প্রজ্জ্বল হাসতে হাসতে মামীর পাশে বসল। মামী কত চাঁদা দিতে হবে?
তোর আবার চাঁদা কিসের?
তার মানে?
তোর চাঁদা আমি দিয়ে দিয়েছি।
তা হবে না মামী। বরং তোমাদের চাঁদাও আমি দেব!
মামা বললেন, তুই কি পাগল হয়েছিস মানা?
প্রজ্জ্বল হাসতে হাসতে বলল, তুমি সাধাসিধে মানুষ বলে মামীর চালাকি ধরতে পারছ না। মামী ভাবছে আমার কাছ থেকে চাঁদা নিলে ভালো শাড়িটা আর বাগাতে পারবে না!
মামী সঙ্গে সঙ্গে প্রজ্জ্বলের পিঠে একটা চড় মেরে বললেন, তুই কি ভেবেছিস আমি তোর মতো ঘুষখোর আইএএস?
কেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছ। বল কত চাঁদা দিতে হবে?
মধ্যস্থতা করলেন গোরাবাবু। না বৌদি, এবার আর তোমরা চাঁদা দেবে না। ভাগ্নেই তোমাদের চাঁদা দেবে। নট ওনলি দ্যাট, তুমি নতুন শাড়ি পরে পিকনিকে যাবে।
প্রজ্জ্বল আবার হাসে। জাজমেন্টে ফাঁক থেকে গেল গোরাদা।
কেন? কি ফাঁক থাকল?
আমি শাড়ি কিনে দেব ঠিকই, কিন্তু সায়াব্লাউজ মামী মামার গ্যাঁড়ামারা টাকা দিয়ে বানাবে।
মামা হো হো করে হেসে উঠলেন।
রবিবার।
বাইরের ঘরের বেডকামসোফায় উপুড় হয়ে শুয়ে প্রজ্জ্বল তখনও বোধহয় স্বপ্ন দেখছিল। মামী চায়ের কাপ সেন্টার টেবিলে রেখে ডাক দিলেন, এই মানা ওঠ! ছটা বাজে।
প্রজ্জ্বল অঘোরে ঘুমুচ্ছে। উঠল না। মামী এবার ওর গায়ে হাত দিয়ে ডাকলেন, মানা উঠবি না? চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে!
আস্তে আস্তে চোখ মেলল প্রজ্জ্বল। ঘুরে দেখল মামী। কি ব্যাপার? ডাকছ নাকি?
ওঠ। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
হ্যা, হ্যাঁ, উঠছি; মামা উঠেছেন?
হ্যা! ও বাথরুমে।
এত ভোরে?
সাতটায় বাস ছাড়বে যে!
ও তাই নাকি? এখন কটা বাজে?
সওয়া ছটা হবে।
প্রজ্জ্বল চায়ের কাপ তুলে নিতেই মামী বললেন, তোর মামা বেরুলেই বাথরুমে যাবি। দেরি করিস না।
না।
.
সাতটায় না, বাস ছাড়তে ছাড়তে প্রায় আটটা হল। প্রত্যেকবারই এমন হয়! এর চাইতে আগে হওয়া সম্ভব নয়। বাস ছাড়ার সময় সুনীলবাবু বললেন, রওনা হতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। মাংসটা খারাপ না হয়ে যায়।
গোরাবাবু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? অত রাত্রে কাটা মাংস সারা রাত বরফ দিয়ে রাখার পর কখনও খারাপ হতে পারে?
প্রায় দুবছর পর এতগুলো পরিচিত মানুষের মধ্যে নিজেকে পেয়ে প্রজ্জ্বল খুব খুশি।
মাসিমা চিনতে পারছেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিনব না কেন?
বলুন তো আমি কে?
কে আবার। তুমি তো মানা।
মানিকদা কেমন আছেন?
ভালো। আপনার খবর ভালো তো?
এমনি ভালোই, তবে তখনকার মত হৈহুঁল্লোড় করার সুযোগ তো আর পাই না।
মানিকদা হেসে বললেন, এখন আপনি এত বড় হয়ে গিয়েছেন যে সেসব ফ্রীডম এনজয় করা অসম্ভব।
প্রজ্জ্বলও হাসে। কিন্তু বয়স তো ছাব্বিশ। মন যে মানে না।
কিছুতেই নিজের জায়গায় বসে থাকতে পারছে না প্রজ্জ্বল। প্রত্যেকটা সীটের কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আরে জয়া! কেমন আছ?
ভালো। তাহলে চিনতে পেরেছেন?
চিনতে পারব না?
অনেকে পারে না।
আমি তো অনেক না, আমি সামান্য একজন।
জয়া হাসে। কথা বলে না।
হাসছ যে?
দেখছি এত বড় অফিসার হয়েও কথাবার্তার ধরন বদলায়নি।
বদলালে বুঝি খুশি হতে?…আরে মায়াবৌদি! তোমাকেই খুঁজছিলাম!
কেন?
তুমি পিকনিকে যাচ্ছ অথচ চাঁদাটা তো এখনও দিলে না!
এমন ঘুষ খাবার হ্যাবিট হয়েছে যে পিকনিকের চাঁদা পর্যন্ত পকেটে পুরতে শুরু করেছ?
.
রিং রোড দিয়ে বাস ছুটে যমুনা ব্রিজ পার হল। মামী বিশ্বাসদার ছোট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে বলছেন, ঐ দ্যাখ উট।
প্রজ্জ্বলকে দেখে মামী বললেন, কিরে, তুই ঘুরে ঘুরেই বেড়াবি? বসবি না?
রোজই তো বসে বসে কাটাই।
প্রজ্জ্বল আর একটু এগিয়ে যায়। কি মণিমালা এখানে লুকিয়ে রয়েছ?
বড় বড় চোখ দুটো তুলে এক মুহূর্তের জন্য প্রজ্জ্বলকে দেখেই মণিমালা দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। একটু হাসল। একটু যেন শুকনো হাসি। লুকিয়ে রয়েছি কোথায়?
এতদিন পর দিল্লি এলাম অথচ একবারও খোঁজখবর নিলে না?
আমি জানতাম না আপনি এসেছেন।
যাই হোক, আজ কিন্তু অনেক গান শুনব।
আমি আর আজকাল গান গাই না।
কেন?
ভালো লাগে না।
না লাগলেও শোনাতে হবে। দাসনায় পৌঁছেই ফাল্গুনীর সেই গানটা শোনাবে।
কোন গানটা?
সেই যে, আকাশ আমার ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে।
মণিমালা বিস্মিত হয়। এখনও মনে আছে ঐ গানটার কথা?
কখন যে হিন্দন নদী পার হয়ে হাপুরের রাস্তায় বাস প্রায় দাসনার কাছাকাছি এসে গেছে, তা অনেকেই টের পাইনি। হঠাৎ সুনীলবাবু চীৎকার করে উঠলেন, ব্যস! ব্যস! ব্রীজকে বাদ ডাইনা টার্ন লেনা।
ছোট্ট একটা ব্রিজ পার হয়ে বাস ডান দিকে ঘুরল। ছোট খালের পাড় দিয়ে মাইলখানেক যাবার পর একটা গেটের সামনে বাস থামল। দুতিনজন বাস থেকে নেমে চৌকিদারকে ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের অর্ডার দেখাতেই সে গেট খুলে দিল।
.
ইন্সপেকশন বাংলোটা পুরনো হলেও পরিবেশটা ভারি সুন্দর। সামনেপেছনে বিরাট লন। সামনের দিকের লনের পাশ দিয়েই ইরিগেশন ক্যানাল ধনুকের মতো বেঁকে ঘুরে গেছে। ক্যানালের জল এক জায়গায় উঁচু থেকে নীচুতে পড়ছে। অনেকটা জলপ্রপাতের মতো। পেছন দিকে লনের শেষ সীমায় দুটি কিচেন। তারপর আমবাগান।
বাস থেকে সমস্ত মালপত্র নামাবার পরই গোরাবাবু আব সুনীলবাবু একটা কিচেন। দখল করে নিলেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ইটের উনুন তৈরি হল। তারপর কাঠে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন জ্বালানো হল। এক উনুনে মুগের ডাল ভাজা শুরু হল আর অন্যটায় গরম জল চাপানো হল।