কোয়েল বাড়ি থেকে যা খেয়ে এসেছেন, তা এতক্ষণে হজম হয়ে গেছে।
দোয়েল বলে, এই ছোট্ট ছোট্ট দুচারটে লুচি খেতে আপনার কোনো কষ্ট হবেনা। আমরা তিনজনে খাবো আর আপনি খাবেন না, তাই কখনো হয়?
কিন্তু…
না, না, দিদা, এক যাত্রায় পৃথক ফল হতে পারে না। নিন, নিন, ধরুন।
মিসেস চৌধুবী প্লেট হাতে নিতেই কোয়েল ওর দিকে তাকিয়ে বলে, দ্যাটস্ লাইক এ গুড গার্ল!
ওর কথা শুনে উনি না হেসে পারেন না।
খেতে খেতেই মিসেস চৌধুরী অনিলবাবুব দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনার এই দুটি নাতনি কী যমজ?
হ্যাঁ।
কোয়েল সঙ্গে সঙ্গে পাশ ফিরে বলে, দাদুন, মিথ্যে কথা বলছ কেন?
ও মিসেস চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে, আমরা যমজ না। দিদি আমার থেকে সাত মিনিটের বড়।
মিসেস চৌধুরী চাপা হাসি হেসে বলেন, তাহলে তো তোমরা যমজ না!
লুচি-আলুর দমের পর্ব শেষ হতেই দোয়েল সবাইকে মিষ্টি দেয়।
মিষ্টি খেতে খেতেই মিসেস চৌধুরী দোয়েল-কোয়েলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা বুঝি একটু রাত করে খাওয়া-দাওয়া করো?
কোয়েল সঙ্গে সঙ্গে বলে, হ্যাঁ
দোয়েল বলে, দশটা পর্যন্ত তো আমরা পড়াশুনাই করি। তারপর আমরা সবাই মিলে একটু আড্ডা দেবার পরই সবাই একসঙ্গে খেতে বসি।
তোমার দাদুনও অত রাত্রে খাওয়াদাওয়া করেন?
ও হাসতে হাসতে বলে, আমরা দুই বউ দুপাশে না বসলে তো বুড়ো যেতেই পারে না।
কোয়েল সঙ্গে সঙ্গে বলে, জানেন দিদা, এই বুড়ো যেমন আমাদের দুজনকে দুপাশে না নিয়ে ঘুমুতে পারে না, আমরা দুজনেও বুড়োকে কাছে না নিয়ে শুতে পারি না।
তোমাদের দাদুন সত্যি ভাগ্যবান।
এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর অনিলবাবু মিসেস চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলেন, হ্যাঁ, সত্যি আমি ভাগ্যবান! শুধু এরা দুজনে না, আমার ছেলে আর পুত্রবধূও অসম্ভব ভালো।
দাদুনকে শুইয়ে দেবার পর দোয়েল-কোয়েল উপরের বার্থে যায়। দোয়েল বার্থের বাইরে মুখে নিয়ে মিসেস চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করে, দিদা, আপনি কোথায় উঠবেন?
আমি ববাবরই হালদার মশায়ের পুরী হোটেলে উঠি।
ও একটু উত্তেজিত হয়ে বলে, আমরাও তো পুরী হোটেলেই উঠব।
কোয়েল সঙ্গে সঙ্গে বলে, দিদা, আমরা পাশাপাশি ঘরে থাকব। আপনি পাশের ঘরে থাকলে খুব মজা হবে।
মিসেস চৌধুরী একটু হেসে বলেন, তোমাদের দুজনকে কাছে পেলে তো আমিও আনন্দে থাকব।
হ্যাঁ, ওরা পাশাপাশি ঘরেই থাকেন। এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়া গল্পগুজব আর সমুদ্রের ধারে, জগন্নাথ মন্দিরের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে দুতিনটে দিন বেশ কেটে যায়।
সেদিন সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। বাইরে না বেরিয়ে ঘরে বসেই ওরা সবাই গল্পগুজব করছিলেন। হঠাৎ কথায় কথায় মিসেস চৌধুরী অনিলবাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, দাদা, বৌদিকে সঙ্গে আনলেন না কেন?
উনি একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, সে বহুকাল আগেই মারা গিয়েছে।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, আমার ছেলে যখন মাত্র ছ’বছরের তখনই আমার স্ত্রী মারা যান।
কথাটা শুনেই মিসেস চৌধুরী অবাক হন। সঙ্গে সঙ্গেই উনি প্রশ্ন করেন, তখন ঐটুকু বাচ্চাকে কে দেখাশুনা করতেন?
অনিলবাবু জবাব দেবার আগেই দোয়েল বলে, দাদুনই তো বাবাকে মানুষ করেছেন।
ও প্রায় না থেমেই একটু হেসে বলে, বাবা তো আমাদের দুই বোনকে সব সময় বলেন, তোমাদের চাইতে তোমাদের দাদুনকে আমি হাজার গুণ বেশি ভালোবাসি।
মিসেস চৌধুরী একটু হেসে বলেন, এটা উনি মজা করে বলেন।
কোয়েল বলে, না, না, দিদা, বাবা সত্যি দাদুনকে অনেক বেশি ভালোবাসে।
দোয়েল ডান হাত দিয়ে দাদুনের গাল টিপে আদর করে মিসেস চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে একটু চাপা হাসি হেসে বলে, বাবা-মা যাকে ইচ্ছে ভালোবাসুক, আমরা এই বুড়োকে নিয়ে মহা সুখে আছি।
ওর কথা শুনে মিসেস চৌধুরী একটু হেসে বলেন, সে তো আমি নিজের চোখেই দেখছি।
উনি একটু থেমে অনিলবাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আপনার স্ত্রী যখন মারা যান, তখন আপনার বয়স কত
ঠিক তিরিশ।
মাত্র তিরিশ?
হ্যাঁ।
ঐ বয়সে তো অনেকে বিয়েই করেন না।
মিসেস চৌধুরী প্রায় এক নিঃশ্বাসেই প্রশ্ন করেন, আপনি আবার বিয়ে করলেন না কেন?
অনিলবাবু একটু হেসে বলেন, মা জোর করে বিয়ে না দিলে আমি বিয়েই করতাম না। দ্বিতীয় বার বিয়ের কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।
কোয়েল সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করে, দাদুন, তুমি বিয়ে করতে চাওনি কেন?
এমনি।
ইস! কি আমার সাধু?
দোয়েল গম্ভীর হয়ে বলে, দাদুন, আমরা কচি বাচ্চা না। আমরা মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে পড়ছি। আমাদের বোকা বানাবার চেষ্টা করো না। সত্যি করে বলল, কেন বিয়ে করতে চাওনি।
বৃদ্ধ হাসতে হাসতে বলেন, সত্যি বলছি বড় বউ, আমি এমনি বিয়ে করতে চাইনি।
কোয়েল ফৌজদারি উকিলের মতো জেরা করে, সত্যি করে বলো তো কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছিলে কিনা।
ওর প্রশ্ন শুনে শুধু অনিলবাবু না, মিসেস চৌধুরীও হো হো করে হেসে ওঠেন।
দাদুন, হাসি দিয়ে ছোট বউকে ভোলাতে পারবে না। আমার কথার জবাব দাও।
সত্যি বলছি ছোট বউ…
বৃদ্ধকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই দোয়েল বিদ্যুৎ গতিতে ওর দুটি হাত ওদের দুই বোনের মাথায় চেপে ধরে গম্ভীর হয়ে বলে, আমাদের মাথায় হাত দিয়ে মিথ্যে কথা বলবে না।
বৃদ্ধ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, হ্যাঁ, বড় বউ, আমি সত্যি একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম।
দোয়েল সঙ্গে সঙ্গে বলে, দ্যাটস্ লাইক এ গুড বয়।