জনপথ পার হয়ে এলআইসি গ্রাউন্ডের পাশ দিয়ে পার্লামেন্ট স্ট্রিটের দিকে এগুতে এগুতে চিত্রিতা ফ্লাইট লেফটেন্যান্টকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি বুঝি সিনেমা দেখতে গিয়ে টিকিট পেলেন না?
মোটেও সিনেমা দেখতে আসিনি। অফিস ছুটির পরই এক বন্ধু জোর করে কফি হাউসে নিয়ে এলো। একটু থেমে বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
চিত্রিতা দুষ্টুমি করে জিজ্ঞাসা কবল, ভয় করছে? নাকি সন্দেহ হচ্ছে?
আমাকে দেখে কি তাই মনে হচ্ছে?
চিত্রিতা ওকথার কোনো জবাব না দিয়ে বলল, আমি আপনার মতো ভালো ফাইটার পাইলট না হলেও খারাপ ন্যাভিগেটর নই। ঠিক বাড়িতে পৌঁছে দেব।
সেদিন সন্ধ্যাবেলায় ভারি মজা হল।
জান মাসি, আজ আর একটু হলেই পালামে হৈ চৈ পড়ে যেত।
মাধুরী মাসী উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল, কেন রে? কি হয়েছিল?
গ্রুপ ক্যাপ্টেন ঘোষ মেয়ের কথায় অবাক হয়ে স্কোয়ার্ডন লীডার রায়ের দিকে তাকালেন।
চিত্রিতা বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, ফ্লাইং এয়ারক্রাফট মিসিং হয় কিন্তু আজ এয়ারক্রাফট ছাড়াই পাইলট মিসিং হচ্ছিল।
ওর কথা কেউ বুঝল না। সবাই হাঁ করে ওর দিকে চেয়ে রইল। মাধুরী মাসীই আবার প্রশ্ন করল, তার মানে?
তোমাদের ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আজ মিসিং হচ্ছিলেন। শুধু আমার মতো ন্যাভিগেটরের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হওয়ায়…
.
চিত্রিতার কথা শেষ হতে দেয়নি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। মিসেস রায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, বৌদি শুনেছেন আজকাল কটন প্লেসে বহু ইয়ং মেয়ে ছেলেদের ব্ল্যাকমেল করছে?
সিফন জর্জেটের প্যাকেটটা নিয়ে চিত্রিতা স্থির হয়ে বসে আছে। কিন্তু বিবর্ণ উদাস মন? ছাব্বিশ নম্বর লেক অ্যাভিনিউ থেকে ছুটে চলে গেছে দিল্লির সুব্রত পার্কে। পালামের রাস্তার ধারে এয়ার ফোর্স অফিসার্স কলোনীতে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ব্যানার্জী মাত্র এক মাসের টেম্পোরারি ডিউটিতে এয়ার হেড কোয়ার্টার্সে এসেছিল। চিত্রিতা কলকাতায় বি. এ. পরীক্ষা দিয়ে দিল্লি এসেছে। হাতে অফুরন্ত সময়। শুধু সপ্তাহে তিন দিন গন্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ে যাতায়াত। চৈতালীর সঙ্গে তেঁতুলের আচার চুরি করে খাবার পর বাকি সময়টা মাধুরী মাসীর কাছে কাটায়। ঠিক সেই সময়েই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এলো মাধুরী মাসীর কাছে। এখানে না এসে উপায় ছিল না ওর। স্কোয়ার্ডন লীডার ভীষণ রেগে যেতেন। তাছাড়া মিঠু তো আছেই। আম্বালায় কাকার স্কুটারে চড়ে ঘুরে বেড়ালে মিঠু কিছুতেই খেতো না। তাছাড়া ঐ কাকু যে ওকে সুর করে কবিতা শোনাত! মিঠুকে ছেড়ে সেই কাকু দিল্লিতে কোথায় থাকবে?
ভাবতে গিয়েই চিত্রিতা হাসে। বিশেষ কিছুই না। নিছক একটু হাসিঠাট্টা গল্পগুজব। মাঝে মাঝে গান। মাঝে মাঝে মন্তব্য। শরতের আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ। মনটা খুশিতে ভরে যায়।
মাধুরী বৌদি ফ্লাইট লেফটেন্যান্টকে বললেন, চিত্রার গান তোমার যখন এত ভালো লাগে তখন কয়েকটা গান টেপে তুলে নিলেই পার।
তা হয় না বৌদি।
চিত্রিতা বলল, টেপ করার যোগ্য নয় বলে।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট একটু হেসেই গম্ভীর হল। ওর গান তোমাদের সবার সামনে শোনার অধিকার থাকলেও লুকিয়ে একা একা লোনার অধিকার আমার নেই।
মাধুরী বৌদি হঠাৎ বলে ফেললেন, কেন, সে অধিকার চাও?
লজ্জায় চিত্রিতা ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। লজ্জা পেয়েছিল ব্যানার্জীও। তাই তো পরের দিন আবার ও সুপার মার্কেটের বাসস্টপে না দাঁড়িয়ে পারেনি। চিত্রিতা বুঝেছিল ও কিছু বলতে চায়।
আজও কি কফি হাউসে এসেছিলেন?
হ্যা!
আজও কি বাসের জন্যে দাঁড়িয়েছিলেন?
না। ন্যাভিগেটরের জন্য।
আমার মতো হাতুড়ে ন্যাভিগেটর দিয়ে আপনার মতো কোয়ালিফায়েড পাইলটের কোনো উপকার হবে কি?
যেটুকু পথ চিনিয়েছেন তাতেই আমি খুশি। আর ভবিষ্যৎ? সে আমারও হাতে নয়, আপনারও হাতে নয়।
আরো দুচারটে টুকটাক কথার পর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বলল, কাল রাত্রে যা বলেছিলাম তা বলা বোধহয় ঠিক হয়নি। মনে কিছু করবেন না।
চিত্রিতা কিছুক্ষণ মুখ নীচু করে চুপচাপ থাকার পর বলল, না না, কিছু মনে করিনি।
কিছু মনে না করলেও লজ্জা পেয়েছিলেন, কিন্তু আপনাকে লজ্জা দেবার অধিকারও তো আমার নেই।
এই পৃথিবীতে প্রায় সবাই নিত্য নতুন অধিকার চায়। দাবি জানায়। অথবা মনে মনে আশা করে। স্বপ্ন দেখে। কিন্তু ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের মতো কজন অধিকার ছাড়তে পারে? দাবি করার সুযোগ পেয়েও নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে?
যারা হাত পাতে, দাবি জানায়, তাদের প্রত্যাখ্যান করা যায়। কিন্তু যারা নিজের জন্য কিছু চায় না, দাবি জানায় না, তাদের জন্য অনেকেরই মন ব্যাকুল হয়। হয়তো চিত্রিতারও হয়েছিল। বুঝতে পারেনি। হঠাৎ এতদিন পর মনটা বেদনায় ভরে গেল। পুরনো দিনের হিসেবের খাতা ওল্টাতে গিয়ে চিত্রিতা যেন আবিষ্কার করল ঋণের বোঝা শোধ করা হয়নি।
এখন উপায়?
ছাব্বিশ নম্বর লেক অ্যাভিনিউয়ের দোতলার ফ্ল্যাটের বেডরুমে বসে আর তো সে ঋণ শোধ করা যাবে না। কখনও যায় না। ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। কোনো রাস্তা নেই। ব্যাঙ্কে টাকা থাকলেই কি চেক কাটা যায়? চিত্রিতার সব কিছুই তো ফিক্সড ডিপোজিট আর সেফ ডিপোজিট ভল্টে। সব সম্পদই ওর, কিন্তু চাবিকাঠি তো ওর কাছে নেই। চুরি করতে পারে সে চাবিকাঠি! কিন্তু তবুও তো ঋণের বোঝা নামাবার উপায় নেই। ও নেবে কি সে সম্পদ?
কিছুতেই না। অসম্ভব। কল্পনাতীত।