.
কি ব্যাপার? এতদিন পর আবার সুপার মার্কেটের এখানে দাঁড়িয়ে?
এয়ার হেড কোয়াটার্সের কাজ শেষ হয়ে গেল তাই।
বড় বেসুরো লাগল চিত্রিতার কানে। কথাটা শেষ করতে দিতেও পারল না।
হ্যাঁ। এক মাস হয়ে গেল।
বারাখাম্বা। তারপর পার্লামেন্ট স্ট্রিট।
কথা বলা হল না কারুরই। তবু যেন দুজনেই অনেক কথা শুনেছিল।
কাল ভোরেই চলে যাচ্ছি।
কাল ভোরেই?
হ্যাঁ।
রিগ্যাল সিনেমা, খাদি গ্রামোদ্যোগ ভবন, আরউইন রোড।
রাস্তা পার না হয়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জিজ্ঞাসা করল, আজও কি সোজা বাস স্ট্যান্ডে যাব নাকি ডান দিকে ঘুরব।
চলুন।
বেশিক্ষণ নয়, বেশি দূরেও নয়। ইনার সার্কেলে সামান্য সময়ের জন্য দুজনে ঘুরেছিল।
আপনার জন্য বেশ কাটল কটা মাস।
মুখ নীচু করে চিত্রিতা বলল, আমি আর আপনার জন্য কি করলাম?
এত গান শোনাবার পরও বলছেন কি আর করলেন?
খুব শুনিয়েছি।
সত্যিই বলছি খুব ভালো লেগেছে আপনার গান। অনেক দিন মনে থাকবে।
আবার চুপ করে থাকে দুজনেই। কথা বলতে পারে না।
হঠাৎ একটু থমকে দাঁড়িয়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বলল, একটা অন্যায় অনুরোধ করব?
আপনি অন্যায় অনুরোধ করবেন কেন?
কেন জানি না তবে করব! করতে ইচ্ছে করছে।
আপনাকে হয়তো খুব বেশি চিনি না। তবে যতটুকু চিনেছি তাতে মনে হয় অন্যায় অনুরোধ আপনি করবেন না।
সত্যি বলছি অন্যায় অনুরোধ করব। রাখবেন?
আচ্ছা বলুন তো
রাখবেন তো?
চিত্রিতা হাসে, আচ্ছা রাখব।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সিফন জর্জেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিলে ফিরিয়ে দিতে পারে নি। কোনো কথা না বলে হাতে তুলে নিয়েছিল। এমন কি ধন্যবাদ পর্যন্ত জানাতে পারে নি।
সব কিছুই তো সবাই জানলেন। শুধু এই সিফন জর্জেটের কথাটুকু আমাদের থাক।
চিত্রিতা জানাতে পারেনি। মাকে বলেছিল, গানের ক্লাসের এক বন্ধু দিয়েছে। সেদিন বাড়ি ফিরেই ওই সিফন জর্জেটটা পরে ছুটে গিয়েছিল মাধুরী মাসীর কাছে। মা, মাসীকে শাড়িটা দেখিয়ে আসি।
স্কোয়ার্ডন লীডার রায় ড্রইংরুমে বসে ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের সঙ্গে গল্প করছিলেন। ঝড়ের বেগে চিত্রিতা ড্রইংরুমে ঢুকেই এদিক ওদিক দেখল। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট একবার মুগ্ধ হয়ে দেখল। স্কোয়ার্ডন লীডার কিছু বুঝতে পারলেন না।
কাকু, মাসী কোথায়?
ও বোধহয় মিঠুকে খেতে দিচ্ছে।
মাসীও চমকে উঠেছিল। আঃ! কি লাভলি তোকে দেখাচ্ছে রে!
মাসী চিত্রিতাকে সঙ্গে নিয়ে ড্রইংরুমে এসে স্কোয়ার্ডন লীডারকে বললেন, দেখছ, সিফন জর্জেটটা পরে চিত্রাকে কি দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে।
স্কোয়ার্ডন লীডার কিছু বলার আগেই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বলল, তাই বলে সিফন জর্জেট পরলে তোমাকে মানাবে না।
বেশি রাগালে হাটে হাঁড়ি ভাঙব কিন্তু।
বিয়ের পর পুরনো শাড়ি কোনো মেয়েই পরে না, ভালো হলেও না। তখন পুরনো জিনিস ভালো হলেও বর্জনীয়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তা জানে। তবুও চৈতালীকে সিফন জর্জেটটা পরতে দেখে মনে মনে বড় অতৃপ্তি বোধ করল। অসহ্য লাগল। চিত্রিতার চাইতে চৈতালীকে দেখতে আরো ভালো কিন্তু ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের চোখে খারাপ লাগল। বড় বেমানান বলে মনে হলো।
.
হিন্দনে ট্রান্সফার হবার পর প্রত্যেক উইক এন্ডে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুব্রত পার্কে আসত। হঠাৎ চৈতালীর আসাযাওয়া বাড়তেই ও আসা বন্ধ করে দিল। কিন্তু কেউ বুঝল না, জানল না। মাধুরী বৌদি টেলিফোন করলেই বলে ভীষণ ব্যস্ত।
তারপর একদিন ব্যানার্জী হঠাৎ নিজেই টেলিফোন করল, বৌদি, তোমার ওখানে আমার যে স্যুটটা রয়েছে, ওটা কাচিয়ে রেখো তো।
আচ্ছা রাখব।
আর ওর পকেটে একটা নতুন ডায়েরি আছে। ওটা কিন্তু একটু সাবধানে রেখো।
রাখব কিন্তু তুমি আসছ কবে?
সামনের রবিবারেই আসব।
ঠিক?
ঠিক।
কল্যাণীয়া চিত্রা,
তো বিয়ের পর এই প্রথম তোকে চিঠি লিখছি। ভাবতে পারিনি প্রথম চিঠিতেই একটা মারাত্মক খবর দিতে হবে। আজ সকালে হিন্দনে ফ্লাইং আকসিডেন্টে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মারা গেছে। ঠিক ভাবতে পারছি না কি হয়ে গেল। ওর একটা স্যুট আমার কাছে ছিল। ড্রাই ক্লিন করতে দিয়েছি। রবিবার নিয়ে যাবার কথা। কোটের পকেটে একটা নতুন ডায়েরি ছিল। বলেছিল সাবধানে রাখতে। রেখেছিলাম। এতদিন ডায়েরিটা আলমারিতেই ছিল, কিন্তু আজ ওটা না দেখে পারলাম না। ডায়েরির একটা পাতাতেও কিছু লেখা নেই। গত বছর এপ্রিলে সুপার মার্কেট থেকে কেনা একটা সিফন জর্জেটের ক্যাশ মেমো ছাড়া আর কিছু ঐ ডায়েরিতে নেই। তোকে না লিখে পারলাম না। তুই আমাকে ক্ষমা করিস।
তোর মাধুরী মাসী
সুবর্ণরেখা
শেষ পর্যন্ত সেই অসম্ভবই সম্ভব হল। সঞ্জয় আর চৈতালী স্বপ্নেও ভাবেনি কলকাকলিতে ময়নাকে ভর্তি করা সম্ভব হবে। কেজি ওয়ান বা টুতে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করার জন্য কত হাজার হাজার বাবামায়েরা যে ধর্না দেন, তার ঠিকঠিকানা নেই। ওখানে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করার চাইতে লটারিতে দুপাঁচ লাখ টাকা প্রাইজ পাওয়া অনেক সহজ।
কলকাকলি স্কুলটি সত্যি ভালো। লেখাপড়া ছাড়াও নাচগাননাটকডিবেটকুইজ সারা বছর ধরে চলছে। এর উপর আছে খেলাধূলার অফুরন্ত সুযোগ। ক্রিকেটহকি ফুটবলবাস্কেটবলটেনিসব্যাডমিন্টন ছাড়াও যোগব্যায়াম। ছোট বড় দুটি অডিটোরিয়াম। কি বিশাল লাইব্রেরি! রিডিং রুমে প্রত্যেকের আলাদা চেয়ারটেবিল। সব চাইতে বড় কথা, একবার ভর্তি করতে পারলে বারো ক্লাস পর্যন্ত নিশ্চিত।