চিনতে পারিনি ঠিকই কিন্তু মুখে বললাম, এবার মনে পড়েছে।
বেয়ারাটা এবার সোজাসুজি বল, বাবুজী আমি জয়দীপ!
জয়দীপ! ব্যান্ড পার্টির জয়দীপ! ব্যান্ড মাস্টার হবার স্বপ্ন দেখত যে সে কফি হাউসের বেয়ারা হয়েছে?
তোমার ব্যান্ড পার্টি
কথাটা শেষ করতে হল না। জয়দীপ বলল, গরিব মানুষের কপালই খারাপ হয় বাবুজী
আমি অবাক হয়ে জয়দীপের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
বাবুজী, বিবিজিকে নিয়ে এসেছেন?
বিবিজি? মৃদুলা?
তাড়াতাড়ি একটা কাগজে আমার হোটেলের ঠিকানা লিখে ওর হাতে দিয়ে বললাম, একটু রাত করে এসো। কথা হবে।
জয়দীপ এসেছিল। বলেছিল সব কথা। দুঃখের কথা, হতাশার কথা, ব্যর্থতার কথা।…লাজপত নগরের এক বিয়েবাড়িতে রিসেপশনে বাজাতে গিয়েছিল জয়দীপের ব্যান্ড পার্টি। প্যান্ডেলের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাজাচ্ছিল খুব সুন্দর একটা গান। হঠাৎ পাশ দিয়ে গ্রামের কুলদীপ সিংকে যেতে দেখে জয়দীপ ছুটে গেল। না গিয়ে পারল না….
জয়দীপের চোখে জল। গলার স্বরটাও কেমন পালটে গেছে। জানেন বাবুজী, যাকে বিয়ে করব ভেবেছিলাম, সে ঐ বাড়িতেই বৌ হয়ে এসেছিল।
জয়দীপের কথা শুনে আমি যেন ইলেকট্রিক শক খেলাম। বল কি?
হ্যা বাবুজী! আপনাকে কি মিথ্যে কথা বলব?
অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে রইলাম। তারপর জয়দীপ জিজ্ঞাসা করল, বিবিজি ভালো আছেন তো?
আমারও চোখের কোণায় একবিন্দু জল এসে গেল। খুব বড় এক সাহেবের সঙ্গে বিয়ে হবার পর ও বিলেতে চলে গেছে।
জয়দীপ প্রায় চিৎকার করে উঠল, বলেন কি বাবুজী?
অনেক কষ্টে আমি মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বললাম, জয়দীপ, আমিও ব্যান্ড মাস্টার হতে পারলাম না।
.
পরের দিন কফি হাউসে গেলাম। জয়দীপ কফি দিল, কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও পয়সা নিতে এলো না। অনেক খুঁজলাম, কিন্তু অত ভীড়ের মধ্যে কিছুতেই ওকে খুঁজে পেলাম না। কাউন্টারে পয়সা দিয়ে আমি কফি হাউস থেকে বেরিয়ে কনট প্লেসের ভীড়ে হারিয়ে গেলাম।
রবিবার
কি ব্যাপার? মিট মিট করে হাসতে হাসতে কি দেখছ?
দেখছি আর ভাবছি।
কি দেখছ আর কি ভাবছ?
অনেক কিছু।
দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখবে আর ভাববে? কথা বলবে না?
বলব বলেই তো এসেছি, কিন্তু…।
কিন্তু কি?
ভাবছি তুমি বলব নাকি আপনি বলব
চমৎকার! প্রজ্জ্বল হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, আগে কি বলতে?
আগে তো তুমিই বলতাম, কিন্তু তুমি তো আর সেই আগের তুমি নেই।
কেন? আমি কি পাল্টে গেছি? প্রজ্জ্বল সোজাসুজি মায়াবৌদির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, নাকি ভালো চাকরি করছি বলে তুমি বলতে দ্বিধা হচ্ছে?
এবার মায়াবৌদিও চোখ তুলে তাকায়। বলে, তুমি হঠাৎ এত বড় হয়ে গেছ যে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দ্বিধা হওয়া স্বাভাবিক।
তাই নাকি?
নিশ্চয়ই।
এখন খুব বড় হয়েছি আর আগে বুঝি খুব ছোট ছিলাম?
তা তো বলছি না।
তবে তুমি যে এখন অনেক বড় হয়েছ, তা তো ঠিক?
তার জন্য তোমার সঙ্কোচ বোধ করার কি কারণ ঘটল? আমি যাই হই, তুমি তো আমার বৌদিই আছ!
মায়াবৌদি জানত, প্রজ্জ্বল বড় হলেও পাল্টাতে পারে না। পাল্টাবে না। তবুও দ্বিধা এসেছিল। আসাটা স্বাভাবিক। ডিজি পি অ্যান্ড টি অফিসের আপার ডিভিশন কেরানির স্ত্রীর পক্ষে একজন আইএএস অফিসারের কাছে সহজ হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। সে প্রজ্জ্বল হলেও নয়।
প্রজ্জ্বলের কথায় মায়াবৌদি খুশি হয়।
মামী দুহাতে দুকাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়েই মায়াবৌদিকে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, কিরে মায়া, দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
মাযাবৌদি কিছু বলার আগেই প্রজ্জ্বল হাসতে হাসতে বলল, জান মামী, মায়াবৌদি পুজোর সময় থিয়েটার করবে বলে এখন থেকেই রিহার্সাল দিচ্ছে।
সেন্টার টেবিলে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে মামী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তার মানে?
আমি মামার অন্ন ধ্বংস করে ভালো চাকরি পেয়েছি বলে মায়াবৌদি আমাকে তুমি বলতে ভরসা পাচ্ছে না। প্রজ্জ্বল মায়াবৌদির দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে কথাগুলো বলল।
এবার মামীও হাসে। তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে মায়া? মানা আইএএস হয়েছে বলে কি আমি মামী নেই, নাকি তুই বৌদি নেই?
মামী আর কথা না বলে রান্নাঘরে চলে গেল। মামা বাথরুমে! বেরুলেই খেতে বসবেন। আটটা চল্লিশ হয়ে গেছে। মামী চলে যেতেই প্রজ্জ্বল উঠে গিয়ে মায়াবৌদির হাত ধরে এনে পাশে বসাল।
নাও, চা খাও।
খাচ্ছি।
চা খেতে খেতে প্রজ্জ্বল জিজ্ঞাসা করল, বল কি ব্যাপার?
শুনলাম তুমি এসেছ। তাছাড়া কদিন থাকছ বলে একটা কথা বলতে এসেছিলাম।
কি কথা?
সামনের শনিবার দিল্লিতে থাকবে?
শনিবার আছি, তবে রবিবার সকালেই চলে যাবার কথা।
এই শনিবার তো সেকেন্ড স্যাটারডে। আমরা সবাই পিকনিকে যাচ্ছি, তুমি যাবে?
.
এই রামকৃষ্ণপুরমের মামার বাড়িতে কটা বছর থাকার সময় প্রজ্জ্বল তখন প্রত্যেকটা পিকনিকে গেছে। আনন্দ করেছে। দারুণ আনন্দ করেছে। প্রথমবার যেতে চায়নি। তখন কলকাতা থেকে ও নতুন এসেছে। পাড়ার সবার সঙ্গে পরিচয় হয়নি! ঘনিষ্ঠতা তো দূবের কথা! প্রজ্জল ভেবেছিল পিকনিকে গিয়ে চুপচাপ একলা একলা কাটাবার চাইতে বাড়িতে থাকাই ভালো, কিন্তু পারেনি। যেতে হয়েছিল। মামামামী এসব ব্যাপারে সবার চাইতে বেশি উৎসাহী। মামীর কাছেই পাড়ার সবাই চাঁদা জমা দিচ্ছিলেন। মামামামীর কথা ফেলতে পারেনি। প্রল নতুন হলেও পিকনিকে গিয়েছিল।
প্রজ্জ্বলের মামামামী দুজনেই বড় ভালোমানুষ। মনটা বড় উদার। পোস্টাপিসে সামান্য চাকবি করেন মামা, কিন্তু তবুও প্রজ্জ্বল যখন ইসলামিক হিস্ট্রি নিয়ে এম. এ. পড়বার জন্য দিল্লি জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিশন নিল, তখন কিছুতেই ওকে হোস্টেলে থাকতে দিলেন না।