প্রজ্জ্বল চমকে উঠল, মণিমালার জন্য?
হা! তুমি জান না কিছু?
না তো।
ওর বিয়ে তো তুমি দেখে গিয়েছ?
না না, আমি তো জানি না ওর বিয়ে হয়েছে!
তাই বুঝি? মায়াববৗদি একটু থেমে বললেন, আরে বোলো না ভাই। ছমাসের মধ্যে মেয়েটার সর্বনাশ হল।
বল কি?
হ্যা ভাই। তুমি কিছুই জানতে না?
না।
মায়াবৌদি চলে গেল। প্রজ্জ্বল সিগারেটটা হাতে নিয়ে পাথরের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ। তারপর হঠাৎ খেয়াল হতেই সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ইন্সপেকশন বাংলোয় ঢুকল। বারান্দা পার হয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়েই মণিমালার সঙ্গে দেখা। একেবারে মুখোমুখি। প্রজ্জ্বল থমকে দাঁড়াল কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারল না। মণিমালাই আগে কথা বলল, কি হল? অমন করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
মুখ নীচু করে ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে প্রজ্জ্বল তবুও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
কি হল? কথা বলছেন না যে?
আমি কিছুই জানতাম না মণিমালা।
মণিমালা হাসল, জেনে আর কি হবে?
আবার একটু নীরবতা।
একটু হাতটা দেবে?
কেন?
দাও না।
আঁচলটা টেনে নিয়ে মণিমালা ডান হাতটা বাড়িয়ে দিতেই দুহাতের মধ্যে ওর হাতটা ধরে বলল, আকাশ আমার ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে।
তাড়াতাড়ি হাতটা টেনে নিয়ে মণিমালা বলল, কি পাগলামি করছেন?
সময় নেই মণিমালা। কথা দাও।
কি কথা দেব?
তুমি আমার আকাশ আলোয় আর গানে ভরিয়ে দেবে।
তাই কি হয়?
হয়।
তা হয় না।
হয়। নিশ্চয়ই হয়। হতেই হবে। তুমি কথা দিলেই হবে।
কিন্তু
প্রজ্জ্বল মুহূর্তের জন্য দুহাত দিয়ে ওর মুখখানা তুলে বলল, বোধহয় তোমাকে পাব বলেই এই পিকনিকে এসেছিলাম, তাই না?
মণিমালা দাঁড়িয়ে রইল। প্রজ্জ্বল ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল।
.
মামী
জয়পুর ফিরে এসেও বার বার মণিমালার কথা মনে পড়ছে।
মন্দির আছে, বিগ্রহ আছে, অথচ শুধু পূজারীর অভাবে ওর
জীবন এমন ভাবে নষ্ট হতে পারে না। আমি আছি।
আমি রইলাম।
তোমাদের স্নেহের মানা।
শিউলি
মালপত্র গুছিয়ে রাখার পর হট কেসটাকে দেখিয়ে শৈবাল বললেন, দোয়েলকোয়েল, তোমরা আগে দাদুনকে খাইয়ে দিও। তারপর তোমরা দুজনে..
উনি কথাটা শেষ করার আগেই দোয়েল একটু হেসে বলল, তোমার ভয় নেই। তোমার বাবাকে আমরা না খাইয়ে রাখব না।
এবার উনি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমরা দাদুনকে একলা রোখে কোথাও যাবে না। দাদনের সব কথা শুনবে।
কোয়েল সঙ্গে সঙ্গে দাদুনের গলা জড়িয়ে ধরে বেশ গম্ভীব হয়ে বলে, এই বুড়ো! শুনলে তো ছেলের কথা? আমাদের পারমিশান না নিয়ে তুমি কোথাও যেতে পারবে না।
দোয়েল বলে, তুই কিছু চিন্তা করিস না কোয়েল। পুরীতে তো দাদুন ছেলেকেও কাছে পাবে না, পুত্রবধূকেও কাছে পাবে না। আমরা যা বলব, বুড়োকে তাই শুনতে হবে।
ওদের কথায় শুধু শৈবাল আর বৃদ্ধ অনিলবাবু না, সামনের বার্থের বৃদ্ধা ও মধ্যবয়সী ভদ্রলোকও হাসেন।
শৈবাল ঐ ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করেন, আপনারাও কী পুরী যাচ্ছেন?
উনি পাশের বৃদ্ধাকে দেখিয়ে বলেন, আমার মামীমা যাচ্ছেন। আমি যাচ্ছি না।
শৈবাল বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বলেন, মাসীমা, আপনিও মেয়ে দুটোর দিকে একটু খেয়াল রাখবেন।
দোয়েল সঙ্গে সঙ্গে বলে, দিদাকে কিছু করতে হবে না। আমরাই দিদাকে দেখব।
বৃদ্ধা এক গাল হাসি হেসে বলেন, আমার মত বুড়িকে দেখাশুনা করতে তোমাদের কষ্ট হবে না তো?
না, না, কিছু কষ্ট হবে না।
দোয়েল মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, এই বুড়োকে যদি সামলাতে পারি, তাহলে আপনার মত সুন্দরী দিদাকে দেখাশুনা করতে আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না।
বৃদ্ধা চাপা হাসি হেসে বলেন, আমাকে আর সুন্দরী বলো না। তোমাদের মত সুন্দরী তো চোখেই পড়ে না।
কোয়েল বলে, ও কথা বলবেন না দিদা। আপনাকে এই বয়সেই যখন এত সুন্দর দেখতে, তখন অল্প বয়সে যে কত সুন্দর ছিলেন, তা ভাবাই যায় না।
উনি চাপা হাসি হেসে বলেন, তোমরা যাই বলো না কেন, আমি অল্প বয়সেও তোমাদের মত সুন্দর ছিলাম না।
বৃদ্ধ অনিলবাবু একবার হাতের ঘড়ি দেখেই ছেলেকে বললেন, হ্যাঁরে খোকা, তুই এবার যা। বাড়িতে বৌমা একলা আছেন।
দোয়েল বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাবা, তুমি যাও। মায়ামাসী আজ কাজে আসবে না। মা অনেকক্ষণ একলা একলা আছে।
শৈবাল বাবাকে প্রণাম করার পর দুই মেয়েকে একটু আদর করে ট্রেন থেকে নামার আগে বলেন, তোমরা রোজ একবার করে ফোন করতে ভুলে যেও না যেন।
দোয়েল বলল, হা হা, রোজই ফোন করবো। সময় পেলে তুমিও ফোন করো
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই করব।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধার বোনপো মাসীকে প্রণাম করে বিদায় নিলেন।
দুপাঁচ মিনিট পরই ট্রেন ছাড়ল।
.
ট্রেন ছাড়ার পর পরই কোচ অ্যাটেনডান্ট চার্টের উপর চোখ বুলিয়েই অনিলবাবুকে জিজ্ঞেস করে, আপনি মিঃ ব্যানার্জী?
হ্যাঁ।
আর ওরা দুজনে মিস ডি ব্যানার্জী আর মিস কে ব্যানার্জী?
হ্যাঁ।
এবার কোচ অ্যাটেনড্যান্ট বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি মিসেস চৌধুরী?
বৃদ্ধা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ।
কোচ অ্যাটেনডান্ট সঙ্গে সঙ্গে চলে যায়।
দোয়েল হট কেস খুলতে খুলতেই বলে, দাদুন, হাত ধুয়ে এসো। কোয়েল সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে সাবান-তোয়ালে বের করে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে দেয়।
অনিলবাবু বাথরুম থেকে ঘুরে আসতেই দোয়েল ওর হাতে লুচিআলুর দমের প্লেট তুলে দেয়।
দ্বিতীয় প্লেটটি ও মিসেস চৌধুরীর দিকে এগিয়ে ধরতেই উনি একটু হেসে বললেন, দিদি তোমরা খাও। আমি খেয়ে এসেছি।