পারে নি।সঞ্জয় ছুটিতে জামশেদপুর এলেই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে এমন পাগলামি করত যে আমি কিছুতেই ঠেকাতে পারতাম না।
চৈতালী বলল, কনগ্রাচুলেশন!
রেখা জিজ্ঞেস করল, ওকে বিয়ে করলি না কেন?
ওর মা আগেই মারা গিয়েছিলেন। তারপর হঠাৎ ওর বাবাও মারা গেলেন ওদিকে সঞ্জয় যাদবপুর থেকে পাশ করেই গ্লাসগো চলে গেল। তাই আর যোগাযোগই রইল না।
.
সেদিন রাত্রে কথায় কথায় চৈতালী সঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করল, তোমার আর জামশেদপুর যেতে ইচ্ছে করে না?
জামশেদপুর যেতে তেমন ইচ্ছে হয় না কিন্তু সুবর্ণরেখার কথা খুব মনে হয়
খুব সুন্দর নদী, তাই না?
পৃথিবীতে অনেক সুন্দর নদী আছে কিন্তু যাদবপুরে পড়ার সময় ছুটিতে বাড়ি গেলে শুধু সুবর্ণরেখার ধারে চলে যেতাম। সঞ্জয় চৈতালীর দিকে তাকিয়ে বলে, ওখানে গিয়ে যে কি আনন্দ পেতাম, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
চৈতালী চুপ করে থাকে।
একটু পরে সঞ্জয় জিজ্ঞেস করে, তুমি সুবর্ণরেখা দেখেছ?
না, না, আমি কী করে দেখব?
চৈতালী কী করে বলবে, বৌদির মেজদার বিয়েতে ঘাটশিলা গিয়ে ছোড়দার মোটর সাইকেল চড়ে সুবর্ণরেখার আশেপাশে চলে যেত। ঐ সুবর্ণরেখার পাড়েই তো অবিস্মরণীয় আনন্দের স্বাদ পেয়েছে। সূর্যের তির্যক রশ্মির আলোয় ঐ শাল ফাঁকে ফাঁকে যে ইতিহাস ছড়িয়ে আছে, তা কী মুখে প্রকাশ করা যায়?
সে স্মৃতি শুধু অনুভবের, শুধু রোমন্থনের।
সেলিম চিস্তি
‘দেওয়ান-ই-আম’-এ এখন আর সম্রাট বিচার করেন না। ‘দেওয়ান-ই-খাস্’-এ বীরবলের সঙ্গে পরামর্শ হয় না সম্রাটের। রাজপুত দুহিতা, জাহাঙ্গীর পত্নী যোধবাঈ তুলসী মঞ্চে প্রণাম করে ‘দেওয়ান-ই-খাস্’এ-র আসরে আসন গ্রহণ করেন না। সে সব দিন শেষ। ফুরিয়ে গেছে! ফতেপুর সিক্রী এখন মূক, বধির, প্রাণহীন। মিঞা তানসেনের গান শুনে যে রাজপ্রাসাদের মানুষ চঞ্চল হয়ে উঠত সকালে, সন্ধ্যায়, চারপাশের গ্রামের মানুষ মুগ্ধ হত যে সঙ্গীত সম্রাটের সুরে, সে অমৃত কণ্ঠস্বর আর শোনা যায় না।
সম্রাট নেই, সম্রাজ্ঞী নেই, নেই রাজপুত্র মন্ত্রী, রাজ জ্যোতিষী, গায়ক, সখী, বাঈজী, নতর্কী। কেউ নেই। সেনাপতি তো দূরের কথা, একজন সাধারণ সৈন্য পর্যন্ত নেই ফতেপুর সিক্রীতে। বুলান্দ দরওয়াজায় আজ আর অশ্বারোহী সৈন্যরা পাহারা দেয় না।
তা না হোক আজও মানুষের কলগুঞ্জনে মুখরিত হয় ফতেপুর সিক্ৰী। প্রাণহীন এই প্রাসাদ, তার পুরনো দিনের স্মৃতি সারা দেশের মানুষকে ঘরছাড়া করে। টেনে আনে! সারা বছর ধরে তারা আসে। দেখে। ভাবে। একটু আনমনা হয়ে ফিরে যায়।
না, বাজপ্রাসাদ দেখেই ফিরে যায় না। সবাই আসে শেখ সেলিম চিস্তির সমাধিতে। প্রণাম করে, প্রার্থনা করে। শ্বেতপাথরের জালিতে লাল সুতো বাঁধে। শ্বেত, শুভ্র, নির্মল, পবিত্র তীর্থে এসে কামনাবাসনার আগুন ছড়িয়ে যায় সবাই।
.
পাপিয়া, তুমি কিছু প্রার্থনা করে লাল সুতো বাঁধবে না?
না।
অবাক হয় রঞ্জন, সেকি? এবার একটু কাছে এসে নিবিড় হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলল, শুনেছি সেলিম চিস্তির কাছে কিছু চাইলে পাওয়া যায়।
আমিও শুনেছি।
তুমি কিছু চাইবে না? তোমার কোন প্রার্থনা নেই?
পাপিয়া মুখ ঘুরিয়ে রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি মুখ ফুটে চাইলেই সেলিম চিস্তি আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করবেন?
রঞ্জন ঠিক জবাব দিতে পারেনি। না, তা ঠিক নয়, তবুও…
সেলিম চিস্তি নিশ্চয়ই আমার মনের কথা জানেন।
সারা বছর ধরে মানুষের স্রোত বয়ে যায় এই সেলিম চিস্তির সমাধিতে। শীত গ্রীষ্ম শরৎহেমন্ত। সব সময়। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত। আজ কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমা। বিকেল হতে না হতেই সবাই তাজের পথে। বিবর্ণ মনকে একটু রঙিন করবার জন্য আজ সেলিম চিস্তির সমাধি ছেড়ে সবাই যমুনা পাড়ের তাজ দেখতে চলেছেন।