হঠাৎ খেয়াল হয়, আমি বিভোর হয়ে মানুষ দেখছি, আমার কামরায়, স্টেশনে, প্ল্যাটফর্মে। আহা! কী চোখ! শুধু সুন্দর নয়, অপূর্ব! এর আগে আর কোথাও দেখিনি। না দেশে, না বিদেশে। ভূমধ্য সাগরের পারে, নাইলের পাড়ে, গ্রীসের ধবংসপের পাশে পৃথিবীর সব চাইতে সুন্দর মানুষদের দেখেছি। এখানকার সুন্দরীরা যুগ যুগ ধরে সারা পৃথিবীর পুরুষকে মুগ্ধ করেছে কিন্তু তাদের এমন চোখ নেই। বোধহয় এদেবই কাউকে দেখে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ
টিকিটবাবু টিকিট চাইতেই সম্বিত ফিরে এল। শুধু আমাব না, গাড়ির সবার টিকিট পরীক্ষা করলেন উনি। অবাক হলাম, সবারই টিকিট আছে। টিকিট পরীক্ষা শেষ করে টিকিটবাবু আমারই পাশে বসলেন। এমন বন্ধু এত কাছাকাছি আর পাইনি! তাই তাকেই বললাম, মাঝপথে ট্রেন বদলে আমাকে আমার গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হবে কিন্তু এ গাড়ি তো পৌঁছবার দুঘণ্টা আগেই ও গাড়ি ছেড়ে দেবে।
টিকিটবাবু হেসে বললেন, এ গাড়ি এ রকমই চলে। আপনি বরং সামনের স্টপেজেই নেমে পড়ুন। টিকিটবাবু আরো বললেন, দু তিন টাকার লোকসান হলেও অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছবেন
গাড়ি থামতেই নেমে পড়লাম। মাত্র দুতিনজন যাত্রী ওঠানামা করতেই গাড়ি আবার ছেড়ে দিল। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম গাড়ি এগিয়ে চলেছে মাঠের মধ্যে। না দেখে পারলাম না। যে গাড়িতে বসে এত কিছু দেখেছি তাকে বিদায় না জানিয়ে দৃষ্টি ঘোরাতে পারলাম না।
এটা স্টেশন নয়, হল্ট। হিন্দি, ইংরেজি, গুজরাতিতে লেখা পরিচয়লিপি থেকে চোখ ঘোরাতেই দেখি, মাস্টারবাবু অবাক হয়ে আমাকে দেখছেন। পরনে ধুতি কিন্তু তার উপর রেল কোম্পানির কোট। বয়স বেশি নয়, বোধহয় ত্রিশবত্রিশ। খুব বেশি হলে চৌত্রিশ পঁয়ত্রিশ। তার বেশি কখনই নয়। এমন কিছু সুপুরুষ না হলেও চেহারাটি মোটামুটি ভালোই।
প্ল্যাটফর্ম বলে কিছু না থাকলেও দু দিকের দুটি পরিচয়লিপির মাঝখানের লম্বা জমিটুকুর উপরই মাস্টারবাবু দাঁড়িয়ে। ওর পিছনেই ছোট্ট একটা ঘর। নিঃসন্দেহে ওটাই ওর অফিস ঘর। তাকিয়ে দেখি, ঐ অফিস ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে একজন বৃদ্ধ ও একজন কিশোরীও মাস্টারবাবুর মতোই অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। মনে মনে হাসি। ভাবি, ওরা কী কোনোদিন আমার মতো মানুষ দেখেনি।
আমি মাস্টারবাবুর দিকে এগুতেই মেয়েটি দৌড়ে কোথায় চলে গেল।
তারপর মাস্টারবাবুর কাছে গিয়ে প্রথমে নমস্কার, পরে আমার সমস্যার কথা বললাম। উনি বাসের খবর না দিয়ে প্রশ্ন করলেন, কোথায় থাকেন?
দিল্লিতে
শুনে উনি অবাক, দিল্লিতে থাকে?
হ্যাঁ।
দিল্লিতে কোন ডিপার্টমেন্টে আছেন?
আমি কোনো ডিপার্টমেন্টে নেই।
আপনি চাকরি করেন না?
হ্যাঁ, করি।
তবে বলছেন, কোনো ডিপার্টমেন্টেই নেই।
আমি সরকারি চাকরি করি না।
তবে আবার দিল্লিতে কী চাকরি করেন?
আমি খবরের কাগজে কাজ করি।
মাস্টারবাবু চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বললেন, আপনি জার্নালিস্ট?
হ্যাঁ।
আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করেই মাস্টারবাবু বললেন, আসুন, আসুন।
ওকে অনুসরণ করে ওর অফিস ঘরে আসি। ঘরে একটা চেয়ার, একটা টেবিল, একটা আলমারি, একটা বেঞ্চ। আমাকে চেয়ারখানা এগিয়ে দিয়ে বললেন, বসুন।
আমি ওর অনেক অনুরোধ-উপরোধ উপেক্ষা করেও বেঞ্চিতে বসলাম। অনেক দ্বিধা সঙ্কোচের সঙ্গে উনি চেয়ারে বসেই হাঁক দিলেন, রতিলাল!
বৃদ্ধ রতিলাল আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই দরজার আড়ালে লুকিয়েছিল। মাস্টারবাবুর হাঁক শুনে এবার সে আত্মপ্রকাশ করতেই হুকুম হল, কৃষ্ণাকে তাড়াতাড়ি চা করতে বল।
কৃষ্ণা! মেয়েটির নাম শুনে একটু অবাক হলেও মুখে কিছু বললাম না।
এবার মাস্টারবাবু আবার আমাকে প্রশ্ন করেন, আপনি কী দিল্লিরই লোক? মানে আপনি কী পাঞ্জাবি?
আমি বাঙালি।
এতক্ষণ হিন্দিতেই কথাবার্তা চলছিল। এবার উনি প্রায় পাগলের মতো চিৎকার করে বাংলায় বললেন, আপনি বাঙালি?
আমিও বাংলায় জবাব দিলাম, হ্যাঁ।
চিৎকার শুনে রতিলাল ছুটে আসে। ও কিছু বলার আগেই মাস্টারবাবু বলেন, রতিলাল, বহু বছর পর একজন বাঙালি পেয়েছি। তুমি আমার সাইকেল নিয়ে চটপট সৈয়দের কাছে গিয়ে একটু মাছ নিয়ে এসো। একটুও দেরি করো না।
আমি কিছু বলতে গেলাম কিন্তু ওরা কেউ আমার কথায় কান দিলেন না। রতিলাল মাস্টারবাবুর হুকুম শুনেই প্রায় উড়ে গেল। মাস্টারবাবুও সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পাঁচসাত মিনিট পরেই ফিরে এলেন। হাতে এক প্লেট ভর্তি মিষ্টি। ওর পিছনেই কৃষ্ণা। হাতে দুকাপ চা। পরনে সুন্দর রঙিন শাড়ি। মাথায় ঘোমটা। হাতে চা নিয়েই ও মাথা নিচু করে বলল, নমস্কার বাবুজী।
আমি কৃষ্ণার মুখে বাংলা শুনে অবাক বিস্ময়ে বলি, তুমি বাঙালি?
কৃষ্ণা ডান হাত দিয়ে ঘোমটা একটু টেনে একটু হেসে মাথা নেড়ে বলে, না বাবুজী, আমাদের দেশ জেতপুরের ওদিকে। আমি বাংলা জানি। মাস্টারবাবু আমার গুরু আছে।
আমি হেসে বলি, তাই নাকি?
কৃষ্ণাও হাসে। বলে, হ্যাঁ
আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলি, তোমার নামটিও খুব সুন্দর।
ও মুখ নিচু করে হাসতে হাসতেই বলে, সেটাও মাস্টারবাবুর কৃপা।
এবার আমি মাস্টারবাবুর দিকে তাকাই। দেখি উনিও হাসছেন। বললেন, হ্যাঁ, আমিই ওর নাম রেখেছি কৃষ্ণা। ভারি ভালো মেয়ে।
প্রশংসা শুনে কৃষ্ণা লজ্জায় প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যায়। অনেক কষ্টে বলে, আমি ঘরে যাবে বাবুজী?