ভাবতে গিয়েই চিত্রিতার একটা ছোট্ট দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ল। পড়বেই। এ যে সেই সিফন জর্জেট। স্মৃতির অরণ্যে ছোট্ট একটা হাস্নাহানা। তা হোক। ভারি মিষ্টি গন্ধ। সুন্দর নিটোল একটা স্বপ্ন। মালিন্যমুক্ত একটু ভালো লাগা। অনন্য অনুভূতির ক্ষণিক জোয়ার।
ভেবেছিল স্নান করতে যাবে! চুল ঠিক করে বাথরুমে শাড়িটাড়িও রেখে এসেছে পিয়ন আসার আগে। এখন আর যেতে ইচ্ছা করছে না। কোলের পর প্যাকেটটা নাড়াচাড়া করতে করতে বিছানাতেই বসে রইল। চুপ করে বসে রইলো। কিন্তু মন? সে তো চুপ করে বসে থাকতে জানে না, পারে না। সামান্য একটু হাওয়াতেই সিফন জর্জেট উড়তে থাকে। মনে পড়ে সেদিনের কথা।
সুপার মার্কেটের বাস স্টপে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ব্যানার্জীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিত্রিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? আপনি এখানে?
বাসের জন্য অপেক্ষা করছি।
কোথায় যাবেন?
কোথায় আবার? সুব্রত পার্কে ফিরব।
তা এখানে কেন? আসুন আমার সঙ্গে।
চিত্রিতার কথামতো ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এগুতেই বাস স্টপের লোকজন সবস দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে রইল। দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে। একটু পরেই ব্যানার্জী জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যাবেন?
আমিও বাড়ি ফিরব।
এদিকে বুঝি বেড়াতে এসেছিলেন?
না, না। গানের ক্লাস করতে এসেছিলাম।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট চিত্রিতার মুখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করল, সুব্রত পার্ক থেকে কনট প্লেস?
চিত্রিতাও একটু হাসল। হ্যাঁ।
এখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার ভালো স্কুল আছে বুঝি?
দিল্লীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার কোনো ভালো স্কোপ নেই বললেই চলে…
তাহলে?
আমি গন্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ক্লাসিক্যাল শিখছি।
হঠাৎ টপপা-ঠুংরীর প্রেমে পড়লেন?
চিত্রিতা আবার একটু হাসে। মার হুকুম তামিল করছি। মনে মনে ভাবে পরশুদিন রাত্রে যখন প্রথম পরিচয় হয়, তখন ভাবতে পারেনি উনি এত সুন্দর কথা বলতে পারেন।
আপনার মা বুঝি ক্ল্যাসিক্যালের ভক্ত?
স্টেটসম্যানের মোড় পার হয়ে চিত্রিতা জবাব দেয়, না, তা নয়। মেনলি গলা ভালো হবে বলেই মা ক্ল্যাসিক্যাল শিখতে বললেন।
আপনার গলা যথেষ্ট ভালো। আর ভালো হবার দরকার নেই।
জনপথের মোড়ে থমকে দাঁড়িয়ে চিত্রিতা হাসিমাখা ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের দিকে ঘুরিয়ে বলল, তাই নাকি?
অব কোর্স!
সিফন জর্জেটের প্যাকেটটা পেয়ে সবকিছু মনে পড়ছে চিত্রিতার। মনে পড়ে মেল ট্রেন মাঝে মাঝে হঠাৎ ছোট্ট স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়লে ভারি ভালো লাগে। অনেক দিন পর্যন্ত ভোলা যায় না স্টেশন মাস্টারের মুখখানা। বার বার মনে পড়ে রেলকোয়ার্টারের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা স্টেশন মাস্টারের স্ত্রীর বিবর্ণ বিস্মিত মুখের ছবি। বিয়ের নেমন্তন্নে গিয়ে অনেক সময় বরের চাইতে একজন বরযাত্রীর কথা বেশিদিন মনে থাকে।
.
গ্রুপ ক্যাপ্টেন ঘোষ আর স্কোয়ার্ডন লীডার রায়ের কোয়ার্টার প্রায় পাশাপাশি। গ্রুপ ক্যাপ্টেন কমান্ড হেড কোয়ার্টাসে আর কোয়ার্ডন লীডার পালামে পোস্টেড। তা হোক পরিচয় বহু দিনের। সম্পর্ক নিবিড়। এই গ্রুপ ক্যাপ্টেন যখন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তখন চিত্রিতার জন্ম। চৈতালী যখন খুব ছোট্ট, তখনই রায় কাকুর সঙ্গে মাধুরী মাসীর বিয়ে হয়। আবার মিঠ যখন হয় তখন চিত্রিতারাও আগ্রায়। মিঠু হবার পর মাধুরী নাসীর শরীরটা বেশ খারাপ। মাধুরী মাসী ওর কিছুই দেখাশুনা করতে পারত না। মি? চিত্রিতার মার কাছেই থাকত। দিন রাত। তাই তো মি ওকে বড়মা বলে। মিঠ আজ কত বড় হয়ে গেছে; তবু বড়মার কাছে আব্দার করতে সঙ্কোচ নেই।
অনেক কাল পরে আবার দুটি পরিবার দিল্লিতে। সুব্রত পার্কে প্রায় পাশাপাশি কোয়ার্টার। ভারি মজা। চিত্রিতার মা আর মাধুরী মাসী পালামের ফেটেতে একসঙ্গে ঈল খুলছেন, লুচিআলুর দম বিক্রি করছেন। আবার রবিবার সকালে দুজনে একসঙ্গে ডিলাইটে সত্যজিৎ রায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি দেখছেন। আরো কত কি! দুর্গাপূজার সময় আর কেউ না গেলেও ওঁরা দুজনে ঠিক সারা রাত জেগে শ্রীমতী অপেরার যাত্রা দেখবেনই। চৈতালীকে না হলেও চিত্রিতাকে ওরা দলে টানতে চান। বিশেষ করে মাধুরী মাসী। কিরে চিত্রা, যাবি নাকি যাত্রা দেখতে?
না মাসী, যাত্রা দেখার কথা বোলো না।
কেন রে?
যাত্রাটাত্রা আমার ভালো লাগে না।
যাত্রা কোনোদিন দেখেছিস?
না!
তাহলে ভালো লাগবে না কি করে জানলি?
চিত্রিতা হাসতে হাসতে বলে, সারা রাত ধরে রাজারানি ষাড়ের মতো চেঁচাবে আর মন্ত্রীরা টিনের তলোয়ার ঘোরাবে, তা আমি সহ্য করতে পারব না।
ওর কথা শুনে মাধুরী মাসীও হাসে। হাজার হোক কলেজ গার্ল তো! গ্রেগরি পেক বা রিচার্ড বার্টনকে না দেখলে ঠিক মন ভরে না তোদের।
দুই ফ্যামেলির জয়েন্ট সেসন বসলে চিত্রিতার যাত্রা না দেখার কথা উঠবেই। সব কিছু শোনার পর স্কোয়ার্ডন লীডার রায় আবার সঙ্গে সঙ্গে একটা কবিতা তৈরি করে বলেন,
আমাদের চিত্রা
দেখে না যাত্রা।
খায় শুধু কেক
পছন্দ করে গ্রেগরি পেক!
চুরি করে মটন
ভালোবাসে বার্টন
গাইতে পারে গান
আর আছে অভিমান।
কবিতার প্রত্যেকটি লাইন পর্যন্ত স্পষ্ট মনে পড়েছে চিত্রার। মনে পড়বে না? রক্তরাঙা কৃষ্ণচূড়ার মতো সেসব দিনের স্মৃতি জ্বল জ্বল করছে মনের মধ্যে। রোজ মনে পড়ে না। মনে পড়তে পারে না। নতুন জীবনের জোয়ারে পুরনো স্মৃতির পলিমাটি পড়ছে। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। স্মৃতির সূর্য মনের আকাশে উঠলেই নতুন পলিমাটিতে ফাটল ধরে। চাপা পড়া সুখদুঃখের মিষ্টি মধুর ইতিহাস আবার মুখোমুখি দাঁড়ায়।