কোয়েল বলল, তোমার মতো হ্যান্ডসাম ছেলে যৌবনে প্রেমে পড়েনি, তাই কখনো হয়?
ওদের কাণ্ডকারখানা দেখে মিসেস চৌধুরী শুধু হাসেন।
দোয়েল বৃদ্ধের মুখের সামনে মুখ নিয়ে প্রশ্ন করে, যে মেয়েটিকে ভালোবাসতে, তার নাম কি?
শিউলি।
কোয়েল চিৎকার করে বলে, হাউ রোমান্টিক!
দোয়েল আবার প্রশ্ন করে, উনি নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী ছিলেন?
হ্যাঁ, বড় বউ, শিউলি খুবই সুন্দরী ছিল।
বৃদ্ধ অনিলবাবু মুহূর্তের জন্য থেমে একটু হেসে বলেন, ও লেখাপড়ায় যেমন ভালো ছিল, সেইরকমই ভালো গান গাইতে পারতো।
কোনোমতে হাসি চেপে কোয়েল জিজ্ঞেস করে, কিভাবে তোমাদের ভাব হল?
বৃদ্ধ চাপা হাসি হেসে বলেন, আমার বাবার মতো শিউলির বাবাও রেলের ডাক্তার ছিলেন। আমরা পাশাপাশি বাংলোয় থাকতাম।
প্রথম যখন আলাপ হয়, তখন তোমাদের বয়স কত?
গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করে দোয়েল।
আমাদের কারুরই বয়স বেশি ছিল না। বলতে পারো কিশোর-কিশোরীর প্রেম; কিন্তু দুজনেই দুজনকে খুব ভালোবাসতাম।
কোয়েল হাসতে হাসতে বলে, দাদুন, তুমি কি পাকাই ছিলে!
যাই বলো ছোট বউ, শিউলিকে দেখলে বা তার সঙ্গে মেলামেশা করলে তোমরাও তাকে না ভালোবেসে থাকতে পারতে না।
দোয়েল প্রশ্ন করে, শিউলিকে বিয়ে করলে না কেন?
আমার বাবা তখন কলকাতা থেকে ধানবাদ বদলি হয়ে গেছেন। আমি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি। ঐ সময় হঠাৎ জানতে পারলাম, শিউলির বাবা-মা অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছেন।…
ও মাই গড!
দোয়েলের মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে যায়।
ঐ অ্যাকসিডেন্টের পরই শিউলি আর ওর দিদিকে বোধহয় কোনো আত্মীয় নিয়ে যায় কিন্তু আমরা ওদের ঠিকানা না জানায় কোনো চিঠিপত্রও লিখতে পারলাম না।
কিন্তু উনি তো তোমাদের ঠিকানা জানতেন!
দোয়েল মুহূর্তের জন্য না থেমেই বলেন, উনি তো তোমাকে চিঠি দিতে পারতেন।
বৃদ্ধ অনিলবাবু মান হাসি হেসে বলেন, বড় বউ, মিসফরচুন নেভার কামস্ অ্যালোন। ঠিক ঐ সময়ই আমার বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন আর আমিও সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া ছেড়ে চাকরি করতে শুরু করলাম।
উনি একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, শিউলি নিশ্চয়ই আমাকে চিঠি দিয়েছিল কিন্তু ওর চিঠি আসার আগেই তো আমি বেনারস ছেড়ে চাকরি নিয়ে কটক চলে গেছি।
মিসেস চৌধুরী মুখ নীচু করে থাকেন। দোয়েল আর কোয়েলও কিছুক্ষণ কথা বলতে পারে না। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোয়েল বলে, রিয়েলী ভেরি আনরচুনেট!
এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর মিসেস চৌধুরী একটু হেসে অনিলবাবুকে বললেন, এত কাল যে কথা কাউকে বলতে পারেননি, তা এই দুই বউকে বলে দিলেন?
কী করব বলুন, এদের তো মিথ্যে কথা বলতে পারি না। ওরা দুজনেও তো আমার কাছে কোনো কিছু গোপনও করে না, মিথ্যেও বলে না।
না, না, আপনি ঠিকই করেছেন। এদের দুজনের চাইতে ভালো বন্ধু তো আপনার হতে পারে না।
কোয়েল হাসতে হাসতে বলে, জানেন দিদা, আমাদের তিনজনের একটা আলাদা জগৎ আছে। সেখানে আমাদের মা-বাবারও নো অ্যাডিমিশন!
মিসেস চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, তোমাদের ঐ তিনজনের জগতে একটু ঠাঁই পাবো না?
দোয়েল সঙ্গে সঙ্গে বলে; আপনাকে ঠাঁই না দিলে কী আপনি আমাদের এইরকম সিক্রেট মিটিং-এ থাকতে পারতেন?
যাই হোক দিনগুলো বেশ কেটে যায়।
সেদিন সকালে মিসেস চৌধুরীর ঘরে বসে দোয়েল-কোয়েল গল্পগুজব করছিল। হঠাৎ একথা সেকথার পর দোয়েল বলল, দিদা, কলকাতায় ফিরে যাবার পর আমাদের ভুলে যাবেন না তো?
না, দিদি, তোমাদের কাউকেই ভুলতে পারবো না।
মিসেস চৌধুরী একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, দিদি, এ সংসারে কিছু কিছু মানুষকে সারা জীবনই একা থাকতে হয়। আমি এইরকমই এক অভাগিনী। আমি কারুর বাড়িতেই বিশেষ যাই না
কিন্তু দিদা…
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই উনি বললেন, না, দিদি, আমাকে জোর করো না। আমি একা একা লুকিয়ে-চুরিয়ে চোখের জল ফেলেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চাই।
উনি দুহাত দিয়ে ওদের দুজনকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, তোমাদের সঙ্গে কটা দিন কাটিয়ে যে আনন্দ পেলাম, তা সারা জীবনেও পাইনি। তোমাদের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না।
পরের দিন সকালে দাদুনকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে দোয়েল-কোয়েলের সঙ্গে ওদের এক বন্ধু ও তার মা বাবার সঙ্গে দেখা। ঐ বন্ধু জোর করে দোয়েল-কোয়েলকে ওদের হোটেলে নিয়ে গেল। বলল, সন্ধের আগেই ফিরে আসবে।
বিকেলবেলায় চা খেয়ে অনিলবাবু বারান্দায় বসে ছিলেন নাতনিদের পথ চেয়ে। হঠাৎ মিসেস চৌধুরী হাজির।
অনিলবাবু মুহূর্তের জন্য ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, বেড়াতে বেরুচ্ছেন?
আমি কলকাতা ফিরে যাচ্ছি।
আজই?
হ্যাঁ।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমেই হঠাৎ নীচু হয়ে অনিলবাবুকে প্রণাম করেই ম্লান হাসি হেসে বললেন, আমাকে চিনতে পারলে না?
অনিলবাবু অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলেন, না, ঠিক…
আমি শিউলি।
তুমি, শিউলি?
হ্যাঁ।
মিসেস চৌধুরী আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরে ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সিফন জর্জেট
পিয়ন রেজিস্টার্ড পার্সেলের প্যাকেটটা এগিয়ে দিতেই চিত্রিতা মনে মনে একটু চঞ্চল হয়ে পারল না। পিয়ন চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা বন্ধ করে সোজা শোবার ঘরে চলে গেল। প্যাকেটটা খুলল না। খোলার দরকার নেই। মা যখন পাঠিয়েছেন তখন সেই সিফন জর্জেটটাই ভেতরে আছে।
সিফন জর্জেট!